আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পায়ের তলায় সর্ষে-3

খুব গোলমেলে, নিজেও ভাল জানি না। তবে আছে,এই ঢের।

ফ্রেজারগঞ্জ বিচ থেকে হাঁটতে হাঁটতে বড় রাস্তায় আসতেই চোখে পড়ল একটা বাস আসছে, যাচ্ছে বকখালি। পেটে যদিও ক্ষিদে নেই, সকালের ঐ ছেঁড়া পরোটা আর আলু মটরের তরকারিতে পেট তখন অব্দি ঠান্ডাই আছে তবুও আগে বকখালি গিয়ে কিছু খেয়ে নেওয়াই সাব্যস্ত হল। ফ্রেজারগঞ্জে খাওয়ার জায়গা নেই সে তো দেখাই যাচ্ছে আর একটিমাত্র খাবার দোকানের কথা যা শুনলাম সেখানেও নাকি বসিয়ে রেখেই রান্না করে দেবে।

বসে থাকাটা বাঞ্ছনীয় নয় মোটেই, চল রে মন বকখালি! তো আমরা হাত দেখানোর আগেই বাস থেমে পড়ল ঠিক সামনেটায় এসে! দুজনে মুখ চাওয়াচাওয়ি করে বাসে উঠে পড়লাম। বেশ মিষ্টি একটা আবহাওয়া। না গরম না ঠান্ডা। ফুরফুরে মনে চারপাশ দেখতে দেখতেই বাসের কন্ডাক্টর ভাই হাঁক দিলেন, বকখালি! ওমা! এত কাছে বকখালি! নেমে ডানে বাঁয়ে তাকিয়ে চোখে পড়ল রাস্তার দুপাশে বেশ কিছু হোটেল শুধু। ও হ্যাঁ।

বাসে থাকতেই চোখে পড়েছে, খানিক দূরে দূরে একটি করে হোটেল। বকখালি সম্পর্কে শোনা সব কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। জোর করেই মনটাকে অন্য দিকে সরিয়ে দিলাম। কয়েক পা এগোতেই চোখে পড়ল ২-৪টে ভ্যান রিকশা এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আর তাদের চালকেরা এক জায়গায় জটলা করছে কেউ দাঁড়িয়ে তো কেউ বালিতে বসে। আমাদের দেখেই এগিয়ে এলো, বাবু, সাইট সিইংএ যাবেন? চলুন না বাবু।

এখানে কি দেখার আছে আর ওরা কোথায় কোথায় নিয়ে যাবে সেগুলো শুনে নিয়ে ঘুরে আসছি বলে সামনের দিকে এগোলাম খাওয়ার দোকানের সন্ধানে। বকখালিতে খাওয়ার ভালো জায়গা আছে হোটেল থেকেই শুনে এসেছিলাম কিন্তু আমি শুধু কিছু ঝাঁপতোলা দোকান ছাড়া আর কিছুই দেখতে পেলাম না। কোন দোকানে ঝুলছে ঝিনুক দিয়ে তৈরি নানা জিনিসপত্র আর কোনো দোকানের সামনে বোর্ড দাঁড়িয়ে আছে কাঠের ঠ্যাঙে ভর করে,কয়েকপরত মরচের নীচে যাতে ভাত ডাল মাছ সব্জির নাম লেখা। তেমনই এক দোকানে ঢুকে রাস্তার দিকে মুখ করে দুজনে বসে খাবারের অর্ডার দিলাম। ভাত ডাল আর সব্জিটা কমন, মাছের অপশন আছে, পমফ্রেট কিংবা ভেটকি।

আমি পমফ্রেট বললাম। সবজির ভেতর আরেকটা জিনিস কমন, চিংড়িমাছ, সে পালংএর ঝোলই হোক বা লাউ-এর তরকারি, তখনও জানিনা এর দুটো ই আসবে আর সাথে একদম স্টাইলিশ ক্যাটারারের হাতফেরতা আলুর ঝুরি ভাজা। যে দোকানটিতে ঢুকে বসেছি তাতে চারখানা লাল, নীল প্লাষ্টিকের টেবল আর টেবলের একপাশে কাঠের একখানা করে বেঞ্চ অন্যপাশে দুখানা করে বাদামী রঙের প্লাষ্টিকের চেয়ার। দেওয়ালে দেখলাম কালো বোর্ডে সাদা খড়ি দিয়ে পুরো খাবারের লিষ্টি লেখা আছে সেখানে পাশে মূল্যতালিকা। যিনি খাবারের অর্ডার নিয়েছিলেন তিনি ভেতরে গিয়ে বলে এলেন আর তারপরে দোকানের মাঝখানে রাখা একটি টেবলের পাশের একমাত্র চেয়ারটিতে বসে গপ্প জুড়লেন অন্যপাশে বসে আহারে রত চারজনের এক দলের সাথে।

ততক্ষণে আমাদেরও খাবার এসে গেছে। যিনি খাবার সার্ভ করলেন তিনি এই দোকানের মালকীন। ক্ষয়াটে চেহারা। কপালে লাল টিপ আর সিঁথিতে মোটা করে পরা সিঁদুর। ছাপা শাড়ি কুচিয়ে পরা গোড়ালির উপর থেকে।

হাতে শাঁখা পলা লোহা ছাড়াও কয়েকগাছা করে কাঁচের চুড়ি। মুখে একটা হাসি লেগেই আছে যাতে করে তাঁকে দোকানমালিক কম বাড়ির গিন্নিই বেশি মনে হয়। পর্দার ওপাশে যে ঘরের আভাস পাচ্ছি ওখানে তাঁর গেরস্থালী। খাবারে মন দিলাম। মাঝারি আকারের একখানা পমফ্রেটকে দু টুকরো রান্না করেছেন ঐ গিন্নিটি।

যে প্লেটে করে মাছ দিয়েছেন তাতে ঐ পমফ্রেট বেশ ভালমতন সাঁতার কাটছে। দেখে একেবারেই পছন্দ হয়নি বলাই বাহুল্য কিন্তু মাছের কোণা ভেঙে মুখে দেওয়া মাত্রই মত পাল্টাতে বাধ্য হলাম। রান্না ভাল কি মন্দ সে প্রশ্ন অবান্তর মনে হল। একদম তাজ মাছ, সকালেই সমুদ্র থেকে ধরা হয়েছে। এত সুস্বাদু পমফ্রেট আগে কখনও খাইনি সে ব্যপারে আমরা দুজনেই একমত হলাম।

কথা বলছি, খাচ্ছি। মাঝে মাঝেই কান চলে যাচ্ছে ওদিকের কথা বার্তায়। এরই মধ্যে গিন্নিটি ভেতর থেকে নিয়ে এলেন একটি বোল, বেশ বড় সাইজের আর আমি একটু চোখ টেরিয়ে দেখতে পেলাম তাতে কাঁকড়া! খাওয়ায় ব্যস্ত তাঁকে দেখালাম ইশারায়, ঐ দ্যাখো, কাঁকড়া! সাথে সাথেই দোকানমালিকের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন গেল, ও দাদা, কাঁকড়া হবে নাকী! দাদাটি চটজলদি উত্তর দিলেন, নাগো দাদা, এতো অর্ডারি রান্না! শহর থেকে এঁরা সব বন্ধুরা এসেছে, এঁদের জন্যে স্পেশালি আনা হয়েছিল আজ, আর তো হবে না! ওদিকের টেবল থেকে তখন কাঁকড়ার স্বাদ সম্পর্কে আলোচনা কানে আসছে। মন : ক্ষুন্ন তিনি পমফ্রেটেই মন দিলেন আবার! দোকানি ভাইটি বললেন, রাতে যদি আপনারা আসবেন বলে যান, তবে বিকেলে দেখব কাঁকড়ার ব্যবস্থা করতে পারি কীনা! আর আপনারা যদি কোন মাছ খেতে চান তো কিনে এনে দিলে আমরা রেঁধেও দিতে পারি। এই সাথেই শোনালেন, ওপাশে যাঁরা বসে আছেন তাঁরা গতকাল সব মিলিয়ে সাড়ে চার কিলো মাছ কিনে এনেছিলেন আর চারজনে মিলে সেটা এক বসাতেই শেষ করেছেন! যাঁদের সম্পর্কে বলা হল তাঁদেরই একজন বললেন, ঐ ফ্রেজারগঞ্জ বন্দর থেকে কিনে এনেছিলাম, আপনারা যাবেন তো ওদিকে? মাছ নিয়ে আসতে পারেন, বৌদি রান্না করে দেবে! তাঁদেরকে ধন্যবাদ জানিয়ে দোকানি ভাইকে বলা হল, রাতে কাঁকড়া যদি হয় তো খুব ভাল হয়, রাতে আমরা আপনার এখানেই খাব! ও পাশ থেকে কাঁকড়া শেষ করার পর হুকুম উড়ে আসছে ভেটকি আর প্রমপ্লেটের, যা বাকি মাছ ছিল তা সব তাদের দিয়ে দোকানি ঝাঁপ বন্ধ করতে উদ্যোগী হলেন।

ও হ্যা ঁবলতে ভুলে গেছি, খেতে বসেই আমার মনে হল, ফ্রেজারগঞ্জ বিচে শুটকি দেখে এলাম আর এখানেও দোকানে ঝিনুকের জিনিসপত্রের সাথেই প্যাকেটে রাখা লটে শুটকি চোখে পড়েছে তার মানে এঁরা শুটকি নিশ্চয়ই রান্না করেন! জানতে চাইলাম দোকানমালকীনের কাছে, এখানে শুটকি রান্না হয় বৌদি? তো বৌদি জানালেন, মাঝে সাঝে হয়। সকলে খায় না বলে রোজ হয় না আর খেতে চাইলে রাতে ইনি করে রাখবেন। কিন্তু রাতে শুটকি খাওয়া আমার পোষাবে না বলে আমি আর খাওয়ার বায়না করলাম না! খাবো না বলেই শুটকি আলোচনা থেমে থাকলো না, কচু এল, কাঁঠালের বিচি এল আরো কত্তসব এখন আর সব মনে নেই। খাওয়া সেরে বেরিয়ে আবার মন দিলাম চারপাশ দেখাতে। এত নীরব কেন এ জায়গাটা? এখানটায় বেশ দোকানপাট আছে দেখতে পাচ্ছি, রাস্তার দুধারে সারি সারি সব দোকান।

যাঁরা আছেন তারা সবই দোকানি! কেনার মানুষ নেই একটিও! আরও একটা জিনিস খেয়াল হল, প্রতিটি দোকানেরই পেছনদিকে বসতবাড়ি। দোকানের ভেতর দিয়েই ভেতরবাড়িতে যাওয়ার ব্যবস্থা। প্রায় সব দোকানেই কর্তা গিন্নি দুজনেই আছেন। একটু খেয়াল করলে আশে পাশে ছানাদেরও দেখা যায়। কিন্তু এখানে লোক নেই কেন? লোকে বেড়াতে আসে না? চিন্তাটা সজোরেই করছিলাম তো জবাব পেলাম, দিনের বেলা কে আর বেরোয়? সবাই হোটেলের ভেতরে আছে! বিকেলে বিচে ভিড় হবে, বেশিরভাগই তো হোটেলেই সময় কাটাতে আসে! আবারও অস্বস্তিটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে লাগল।

এক নীরব শুনশান রাস্তা দিয়ে আমরা দুজনে হেঁটে এগোতে লাগলাম সাগরের দিকে। পিচের রাস্তা যেখানে শেষ হয়েছে সেখানে একটা মাঠমত জায়গা। বালির মাঠ। গোড়ালি অব্দি ডুবে যায় বালিতে। বেশ গরম লাগতে শুরু করেছে ততক্ষণে।

সুর্য একদম মাথার উপরে। আমি একটু ক্লান্ত বোধ করছি, একটু গড়াতে পারলে ভাল হয়। কিন্তু মাত্র একদিনের জন্যে এসেছি আর কত কী দেখার আছে বলে সমানে হেঁকে গেছে ঐ ভ্যান রিকশা চালকেরা যার কিছুই এখনও অব্দি দেখা হয়নি। ঘরবন্দী হয়ে একটুও সময় নষ্ট করবো না বলে ক্লান্তির কথা একবারটিও না বলে সামনে এগোলাম। বালির উপর দিয়ে পা টেনে টেনে হেঁটে এই মাঠ পেরিয়ে দেখি আবার একটা পিচরাস্তা শুরু।

যার দুপাশে আবার সব দোকান। তবে এখানে দোকানের সংখ্যা বেশি নয়। ঐ তো সামনেই এই রাস্তা ঢালু হয়ে নেমে যাচ্ছে বিচে। এই রাস্তা গিয়ে শেষ হয়েছে একটা বাধানো চাতাল মত জায়গায়। যার ডানদিকে বেশ উঁচু করে বাঁধানো এক ফুটপাথ।

হ্যাঁ। আমার এটাকে ফুটপাথই মনে হয়েছে। অনেকদূর চলে গেছে এই ফুটপাথ। যদ্দূর চোখ যায় শেষ দেখতে পাচ্ছি না। ফুটপাথে খানিক দূরে দূরে একটা করে লোহার বেঞ্চ।

এই ফুটপাথের ডানধারে ঝাউবন আর বাঁদিকে বিস্তৃত বালুরাশির ওধারে সমুদ্র। ভাটার সমুদ্র এখন বহুদূরে। জলের শব্দ নেই। বাতাসের শনশনানি নেই। নিস্তব্ধ এক রোদেলা দুপুর।

আমি মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে দেখছি এদিক ওদিক। যেদিকেই তাকাই , চোখ ফেরাতে পারি না। ফুটপাথে উপর দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছি বিচের দিকে। বাঁধানো চাতালের আশে পাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা আছে বেশ কিছু রঙিন চেয়ার। কোথাও বা ছোট্ট নাগরদোলা, রঙিন।

অনেকটা যেন মেলার মত। কিন্তু জনশূণ্য, রঙিন কাঠের ঘোড়ারা সার বেঁধে যেন জল খেতে নেমে আসছে সাগরে। চাতাল যেখানে শুরু হয়েছে সেখানে এক বোর্ডে দেখলাম বড় বড় হরফে ইংরেজী ও বাংলায় লেখা আছে, বিচে গাড়ি চালানো নিষিদ্ধ। ঠিক এই জায়গাটায় বেশ কিছু চায়ের দোকান দেখলাম। প্রতিটা দোকানের সামনেই বেশ কিছু চেয়ার পাতা।

সবই লাল রঙের। এই দুপুরে কোন দোকানেই কোন খদ্দের নেই। মনে মনে আমি চায়ের দোকানই খুঁজছিলাম, খাওয়ার পরে চা না খেলে আমার চলে না ! একটি দোকানের দিকে এগিয়ে গিয়ে দোকানি মহিলাকে জিজ্ঞেস করলাম, দিদি , এখন কি চা হবে? তিনি বললেন, হ্যা ঁহবে, আপনি বসুন। বছর পনের-ষোলর একটি ছেলে দোকানের ভেতর ঢুকে চা করতে গেল। আমি চেয়ারে বসে তাকালাম বিচের দিকে।

বারে বারে একটা কথাই শুধু মনে হচ্ছে, এত সুন্দর মায়াময় বিচ অথচ কি ভীষণ নীরব! হোক না দুপুর, তাই বলে এত নীরব? দূরে ফ্রেজারগঞ্জ বিচের সেই তিন ব্লেডের বিশালাকার পাখা এখানে থেকেও আবছা নজরে আসছে।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।