আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শুন্যের গর্ভে- পর্ব ৬

মাঝে মাঝে মনে হয় জীবনটা অন্যরকম হবার কথা ছিল!

...এভাবে কেটে গেল প্রায় বছরখানেক। তন্ময় প্রায়ই মস্কো যেত। ওখানে কেন যেত? গিয়ে কি করত ? সেটা আমার ধারনা প্রায় কাউকেই বলত না। প্রায় প্রত্যেকেই দেখতাম তার এই ঘন ঘন মস্কো যাওয়ার অন্তর্নিহিত কারন জানতে উৎসাহী? সে প্রথম হোস্টেলে আসার মাস তিনেক বাদে আমাকে সাথে নিয়ে মস্কো গিয়েছিল। আমি যে শহরে থাকতাম সেটা মস্কো থেকে প্রায় সাড়ে চারশো কিলোমিটার দুরে।

যোগাযোগের দুটো মাধ্যম ছিল-ট্রেন ও প্লেন। বছরের প্রায় নয় মাস সারা দেশ বরফে মুড়ে থাকার কারনে দুরপাল্লার বাস যোগাযোগ প্রায় ছিল না বললেই চলে। পণ্য ও যাত্রী পরিবহনের মুল মাধ্যমই ছিল ট্রেন। ট্রেনের প্রথম শ্রেনীর ও বিমানের ভাড়া ছিল প্রায় সমান তবুও প্রায় সব রুশদের বিমান যাত্রায় ছিল দারুন অনীহা। তখন সামার ভ্যাকেশন চলছ।

ছোট শহর আর হোস্টেলের পরিবেশে কিছুটা যেন হাঁপিয়ে উঠেছিলাম। ও যখন মস্কো যাবার অনুরোধ করল তখন নিদ্বিধায় সাড়াদিয়ে ছিলাম। বরফে মোড়া মস্কোকে ভাল করে দেখতে পারিনি ইচ্ছে ছিল সামারে কয়েকটা দিন ইচ্ছেমত সেখানে ঘুরে বেড়াব সেইসাথে কিছু কেনাকাটাও করা যাবে। কিন্তু উপযুক্ত সঙ্গী কাউকে পাচ্ছিলাম না। সেজন্যই তন্ময়ের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়ার প্রশ্নই আসে না।

আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম প্লেনে যাব। রুশ নির্মিত সেই ছোট্র ইয়াক-৪২ বিমানটিতে উঠার পরে অনুধাবন করলাম কেন রুশরা বিমানের চেয়ে ট্রেনকে প্রেফার করে বেশী। ভিতরটা ছোট্র অপরিসর। সিটগুলো মোটেই আরামদায়ক নয়। সমস্ত বিমানটাতে একটামাত্র এয়ার হোস্টেজ যার কাজ মুলত বিমান উঠা ও নামার ঘোষনা প্রচার করা ।

কেননা এসকল ভ্রমনে কোন আপ্যায়নের ব্যাবস্থা নেই। তবে সুখের কথা এই যে ভ্রমন পথ খুবই সংক্ষিপ্ত । মস্কো অভ্যান্তরিন বিমানবন্দরে নেমেই ও তড়িঘড়ি করে কয়েক জায়গায় ফোন করল। তারপর ট্যাক্সিতে করে আমাকে সাথে নিয়ে চলল শহর অভিমুখে। শহরের চারপাশে সবুজের সমারোহ দেখে তো আমি বিমোহিত।

অবাক বিস্ময়ে আমি তাকিয়ে ছিলাম সেই সৌন্দর্যের দিকে। ঘন্টা খানেক পরে দশতলা উচু এক এপার্টমেন্টের সামনে সে গাড়ি থামাতে বলল। রাশিয়ার বাইরে থেকে প্রায় সব বাড়িই সাধারন লাগে। কিন্তু ভিতরে ঢুকলে অনেক সময় চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়। যেটা আমার ক্ষেত্রে সেই প্রথম হল।

ভিতরে ঢুকেই বোঝা গেল এখানে অভিজাতদের বাস। কারন আমার চির পরিচিত লক্কর ঝক্কর লিফট আর নোংরা সিড়ি দুটোই অনুপস্থিত। তাছাড়া সিড়ির মাথায় কেতাদুরস্ত পোষাক পরে দারোয়ানও একজন দাড়িয়ে। তার কাছে একটা মিনি ইন্টারভিউ দিয়ে ভিতরে ঢোকার অনুমতি পেলাম। আমাকে সাথে নিয়ে সাত তলায় অবস্থিত যে ফ্লাটটাতে প্রবেশ করল সেটা দেখেই বোঝা যাচ্ছিল এর মালিক যথেস্ট অর্থবান।

আমরা ওয়েটিং রুমে অপেক্ষা করার এক পর্যায়ে পর্দা ঠেলে সাধারন চেহারার খাটোমত এক বাঙ্গালী ভদ্রলোক প্রবেশ করলেন। তন্ময় তাকে দেখামাত্র উঠে দাড়িয়ে সন্মান জানাল। আমিও তার দেখাদেখি উঠে দাড়ালাম। সে আমার সাথে তার পরিচয় করিয়ে দিল। ভদ্রলোক তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে আমার দিকে একবার শুধু তাকালেন।

সন্দেহ নেই যে কারনে আমি কিঞ্চিৎ অপমানিত বোধ করলাম। তারা দুজনে দীর্ঘক্ষন নিজেদের মধ্যে কখনও উচ্চস্বরে কখনও বা নিন্ম স্বরে আলাপ করছিল। তাদের আলোচনার বিষয়বস্তু নিয়ে কেন যেন আমার কোন আগ্রহ সৃস্টি হলনা। তাদের মধ্যেকার আলোচনার প্রায় সব সময়টুকু আমি রুমের সৌন্দর্য দেখায় মনোনিবেশ করেছিলাম। বাংলাদেশের সব্বোচ্চ পর্যায়ের দুজন রাজনৈতিক ব্যাক্তিত্বের সাথে তার ঘনিষ্ঠ ছবি দেখে আমি নিশ্চিত হলাম ইনি শুধু অর্থবানই নন ক্ষমতাধরও।

আলোচনা শেষে তন্ময় আমাকে উদ্দেশ্য করে বলল,কখনও যদি কঠিন কোন সমস্যায় পর তাহলে উঁনার সাথে যোগাযোগ কোর। ভদ্রলোক একটা অহংকার পূর্ন হাসি দিয়ে তার ভিজিটিং কার্ড আমার দিকে এগিয়ে দিলেন। ওখান থেকে রের হয়ে আমার অনিচ্ছা সত্বেও তন্ময় আরো কয়েক জনের সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দিল সেই সাথে নিজেও তার আলাপ সেরে নিল। আমাকে যাদের সাথে পরিচয় করাল তারা প্রত্যেকেই সুপ্রতিষ্ঠিত ব্যাবসায়ী। আমার ধারনা ছিল না যে মস্কোতে এতগুলো বাঙ্গালী ধনী ব্যাবসায়ী আছে ।

ইনারা নিশ্চই আমার দেখা বাংলাদেশী ব্যাবসায়ীদের একাংশ। পরে জেনেছিলাম এরা সবাই রাজনৈতিক মদদপুস্ট। এদের ধনী হওয়ার পিছনের ইতিহাস খুব একটা কলঙ্কমুক্ত নয়। এদের থেকেও অনেক বড় বড় ব্যাবসায়ী আছে যারা সম্পুর্ন নিজেদের প্রচেস্টা আর ভাগ্যের সহায়তায় অনেক দুর গিয়েছে। কিন্তু এদের মত কারো মদদ বা অনুগ্রহে নয়।

সেবার মস্কোতে মাত্র একদিন ছিলাম। ওখান থেকে ফেরার পথে বা ফেরার পরে কখনই তন্ময়কে আমি জিজ্ঞস করিনি ওঁদের সাথে পরিচয়ের সুত্র। হোস্টেলের সবাই তন্ময়ের রহস্যজনক ব্যাবহারের এমনিতেই কিছুটা সন্দেহ করত। তদুপরি তারা যদি জানত তারসাথে মস্কোর বড় বড় চাঁই এর সাথে তার ঘনিষ্ঠতা তাহলে সেই সন্দেহটা নিঃসন্দেহে ডালপালা ছড়িয়ে আরো বিস্তার লাভ করত। কোন রকম অঘটন ছাড়াই প্রথম বর্ষ ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হল।

যথাসময়ে রেজাল্টও বের হল। সবাইকে বিন্দুমাত্র অবাক না করে তন্ময়ই সব থেকে ভাল রেজাল্ট করল। আর সবার ধারনা কে সামান্যতম অমর্যাদা না করে আমার সেই প্রাক্তন রুমমেট সব থেকে খারাপ! এত ভাল ফলাফলের পর অন্যান্য ছাত্ররা যখন তন্ময়কে অভিন্দন জানাচ্ছিল তখন লক্ষ্য করলাম সে যেন লজ্জায় নুয়ে পড়ছে। ভাবটা এমন যে এত ভাল রেজাল্ট করে সে বড় ধরনের কোন অপরাধ করে ফেলেছে । রেজাল্টের পরদিন আমরা সবাই মিলে বড় ধরনের উৎসবের আয়োজন করলাম।

আমাদের পূর্বের সব পার্টিতেই কোন না কোন অঘটন ঘটত কিন্তু এবার বিশেষ কোন বিপর্যয় ছাড়া ভালয় ভালয় পার্টি শেষ হল। গভীর রাতে ক্লান্ত বিধ্বস্ত সবাই প্রসন্ন চিত্তে ঘুমোতে গেলাম। কেউ ঘুনাক্ষরেও বুঝতে পারল না যে এটাই আমাদের শেষ উৎসব! পরদিন ইনস্টিটিউটে আমাদের কোন ক্লাস না থাকায় সবাই একটু দেরী করে ঘুম থেকে উঠল, কেউবা অনেক বেলা অব্দি ঘুমাল। দুপুরের দিকে আমাদের ডিপার্টমেন্ট ডিন টেলিফোনে জানালেন যে তারা তিনটার দিকে জরুরী একটা মিটিং ডেকেছেন সেখানে আমরা সবাই যেন অবশ্যই উপস্থিত থাকি । হাতে বেশী সময় ছিলনা।

সারাদিন অবসরে কাটাবে বলে কেউবা তখনো বিছানায় শুয়ে আড়মোড় ভাঙ্গছে -কেউবা হেড ফোন কানে লাগিয়ে চোখ বুজে মনের সুখে গান শুনছে! কেউ স্বদেশে প্রিয়জনকে চিঠি লেখায় ব্যাস্ত। অতিধুমপায়ীরা বাসি মুখেই একের পর এক সিগারেট টানছে সেই সঙ্গে খোশ গল্প আর খুচরো হাসি ঠাট্রায় ব্যাস্ত , আর সাস্থ্য সচেতন দুয়েকজন করিডোরের শেষ মাথায় অবস্থিত শুধু প্রবাসী ছাত্রদের জন্য নির্মিত আধুনিক জিমনেসিয়ামে ব্যায়াম করছে। মিটিংয়ের কথা শোনা মাত্র সবকিছু তালগোল পাকিয়ে ফেলল। শুরু হয়ে গেল চিৎকার চেচামেচি হুল্লোড়! প্রথমে কেউ বিশ্বাস করতে চাইল না ভাবল হয়ত ইয়ার্র্কী মারছে। অতি উৎসাহী (অতি সন্দিহান) একজন )ছুটে গেল টেলিফোন করে খবরের সত্যতা যাচাই করতে ।

মিটিংয়ের ব্যাপারটা নিশ্চিত হবার পরে অনিচ্ছাকৃতভাবে বিমর্ষ বদনে ক্ষুধার্ত পেটে সবাই চললাম ইনস্টিটিউট অভিমুখে অল্প ক’মিনিটের মিটিং। তবে অতীব গুরুত্বপূর্ন সে ব্যাপারে সন্দেহ নেই । মিটিংয়ের সারমর্ম দুয়েকজন বুঝতে না পেরে পাশের জনকে খোচাচ্ছিল বিস্তারিত ব্যাখ্যা করার জন্য। আমাদের গুরুত্বপূর্ন ক্লাস বা মিটিংয়ের সারমর্ম সবাই যাতে বুঝতে পারে সেজন্য পর্যায়ক্রমে দু'তিনজন ছাত্রের দায়িত্ব দেয়া হত সবার সামনে দাড়িয়ে সেটার বাংলায় তর্জমা করার। এবার সে দায়িত্ব পড়ল তন্ময়ের উপর ।

সে প্রথমে বলতে অপারগতা প্রকাশ করল উল্টো উপস্থিত শিক্ষক বিশিষ্ট ব্যাক্তিবর্গের সাথে প্রচন্ড তর্ক জুড়ে দিল। শিক্ষকদের সাথে আমাদের সম্পর্ক যথেস্ট বন্ধুত্বপূর্ন ছিল কিন্তু তন্ময় আজ যেভাবে কথা বলছে সে ভঙ্গীতে বা সে ভাষায় কেউ কখনো কথা বলতে সাহস পায়নি। সমগ্র ক্লাস বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে দেখছিল রুদ্র তন্ময়কে। তার এই রুপের সাথে অপরিচিত সবাই। তবে মনে মনে প্রত্যেকেই দারুন খূশী হচ্ছিল।

কতৃপক্ষ হুট করে যে অনৈতিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেটা মেনে নেয়া সম্ভব নয়। এখানে আমাদের অস্তিত্বের প্রশ্ন জড়িত। ব্যাপারটা একটু ব্যাখ্যা করি; এখানে কেউই আমরা বৃত্তি ভোগী না কেউ। সবাই নিজেদের গাঁটের পয়সা খরচ করে পড়ালেখা করি। আমাদের টিউশন ফি অন্যান্য দেশের তুলনায় কম হলেও আমরা এখানে অনেক সুযাগ থেকে বঞ্চিত! যেমন এখানে পার্ট টাইম জবের কোন ব্যাবস্থা নেই।

এদের মুদ্রার মুল্য মানের বিচারে আমরা ডলারে অনেক বেশী প্রদান করি । তাছাড়া এদের সাথে চুক্তিই ছিল শেষ বর্ষ পর্যন্ত আমাদের একই পরিমান টিউশন ফি দিতে হবে। কিন্তু কোন এক অজানা কারনে এরা সব চুক্তি ও নৈতিকতা ভঙ্গ করে টিউশন ফি সরাসরি তিনগুন বাড়িয়ে দিল। ফুট নোটঃ রুশ জাতিরা নিঃসন্দেহে বুদ্ধিমান। আমার ধারনা, আমরা কিছুদিন আগে যেই চরম আন্দোলন করে দাবি আদায় করে তৃপ্তির ঢেকুড় তুলেছিলাম সেইটেই ছিল আমাদের শাপ।

এই ঘটনার যাতে পূনরাবৃত্তি না ঘটে শঙ্কার জন্যই হয়তোবা সরাসরি ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের না করে একটু কৌশলে বের করতে চাইছিল। ৬ষ্ঠ পর্ব সমাপ্ত Click This Link

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।