আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জঙ্গিবাদ ও সুইসাইড টেররিজম

কবি হওয়ার ভান করি, উদাস হই; ভালোবাসার মাহাত্ব খূঁজি

রাশেদুল হাসান পশ্চিমা শক্তির অন্যায্য আচরণ, দখলদারিত্ব, বাজার আগ্রাসন যে সামাজিক ন্যায়বিচার এবং রাষ্ট্রীয় সুশাসনকে বিঘিœত করছে ঠিক তেমনি নানা উগ্রবাদেরও জন্ম দিচ্ছে। এসব উগ্রবাদ মানুষকে অনেক ক্ষেত্রেই বিচারের ভার নিজের হাতে নিতে প্ররোচিত করে। বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে জঙ্গিবাদ, ধর্মান্ধতা, উগ্র মৌলবাদী আচরণ অগ্নিময় পরিস্থিতি সৃষ্টির মাধ্যমে স্বীয় স্বার্থ হাসিলের চেষ্টায় মত্ত। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মদদ পরোক্ষ কিংবা প্রত্যক্ষভাবে এ জঙ্গিবাদকে উৎসাহিত করে চলছে। জঙ্গিবাদের উত্থানের সঙ্গে আন্তর্জাতিক রাজনীতির যে নৈকট্য তাকে অবজ্ঞা করলে অতীব জটিল বিশ্বরাজনীতির কবলে পড়তে হয় যে কোন রাষ্ট্রকে।

জঙ্গিবাদ বিষয়ে শিথিলতা এবং জঙ্গিবাদের উৎস ও ব্যক্তি কিংবা প্রতিষ্ঠানের প্রতি নির্লিপ্ততা জঙ্গিবাদী সংগঠনগুলোর অধিকতর সুবিধা বা প্রসারকে কি উসকে দেয় না ? পাকিস্তানের বর্তমান অবস্থা তারই বড় প্রমান। বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ জঙ্গিবাদ নির্মূলের দৃঢ় পদক্ষেপ নিলেও জঙ্গি সংগঠনগুলোর প্রতি সরকারের নি¯পৃহতা প্রশ্নের সৃষ্টি করে। জঙ্গি সংগঠনগুলো তাদের পূর্বনির্ধারিত আদর্শিক, দার্শনিক মতবাদ প্রতিষ্ঠায় নানা কর্মকান্ড পরিচালনা করে থাকে। এ কর্মকান্ড গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে সহিংসতায় রুপ নেয়। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে জঙ্গিবাদের তীব্র উত্থানে নাকাল অবস্থা।

আতœঘাতী হামলা জঙ্গিদের কর্মকান্ডের প্রদান নিয়ামক হিসেবে রূপান্তরিত হয়েছে। যত্রতত্র আতœঘাতী সন্ত্রাস বা সুইসাইড টেররিজম সংগঠিত হচ্ছে একে নিয়ন্ত্রণ করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ বলা চলে। ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ইসরায়েল, ফিলিস্তিন, ইরাক, ইরানসহ নানা দেশ সুইসাইড টেররিজম এ জিম্মি হবার পথে। রাজনৈতিক লক্ষ্য উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্যও অহরহ সুইসাইড টেররিজম সংগঠিত হচ্ছে। স্টিফেন ফেডরিক ডেল তথ্যানুসন্ধান করে বলেন যে, আত্মঘাতী সন্ত্রাসের জনক ইহুদিরা।

সুইসাইড টেররিজম সর্বপ্রথম চর্চা করে ইহুদিদের সিকাইরি নামক একটি গ্র“প। মুসলমানদের মধ্যে হাশিশিয়ান নামক একটি ক্ষুদ্রদল আত্মহত্যা সন্ত্রাসবাদের পথে চলেছিলেন বলে জানা যায়। পরবর্তীতে দক্ষিণ পশ্চিম ভারতের মালাবার উপকূলে, সুমাত্রায়, ফিলিপিন্সে, আফ্রিকায় সুইসাইড টেররিজম প্রসার লাভ করে। বাংলার বিপ বীরাও ক্ষেত্র বিশেষে স্বশস্ত্র আক্রমনের এক পর্যায়ে আত্মদানের দিকে কিছুকাল অগ্রসর হয়েছিলেন। উনবিংশ শতাব্দীর নৈরাজ্যবাদী বা নিহিলিষ্ট দার্শনিক বাকুনিনের আদর্শে অনুপ্রাণিত তরুণরা জার শাসিত রাশিয়ায় সংগঠিত আন্দোলন শুরু করে।

আন্দোলনের পুরোভাগে ছিলেন বাকুনিনের মানসপুত্র নেচায়েভ। পরবর্তীকালে এ আন্দোলনের নেতৃত্বে আসেন জেলি জালিয়ারভ। নিহিলিস্ট্ররা বিশ্বাস করতো যে সন্ত্রাসের মাধ্যমে বিদ্যমান সরকারও রাষ্ট্রযন্ত্রকে ধ্বংস করার মধ্যেই নিহিত রয়েছে মানুষের ব্যক্তিগত ও সামাজিক মুক্তি। এই মতাদর্শের চেতনায় উজ্জিবীত হয়ে তারা ঊনবিংশ শতাব্দীর আশির দশকে রাশিয়ার জার দ্বিতীয় আলেক জেন্ডারকে হত্যা করে। এডাম ডোলিঙ্ক স্ট্যাডিজ ইন কনফ্লিক্ট অ্যান্ড টেররিজম গ্রন্থে, ‘সুইসাইড টেরর’ এর সজ্ঞা দিয়েছেন এভাবে- পূর্বনির্ধারিত আদর্শিক, দার্শনিক বা ধর্মীয় প্রেরণায় সংঘঠিত সন্ত্রাস।

যার মাধ্যমে আক্রমনকারী স্বপ্রণোদিতভাবে মৃত্যুকে বরণ করে। আধুনিক টেররিজম প্রথমে প্রয়োগ করা হয় মধ্যপ্রাচ্যে। হিজবুল াহ ও হামাসকে এর পথিকৃত ধরা হলেও শ্রীলঙ্কায় অধুনালুপ্ত এলটিটিই (লিবারেশন টাইগার্স অব তামিল ইলম) সুইসাইড টেররিজমের প্রয়োগ ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অন্য সবার রেকর্ড ছাড়িয়ে গিয়েছিল। গবেষকরা বলেছেন, পৃথিবীর মধ্যে শ্রীলঙ্কার এলটিটিই হলো প্রথম সংগঠন। যারা সবচেয়ে ব্যাপক ভিত্তিক সুইসাইড টেররিজম পরিচালনা করেছে।

মনোজ যোশির তথ্যমতে, ১৯৮৭ সাল থেকে বিলুপ্ত হবার পূর্ব পর্যন্ত এলটিটিই যে পরিমাণ আত্মঘাতী হামলা চালিয়েছে, বিশ্বের অন্যসব সন্ত্রাসী দল মিলেও ততটুকু চালাতে পারেনি। সন্ত্রাসী কিংবা বিপ বাকাঙ্খী সশস্ত্র জঙ্গি সংগঠনগুলো কেন সুইসাইড বা আত্মহত্যাকে বেচে নিয়েছে সে সম্পর্কে সদ্য পরাজিত এলটিটিই’র নথিপত্র ঘেঁটে এর একাধিক কার্যকরণ চিহ্নিত করেছেন গবেষক বিশে ষকগণ। এর মধ্যে রয়েছে- আত্মঘাতী হামলা উলে খযোগ্য সাফল্য বয়ে আনে। একজন বা দু’জনের জীবনের বিনিময়ে বহু মানুষের জীবন ও প্রভূত সম্পদ বিনষ্ট করা যায়। আত্মঘাতী হামলা ব্যাপক মিডিয়া কাভারেজ ও প্রচার পায়।

উপয়ন্তু জীবনদানকারী-আক্রমনকারীর দল নীতি-আদর্শ সম্পর্কে দৃঢ় মনোভাব ও লড়াকু মানসিকতার চর্চা হতে থাকে জনমনে। এতে করে দলগুলো তাদের মেসেজ বিপুল জনগোষ্টির কাছে পৌঁছাতে সক্ষম হয়। আত্মঘাতী হামলায় কম লোকের অংশগ্রহন থাকে। তাই পরিকল্পনা নেওয়া ও বাস্তবায়ন করা সহজতর। আত্মঘাতী হামলায় খরচও বেশকম।

সাধারণ মানের দেশীয় যন্ত্রপাতি নিয়েই কাজ করা যায়। আত্মঘাতী হামলায় প্রতিপক্ষের বিরাট ক্ষতির মাধ্যমে স্বপক্ষের ক্যাডার ও যোদ্ধাদের অনুপ্রাণিত করা যায় ইত্যাদি ইত্যাদি। এসব কারণে জঙ্গি সংগঠনগুলো সুইসাইড টেররিজমের মাধ্যমে সুইসাইড স্কোয়াড গঠন করে আত্মঘাতী হামলা পরিচালনা করে থাকে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এ সুইসাইড টেররিজম ঘটেই চলছে এবং আত্মঘাতী সন্ত্রাসবাদ ঘটানোর উদ্দেশ্যে দেশী বিদেশী জঙ্গি সংগঠনের সদস্যরা ওঁৎপেতে রয়েছে। স¤প্রতি দেশের মাটিতে ভারতীয় ও আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠনের সদস্য ধরা পড়ার বিষয়টি উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সরকার ও আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারীর বাইরে আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠনগুলো বাংলাদেশে তাদের ঘাটি বানানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ১৬ মার্চ মন্ত্রিসভায় এক বৈঠকে দেশের ধর্মভিত্তিক বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের তৎপরতা নিয়ে আলোচনা করা হয়। হিযবুত তাহরীর, জামে’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি), হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী বাংলাদেশ (হুজি), হিযবুত তাওহীদ, উলামা আঞ্জুমান আল বাইয়্যিনাত, ইসলামিক ডেমোক্রেটিক পার্টি (আইডিপি), ইসলামী সমাজ, তৌহিদ ট্রাষ্ট, জাগ্রত মুসলিম জনতা বাংলাদেশ (জেএমজেবি), শাহাদৎ-ই-আল হিকমা, তাআমির উদ-দ্বীন (হিযাব আবু উমর) এবং আল াহর দল এ ১২ টি ধর্মভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা হয়। যদিও হুজি, জেএমবি, জেএমজেবি ও শাহাদৎ-ই-আল হিকমাকে বিএনপি-জামায়ত জোট সরকার নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল এবং গত ২২ অক্টোবর হিযবুত তাহরীরকে নিষিদ্ধ করা হয়। ইতিমধ্যে জঙ্গিবাদ বিষয়ে আন্তর্জাতিক প্রচারণা, জঙ্গিবাদী দলগুলোর আন্তর্জাতিক যোগাযোগ পশ্চিমি মিডিয়াতে বাংলাদেশকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলছে।

বাংলাদেশ জঙ্গি-সন্ত্রাসী দেশ, দিনদিন এ প্রচারণাই বাড়ছে। সরকারের এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে দেরীর ফলে নেতিবাচক প্রচারনা বাংলাদেশের বিনিয়োগে পরিস্থিতি সহ ভাবমূর্তির ক্ষেত্রে দারুন সংকটময় চেহারার উম্মেষ ঘটাচ্ছে। শুধু ধর্মান্ধয়ী জঙ্গিবাদই নয়, কথিত মাওবাদীরা উপমহাদেশ জুড়ে যে সশ্রস্ত্র রাজনীতির ডাক দিচ্ছে তার সাথে বাংলাদেশের নামও সম্পৃক্ত হচ্ছে। ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি. চিদাম্বরম স¤প্রতি অভিযোগ করেন ভারতের মাওবাদীরা বাংলাদেশ থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করছে। ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এ উক্তি মিডিয়ায় প্রকাশিত হলেও সরকারকে এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে দেখা যায়নি।

সরকারের এ আপোষহীন নিরবতা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের নেতিবাচক ভাবমূর্তিকে আরো বাড়াবে, কমবে না। আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন হিযবুত তাহরীরের সঙ্গে আল কায়েদার যোগাযোগ রয়েছে বলে জানা যায়। ১/১১ তে আমেরিকার টুইন টাওয়ার হামলার ঘটনায় হিযবুত তাহরীরের তিন সদস্য জড়িত রয়েছে বলেও জানা যায়। আরব বিশ্ব, মধ্য এশিয়া ও ইউরোপের কমপক্ষে ২২ টি দেশে এ সংগঠনের কর্মকান্ড নিষিদ্ধ। সরকারের কাছে এসব জঙ্গি সংগঠনের বিস্তারিত তথ্য থাকার পরও কেন অন্য সংগঠনগুলোকে নিষিদ্ধ ঘোষনা করছে না ? সরকার জঙ্গি নাশকতার আশংকা করে আইন শৃঙ্খলা জোরদার করলেও কথিত জঙ্গি সংগঠন গুলোর উপর নজরদারী বাড়ানো হয়েছে কিনা জানা যায়নি এবং মন্ত্রি পরিষদে আলোচিত অন্য সংগঠনগুলোর সাথে আন্তর্জাতিক জঙ্গি কালেকশান আছে কি না বা তাদের কর্মকান্ডের বিস্তারিত উপস্থাপন করতে পারেনি বরং হিযবুত তাহরীর নিষিদ্ধ প্রশ্নে সরকারের তৎপরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে না।

সংগঠনটির কার্যক্রম দেশে জননিরাপত্তার জন্য হুমকি স্বরুপ সরকারের উচ্চ মহলের এমন মন্তব্যের পরও হিযবুত তাহরীরের কেন্দ্রীয় নেতারা এখনো কেউ ধরা পড়েনি। এমনকি কারো বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত মামলাও হয় নি। নিষিদ্ধ ঘোষণা সত্ত্বেও তাদের আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে সংগঠনের প্রধান সমন্বয়কারী ও মুখপাত্র মহি উদ্দিন আহমেদ। পত্রিকায় প্রেস বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ, ওয়েব সাইড চালুসহ গোপন বৈঠক করেছে তারা। সরকারের এ নির্লিপ্ততা প্রশ্ন সাপেক্ষ নয় কি ? বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ, জঙ্গিবাদের উত্থান, ক্রমবিকাশ এবং জঙ্গিবাদের মদদদাতা হিসেবে সরকারী উচ্চ পর্যায়ের প্রসারিত হাত রাজনৈতিক উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য জঙ্গি সংগঠনগুলোর সুইসাইড টেররিজম, জঙ্গি নির্মূল ও সুইসাইড টেররিজম বন্ধে সরকারের ধীরে চলো নীতি ক্ষতির ঝোলাই বড় করবে।

সরকারের উচিত হবে আলোচিত ১২ টি জঙ্গি সংগঠনকে দ্রুত নিষিদ্ধ ঘোষণার মাধ্যমে জঙ্গি তৎপরতায় প্রতি কঠোর নজরদারী এবং রাষ্ট্রের অকল্যাণকামী, শান্তি বিনষ্টকারীদের গ্রেফতারের মাধ্যমে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে যাবে। রাশেদুল হাসান কবি ও প্রাবন্ধিক

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.