আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শাপলা শালুক ঝিলের দেশ

সকাল আর আসেনা গোলাপ হয়ে ফোটেনা কিশোরীর হাতে

চমৎকার নীল আকাশ। কোথাও কোথাও তুলার পাহাড়ের মত শাদা মেঘ জমে আছে। ভাদ্রমাস । কখনো প্রখর রোদ কখনোবা অঝোর ধারায় বৃষ্টি। রোদ যত প্রখরই হোক মানুষ চায় রোদটাই থাকুক।

বানের পানিতে চারদিক ভেসে গেছে । একটু বৃষ্টি হলেই দুই তিন আঙ্গুল পানি বেড়ে যায়। ঘরবাড়ি সব পানিতে নিমজ্জিত। খড়ের ঘরগুলি পানিতে পঁচে মিশে গেছে। ঘরের খুঁটি দাঁড়িয়ে আছে।

কারো বাড়ির টিনের চালায় আগাছা শুকানো হচ্ছে। জলজ আগাছা। রান্নার উপকরণ। যাদের বাড়ি তুলনামূলক ভাবে একটু বেশি উঁচু তাদের বাড়িতেও পানি এসেছে। কারো ঘর ছুইছুই,কারো ঘরে হাটু পানি,কারোটা পুরোপরি তলিয়ে গেছে।

যাদের ঘরবাড়ি সব তলিয়ে গেছে তাদের আশ্রয় এখন গ্রামের প্রাইমারী স্কুলগুলো। মানুষে গাদাগদি। একসাথে বাঁচা কিংবা মরার প্রতিক্ষায়। সবচেয়ে বিপদ হচ্ছে গরু আর ছাগলগুলোর। মোরগ মুরগী গাছের ঢালে উঠে গেছে।

হাঁসগুলো সারাদিন সাঁতার কেটেকেটে ক্লান্ত হয়ে মনিবের আশ্রয় স্থলে এসে কঁচুরীপানার স্তুপের উপর ঝিমায়। অধিকাংশ গরু,বাছুর ,ছাগল মরে জলে মিশে গেছে। যেগুলো মরেনি সেগুলো গলা পানিতে দাঁড়িয়ে ঝিমায়, মৃত্যুচিন্তা করে। ভাসতে ভাসতে কোন কঁচুরী পানা মুখের কাছে এলে কখনো জিহবা বের করে আটকায় কখনো ছেড়ে দেয়। পুরুষেরা উদাস হয়ে হাঁটুর উপর হাত রেখে বসে থাকে।

কারো পরনে লুঙ্গি, কারো গামছা। মহিলারা খোঁদকুড়ো যা আছে সময়ে সময়ে রান্না করে,বাচ্চাদের খেয়াল রাখে । কোনটা না আবার জলে পড়ে মরে ভেসে উঠে। রৌশন মিয়া ব্যাপারীর বাড়িটা কিছুটা উঁচু হওয়াতে বন্যায় আগে কখনো তলিয়ে যায়নি। কিন্ত্ত এবার জল বেশি ।

বাড়ি তলিয়ে ঘরে হাঁটু পানি। রান্না ও থাকার ব্যাবস্থা উঁচু চৌকিতেই। একঘর থেকে আরেক ঘরে যাবার জন্য উঠানের মধ্যে বাঁশের সাঁকো। বড়শি দিয়ে উঠানে মাছ ধরা হয়। বিকেলবেলা মহিলারা ঘরের বাহিরে বড়শি ফেলে মাছ ধরে।

কখনো কখনো রান্না করার সময় কিংবা খাবার সময় খাদ্যকণা পানিতে পড়লে বড় বড় মাছ ঘরে ছুটে আসে। শায়েরা বানু মাছভাজার চোঁখা খুন্তিতে মাঝেমাঝে গেঁথেও ফেলেন একেকটা। শায়েরার বার বছরের ছেলে দয়াল মিয়া মায়ের কৃতিত্বে খুশি। খাবারের সময় বাপ-বেটায় মাছের মুড়ো খাওয়া নিয়ে কাড়াকাড়ি পড়ে যায়। বাড়ির সামনে বিশাল আমনের মাঠ জুড়ে শাপলা শালুক ফুঁটে আছে।

রৌশন মিয়া ছেলেকে নিয়ে প্রায়ই শালুক তুলে আনে। গরুর জন্য কঁচুরী পানা ,রান্নার জন্য আগাছা। আগাছা ঘরের চালায় শুকিয়ে তৈরি হয় রান্নার সরঞ্জাম। ভাদ্রের কুত্তাপাগল রোদে শুকাতে সময় লাগেনা। ব্যাপারী আড়ং করতে গেছে।

দয়াল মিয়া ভরদুপুরে ডিঙ্গিটা নিয়ে আমন ধানের মাঝমাঠে খুঁটি দাবায়। শালুক তুলবে। আজই একা । আগে সে বাপের সাথে আসত। জলে ভাসা মানুষ জল ঘাটতে ঘাটতে জলাসক্ত হয়ে পড়ে।

জলের স্পর্শ ছাড়া জ্বালাপোড়ায় ভোগে। ঘন্টার পর ঘন্টা পানিতে পানকৌড়ির মত না ডুবালে শরীরের জ্বালা মেটেনা। দশ হাত পানির নিচ থেকে ডুব দিয়ে শালুক তোলা বার বছরের ছেলের জন্য যথেষ্টই কষ্টের। একটা শালুক তুলার পর অনেক্ষণ জিরিয়ে নিতে হয়। একবার দু'টো শালুকের পাঙ ধরে ডুব দেয় এবং একসাথে দু'টো শালুক তুলে নিয়ে আসে ।

কষ্ট হয় খুব। তারপরও বালক রাজ্য জয়ের আনন্দ লাভ করে। এভাবে সে নেশায় মেতে উঠে । এক ডুবে কখনো দুইটি কখনো তিনটি। ঘন্টার পর ঘন্টা ডুবিয়ে শালুক নিয়ে বাড়ি আসে।

শায়েরা বানু একা একা যাবার জন্য খানিকটা ভর্ৎসনা করলেও খুশি হয়। ছোট বোন পারভিনের সাথে খুনসুটি করে। শায়েরা বানু ধমকের সুরে শাসন করে। স্বামীর জন্যে সিঁকোয় তুলে রাখে কয়েকটা। ভাইবোনের ঝগড়া চলতেই থাকে।

পারভিন বলে- -এই বড় সুইন্ধা শালুকটা আমি খামু। -ক্যান তুই খাইবি ক্যান?কষ্ট কইরা আমি তুইল্লা আনছি আমি খামু। পারভিন ছাড় দেয়। -পানির তলাত থাইক্কা শালুক তুইল্লা আনতে তোর ডর লাগেনা? -ক্যান ডরামু ক্যান? -জল দানব যদি তরে রাইখা দিত নাইলে বড় বোয়াল মাছে যদি তোরে খাইয়া লাইতো? দয়াল ভয় পেলেও ছোট বোনের কাছে প্রকাশ করে না । বলে- -জল দানব আমার কাছে আইলে একটা ঘুসি দিয়া ফাডাইয়া লামু না।

পারভিন আশ্বস্ত হয়। বিকেলে শায়েরাবানু ছিপ দিয়ে কয়েকটা টেংরা মাছ ধরে। কী একটা অভিসন্ধি তার মনে আসে। মাছগুলো পানি দিয়ে জিইয়ে রাখে। সন্ধ্যার দিকে বোয়াল মাছ ধরার বড়শিতে দুইটা টেংরা গেঁথে দিয়ে বাড়ির কাঞ্ছায় পুঁতে দিয়ে আসে।

মাঝরাতে ব্যাপারী শায়েরা বানুকে জাগিয়ে তোলে। -বাইরে পানির মইধ্যে এত শব্দ কিয়ের?চোর আইলো নিহি উড দেখি। শায়েরা হারিকেন জ্বালিয়ে দরজা খুলে। অস্পষ্ট আলোয় দেখা যায় বাড়ির কাঞ্ছায়পুঁতে রাখা বড়শিটা যেন ভেঙ্গে যাচ্ছে। -একটা ছিপ পাইত্তা রাখছিলাম।

মনে হয় বোয়াল মাছ লাগছে। ঠেলাডা লও চাই-লও দেখি। ব্যাপারী ধীরে ধীরে ঠেলা হাতে বড়শির দিকে এগিয়ে যায় । বুঝতে অসুবিধা হয় না বড়শিতে অনেক বড় বোয়াল মাছ ধরা পড়েছে। ব্যাপারী বড়শির নিচে ঠেলা চালায়।

বড়শিতে আটকানো মাছ ঠেলা জাল দিয়ে নৌকায় উঠায়। পারভিন আর দয়াল মিয়া অনেক হয়ে দেখে। বাপরে কত্ত বড় গোঁফ! দুই তিন দিন তাদের বাড়িতে প্রায় উৎসবের মত লেগে থাকে। সকাল থেকে দয়াল মিয়াকে পাওয়া যাচ্ছেনা । বিকেল হয়ে এলো।

ডিঙ্গিটাও নেই। কোথায় গেলো?ব্যাপারী ভাইয়ের নৌকাটা নিয়ে আমন ধানের মাঠে খুঁজতে বের হয়। দূরে একটা খুঁটি দেখা যায়। খুঁটির মাথায় একটা পাখি বসে আছে। খুঁটিতে বাধা আছে তাদের ডিঙ্গিটা।

ব্যাপারীর ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠে। যা ভেবেছিল তাই। সর্বনাশ হয়ে গেছে। জলজ আগাছায় আষ্টেপিষ্টে জড়িয়ে গিয়েছিল দয়াল মিয়ার শরীর। বালক হয়তো অনেক চেষ্টা করেছে বেঁচে থাকবার।

শেষ পর্যন্ত জলদানবের কাছে পরাজয় বরণ করেছে। এই হলো শাপলা শালুকের দেশের গল্প। এখানে মানুষ ছোট সুখে বড় আনন্দ পায়। বড় দুঃখে পাথর হয়ে থাকে। তবুও ভাঙ্গেনা।

আবার শুরু থেকে শুরু হয় তাদের জীবন।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।