আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শুন্যের গর্ভে- তৃতিয় পর্ব

মাঝে মাঝে মনে হয় জীবনটা অন্যরকম হবার কথা ছিল!

আমি অবসরে দুয়েকবার তার নিজের সন্মন্ধে জিজ্ঞেস করেছিলাম - প্রতিউত্তরে সে কাষ্ঠ হেসে ফ্যাস ফ্যাসে কন্ঠে বলত,'ধুর মিয়া বাদ দ্যান - কি হবে ওসব জেনে'। ব্যাস এটুকুই - সে কিছু বলতে চায়না দেখে আমিও বেশী চাপাচাপি করতাম না। তবুও দিনে দিনে বন্ধুত্ব আরো গভীর হলে -একদিন কোন এক দুর্বল মুহুর্তে সে বিচলিত চিত্তে ব্যাক্ত করল তার মনের কথা; মাদরীপুরের এক সম্ন্ভ্রান্ত বংশে তার জন্ম। বাবা ছিলেন এলাকার নামী দামী ব্যক্তি। সে ছিল সবার বড় এবং তার একমাত্র ছেলে সন্তান ।

জন্মের পরে সে কখনও অস্বচ্ছলতা দেখেনি। বাবা মা ও আত্মীয়দের অতিরিক্ত স্নেহ -আদর তাকে কখনো বেপথে ঠেলে দেয়নি। ছোট থেকেই ছাত্র হিসেবে এলাকায় তার দারুন সুনাম ছিল। ক্লাসে কখনই সে প্রথম বৈ দ্বীতিয় হয়নি। ম্যট্র্যিক ও ইন্টার মিডিয়েটের রেজাল্ট ছিল যথেষ্ঠ কৃতিত্বপূর্ণ।

দোষের মধ্যে - ছিল একরোখা জেদী ও গোঁয়াড়। যেটা বলবে সেটা করবেই। তাছাড়া বরাবরই সে কথা খুব কম বলত । বাবা চেয়েছিলেন তার ছেলে আর্মি অফিসার হবে ,তাঁর ধারনা ছিল সেই পেশায় ছেলে সহজেই উন্নতি করবে। আর মা চেয়েছিলেন, তাকে আরো পড়ালেখা করাতে- তবে তা মোটেই জেনারেল সাবজেক্টে নয় সে ডাক্তার বা প্রকৌশলী হয়ে সক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত হবে ।

কিন্তু সে ডাক্তার প্রকৌশলী বা আর্মি অফিসার কিছুই হতে চাইল না। তার ইচ্ছে ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার। বাবা মা প্রথমে আপত্তি করলেও পরে তার কথাই মেনে নিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে কোন সমস্যা হয়নি। অনার্সে সাবজেক্ট ছিল রসায়ন।

আশির দশকের শেষের দিককার কথা; ঢাকা ভার্সিটির পরিস্থিতি তখন খুবই খারা! ছাত্ররা পড়ালেখার থেকে রাজনীতি নিয়েই যেন বেশী ব্যাস্ত! হোস্টেল গুলো ছিল সন্ত্রাসীদের আখড়া। খুন যখম ছিল নিত্যদিনের ঘটনা। উত্তপ্ত সেই পরিস্থিতি সামাল দিতে না পেরে বিশ্ববিদ্যালয় কতৃপক্ষ প্রায়শই অনির্দিষ্ট কালের জণ্য ছুটি ঘোষনা করতেন! সেশন জটের ধাক্কায় ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়া সদ্য যুবক ছেলেদের তখন অনার্স কমপ্লিট করতেই চুল পাকার উপক্রম হচ্ছিল। তন্ময় প্রথম প্রথম এখানে এসে যেন অথৈ সাগরে পড়ল! প্রথমত রাজনীতির আগ্রাসনে বিধ্বস্ত অনিশ্চয়াতাপূর্ন এ ছাত্র জীবন, আর দ্বীতিয়ত -অনেক কষ্টে যাওবা হোস্টেলে মাথা গোজার একটা ঠাই মিলল, কিন্তু প্রথম দিনেই হোস্টেলের সার্বিক পরিস্থিতি ও পরিবেশ দেখে সে আতকে উঠল! এমনিতেই মফস্বলের ছেলেরা শহরের এই পরিবেশে বা বিশ্ববিদ্যালয়ের হোস্টেলে আসলে প্রথমে ঠিক মানিয়ে নিতে পারে না। অবসরে মন ছুটে যায় দেশের পানে।

বেশ কিছুদিন তারা নিজেদের কে কিছূটা গুটিয়ে রাখে। মা বাবা আত্মীস্বজন অথবা প্রিয়জনদের কথা মনে পড়ে অনেকেরই চোখ ভিজে উঠে। মায়ের হাতের খাবারকে যারা কখনও মুল্যায়ন করেনি অনেকে অতিরিক্ত ভালবাসা প্রশ্রয় বা জেদে সেই খাবার অনেক সময় ছুড়ে ফেলেও দিয়েছে। তারাই ক্যন্টিনের নোংরা পরিবেশে স্বাদহীন খাবারের প্লেট সামনে নিয়ে তুলনা করে মায়ের হাতের খাবারকে বিশ্বের সবচেয়ে মহার্ঘ্য ও স্বুসাদু হিসেবে। সে বরাবরই মা বাবা আত্মীয়দের অপরিমিত আদর যত্নে লালিত - কোন কিছু চাইতেই হাতের কাছে এসে হাজির হয়েছে।

কিন্ত হোস্টেলের এই পরিবেশে (?)এসে সে চরম বিমর্ষ হয়ে পড়ল। ক্যান্টিনের সেই বিশ্রী জঘন্য (তার দৃষ্টিতে)খাবার কোন মতেই তার গলা দিয়ে নামতে চাইত না। যে জন্য সে প্রায়ই রুমমেটদের লুকিয়ে বাইরে থেকে খেয়ে আসত । অন্য সবার মত একসময় সে ঠিকই হোস্টেলের সেই পরিবেশ ও খাবারে অভ্যাস্ত হয়ে উঠল । সেই সঙ্গে ধীরে ধীরে সে মানিয়ে নিল বিশ্ববিদ্যলয়ের দ্বৈত পরিবেশে।

প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়;একদিকে রাজনীতি সন্ত্রাস ও আতংক অন্যদিকে শিক্ষা সৌহার্দ্য সাংস্কৃতি ও উন্মুক্ত উচ্ছল বন্ধুত্বের অপূর্ব সমন্বয়! তার শুভাকাঙ্খীরা পই পই করে নিষেধ করেছিল সে যেন রাজনীতির ছায়াও না মাড়ায় -ওই পোকা মাথায় ঢুকলে পড়াশুনা শিকেয় উঠবে। আর মা-তো মাথা ছুইয়ে দিব্যি দিয়েছে, সেও তাকে কথা দিয়েছিল যে কখনও ছাত্র রাজনীতিতে নিজেকে জড়াবে না কিন্তু নোংরা ছাত্র রাজনীতির পঙ্কিল আবর্তে একসময় নিজের অজান্তেই জড়িয়ে পড়ল। তবে নিজেকে ডুবতে দিল না। তার রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়াটা মোটেই ইচ্ছাকৃত ছিল না। এফ রহমান হলের ছাত্রাবাস যেখানে তন্ময় থাকত সেখানকার কতৃত্ব ছিল বিশেষ একটা রাজিনৈতিক দলের ছাত্রদের।

সেখানে টিকতে হলে সাধারন ছাত্রদের রাজনীতি করাটা ছিল অনেকটা বাধ্যতামুলক। প্রথমদিকে অনিচ্ছা সত্বেও সে বিভিন্ন মিছিল মিটিং এ অংশ গ্রহন করত । নিজের গা বাঁচানোর তাগিদেই সে সেই রাজনৈতিক দলের সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত করেছিল। নিজেকে ধ্বংসের(তন্ময়ের কথায় ) ষোল কলা পূর্ন করতে ঠিক সেই মুহুর্তে তার জীবনে এল প্রেম -যদিও অতি ধীরে মৃদু পদক্ষেপে... মেয়েটা ছিল তার ক্লাসেরই। দারুন সুন্দরী ছিল না কিন্তু চেহারায় ছিল একধরনের আলগা লাবন্য সেই সঙ্গে নিজের পোষাক ও সাজগোজ সন্মন্ধে দারুন উদাসীনতা তার মধ্যে এনে দিয়েছিল অন্যরকম সৌন্দর্য।

তৎসত্বেও সে ছিল আকর্ষনীয়া তন্ময়ের দৃষ্টিতে সে ছিল ’ওয়াইল্ড বিউটি’ যার বাংলায় তরজমা করলে দাড়ায় ’বন্য সুন্দরী'। তন্ময় ছিল খূব লাজুক ও মুখচোরা স্বভাবের। ক্লাশের ছেলে বন্ধুদের সাথে খানিকটা সাবলীল ভাবে মিশতে পারলেও মেয়ে ক্লাসমেটদের সে এড়িয়ে চলত। যেকোন মেয়ের সাথে সে কথা বলতে গেলেই ঘেমে নেয়ে একাকার হত,এমনিতেই একটু ফ্যাসফ্যাসে কন্ঠস্বর তার তদুপরি অনেক কষ্টে কন্ঠনালী দিয়ে শব্দ বের হলেও সেটা নিজের কানেই বেমানান ঠেকত, মনে হত এ কন্ঠস্বর তার অচেনা। এরকম বিব্রত পরিস্থিতির থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্যই তার এই এড়িয়ে চলা।

ভাব দেখাত সে একটু মুডি -সেজন্যই সর্বক্ষন মুখের উপর সর্বক্ষন একটা কাঠিন্যতার পর্দা ঝুলিয়ে রাখত। সেই মেয়েটার সাথে তার পরিচয় অভাবিত ভাবে। সেটা ঘটেছিল ছোট্র একটা দুর্ঘটনার কারনে। শুধু এইটুকুই বলেছিল। অনেক চাপাচাপির পরেও সে আমাকে জানায়নি,যে আসলে কি ঘটেছিল ।

যাহোক, কে না জানে প্রতিটি মানুষের কোন কোন গোপন কথা থাকে যা একান্ত তার নিজের। অন্য যে কারো প্রবেশ অধিকার যেখানে নিষিদ্ধ। সেদিনের পরে কখনও এব্যাপারে আমি আর কিছু জানতে চাইনি বা জানার আর সুযোগ হয়নি । তাদের সস্পর্ক প্রথমে নেহায়েৎ কুশল জিঞ্জাসার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল কিন্তু ধীরে ..অতি ধীরেই কিভাবে একে অপরের অত কাছা কাছি এসে পড়েছিল সেটা আর সে মনে করতে পারে না .. হয়তোবা মনে করতে চায়না। বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সে এখানেই থেমে গিয়েছিল।

তার সেই দীর্ঘশ্বাস বলে দেয় এর সাথে জড়িয়ে আছে এক দীর্ঘ বেদনার ইতিহাস। হয়তো বা সেটাই ছিল টার্নিং পয়েন্ট। ভালোবাসার সেই ঝড় তাকে করে দিয়েছিল ক্ষত বিক্ষত একেবারে এলোমেলো। বাকী জীবনে সে ক্ষত শুকোয়নি বা তার আগোছালো জীবনটাকে আর গুছাতে পারেনি। একটুক্ষন চুপ থেকে সে বলতে শুরু করল তার প্রেম পরবর্তী ঘটনাগুলোর কথা।

কিন্ত চেষ্টা করা সত্বেও নিজেকে সহজ ও স্বাভাবিক রাখতে পারছিল না। মাঝে মধ্যেই উত্তেজিত হয়ে পড়ছিল। পড়ালেখা শেষ হতে তখনও অনেক দেরী তবুও সে ভালবাসার পরিপুর্নতার জন্য তখন থেকেই নিজেকে প্রস্তুত করছিল। কোন এক অশুভ ক্ষনে অনেকটা বাধ্য হয়েই তার দলের এক সিনিয়র নেতার সাথে তাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। তাকে নিয়ে বাইরে ঘুরতে গিয়ে হঠাৎ মুখোমুখি হয়ে যাওয়ায় ঘটেছিল সেই বিপত্তি! বাকপটু সেই নেতার সেদিনের চোখের চাহনি তার ভাল লাগেনি ।

সে খুব অবাক হয়েছিল সেই সঙ্গে কিছুটা মর্মাহত ঠিক দুদিন পরেই যখন দেখল ক্যাম্পাসে সেই নেতার সাথে তার প্রেমিকা দারুন প্রানবন্ত আলাপে মগ্ন। খুব রাগ লাগছিল ...কিন্তু অল্পক্ষনেই নিজেকে সংযত করল যখন ভাবল এই সামান্য ব্যাপারে এমন উত্তেজিত হওয়া তার ক্ষুদ্র মানসিকতারই প্রতিফলন বা পরিচায়ক। ওরা পরিচয়ের সুত্র ধরে একে অপরের সাথে কিছুক্ষন আড্ডা দিতেই পারে। কিন্ত তার ফের খটকা লাগল তখনই যখন বুঝল তাকে দেখামাত্রই তার সেই প্রেমিকা কিছুটা সংকুচিত হয়ে গেল নেতাটিও তাড়াহুড়ো করে বিদায় নিল। কারো কারো মনের ভাষা বুঝতে হলে নাকি শরীরের ভাষা আগে বুঝতে হয়।

...তৃতিয় পর্ব শেষ প্রথম পর্বের জন্য; Click This Link দ্বীতিয় পর্বের জন্য; Click This Link

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।