আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শুন্যের গর্ভে- দ্বীতিয় পর্ব

মাঝে মাঝে মনে হয় জীবনটা অন্যরকম হবার কথা ছিল!

প্রথম দিন থেকেই লক্ষ্য করেছি হোস্টেলের অন্য সবার থেকে কেন জানি আমার সাথে তার ব্যাবহার একটু অন্য রকম। বয়সে তার থেকে আমি একটু ছোট হলেও সে আমার মতামতের যথেষ্ট মুল্যায়ন করত। মাঝে মাঝে আমার রুমে এসে গল্প করত ( গল্প করত না বলে বসে থাকত বলাই শ্রেয়)। কার্ড খেলায় আমি যখন বেশী হেরে যেতাম তখন সে ইচ্ছে করে তার কার্ড খারাপ বলে ছুড়ে ফেলে দিয়ে আমাকে বোর্ড পাইয়ে দিত বা সুযোগ দিত। আমি প্রথমে বুঝতে পারিনি একদিন কৌতুহল বশত তার ছুড়ে ফেলা কার্ড উল্টিয়ে দেখলাম যথেষ্ট ভাল কার্ড থাকা সত্বেও সে কল দেয়নি।

পরে তাকে এর কারন জিজ্ঞেস করাতে লাজুকভাবে হেসে বলেছিল ’এই..এমনিই’ । যদিও আমার প্রতি তার যথেষ্ট আন্তরিকতা ছিল ,তবে যেটাকে সে সহযোগীতা বলে ভেবেছিল সেটাই ছিল আমার মনকষ্টের কারন- কেননা সেটা ছিল আমার খেলোয়াড়ী ব্যক্তিত্বের প্রতি আঘাত - আমি অপমানিত বোধ করেছিলাম। তখনো পর্যন্ত নিজেকে আমি বেশ উচুঁমানের খেলোয়ার মনে করতাম! দিনের বেলায় আমরা সবাই ক্যান্টিনে বা রেস্টুরেন্টে খেতাম। প্রতিদিন সন্ধ্যায় অথবা ছুটির দিনে আমরা সবাই মিলে একসাথে রান্না করতাম । সবাইকে তার যোগ্যতা অনুসারে আলাদা আলাদা কাজ দেয়া হত।

প্রত্যেকেই অতি উৎসাহের সাথে তাদের দায়িত্ব পালন করত। আনাড়ী হাতে মসলা বিহীন সে রান্না কতটুকু স্বুসাদু জানিনা তবে তা উপভোগ করতাম। একমাত্র তন্ময় সর্বদা সচেষ্ট থাকত কাজে ফাঁকি দেয়ার। রান্নার ঐ সময়টুকু সে হয় ঘুমিয়ে কাটাত কিংবা অসুখের ভান করত নয়তো জরুরী কাজের ছুতো দিয়ে বাইরে বেরিয়ে যেত। স্বভাবতই; সেজন্য সবাই তার প্রতি নাখোশ ছিল! মাঝে মাঝে সবার চাপের মুখেই সে কাজ করতে বাধ্য হত।

কিন্তু কাজের প্রতি তার অমনোযোগ আর আনাড়ীপনা দেখে তারাই আবার তাকে ক্ষান্ত করত । ক্যান্টিনের রাশান কুকের হাতে তৈরি খাবার এতই জঘন্য ছিল যে, সারাদিনের বিস্বাদ হয়ে যাওয়া জিহ্বা টাকে স্বস্তি দেয়ার জন্য সন্ধ্যার পরে উঠেপড়ে লাগতাম। প্রতি সন্ধ্যায় বাজার থেকে দু-চারখানা মুরগী কিনে একসাথে ক্যাপসিকাম, পিয়াজ , রশুন আর বাটার দিয়ে ভাজা ভাজা করে পাউরুটি খেতে তখন দারুন স্বুসাদু লাগত। আমরা যখন সবাই মিলে এককন্ঠে ওদেশী খাবারের চৌদ্দগুস্টি উদ্ধার করতাম, তন্ময় তখন একাগ্রনিষ্ঠ শ্রোতার মত চুপচাপ শুনে যেত কোন মন্তব্য করত না! মাঝে মধ্যে তাকে কমেন্টস করার জন্য জোড়াজুড়ি করলে -বাধ্য হয়েই হয়তোবা বিব্রত মুখে লাজুক হেসে বলত ‘ভালইতো- আমারতো সমস্যা হয়না’। আমাদের সহপাঠী তন্ময়ের সবচেয়ে অপছন্দের মানুষ 'হুজুর'(একজন লোককেই সে ভীষন অপছন্দ করত- এটা সে খোলাখুলি বলত) আড়ালে বাগধারার উদ্ধৃতি দিয়ে বলত ‘ও একটা ছাগল।

’ তবে এ কথাটা সামনা সামনি বলার দুঃসাহস তার কোন দিনই হয়নি । যদিও দেশী খাবারের প্রতি তার লোভ ছিল অপরিসীম তবুও সে যে কোন বিস্বাদ খাবার খেতে পারত । আমার সাথে একটু সম্পর্ক ভালো হওয়ার পর তাকে প্রায়শই দেখতাম আমার অনুপস্থিতিতে আমার বিছানায় এসে শুয়ে থাকতে। প্রথমে ভালো না লাগলেও একসময় তা মেনে নিলাম। মনে হয় তার নিজের বিছানা থেকে আমার বিছানাই তার বেশী প্রিয় ছিল।

বন্ধুত্ব যখন আরো গাঢ় হল তখন সে আমার পোশাক আশাক ব্যাবহার শুরু করল , যখন ইচ্ছে আমার শার্ট, জ্যাকেট, টুপি, দস্তানা এমনকি ট্রাওজার পর্যন্ত যেটা খুশি সেটা নিজের ভেবে ব্যবহার করত। প্রথম প্রথম আমাকে জিজ্ঞেস করত; কিন্তু কয়েকদিন বাদেই আর অনুমতি নেয়ার প্রয়োজন অনুভব করল না। আমার রুমমেটদের কাছে ব্যাপারটা ভালো লাগত না। তারা আমার শুভাকাঙ্খী সেজে প্রায়শই নিষেধ করত তাকে এতটা প্রশ্রয় দেয়ার জন্য। প্রতিউত্তরে আমি হেসেই উড়িয়ে দিতাম।

তন্ময়কে নিষেধ তো করতামই না বরং আরো বেশী বেশী অনুরোধ করতাম তার যখন যেটা প্রয়োজন সেটা যেন দ্বীধা না করে আমাকে সরাসরি বলে। তারা হয়তো কিছুটা ইর্শান্বিত ছিল তন্ময় ও আমার গভীর বন্ধুত্বের জন্য। .. ..গত ছয় মাসে একটাও চিঠি আসেনি তার নামে। সেও কাউকে লেখেনি। এমনিতেই অথবা বিভিন্ন পার্বনে সবাই যখন তাদের প্রিয়জনের চিঠি নিয়ে উৎফুল্ল থাকত।

তন্ময়কে দেখতাম এককোনে বিমর্ষ বদনে বসে আছে। অনেকেই আফসোস করত আহারে বেচারার মনে হয়ত চিঠি লেখার মত তেমন আপনজন কেউ নাই। আমার কোন চিঠি আসলে বিশেষ করে সেটা যদি আমার প্রেমিকার লেখা হত –তাকে বলতেই সেও যেন ঠিক আমারই মত খুশী হত ,যদিও নিজের মনের ভাব সে ঠিকভাবে প্রকাশ করতে পারত না - কিন্তু তার আন্তরিক উপলদ্ধি চাপা থাকত না । রাস্তার পাশের কোন ফোন বুথ থেকে তখন দেশে টেলিফোন করার উপায় ছিল না। এক্সচেঞ্জে গিয়ে অপারেটরের কাছ কাঙ্খিত নাম্বার ধরিয়ে দিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করতে হোত (ভাগ্য সু-প্রসন্ন হলে , কখনওবা একটা ফোন লাইন পেতে সপ্তাহ পেরিয়ে যেত)।

মাঝে মধ্যে দলবেধে আমরা যেতাম ফোন করতে। সবাই একসাথে নাম্বার লিখে দিয়ে অপেক্ষার সাথে চলত গল্প গুজব। যে প্রথম লাইন পেত তাকে নিয়ে শুরু হত ভিন্ন ধরনের মজা সেই সাথে বর্ষন চলত কটু বাক্যের - মুলত এর সবই হোত ইর্ষা থেকে। যেন সে আগে লাইন পেয়ে জঘন্য কোন অপরাধ করে ফেলেছে। কথা বলতে নির্দিস্ট ফোন বুথে ঢুকলেই সবাই বিভিন্ন ফাঁক গলে আড়ি পেতে শুনতে চাইতাম তার কথপোকথন।

বাপ মা হলে তবু রক্ষে - বান্ধবী হলে খবর ছিল! দু-চারটা শব্দ কোন মতে কানে এলেই হয়েছে -সপ্তা খানেক তার ঘুম হারাম! দেশে প্রিয়জনের সাথে কথা শেষে সবাই যখন ছল ছল চোখে বেরিয়ে আসত,বিচ্ছেদের বেদনা না-বলা কথা আর ভালবাসার আবেশ কিছুক্ষনের জন্য বিহ্বল করে দিত সবাইকে - চেহারায় তখন আনন্দ আর বেদনার পার্থক্য বোঝা যেত না। উচ্ছল পরিবেশটা কিছুক্ষনের জন্য ভয়ানক থমকে যেত। ফোন রিং বেজে উঠলেই সবাই একসাথে সচকিত হয়ে তাকাত অপারেটরের দিকে– যার ডাক আসত সে অপরাধী মুখে অন্তরের আনন্দকে চেপে রেখে ফোন বুথের দিকে হেটে যেত –তখুনি ফের শুরু হোত সবার সেই উৎপাত! তন্ময়ও মাঝে মধ্যে যেত আমাদের সঙ্গে তবে কখনই ফোন করত না। সে ফোন করতে যেত একাকী নিঃশব্দে কাউকে না জানিয়ে... দ্বতিয় পর্ব শেষ আগের পর্বের জন্য; Click This Link

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।