আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শুন্যের গর্ভে- প্রথম পর্ব

মাঝে মাঝে মনে হয় জীবনটা অন্যরকম হবার কথা ছিল!

ওর সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল দু-দশকের ও অধিককাল আগে ,দেশের বাইরে। বলতে দ্বীধা নেই যে প্রথম দেখায় তাকে আমার মেটেই পছন্দ হয়নি! নাম বলেছিল 'তন্ময়'(নামটি ছদ্ম-সংগত কারনেই তার আসল নামটি গোপন করছি)। বাঙ্গালীদের চেয়ে তুলনামুলক অনেক বেশী লম্বা,একহাড়া গড়ন, মাথা ভর্তি এলোমেলো কোঁকড়ানো চুল, চেহারা ও চাহনীতে ছিল রুক্ষতা সেই সঙ্গে একধরনের উদাসীনতা। অতিরিক্ত লম্বার কারনেই হয়তোবা হাটার সময় একটু ঝুকে- কুজো হয়ে হাটত। দারুন মুডি ছিল।

কথাবার্তা ছিল চাঁছাছোলা- বিনয়ের কোন ধার ধারতো না। ফ্যাসফ্যাসে ভাঙ্গা ভাঙ্গা কন্ঠে কথা বলার সময় মনে হত তার উচ্চারিত প্রতিটা শব্দের কন্ঠনালী ত্যাগ করতে কস্ট হচ্ছে। অন্য সবার থেকে ব্যাতিক্রম সেই সদ্য-আগত ছাত্রটাকে শুধু আমি বাকি ক্লাস-মেটরাও প্রথমে তাকে পছন্দ করেনি। রাশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ তবে বেশ ছোট শহর তাম্বোভ। বর্হিবিশ্বে মোটেই তেমন পরিচিত নয়।

ওখানে তখন সর্বসাকুল্যে জনা-বিশেক বিদেশী ছাত্র ছিল তন্মদ্ধে বেশীর ভাগই বাঙ্গালী। আমরা একই সাথে অনেকটা একই পরিবারের মত থাকতাম। যদিও সবার সাথে পরিচয় ছিল মাত্র কয়েক মাসের তবুও আন্তরিকতার ন্যুনতম অভাব ছিল না। ওখানে ভর্তির প্রথম বছরের অর্ধেকের বেশী সময় আমাদের রুশ ভাষা শিখতে হয়েছে কারন বিদেশীদের জন্য ইংরেজী ভাষায় শিক্ষা ব্যাবস্থা তখনও সেখানে চালু হয়নি । আমাদের ভাষা শিক্ষা ক্লাস শুরু হওয়ার মাস চারেক পরে সে আসাতে শিক্ষকরা তার জন্য আলাদা ক্লাসের ব্যাবস্থা করল।

কিন্তু রুশ ভাষা সে এত দ্রুত আয়ত্ব করল যে সবাইকে হতবাক করে দিয়ে মাস খানেকের মধ্যে কতৃপক্ষ তাকে আমাদের সাথে ক্লাস করার অনুমতি দিলেন কিছুদিনের মধ্যে আমরা বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করলাম সে-তো আমাদের থেকে পিছিয়ে নেই-ই বরং খানিকটা এগিয়ে গেছে। সে কারনেই হয়তোবা তখন অনেকেই তাকে ইর্ষা করতে শুরু করল! এমনকি অনেকেই ধারনা করল সে আগে থেকেই রাশান ভাষার উপর কোর্স করেছে। সবার এই ধারনার যুক্তিযুক্ত কারন ছিল; কেননা সবাইকে ধর্ত্যব্যের মধ্যে না ধরলেও আমাদের মধ্যে অন্তত দু-চার জন ছাত্র তো অবশ্যই প্রতিভাবান ছিল, কিন্তু তাদের যে কোর্স করতে ছ’মাসের অধিক সময় লেগেছে সেই কোর্সটাই একমাসে কেউ শেষ করে ফেললে তখন সন্দিহান হওয়াই স্বাভাবিক! তন্ময়কে একবার আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম -সে দেশ থেকে রুশ ভাষাটা আগে শিখে এসেছে কিনা ? -উত্তরে সে কিছু বলেনি; শুধু লাজুক হেসেছিল । সেই হাসি কোন গোপন অর্থ বহন করে ছিল কিনা আমার জানা নেই, তবে তার হাসিটা মোটেই সুন্দর ছিল না- -মনে হচ্ছিল বেশ কৃত্রিম ও জটিল। অপ্রয়োজনে নয় নিজেদের প্রয়োজনেই প্রায়শই আমরা দল বেধে বাইরে যেতাম।

তখন সেখানে প্রচন্ড শীত -অযথা বাইরে ঘোরা-ঘুরি করার প্রশ্নই আসে না। হোস্টেল থেকে বের হয়েই অনেকটা দৌড়ে ট্যক্সিতে চেপে সরাসরি কোন মার্কেটে যেতাম কেনাকাটা করতে। তন্ময় সে সময়টা হোস্টেল রুমে ঘুমিয়ে কাটাত। মাঝে মাঝে যে সে সঙ্গ দিত না তা নয়- তবে সেটা ছিল হয় নিজের প্রয়োজনে নয়তো নেহায়েৎ অনিচ্ছাসত্বে। আমরা পরাশুনার ফাঁকে অবসর সময়টুকু কাটিয়ে দিতাম আড্ডা দিয়ে হৈ হুল্লোড় করে অথবা রান্না করে।

তন্ময় সেই সব ব্যাপারেই ছিল দারুন নিস্পৃহ! রান্না করাতো দুরের কথা রান্না ঘরের আশেপাশে সে যেত না। প্রথমদিকে আড্ডাতেও সে ছিল অনেকটা নিরব অমনযোগী শ্রোতা। সবাই যখন নিজেদের ফেলে আসা স্মৃতি,বন্ধু , প্রিয়জন,গ্রাম বা শহরের কথা বলতাম,তখন সে আমাদের কথা শুনত ঢুলু ঢুলু চোখে অনাগ্রহভরে। তার মুখ থেকে কখনই কেউ তার পুরনো স্মৃতি কথা বা তার কোন প্রিয়জনের কথা শোনেনি বলে আমার বিশ্বাস। এমনকি অনেক অনুরোধের পরেও সে কখনই তার মা বাবা ভাই বোন এমনকি নিজের জন্মস্থান সন্মন্ধেও কিছু বলেনি।

তবে মাঝে মাঝে দু-য়েকটা বুদ্ধিদীপ্ত কথা বলে সবাইকে চমকে দিত। শুধুমাত্র কার্ড খেলায় ছিল তার অসীম আগ্রহ। কার্ড খেলার কথা শুনলেই তার মুখ খুশীতে ঝলমল করে উঠত। এই খেলাটার প্রতি আমারও আগ্রহের কমতি ছিলনা। এই কার্ড খেলার সুত্র ধরে তার সাথে আমার ঘনিষ্ঠতা বা হৃদ্যতার সুত্রপাত।

খেলার সময় তার ধৈর্য্য মনযোগ ও তাৎক্ষনিক বুদ্ধিমত্বা আমাকে আকৃষ্ট করেছিল। কার্ড খেলার প্রতি তার আগ্রহ ভালবাসা কিংবা অনুরাগ ছিল চোখে পড়ার মত। তাকে খুব কমই আমি হারতে দেখেছি। আমার ধারনা অন্য সবাই যাতে হারতে হারতে খেলার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে না ফেলে সে জন্য সে মাঝে মধ্যে ইচ্ছে করেই হারত! আরেকটা জিনিসের প্রতিও তার তেমনি আকর্ষন ছিল প্রবল -যেটাকে আমি তেমনি অপছন্দ করতাম। মদ্যপান-যে আমি কখনও করিনি তা নয় তবে সেটা আমার কখনই পছন্দের তালিকার মধ্যে ছিল না ।

তবে খালি পেটে গেলাসের পর গেলাস খাওয়ার পরেও তন্ময় কে কখনই অস্বাভাবিক বা পাড় মাতাল হতে দেখিনি। মাতাল অবস্থায় কখনও তাকে অসগলগ্ন কথা বা অসহিষ্ণু আচরন করেনি। মদ খেয়ে মুক যখন বাঁচাল হয় উল্টো সে তখন আরো বেশী করে নিজেকে গুটিয়ে নিত। তন্ময়ের চালচলন কথাবার্তা সবই ছিল কেমন যেন একটু রহস্যপুর্ন! অনেকেরই তার সন্মন্ধে জানার ভীষন আগ্রহ ছিল,এমন রহস্যময় এক যুবকের ব্যাপারে জানার আগ্রহ থাকাটাই স্বাভাবিক!সবার আবোল-তাবোল প্রশ্নের উত্তরে সে শুধু হাসত ,তার প্রখর ব্যক্তিত্বের জন্যই হয়তোবা ওরা তাকে বেশী ঘাটাতে সাহস পেত না। তার শীতল চাহনী ও উদ্ধত আচরন এজন্য কিয়দাংশ দায়ী।

দেশ থেকে তার সঙ্গে নিয়ে আসা পোশাক আশাক ও অন্যান্য ব্যবহার্য সামগ্রীর অপর্যাপ্ততা দেখেও সবাই অবাক হয়েছিল সন্দেহ নেই। গাঢ় সবুজ রঙ্গের বড় সড় একটা মাত্র ব্যাগই সে এনেছিল। যা বাইরে থেকে দেখলেই মালুম হয় যে ব্যাগের অর্ধেকের বেশীই খালি। শীতের ওভার কোট ও জ্যাকেটটা বাদ দিলে বাকী পোশাকের পরিমান এত অল্প ছিল যে তা নিয়ে এক সপ্তাহের ভ্রমনেও কেউ যায় কিনা এ বিষয়ে যথেষ্ট তর্কের অবকাশ আছে। এমনও হতে পারে অর্থনৈতিক দুরাবস্থার কারনে তার সামর্থে কুলোয়নি অথবা পোশাক পরিচ্ছেদের ব্যাপারে সে উদাসীন।

অনেককেই আছে যথেষ্ট থাকা সত্বেও একটা পোষাক পরেই মাসের পর মাস কাটিয়ে দেয়। দ্বীতিয় যুক্তিটা মেনে নিলেও প্রথম মানতে আমার আমার যথেষ্ট আপত্তি আছে। কেননা সে বিদেশে এসেছে চাকুরি করতে নয় নিজের পয়সায় পড়তে- তাও সল্প মেয়াদী কোন কোর্স নয় দীর্ঘ ছ’বছরের জন্য। বছরে লক্ষাধিক টাকা ব্যায় করে কোন নিন্ম বিত্তের পক্ষে সম্ভব নয় দেশের বাইরে এসে পড়াশুনা করা। তাছাড়া তন্ময়ের চলন বলন ও প্রতিটি অভিব্যক্তিই বলে দেয় যে সে কখনও অভাবে মানুষ হয়নি।

তখন সন্দিহান হলেও পরে সন্দেহহীন হয়ে ছিলাম। কারো সন্মন্ধে কোন ক্ষোভ থাকলে বা কারো দুর্বলতা নিয়ে কোন রাখ ঢাক না করে সে সরাসরি বলত। তার চাছাছোলা মন্তব্যে অনেকেই কষ্ট পেত । কাউকেই সে খুব একটা পাত্তা দিত না। যে কারনে অনেকেই তাকে আরো বেশী অপছন্দ করতে শুরু করল।

অবশ্য তার স্পষ্ট বাক্ ও ব্যাক্তিত্বপুর্ন আচরনের জন্য সবাই তাকে সমীহ করত। প্রথমে তাকে আমার পছন্দ না হলেও- ধীরে ধীরে অন্যান্য সবাইকে ছাড়িয়ে তার সাথে আমার দারুন বন্ধুত্ব হয়ে গেল। প্রথম পর্ব সমাপ্ত


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।