আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শুন্যের গর্ভে- পর্ব পাঁচ

মাঝে মাঝে মনে হয় জীবনটা অন্যরকম হবার কথা ছিল!

দ্বীধান্বিত পায়ে এগিয়ে গেলাম তার রুমের দিকে । রুমে ঢুকেই আবার চমকে উঠার পালা একি সবাই এখানে ? যেন মৃত মানুষের আত্মার শান্তির জন্য মৌনতা অবলম্বন করছে ! সবাই মাথা নিচু করে নিশ্চুপ বসে আসে । আমার ধারনা হোল ইনস্টিটিউট কতৃপক্ষ নিশ্চই আমাদের দাবি প্রত্যাখান করেছে সে কারনেই হয়ত ..... । তন্ময় হঠাৎ মুখ তুলে আমাকে ডাকল তার সামনে বসার জন্য বলল। তার কন্ঠস্বর শুনে আমি হতভম্ব! এ রকম কন্ঠে সে আমার সাথে কখনও কথা বলেনি।

তার চেহারার দিকে তাকেয়ে আমি একটু ঘাবড়ে গেলাম। চোখ দুটো টকটকে লাল সেখানে আবার পানি টলমল করছে। কোকড়ানো চুলগুলো আরো বেশী উস্কখুস্কো। ভাবলাম, বেচারার প্লান হয়তো সফল হয়নি তাই সে এভাবে ভেঙ্গে পড়েছে... সামনা সামনি দুটো খাট তার একটায় পা নামিয়ে সে বসে আছে আমি ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে তার সামনের খাটটায় বসলাম। তাকে জিজ্ঞেস করলাম ,’কি হয়েছে? সে আমার কথার উত্তর না দিয়ে বিশাল জানালা দিয়ে বাইরে আকাশের দিকে তাকাল।

হয়তো অশ্রু“ সংবরন ও ধাতস্ত হওয়ার প্রচেস্টা- কেননা এখান থেকে বাইরে দেখার মত কিছুই নেই বরফ ছাড়া। একটুক্ষন পরে সে আমার দিকে মুখ ফেরাল। খুব শান্ত ভাবে জিজ্ঞেস করল, ডিন আমাকে কি কি প্রশ্ন করেছিল আর আমি তার কি উত্তর দিয়েছি? আমি খুব স্বাভাবিক ভাবে বলতে শুরু করলাম। কিন্তু আমার কথা মাঝপথে থাকতেই আচমকা প্রচন্ড ঘুষির তোড়ে আমি ভুপাতিত হলাম। আমাকে আঘাত করেছে আর কেউ নয় সেই তন্ময়!! বিস্ময়ে হতবাক হয়ে আমি যখন কিছু ভাবার সুযোগ খুজছি তখনই আবার আঘাত।

আমিও প্রতিরোধ করার চেস্টা করলাম। কিন্তু সে তখন চালকের আসনে- তা ছাড়া সে ছিল আমার চেয়ে যথেস্ট শক্তি শালী। সবাই যখন দাড়িয়ে দাড়িয়ে আমাদের ডুয়েল দেখছে তখন সবাইকে উপেক্ষা করে হোস্টেলের সবছেয়ে ছন্নছাড়া রাগী ছেলেটা তাদেরকে সে দ্বৈরথ থামাতে এগিয়ে আসল। আমি লড়িনি শুধু অহিংস প্রতিরোধ করেছিলাম। যেন প্রচন্ড ঝড়ের পরে পৃথিবী শান্ত হয়ে গেল।

আমি সেখান থেকে এতটুকু নড়িনি আর তন্ময়ও তার সেই আগের অবস্থানে। বিস্ময় রাগ দুঃখ ক্ষোভ অপমান অভিমানে আমার দুচোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে উষ্ণ জলের ধারা । আর ওদিকে তন্ময়ও কেঁদে চলেছে শিশুদের মত শব্দ করে। আমার সেই ছন্নছাড়া বন্ধু হাত বাড়াল আমাকে আমার রুমে নিয়ে যাবার জন্য, আমি এক ঝটকায় তার হাত ছাড়িয়ে তখন রুখে উঠলাম- বললাম,একটা প্রশ্নের উত্তর না জেনে কিছুতেই আমি এখানথেকে যাব না। আর সেটা তন্ময়ের কাছে, কেন সে আমাকে আঘাত করল ? তন্ময় নিশ্চুপ নির্নিমেষে অন্য দিকে তাকিয়ে আছে - আমি অপেক্ষা করছি উত্তরের জন্য? বেশ কিছুক্ষন এভাবে কাটল তখন অন্য এক সহপাঠী আমাকে এর কারন ব্যাখ্যা করল; সে নাম মেনশন না করে বলল, দুয়েকজনের ধারনা ছিল আমাদের মধ্যে কেউ কেউ এই আন্দোলনের বিপক্ষে তারা সামনে কিছু না বললেও ডিনের সামনে ঠিকই প্রকাশ করবে।

আর সেই বিট্রেয়ারকে বের করার জন্য আড়ি পাতা হয়ে ছিল। আর তাদের সেই গোয়েন্দা খবর দিয়েছে আমি নাকি বলেছি ’এই আন্দেলন ওদের আমি ওর মধ্যে নেই। ’ একথা শুনেই তাদের ধারনা হয়েছে শিক্ষকরা আমাদের দাবি মেনে নিবে না সেজন্যই তারা শিক্ষকদের সিদ্ধান্তের কথা না শুনেই চলে এসেছে। ছিঃ কি মিথ্যা অপবাদ! আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম ,আমার কথা কে শুনেছিল? সে বলতে চাইলনা। সেদিন সারা রাত একফোটা ঘুমাতে পারিনি।

সারারাত ক্ষোভে অপমানে ছট্ফট করেছি। পরদিন সকালেই খবর এল আমাদের পরিক্ষা বাতিল অর্থাৎ কেউ বিশ্বাসঘাতকতা করেনি। আমার এই ছন্নছাড়া বন্ধুতো দারুন খুশী। সে খুশীর চোটে অনেকটা ভদকা গিলে ফেলল। তার পরেই তার স্বভাব সুলভ মেজাজে সবাইকে শাসাতে শুরু করল।

আমার পক্ষ নিয়ে হোস্টেলের সবাইকে গালিগালাজ করল ইচ্ছেমত। মদ গিললে তাকে রুখে কার সাধ্যি? তখন সবার কি অভিব্যাক্তি! কেউ যেন আমার সামনে চোখ তুলে তাকাতে পারছে না যেন দারুন লজ্জা পাচ্ছে। কেউ কেউ আমার কাছে এসে অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে নিজেকে সাধু সাজানোর চেস্টা করল। আমি তাদের কাছে শুধু জানতে চাইলাম, কে আমার সময়ে আড়িপেতে ছিল? অবশেষে জানলাম। সে আর কেউ নয় আমার প্রাক্তন রুমমেট! আমার আগেই সন্দেহ হয়েছিল।

সেই শত্রুতাবশতঃ এ কাজ করেছে। অবশ্য সুযোগ পাওয়া সত্বেও আমি কোন প্রতিশোধ নেইনি। সেদিনের পর থেকে তন্ময় আর কখনই আমার সাথে লজ্জায় কথা বলতে পারেনি। তবে অন্য বন্ধু মারফত আমার কাছে ক্ষমা চেয়েছিল। কিন্তু আমি কোনদিন সে অপমান ভুলতে পারিনি।

সেদিনের পর থেকে আমরা দৃশ্যত দুটো শিবিরে বিভক্ত হয়ে গেলাম। আমাদের বিপক্ষ শিবিরের মুল উদ্যোক্তা ছিল আমার সেই প্রাক্তন রুমমেট । যদিও তারা সংখ্যায় নেহায়েত কম ছিল কিন্তু তাদের তুরুপের তাস ছিল তন্ময়। অনেক চেস্টা করেছে তন্ময়কে তাদের দলের লিডার বানাতে। কিন্তু তন্ময় সেদিনের ঘটনার পরে একদম ম্রিয়মান হয়ে পরেছিল।

সেইসঙ্গে হয়তোবা অনুতপ্তও- যেজন্য আমাদের বিশেষ করে আমার সাথে তার বন্ধুত্ব কাম্য ছিল শত্রুতা নয়। সে প্রথম প্রথম বাধ্য হয়ে ঐ দলকে সাপোর্ট করলেও একসময় ঠিকই আমাদের দলে ভেড়ার সুযোগ খুজতে থাকল। আর সেই পথটা প্রসস্ত করে দিলাম স্বয়ং আমি । তার প্রতি আমার প্রচন্ড রাগ থাকলেও একটা সহানুভুতি অবশ্যই ছিল । এটা বুঝতে আমার অসুবিধে হয়নি য , সে ও আমি দুজনেই পরিস্থিতির স্বীকার।

আমাদের রুমে বিশেষ রান্নার আয়োজন হলে তাকে অন্য বন্ধু মারফত ডেকে নিয়ে আসতাম। সে আসত দ্বীধাভরে মাথা নিচু করে। আমার রুমে ঢুকে খাটের এককোনে চুপ করে বসে থাকত। ধীরে ধীরে সে অনেকটা সহজ ও স্বাভাবিক হয়ে উঠল। কখনো আমার ইনস্টিটিউটে যেতে দেরী হলে তাকে দেখতাম রেডি হয়ে বাইরের দরজায় অপেক্ষা করতে।

আমাদের কার্ড খেলায় আবার সে হয়ে উঠল অপরিহার্য নিয়মিত পার্টনার। সেই আগের মতই অধম যখন গো হারা হারতাম তখন তাকে দেখতাম দান ছেড়ে দিতে। সে এক অদ্ভুত রকমের বন্ধুত্ব। কেউ কারো সাথে কথা বলতাম না কিন্তু সর্ম্পর্ক ছিল দারুন আন্তরিকতাপূর্ন। আমি যখন বাইরে বাজার করতে বা ঘুরতে বেরুতাম এসে দেখতাম সে আমার বিছানায় শুয়ে বেঘরে ঘুমাচ্ছে ।

আমি তার ঘুমের ব্যাঘাত না ঘটিয়ে তখন অন্য রুমে গিয়ে আড্ডা দিতাম । কখনোবা বাইরে বেরুনোর মুখে আমার সার্ট ওভার কোর্ট, মাফলার বা টুপি খুজে পাচ্ছিনা। রুমের সম্ভাব্য সব জায়গায় আতিপাতি করে খুজে ক্লান্ত হয়ে হাল ছেড়ে বিমর্ষ বদনে অন্য বন্ধুরটা ধার করার উদ্দেশ্যে পা বাড়াতে গিয়ে দেখি তন্ময় সেই পোষাক পরে নিশ্চিন্ত মনে ঘুরে বেড়াচ্ছে । রাগ করতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিতাম । যা একসময় অভ্যাসে পরিনত হয়ে গেল।

আমার কোন পোষাক না পেলেই ধরে নিতাম এটা সে নিয়েছে। প্রথম দিকে সে আমার অগোচরেই নিত- কিন্ত যখন বুঝতে পারল আমি তাকে প্রশ্রয় দিচ্ছি তখন সেআমার সামনেই পোষাকের আলমারি থেকে ইচ্ছেমত পোষাক বের করে পরা শুরু করল। তবে আমার অগোচরে একটা ব্যাপার প্রায়ই ঘটতে থাকল আর সেটা হল আমার রুমে উদ্বৃত্ত কোন খাবার রেখে গেলে সে সেটা চেটেপুঠে সাবাড় করে দিত। আমি আমার রুমের তালা বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া লাগাতাম না- কেননা ওটা ছিল সবার আড্ডা কার্ড খেলা মিটিংয়ের স্থান। তাছাড়া কারো কিছু প্রয়োজন পরলে সবার আগে আমার রুমে খুজতে আসত।

প্রায় সবার সেখানে ছিল অবাধ প্রবেশ। তবুও আমি ও আমার রুমমেট বাইরে থাকলে কেউ পারতপক্ষে আসত না। কিন্তু তন্ময় ছিল এর ব্যাতিক্রম। সে রুমে আমি থাকলেই কম আসত। বাইরে গেলেই সমগ্র রুমের নিয়ন্ত্রন সে নিয়ে নিত ।

আমি আশ্চর্য হতাম হোস্টেলের এতগুলো ছেলের কেউই কখনই উদ্যোগী হয়নি আমাদের সম্পর্ক উন্নয়নের। আমাদের সম্পর্ক যততুকু তরল হয়ে ছিল সেটা আমাদেরই প্রচেস্টায়। আমাদের পরস্পরের বাকহীন আন্তরিকতা দেখে তারা হয়তো মজাই পেত। ...এই পর্ব সমাপ্ত আগের পর্বের জন্য; Click This Link

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।