আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জানালার ওপাশে

মাঝে মাঝে বৃষ্টি দেখে হাত বাড়ানোর ইচ্ছে জাগে... ভেতর ভেতর যাই পুড়ে যাই, কেউ জানেনা আমার আগে... ‘হ্যালো’ ‘হ্যা, বলো। ’ ‘আমার মেসেজ পাও নি তুমি?’ ‘পেয়েছি। ’ ‘কয়টা পেয়েছো?’ ‘গুনি নি। ’ ‘গুনি নি মানে?’ ‘গুনি নি মানে এগজ্যাক্ট বলতে পারবোনা কয়টা। ’ ‘ এগজ্যাক্ট বলতে হবে না।

আনুমানিক বলো। ’ ‘সাত আটটা হবে। ’ ‘রিপ্লাই দাওনি কেনো?’ ‘কি রিপ্লাই দিব?’ ‘কি রিপ্লাই দিব মানে! মেসেজের রিপ্লাই দেবে। ’ ‘সেটাইতো। মেসেজের কি রিপ্লাই দিব!’ ‘তুমি... তুমি...তুমি একটা...।

’ ওপাশ থেকে ফোন কাটার শব্দ হলো। তারপরও অযথাই মোবাইল ফোনটা কানে চেপে বসে থাকে রাতুল। রাতুলের মাথার ওপর সিলিংফ্যানটা ভীষণ শব্দে ঘুরছে। এই শব্দে রাতুলের অস্বস্তি লাগে। তার একধরনের Akousticophobia আছে।

Akousticophobia হলো শব্দাতঙ্ক। তার কেবল ফ্যানের এই তীব্র শো শো শব্দ সহ্য হয় না। কেমন অস্বস্তি লাগে। একধরনের আতঙ্ক কাজ করে। মনে হয়, ফ্যানটা সিলিং থেকে ছুটে যেকোন মুহুর্তে মাথায় পড়বে।

এই সময় ফোনটা আবার বাঁজলো। রাতুল ফোনের স্ক্রিন না দেখেও জানে, আনিকা। একটু আগে সে রেগেমেগে ফোন কেটে দিয়েছিলো। এখন আবার করেছে। আবার কেটে দিবে।

আবার করবে। এই কাটাকুটি খেলা আজ চলতেই থাকবে। ‘হ্যা, বলো। ’ ‘হ্যা বলো মানে?’ আনিকার কণ্ঠে ঝাঁঝ। রাতুল জবাব দেয় না।

চুপ করে থাকে। জানালায় হেলান দিয়ে আরাম করে বসে। সে জানে, এখন সে যাই বলবে, আনিকা তার সবকিছুরই মানে জানতে চাইবে। অথচ যার কোন মানেই নেই। ‘কি হলো? কথা বলছো না কেন?’ আনিকার কণ্ঠে ঝাঁঝ খানিকটা বাড়ে।

‘বলো, শুনছি। ’ ‘বলো শুনছি মানে? তোমাকে আমি একটা প্রশ্ন করেছি। জবাব দাও। ’ ‘জবাব দেব। কিন্তু তার আগে তোমাকে স্বাভাবিক হতে হবে।

’ ‘স্বাভাবিক হতে হবে মানে! স্বাভাবিক হতে হবে মানে কি?’ আনিকার গলার স্বর সপ্তমে চড়ে। ‘তুমি কি বলতে চাইছো? কি বলতে চাইছো তুমি? আমি অস্বাভাবিক? আমি অসুস্থ? আমি পাগল?’ আনিকা ফোন কেটে দেয়। রাতুল ফোন কানে চেপে ধরে বসে থাকে। কথা শেষ হবার পরও ফোন কানে ধরে থাকার একটা বিশেষ মজা আছে। এই মজাটা রাতুল টের পায়।

তার কেন যেন মনে হয়, এই নিঃশব্দ ফোনে সে অনেকগুলো কণ্ঠ শুনতে পায়। এলোমেলো কণ্ঠ। সে এই কণ্ঠগুলো ধরতে চেষ্টা করে। কথাগুলো বুঝতে চেষ্টা করে। কিন্তু পারে না।

আবারো ফোন বাঁজছে। রাতুল ফোনটা টেবিলের উপর রেখে দেয়। তারপর উঠে দাঁড়ায়। ফ্যানের সুইচ বন্ধ করে। রুমে একটাই মাত্র জানালা।

জানালার কাঁচ কয়েক জায়গায় ভেঙে গেছে। ভাঙা জায়গাগুলো কেউ একজন পুরনো পত্রিকায় স্কচটেপ লাগিয়ে ঢেকে দিয়েছে। রাতুল অনেক কায়দা করে জানালাটা খুললো। মে মাসের মাঝামাঝি। বাইরেও ভ্যাপসা গরম।

কোথাও হাওয়া নেই। কিন্তু এখন সে ফ্যান চালাতে পারবে না। ফ্যানের শব্দ তার সহ্য হয় না। অস্থির লাগে। তারচেয়েও বেশী অস্থির লাগে আনিকার ফোন পেলে।

গত তিন মাসে রাতুল একটা জিনিস আবিষ্কার করে ফেলেছে, সে আর দশটা স্বাভাবিক ছেলের মতো না। সে কাউকে ভালোবাসতে পারে না। সে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফোনে কথা বলতে পারে না। কোন তরুণীকে নিয়ে রিকশায় হুড তুলে দিতে পারে না। কারো হাত ধরে রাস্তায় হেঁটে যেতে পারে না।

তার অস্বস্তি লাগে। হাসফাস লাগে। অথচ একসময় তার মনে হতো, সে এমন একটা মেয়ের অপেক্ষায় আছে, যে মেয়ে তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রাখবে। পাগলের মতো ভালোবাসবে। সে সেই ভালোবাসায় ডুবে থাকবে।

তার আর কিছু চাই না। ভালোবাসাহীনতা তার চেয়ে বেশী আর কে জানে? কিন্তু গত তিন মাস, তিনটি মাস, সে নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করেছে। কিংবা আনিকা তার ভেতর থেকে সত্যিকারের রাতুলকে বের করে এনেছে। এই রাতুল রাতুলের নিজের কাছেই অচেনা। অন্য কেউ।

আবারো ফোনের শব্দ। রাতুল ফোন রিসিভ করে কানে চেপে ধরে, কথা বলে না। ‘তুমি কি আমার সাথে কথা বলতে চাও না?’ আনিকার কণ্ঠ এবার অনেক স্থির শোনায়। ‘চাই’ ‘তাহলে এমন কেন করছো?’ এই প্রশ্নের জবাব রাতুলের কাছে নেই। সে নিজেও জানে না সে কেন এমন করছে।

আনিকার মেসেজের রিপ্লাই দিতে তার ভালো লাগে না। কথা বলতে ভালো লাগে না। কিন্তু একথা সে আনিকার মুখের উপর বলে দিতে পারে না। আনিকা মেয়েটাকে সে ভালোবাসে। কিন্তু কিছু একটা হয়েছে তার।

সে ভেতর ভেতর টের পায়, কিন্তু ধরতে পারে না। এমন না যে সে নতুন কারো প্রেমে পড়েছে। নতুন করে প্রেমে পড়ার অবস্থাও তার নেই। গত মাসে চাকরি ছেড়ে দিয়েছে। বাসা বদলাতে হয়েছে।

মুরগীর খোপের মতো এক বাসা সে ভাড়া নিয়েছে। এই বাসা ভাড়ার পেছনে রয়েছে অদ্ভুত ঘটনা। ১৪ ডিসেম্বর সকালে সায়েম আর রনির সাথে রাতুল যাচ্ছিল রায়ের বাজার বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধে। চা খেতে বসেছিলো রাস্তার পাশের ঝুপড়ি চায়ের দোকানে। উল্টোপাশে তাকাতেই চোখ আটকে গিয়েছিলো রাতুলের।

কতগুলো বস্তি ঘর আর পাশেই বিশাল এক রেইন ট্রি। ক্ষয়ে যাওয়া ইটের চাতালের উপর একটা হাতলভাঙা চাপকল। কিন্তু রাতুলের কিছু একটা হয়েছিলো। চোখ ফেরাতে পারছিলো না সে। মনে হচ্ছিলো এই দৃশ্যটি সে আগে কোথাও দেখেছে, বহুদিন ধরে, বহুবার।

চলেও এসছিলো রাতুল, কিন্তু মাথার ভেতর গেঁথে গিয়েছিলো দৃশ্যটি। হঠাৎ একদিন সেই বস্তির পাশের বিল্ডিংয়ের নিচতলার এক ঘুপচি ঘরে উঠে আসে সে। এই বাসার ঠিকানা আনিকার কাছে ছিলো না। কিন্তু আনিকা পারে না এমন কোন কাজ নেই। সে কিভাবে কিভাবে যেন এই বাসার ঠিকানা জোগাড় করে ফেলেছে।

রাতুল জানে, আনিকা চাইলে এই মাঝরাতে বাড্ডা থেকে হেঁটে রায়ের বাজারের এই বাসায়ও চলে আসতে পারে। ‘কেমন করছি?’ রাতুল শান্ত গলায় প্রশ্ন করে। সে জানে তার এই প্রশ্নের কোন অর্থ নেই। ‘তুমি বুঝতে পারছো না তুমি কেমন করছো?’ আনিকার গলা অ™ভুত শান্ত। ব্যাপারটা অস্বাভাবিক।

সাধারণত রাতুল এমন শান্ত থাকে। আর আনিকা চেঁচায়। ‘না’ ‘সত্যি কি তাই রাতুল?’ রাতুল জবাব দেয় না, চুপ করে থাকে। তার আর কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। এই একটা বিষয় নিয়ে গত কিছুদিনে তারা অসংখ্যবার কথা বলেছে।

কোন সমাধান হয়নি। বরং কথা শেষ হয়েছে তুমুল চেঁচামেচি আর ঝগড়ায়। রাতুল অবশ্য কখনোই চেঁচামেচি করে না। সে শান্ত, চুপচাপ। ‘আসলে আমি জানি না আনিকা।

’ ‘কাম অন রাতুল। ’ আনিকার কণ্ঠ শান্ত কিন্তু কঠিন। ‘আমার মনে হয় যথেষ্ট হয়েছে। দিস ইজ দ্যা টাইম টু মেক অ্যা ডিসেশন। তুমি কি আর আমার সাথে রিলেশন রাখতে চাও না?’ এই প্রশ্নের উত্তর সত্যিই রাতুলের কাছে নেই।

সে কি সত্যিই আর আনিকার সাথে সম্পর্কটা চায় না? তাতো না। আনিকার সাথে সম্পর্ক রাখতে না চাওয়ারতো কোন কারণ নেই। আনিকা সুন্দরী শিক্ষিত মেয়ে। তারচেয়ে বড় কথা মেয়েটা রাতুলকে অসম্ভব ভালোবাসে। সেই ভালোবাসা গভীর জলের মতো, প্রতি মুহুর্তে সেই জলে ডুবে যাওয়া যায়।

‘রাতুল চুপ করে থেকো না প্লিজ। যা হোক কিছু একটা বলো। ’ ‘আনিকা...। ’ রাতুল কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে যায়। তারপর চুপ করে থাকে।

ফোনের ওপাশে নিঃশব্দ আনিকাও। ‘আমার একটা ব্রেক দরকার আনিকা। আমি জানি না কেন? বাট আই নিড অ্যা ব্রেক। ব্রেক ফ্রম মাই লাইফ। ব্রেক ফ্রম সামথিং... ফ্রম সামথিং আই কান্ট রিকগনাইজ।

’ রাতুল এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে। তারপর চুপ করে থাকে। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে আনিকাও। ‘কি ধরনের ব্রেক রাতুল?’ ‘স্পেসিফিক কোন ধরন নেই। জাস্ট সব কিছু থেকে একটু দূরে থাকতে চাই।

’ ‘কতদিনের জন্য?’ ‘এখনো জানি না। ’ ‘কিন্তু জানা উচিত, তাই না?’ আনিকা একটু থামে। সম্ভবত নিজেকে কিছুটা গুছিয়ে নেয়। ‘তুমি মুনিরা আন্টিকে এখনো কিছু জানাও নি। ওনারা তোমাকে খুঁজছেন।

’ ‘ওনারা কারা?’ ‘রাফি, আন্টি। ’ ‘কিন্তু ওদেরতো আমাকে খোঁজার কথা না। ’ ‘কেন?’ এ প্রশ্নের উত্তরে রাতুল আবার চুপ করে থাকে। খোলা জানালা দিয়ে এক চিলতে আলো গিয়ে পড়েছে বাইরে। অনেকগুলো ঘুপচি বস্তি ঘর ওখানে।

জায়গাটা প্রায় অন্ধকার। ঘন আবছা অন্ধকারেও চোখে পড়ে বাঁশের বেড়ার মাঝে নীল পলিথিনের জানালাওয়ালা খুপড়ি এক ঘর। জানালার নিচেই ময়লার ড্রেন, তার পাশে ভাঙা হাতলওয়ালা একটা চাপকল। ক্ষয়ে যাওয়া ইটের একটুকরো চাতাল। সেই চাতালে রোজ ভোরে রঙচটা সবুজ একটা শাড়ী কাঁচেন মাঝ বয়সি এক মহিলা।

তার পাশেই আবছা অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে বড় এক রেইন ট্রি। রেইন ট্রির শরীর জুড়ে পেরেক ঠুকে লাগানো অজস্র টিনের বিজ্ঞাপন। অতি সাধারণ এক দৃশ্য। কিন্তু অতি সাধারণ এই দৃশ্য দেখে প্রথম দিনই কেন যেন চমকে গিয়েছিলো রাতুল। দৃশ্যটি কি আগে কোথাও দেখেছে সে? কোথায়? ফোনের ওপাশে নিঃশব্দ আনিকা রাতুলের উত্তরের অপেক্ষায়।

ফোনের এই নিঃশব্দ সময়গুলোতেও রাতুল যেন সেই অদ্ভুত কণ্ঠগুলো শুনতে পায়। এলোমেলো শব্দ। জানালার বাইরের দৃশ্যের মতোই ফোনের ওই কাল্পনিক শব্দগুলোকেও রাতুলের খুব চেনা মনে হয়। এই কথাগুলো কি আগে কোথাও শুনেছে রাতুল? কোথায়? ‘আনিকা, পৃথিবীতে আমাকে খুঁজবার মতো একটা মাত্র মানুষ ছিলেন, রহমান চাচা। উনি বেঁচে নেই।

’ একটু থামে রাতুল। তার চোখ স্থির হয়ে আছে জানালার বাইরে। ‘এখন তুমি আছো। আর কেউ না। ’ ‘আমি জানি রাতুল।

কিন্তু মুনিরা আন্টি তোমাকে ভালোবাসেন’। ‘হয়তো। হয়তো না। মুনি মা...। ’ কি ভেবে কথাটা শেষ করে না রাতুল।

মুনিরা আন্টিকে মুনি মা বলে ডাকে সে। রাতুলের ঠোটের কোনায় খুব ছোট্ট এক চিলতে হাসি ফোটে। হাসিটুকু মিলিয়ে যায় না, ঝুলে থাকে। একটু থামে রাতুল। তারপর বলে, ‘তবে আমার খুব ছোট বেলার কিছু স্মৃতি মনে আছে।

তখনো মুনি মা আমার কাছে আমার সত্যিকারের মা। রহমান চাচা আমাকে কিছু বলেন নি তখনো। আমি কিন্তু মুনি মার ভালোবাসাটা ঠিক টের পেতাম আনিকা। আমি স্কুলে যেতাম, ক্লাস থ্রী কি ফোর, উনি গাড়ীতেও আমাকে বুকের সাথে চেপে ধরে রাখতেন। ধরো, গাড়ীতে আমি ওনার পাশে বসে আছি, হঠাৎ অন্য একটা গাড়ী একটু বেশী গতিতেই ওভারটেক করলো, সাথে সাথে উনি পাগলের মতো আমাকে বুকে চেপে ধরে রাখতেন।

ঘটনাটা মাথা থেকে পুরোপুরি না যাওয়া পর্যন্ত উনি আমাকে কখনোই আর গাড়ীর সীটে বসতে দিতেন না। কোলের ভেতর বুকে চেপে রাখতেন। ’ ফোস করে নিঃশ্বাস ফেলে রাতুল। তারপর চুপ করে থাকে। আনিকাও।

রাতুলের অনেক কিছুই জানে আনিকা। তারপরও প্রতিদিনই নতুন কিছু না কিছু থাকে। ‘একবার কি হলো শোনো, সেবার ঈদে আমরা রহমান চাচার গ্রামের বাড়িতে গেছি। আমি, মুনি মা, রহমান চাচা। রহমান চাচার সাথে মুনি মার বিয়ের বছর পাঁচেক পর থেকে আর গ্রামে যান নি মুনি মা।

রহমান চাচা একাই যেতেন। বাচ্চা কাচ্চা হচ্ছে না বলে গ্রামের আত্মিয়-স্বজনেরা নানান কথা বলে। মুনি মা তাই গ্রামে যেতে চান না। তারওপর গ্রামে ইলেক্ট্রিসিটি নেই, ফোন নেই, দোকানপাট নেই। তো সন্ধ্যে বেলা কি করে যেন পায়ে পেরেক ঢুকিয়ে ফেললাম আমি।

জং ধরা পুরনো পেরেক। গলগল করে রক্ত ছুটছে পায়ে। টিটেনাস ভ্যাকসিন দিতে হবে। কিন্তু কিভাবে সম্ভব? ডাক্তার নেই কোথাও। কাছের গঞ্জও মাইল পাঁচেক দূরে! মুনি মা পাগলের মতো হয়ে গেলেন।

রহমান চাচা অনেক বুঝিয়েও তাকে আর শান্ত করতে পারেন না। আমার বয়স তখন সাত কি আট। প্রচন্ড ব্যাথায় চিৎকার করে কাঁদছি আমি। একটা কাপড় দিয়ে আমার পা শক্ত করে বেঁধে দেয়া হলো। শক্ত করে বেঁধে দেয়া পায়ে এক ধরনের প্রেসার তৈরি হয়, এই প্রেসারে ব্যাথা একটু কম মনে হয়।

মুনি মা আমাকে কোলে নিয়ে বিশাল উঠানের এপাশ থেকে ওপাশে হাঁটতে থাকেন। তিনি যখন আমাকে কোলে করে হাঁটেন তখন আমার পা দুলতে থাকে, একধরনের ছন্দ তৈরি হয়, এই ছন্দে ব্যাথাটা তেমন টের পাওয়া যায় না। সমস্যাটা হচ্ছে মুনি মা যখন একটু দাঁড়ান, তখনই আমি চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠি। আবার মুনি মা হাঁটা শুরু করেন। সেই রাতে ফজরের আজান পর্যন্ত মুনি মা আমাকে কোলে নিয়ে উঠানের এপাশ ওপাশ হেঁটেছেন।

তার দু’পা ফুলে থামের মতো হয়ে গেছে আর আমি নিশ্চিন্তে তার কোলে ঘুমিয়েছি। সারা রাত। ’ প্লাস্টিকের জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢালে রাতুল। অনেকগুলো বুদবুদ কাঁচের গ্লাসের চারপাশে ঘোরে, ঘুরে মিলিয়ে যায়। জানালায় মাথা গলিয়ে খানিকটা পানি মাথায় ঢালে রাতুল।

বা হাতে তোয়ালে নিয়ে কোনভাবে মাথা মোছে। আনিকা কোন কথা বলে না। এই গভীর রাতে দেয়াল ঘড়ির একটানা টিক টিক শব্দ খুব কানে বাজে। রাত তিন টা। ‘আমি মুনি মাকে ছাড়া ঘুমাতে পারতাম না আনিকা।

খেতে পারতাম না। মুনি মার ডান হাতের বাহুতে ঘুমাতাম আমি। আমি বালিশে ঘুমাতে পারতাম না, ওটাই আমার বালিশ ছিলো। দিনের পর দিন বøাড সার্কুলেশনে সমস্যা হওয়ায় মুনি মার হাতখানাই যেতে বসেছিলো। স্কুলে আমার কোন বন্ধু ধরো আমাকে দাঁত দিয়ে ভেঙে একটুকরো চকলেট খেতে দিয়েছে।

এই এতোটুকু। আঙুলের করের সমান। আমি খাতার পাতা ছিড়ে ভাঁজ করে তাতে চকলেটটুকু পেঁচিয়ে বাসায় নিয়ে আসতাম। মুনি মা দেখে হাসতেন। তারপর আমাকে বুকের মধ্যে চেপে ধরে...।

’ রাতুলের গলাটা কেমন ভারি শোনায়। ভেজাও খানিকটা। চুপচাপ দেয়াল ঘড়ির দ্রুত অপসৃয়মান কাটাটির দিকে তাকিয়ে থাকে সে। ‘হঠাৎ মুনি মার শরীর খারাপ হলো, কদিন থেকেই আমাকে আর স্কুলে দিতে কিংবা আনতে গেলেন না। এমনি একদিন স্কুল থেকে বাসায় ফিরলাম আমি, মাঠে খেলতে গিয়ে পা কেটে ফেলেছি।

মুনি মা ব্যালকনিতে দাঁড়িয়েছিলেন। আমি ড্রাইভার চাচার হাত ধরে খুড়িয়ে খুড়িয়ে গাড়ি থেকে নামলাম। পায়ে সাদা ব্যান্ডেজ। ঘাড় উঁচু করে দোতলার ব্যালকনিতে মুনি মার দিকে তাকালাম আমি। আমার চোখ ভর্তি অপেক্ষা, বুকভর্তি কান্না।

মুনি মা এখুনি দৌঁড়ে এসে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরবে। তারপর বুক ভাসিয়ে কাঁদবে। কিন্তু মুনি মা আমার দিকে তাকালেন, খুব অবহেলায়, তারপর খুব সহজভাবে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। ব্যালকনিতে ঝোলানো ময়না পাখির খাঁচায় চুপচাপ খাবার দিতে থাকলেন। আমি খানিকটা অবাক হলাম।

কিন্তু কিছু মনে হয়নি তখনো। মুনি মাকে চিৎকার দিয়ে ডাকলাম। মুনি মা আমার দিকে তাকালেন, তারপর ধীরে ঘরে ঢুকে গেলেন। আমি নিচে মুনি মার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে রইলাম। মুনি মা এখুনি নিচে নেমে আসবেন।

কিন্তু মুনি মা আর আসলেন না। আমি দাঁড়িয়েই রইলাম। কাজের বুয়া সুফিয়া খালা আসলো, সেও আমাকে উপরে নিতে পারলো না। আমি চিৎকার করে কান্না শুরু করলাম। মুনি মাকে ছাড়া আমি উপরে যাবো না।

কিন্তু মুনি মা আর আসলেন না। আমি কাঁদতে কাঁদতে সিঁড়ির গোড়ায় ঘুমিয়ে পড়লাম। রহমান চাচা আসলেন ঘণ্টাখানিক পর। তিনি সিঁড়ির গোড়া থেকে আমাকে ডেকে তুললেন। আমি রহমান চাচাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলাম।

মুনি মার নামে নালিশ দিতে থাকলাম। রহমান চাচা চুপ করে শুনলেন। তার মুখে চিন্তার ছাপ। আমি তখনো কিছু বুঝিনি। সে রাতে খাবার টেবিলে মুনি মা আমার সাথে বসলেন না।

আমি খাবার টেবিলে চুপচাপ বসে আছি। রহমান চাচা গেছেন মুনি মার ঘরে। মুনি মা কিছুতেই আসবেন না। শেষমেষ চিৎকার, চেঁচোমেচি। মুনি মা কিছু একটা ভাঙলেন।

আমি সাত আট বছরের ছোট্ট বালক। কিন্তু কি করে যেন আমি সব বুঝে গেলাম, মুনি মা আমার কেউ না। আমি এদের কেউ না। রাতে আমার ঘুমানোর আলাদা বিছানা হলো। আলাদা ঘরে।

আমি চুপচাপ সেই ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে অন্ধকারে বসে রইলাম। সারারাত। আমি মুনি মার আঁচলের ঘ্রাণ ছাড়া ঘুমাতে পারি না। আমি মুনি মার হাতের বালিশ ছাড়া ঘুমাতে পারি না। সেই আমি দু হাঁটু ভাঁজ করে বুকের কাছে এনে চুপচাপ কুন্ডুলি পাকিয়ে শুয়ে জেগে রইলাম।

ফজরের আজান অবধি। ভোরের দিকে রহমান চাচা এলেন। আমাকে বুকে চেপে ধরে বোঝালেন, মুনি মার অসুখ করেছে। এইজন্য মুনি মা অমন করছে। ঠিক হয়ে যাবে।

যে ক’দিন ঠিক না হয়, আমি যেন মন খারাপ না করি, কষ্ট না পাই। আমি রহমান চাচার কথা খুব মন দিয়ে শুনলাম। কিছু বললাম না। চুপ করে মাথা নাড়লাম। তারপর উঠে স্কুলে গেলাম।

স্কুল থেকে ফিরে দোতলায় উঠতেই দেখি রহমান চাচা দরজার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন। তার গায়ের জামা ছিন্ন ভিন্ন। মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ভাঙা ফুলদানি, কাঁচের গ্লাস, প্লেট। উষ্কোখুষ্কো চুলে দাঁড়িয়ে ফুঁসছেন মুনি মা। আমাকে দেখে যেন উন্মাদ হয়ে গেলেন।

অশ্রাব্য গালি গালাজ করতে করতে তেড়ে এলেন। অসহায় রহমান চাচা কোনমতে ঠেকালেন। মুনি মাকে জাপটে ধরে আমাকে বললেন সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে যেতে। মুনি মার ওই চেহারা দেখে আমার হাত পা থরথর করে কাঁপছিলো। আমি কোনমতে নিচে নেমে এলাম।

নিচে নামতে নামতেই মুনি মার চিৎকার শুনতে পাচ্ছিলাম, ওকে বাড়ি থেকে বের করো। এক্ষুণি বের করো। ও থাকলে আমার খোকার ক্ষতি হবে, তোমার পায়ে পড়ি, ওকে খেদাও। মুনি মা চিৎকার করে কাঁদছিলেন। তার কান্নায় ক্রোধ ছিলো, ঘেন্না ছিলো, আর্তনাদও ছিলো।

আমি নিচে নেমে সিঁড়ির গোড়ায় বসে থর থর করে কাঁপছিলাম। আমি কি বুঝেছিলাম জানি না। সেদিন রাতে আমার ঘুমানোর জায়গা হলো নিচ তলায়। রাতে আমার গা কাঁপিয়ে জ্বর এলো। সাথে বমি।

তারপর আর আমার কিছু মনে নেই। সপ্তাহখানেক পরে রহমান চাচা আমাকে স্কুলের হোস্টেলে দিয়ে আসলেন। তিনিও আমাকে কিছু বলেন নি, আমিও কিছু জানতে চাইনি। ’ রাতুল থামে। গ্লাস থেকে নিয়ে ঢকঢক করে পানি খায়।

এই সময় জানালার বাইরের বস্তির ঘর থেকে তীব্র চিৎকার ভেসে আসে। রাতুল খোলা জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়। জানালাটা খানিক নড়ে ওঠে। একটা পুরুষ কণ্ঠের অশ্রাব্য গালি ভেসে আসে, ‘খানকি মাগী, টেকা দেই নাই? টেকা কি কম দিছি? কথা আছিলো তিনশো টেকায় পুরা রাইত। ’ ‘রাইতের আর বাকি কি?’ একটি নারী কণ্ঠের গোঙানী।

ধস্তাধস্তির শব্দ। তারপর আবার চুপ। রাতুল চোখ ফিরিয়ে দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকায়। রাতের আসলেও বেশি বাকি নেই। রাত প্রায় চারটা।

খানিকবাদেই ফজরের আজান হবে। ‘আনিকা, বিরক্ত হচ্ছো? অনেক বকবক করছি আজ?’ ‘তুমি বলো, আমি শুনছি। ’ আনিকার গলা শীতল, স্থির। ‘রহমান চাচা হোস্টেলে আমাকে নিয়মিত দেখতে আসতেন। একদিন আমাকে বললেন, মুনি মার পেটে আমার একটা ভাই হবে।

এইজন্যই মুনি মা এত অসুস্থ। এইজন্যই এমন করেছেন সবার সাথে। মুনি মাকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে। আমার ভাইটা হলেই মুনি মা আবার আগের মতো হয়ে যাবে। তখন আমাকে বাসায় নিয়ে যাবেন।

আমি যেন মন খারাপ না করি। রহমান চাচার কথা শুনে আমার বিশেষ কোন অনুভূতি হলো না। আমি ঘাড় কাঁত করে সায় দিলাম শুধু। রহমান চাচা চলে গেলেন। এর কয়েক মাস পরে রাফির জন্ম।

রাফির জন্মের বছরখানেক পর, আমি তখন সিক্স বা সেভেনে পড়ি, আমাকে আবার বাসায় আনা হলো। মুনিমা কে দেখে আমার কেমন একটা অ™ভুত অনুভূতি হতে থাকে। মুনি মার চোখে কিছু একটা ছিলো। আমি মুনি মার কাছে যেতাম না। কিন্তু সারাক্ষণ দূর থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে মুনি মাকে দেখতাম।

মুনি মা পাগলের মতো রাফিকে আগলে রাখতেন। রাফির কাছাকাছি কাউকে যেতে দিতেন না। মুহুর্তের জন্য চোখের আড়াল করতেন না। ভালোবাসার কি অসম্ভব ক্ষমতা যে একটা মানুষের থাকতে পারে তা মুনি মাকে না দেখলে বোঝা যেত না। একদিন দুপুরে, স্কুল থেকে ফিরে আমি মুনি মার ঘরে উঁকি দিলাম।

মুনি মা নেই, রাফি মশারির ভেতর ঘুমাচ্ছে। বাচ্চাদের ছোট্ট স্ট্যান্ড মশারি। রাফির নড়াচড়ায় মশারিটা কাত হয়ে পড়ে আছে রাফির মুখে। আটকে গেছে। বার কয়েক শ্বাস টানার চেষ্টা করলো রাফি, নাকের কাছে গিয়ে আটকে গেলো মশারির কাপড়।

কয়েকবার হাঁচি দিয়ে কেঁশে উঠলো ও। আমি ভালো করে উঁকি দিয়ে দেখি ঘরে কেউ নেই। রাফি আরো জোরে শ্বাস টানার চেষ্টা করছে। আমি ভয় পেয়ে গেলাম। এদিক ওদিক তাকিয়ে দৌঁড়ে গেলাম খাটের কাছে।

মশারিটা তুলবো এই মুহুর্তে বাথরুমের দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন মুনি মা। মশারি হাতে খাটের কাছে দাঁড়ানো আমার দিকে তাকালেন একবার, আরেকবার কাঁশতে থাকা ঘুমন্ত রাফির দিকে। তারপর চিৎকার দিয়ে এসে ছোঁ মেরে রাফিকে কোলে তুলে নিলেন। এক হাত দিয়ে রাফিকে বুকে চেপে ধরে আরেক হাতে আমার চুল মুঠো করে ধরলেন। এক ঝটকায় আছড়ে ফেললেন মেঝেতে।

তারপর বা পায়ের লাথিতে আমাকে ছিটকে ফেললেন দরজার কাছে। জান্তব স্বরে চেঁচাতে লাগলেন, আমি আগেই বলছিলাম, এই জানোয়ারটা আমার খোকাকে মেরে ফেলবে, এই বেজন্মাটা আমার বাবাকে মেরে ফেলবে। আমি আগেই বলছিলাম, তোমরা কেউ আমার কথা বিশ্বাস করো নাই। কেউ না। কেউ না।

’ ‘উনি কি মানসিকভাবে অসুস্থ ছিলেন? কোন সাইকোলোজিকাল প্রবেøম বা এরকম কিছু?’ অনেক্ষণ পর প্রশ্ন করলো আনিকা। ‘হুম। হতে পারে। ’ রাতুল কিছু একটা ভাবে। শেষ রাতের নিস্তব্ধতায় ফিসফাস কিছু কথা কানে আসে।

কিছু শব্দ। ওর চোখ জানালা দিয়ে বাইরে। সেখানে ক্ষয়ে যাওয়া ইটের ছোট্ট একটুকরো চাতাল। একটা হাতলভাঙা চাপকল। পাশের অন্ধকারে অজস্র পেরেকের ঘায়ে অজস্র সাইনবোর্ড শরীরে দাঁড়িয়ে বিশাল রেইন ট্রি।

বস্তির ঘুপচি ঘর। নীল প্লাস্টিকের জানালা। জানালার ওপাশে ঘুটঘুটে অন্ধকার। সেই অন্ধকারেও পেরেক ঠোকার খেলা। একটি শরীর আরেকটি শরীরে পেরেক ঠুকে ঠুকে সেঁটে দিচ্ছে সাইনবোর্ড।

চিরন্তন অন্ধকারের সাইনবোর্ড। রাতুলের ভাবনা যেন আর শেষ হয় না। সে চুপ করে থাকে। নিঃশব্দ মোবাইল ফোনের ভেতর রাতুলের কাল্পনিক সেই কণ্ঠগুলো যেন আবার ফিরে আসে। সেই এলোমেলো ফিসফাস শব্দগুলো।

রাতুল কণ্ঠগুলো বোঝার চেষ্টা করে। এই কণ্ঠগুলো সে অন্য কোথাও শুনেছে। দীর্ঘদিন শুনেছে। কিন্তু কোথায়? ‘রাতুল? তুমি কি ঠিক আছো?’ অনেক্ষণ অপেক্ষার পর আনিকা নিজেই আবার প্রশ্ন করে। ‘হ্যা, আমি ঠিক আছি।

’ ‘মুনিরা আন্টি কি মানসিকভাবে অসুস্থ ছিলেন?’ ‘এই প্রশ্নের উত্তরটা একটু জটিল আনিকা। হতে পারে তিনি অসুস্থ ছিলেন আবার নাও হতে পারে। যদি মেডিকেল সায়েন্সের কথা বলো, হ্যা, তাহলে হয়তো তিনি কোন না কোনভাবে অসুস্থ ছিলেন। Paranoid schizophrenia নামে একধরনের মানসিক অসুস্থতা আছে। তার আচরণগুলোকে হয়তো এই অসুস্থতার সাথে কোনভাবে মেলানো যাবে।

এর বাইরেও কিন্তু কিছু সহজ সাধারণ ব্যাখ্যাও আছে আনিকা। রহমান চাচার সাথে মুনি মার বিয়ের কয়েক বছরের মধ্যে তারা আবিষ্কার করলেন তারা বাবা-মা হতে পারছেন না। এটা অনেকের ক্ষেত্রেই হয়। দেরী করে সন্তান হয়। কিছু মেয়ে আছে যাদের মাতৃসত্তার প্রতি প্রবল দূর্বলতা থাকে।

এই দেরিটা তারা সহ্য করতে পারে না। মুনি মা ছিলেন সেরকম একজন। বিয়ের ছ’-সাত বছরের মধ্যেও যখন মা হতে পারলেন না তখন তার মধ্যে তীব্র একধরনের আতঙ্ক কাজ করা শুরু করলো। তিনি একের পর এক ডাক্তার দেখাতে থাকলেন। এবং কোন এক ডাক্তার তাকে বলে দিলেন যে তিনি আর মা হতে পারবেন না।

এই সময় মুনি মা পাগলের মতো হয়ে গেলেন। এবং সেই সময় আমাকে নিয়ে আসেন রহমান চাচা। আমাকে পেয়ে মুনি মা তার মাতৃত্বহীনতা ভুলে থাকার চেষ্টা করতে লাগলেন। তার মাতৃ-হৃদয়ের সকল মমতা উজাড় করে দিয়েছেন। একসময় হয়তো ভুলেও গেলেন যে আমি তার নিজের সন্তান নই।

কিন্তু হঠাৎ করেই, বিয়ের প্রায় বছর দশেক পরে কনসিভ করেন মুনি মা। এবং নিজের শরীরের ভেতর যে অস্তিত্ব তিনি টের পেলেন, সেই অস্তিত্ব তার নিজের, একান্তই নিজের। এই অনুভূতিতে তার মাতৃত্বের অহংকার যেমন আছে, তেমনি নিজ অস্তিত্বের প্রতি নিরংকুশ ভালোবাসাও। নিজ সন্তানের প্রতি মায়ের ভালোবাসা সবসময়ই প্রবলভাবে কেন্দ্রীভূত। এই বোধটা মুনি মার ভেতরে আরো বেশী তীব্র ছিলো।

আমার প্রতি তার যে ভালোবাসাটা ছিলো সেটি আসলে আমার প্রতি নয়, সেটি মুনি মার নিজের প্রতি নিজের ভালোবাসা ছিলো। নিজের অক্ষমতা, অতৃপ্তি, তৃষ্ণা ভুলে থাকার একটা উপায় ছিলাম আমি। কিন্তু রাফি যখন আসলো, তখন আর আমাকে দিয়ে তার সেই অতৃপ্তি কিংবা অক্ষমতা ভোলার দরকার ছিলো না। একচুয়ালি, তখন আর তিনি অক্ষমই নন। ’ ‘রাতুল, আমি স্বীকার করছি যে তোমার এই ব্যাখ্যাটা অনেকটাই যৌক্তিক।

কিন্তু মুনিরা আন্টির এই যে বদলে যাওয়া এটা কিন্তু একটা ম্যাসিভ চেঞ্জ, বড় ধরনের র্যাযডিকাল চেঞ্জ। এর ব্যাখ্যা কি? হঠাৎ করেই তোমার প্রতি ওনার এক ধরনের তীব্র ঘৃণা তৈরি হয়েছিলো। এর কারণ কি?’ আনিকা একটু থামে। রাতুল কোন জবাব দেয় না। আনিকা আবার বলে, ‘হ্যা, রাফি আসায় ওনার ভেতরে একটা পরিবর্তন হতেই পারে।

তোমার প্রতি ওনার যে তীব্র ভালোবাসা ছিলো, তা নাও থাকতে পারে। কিন্তু সেই তীব্র ভালোবাসার পরিবর্তে হুট করেই এমন তীব্র ঘৃণার কারণটা কি? এবং উনি কিন্তু ভাবতেন তোমার কারণে রাফির অমঙ্গল হবে কিংবা তুমি রাফির কোন ক্ষতি করবে। ’ আনিকার এই প্রশ্নের কোন জবাব খুঁজে পায় না রাতুল। সে নিজেও দিনের পর দিন এই প্রশ্নের জবাব খুঁজেছে। তার মনে নেই সে কবে প্রথম রহমান চাচার সাথে এসেছিলো।

তার কেবল আবছা মনে পড়ে, কোন এক বর্ষার বিকেলে সে রহমান চাচার সাথে গাড়ি থেকে নেমেছিলো। গায়ে হলুদ স্যান্ডো গেঞ্জি আর টুকটুকে লাল হাফ প্যান্ট। মুনি মা দৌঁড়ে এসে তাকে বুকে নিয়েছিলেন। তারপর বাথরুমে। ঘণ্টাখানেক ডলে ডলে গোসল করিয়েছিলো তাকে।

সেই থেকে মুনি মাকে মুনি মা বলে ডাকে রাতুল। কিন্তু রহমান চাচাকে চাচাই। এই নিয়ে কেউ তাকে কখনো কিছু বলেও নি। রহমান চাচাও না। নিঃশব্দ মোবাইল ফোনটা কানে চেপে ধরে বসে থাকে রাতুল।

ফিসফাস সেই কণ্ঠগুলো যেন আবার শুনতে পায় সে। তার কান ঝালাপাল হয়ে যায়। মাথা ঝিম ঝিম করে ওঠে। মনে হয় কথাগুলো সে বুঝতে পারছে। প্রায় বুঝতে পারছে।

রাতুল আরো শক্ত করে ফোনটা কানের সাথে চেপে ধরে। তার সারা শরীর বেয়ে ঘামের স্রোত নামে। কিন্তু রাতুল কিছুই বুঝতে পারে না। সে আনিকার ফোনটা কেটে দেয়। মোবাইল ফোনটা অফ করে রেখে দেয় টেবিলের উপর।

এই সময় সে সেই ফিসফিস কণ্ঠগুলো যেন আবার শুনতে পায় রাতুল। কিন্তু বন্ধ মোবাইল ফোনটাতো তার কানেই নেই! রাতুল প্রবল যন্ত্রণায় তার মাথা চেপে ধরে। ফিসফিস শব্দগুলো সে শুনতে পাচ্ছে, প্রায় শুনতে পাচ্ছে, হ্যা শুনতে পাচ্ছে। নিচু গলায় টাকা পয়সা নিয়ে বসচা হচ্ছে দুটি কণ্ঠের মধ্যে। নারী কণ্ঠ: ‘তিনশো টেকা দেওনের কতা আছিলো।

অহন দুইশো টেকা দিতেছেন কেন?’ পুরুষ কণ্ঠ: ‘নে মাগী, আমিতো তোর বান্দা কাস্টোমার, আইজ কম, কাইল বেশী নিবি। ’ নারী কণ্ঠ: ‘না, আপনে টেকা দিয়া যান, তিনশো টেকা, আমার শইল ভালো না, ডেইলি কাম করতে পারি না। ’ পুরুষ কণ্ঠ: ‘হ, বয়সতো আর তোর কম অয় নাই, বুড়া বয়সে আর কতো পারবি?’ নারী কণ্ঠটা ফিসফিস করে কাঁদে, আঁকুতি করে। ফিসফাস শব্দগুলো বেড়েই চলে। রাতুল যেন কল্পনায় কিংবা স্মৃতিতে দেখতে পায়, এই ফিসফাস কণ্ঠগুলোর পাশে, খুব কাছেই দুহাঁটু ভাঁজ করে বুকের কাছে এনে চুপচাপ কুন্ডুলি পাকিয়ে শুয়ে জেগে আছে একজোড়া নিষ্পলক সন্ত্রস্ত শিশু চোখ, ছোট্ট একজোড়া ভয়ার্ত কান।

ওই ভয়ার্ত কানে ফিসফাস শব্দগুলো যেন ঠেঁসে ঢুকে যাচ্ছে। ঢুকে যাচ্ছে। ঢুকে যাচ্ছে। নীল প্লাস্টিকের জানালাটা নড়ে ওঠে। তারপর ফাঁক হয়ে খুলে যায় পুরো জানালাটা।

বাইরে ভোরের আবছা আলো ফুটতে শুরু করেছে। সেই আবছা আলোয় শীর্ণকায় লম্বা এক লোক জানালায় মাথা গলিয়ে লাফিয়ে নামে। তারপর এদিক সেদিক তাকিয়ে লুঙ্গির কোচর থেকে বিড়ি বের করে। দিয়াশলাইয়ের জ্বলন্ত কাঠিতে ধরিয়ে হনহন করে হেঁটে যায়। রাতুল নীল প্লাস্টিকের সেই জানালা থেকে চোখ ফেরাতে পারে না।

তাকিয়ে থাকে। নীল প্লাস্টিকের জানালাটা আবার নড়ে ওঠে। জানালার ফাঁক গলে বের হয় একটি নারী শরীর। লাফিয়ে নামে নিচের ক্ষয়ে যাওয়া ইটের ছোট্ট চাতালে। তারপর ভাঙা চাপকল চেপে পানি তুলে বসে পড়ে কাপড় কাঁচতে।

রাতুল চেহারাটা দেখতে পায় না। কিন্তু ক্রমশই ভোরের আলোয় জেগে ওঠে বিশাল রেইন ট্রি। রেইন ট্রির শরীর জুড়ে অজস্র পেরেক ঠোকা সাইনবোর্ড। বস্তির ঘুপছি ঘর, নীল প্লাস্টিকের জানালা। জানালার নিচে ময়লার ড্রেন।

ক্ষয়ে যাওয়া ইটের ছোট্ট চাতাল। হাতলভাঙা চাপকল। চাপকলের নিচে কাপড় কেঁচে চলছেন নীল প্লাস্টিকের জানালা গলে লাফিয়ে নামা সেই মহিলা। রাতুল আর দেখতে চায় না। সে চোখ ফেরানোর প্রাণপণ চেষ্টা করে।

কিন্তু চাপকলের নিচের দৃশ্যটি থেকে সে চোখ ফেরাতে পারে না। রাতুলের সারা শরীর বেয়ে ঘামের স্রোত নামে। রাতুল চোখ ফেরাতে পারে না। সে প্রাণপণ চেষ্টায় চোখ বন্ধ করে। কিন্তু তার সেই বন্ধ চোখের ভেতর দিয়ে, গুটি গুটি পায়ে রেইন ট্রি গাছটি পেরিয়ে, নীল প্লাস্টিকের জানালার নিচে, ভাঙা হাতলের চাপকল আর ক্ষয়ে যাওয়া ইটের ছোট্ট চাতালের পাশে ছোট্ট শিশুটি ঠিক তখনই এসে দাঁড়ায়।

হলুদ স্যান্ডো গেঞ্জী আর লাল টুকটুকে হাফ প্যান্ট তার পরনে। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১৩ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।