আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মুক্তিযোদ্ধার সনদ!!!!!



কলাপসিবল গেটের বাইরে মুক্তিযোদ্ধাদের লম্বা লাইন। সময় যত যাচ্ছে, বাড়ছে হৈহুল্লোড়, জটলা। সেই জটলা থেকেই হঠাৎ ছিটকে পড়লেন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা আবদুল গফুর। পড়তে পড়তে ক্র্যাচে ভর দিয়ে কোনোমতে দাঁড়ালেন দেয়াল ধরে। বাঁ পা নেই।

গুলিবিদ্ধ ডান হাতটাও প্রায় অকেজো। মুখে খোঁচা খোঁচা কাঁচাপাকা দাড়ি। হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, 'দুই বছরেও সার্টিফিকেট পাই নাই। কারে কমু, কী কমু, কেউ তো শোনে না। ভেতরে ঢোকন নিষেধ।

আবার কিছু কইলেই দূর দূর করে। য্যান ওগো কাছে ভিক্ষা নিতে আইছি!' মঙ্গলবার সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রাম নিজপাড় থেকে রাজধানীর পুল ভবনের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে সনদ নিতে এসেছিলেন আবদুল গফুর। গাড়ি থেকে নেমে সকাল ৬টায় সায়েদাবাদ বাসস্ট্যান্ডের রাস্তার পাশের একটি দোকান থেকে চা দিয়ে ভিজিয়ে একটি আটার রুটি খেয়েছেন। তারপর ৯টায় উঠেছেন মন্ত্রণালয়ের সাততলায়। বেলা দেড়টা পর্যন্ত এক গ্লাস পানি তো দূরে থাক, বসার একটু জায়গাও পাননি তিনি।

ক্রাচে ভর দিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে অসুস্থ শরীরে তখন আর কুলাচ্ছিল না। বসে পড়লেন ধুলোমাখা সিঁড়িতে। হাতে রাখা ফরমটি কাঁধের ঝুলিতে তুলে রেখে বললেন, 'আর পারি না। ' ২০০৮ সালের ৩০ জুন সনদের জন্য আবেদন (নম্বর ২৮৬৬) করেছিলেন তিনি। সনদ নিতে এসে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে এভাবেই চরম নিগৃহীত হতে হচ্ছে মুক্তিযোদ্ধাদের।

বছরের পর বছর সেই বারান্দায় দাঁড়িয়ে কেবলই জুটছে লাঞ্ছনা, অপমান আর লজ্জা। সহানুভূতি নেই। নেই সম্মান। মন্ত্রণালয়ের সচিব কিংবা কর্মকর্তা তো দূরে থাক, সামান্য একজন কর্মচারীর সামনে মাথা নিচু করে সনদের জন্য দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। পান থেকে চুন খসলে উঁচুগলায় তিরস্কার জুটছে।

একবারের জায়গায় দুবার কিছু জানতে চাইলেই ভর্ৎসনা। অপমান-ক্ষোভে কখনো কখনো দুই পক্ষের মধ্যে লাগছে বাকযুদ্ধ। ঘটছে হাতাহাতির ঘটনাও। মঙ্গলবার সকাল ৯টা থেকে বেলা ৩টা পর্যন্ত সরেজমিনে মন্ত্রণালয়ের ষষ্ঠ ও সপ্তম তলায় ঘুরে মুক্তিযোদ্ধাদের এই দুর্ভোগ চোখে পড়ে। কলাপসিবল গেট বন্ধ পনের দিন আগেও মুক্তিযোদ্ধারা সোজা সপ্তম তলার সনদ বিতরণ শাখার নির্দিষ্ট কক্ষে সনদের জন্য আবেদনপত্র জমা দিতেন ও সংগ্রহ করতেন।

কিন্তু এখন তাও বন্ধ। গত সোমবার থেকে দুটি তলার দুই পাশে চারটি কলাপসিবল গেট লাগানো হয়েছে। বসানো হয়েছে কড়া পুলিশি পাহারা। মুক্তিযোদ্ধাদের এখন ভেতরে প্রবেশ সম্পূর্ণ নিষেধ। জোর করে ঢুকতে চাইলে খেতে হচ্ছে গলাধাক্কা।

এ নিয়ে অতিষ্ঠ মুক্তিযোদ্ধারা সচিবের কক্ষে পর্যন্ত ঢুকে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। এ পরিস্থিতি থেকে রক্ষা পেতেই ছয় ও সাততলায় কলাপসিবল গেট লাগানো হয়। ফলে গত রবিবার থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের যেকোনো কাজের জন্য গেটের বাইরে অপেক্ষা করতে হচ্ছে। গেটের ভেতর চেয়ার-টেবিল নিয়ে বসা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা কলাপসিবল গেটের ফাঁক দিয়ে সনদের জন্য আবেদনপত্র গ্রহণ করেন ও সেই ফাঁক দিয়েই সনদ বিতরণ করেন। কাগজ গেলে আসে না 'গেট লাগানোয় এখন নিজেদের ভিক্ষুক মনে হয়'_প্রচণ্ড কষ্ট নিয়ে বললেন মুক্তিযোদ্ধা কনু মিয়া চৌধুরী।

যুদ্ধ করেছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আঘরা সেক্টরে। তিন মাস ধরে চার-পাঁচ দিন পরপরই তিনি আসছেন সনদের খোঁজ নিতে। সকালে সনদের রসিদ পাঠান ভেতরে। বেলা ২টার পর গেটের লোকজন ফেরত দিয়ে বলেন, হয়নি। কনু মিয়া বললেন, 'যখন গেট ছিল না, তখন ভেতরে ঢুকে লোকজনের সঙ্গে কথা বলে ১০ মিনিটেই কাজ শেষ করে চলে যেতাম।

এখন কাজ না হলেও ডাকে না। কাগজ টেবিলে পড়ে থাকে। ভেতরে যেতে পারি না। কারো সঙ্গে কথাও বলতে পারি না। সনদের কী অবস্থা_তাও জানতে পারছি না।

শুধু বলে, আরেক দিন আসুন। ' আবেগজড়িত কণ্ঠে কনু মিয়া বললেন, 'আমাদের মন্ত্রণালয়। অথচ আমাদেরই বাইরে ভিক্ষুকের মতো দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। ' সনদের জন্য বারবার ধরনা বারবার ধরনা দিয়েও সনদ মিলছে না মুক্তিযোদ্ধাদের। টাঙ্গাইল থানা সদরের মুক্তিযোদ্ধা আবদুল বাছেত আবেদন (নম্বর ৯২২৩) করেছেন গত বছরের ২৪ জুন।

সনদ দেওয়ার কথা ছিল সে বছরের ৭ ডিসেম্বর। কিন্তু পাননি। এরপর আরো পাঁচবার এসেছেন। বারবার কেবল তারিখ বদল হয়েছে। সনদ দিতে না পেরে মন্ত্রণালয়ের লোকজন এখন মুক্তিযোদ্ধাদের ভুল তারিখ দিয়ে শুধু সান্ত্বনা দিচ্ছেন।

তাঁদের গাফিলতির কারণে একজনের সনদ চলে যাচ্ছে অন্যের হাতে। মঙ্গলবার এ অভিযোগ করলেন বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা। চাঁদপুরের কচুয়া থানার সুয়ারু দীঘিরপাড় গ্রাম থেকে আসা মুক্তিযোদ্ধা দেলোয়ার হোসেন জানান, কর্মকর্তাদের কারণে ভুল ঠিকানা সনি্নবিষ্ট হওয়ায় এক বছর ধরে ধরনা দিয়েও সনদ পাননি। সনদ দেওয়ার সর্বশেষ তারিখ ছিল গত ১৬ ফেব্রুয়ারি। এমনকি মঙ্গলবার তাঁকে সনদ দেওয়ার ভুল তারিখ দিয়ে কেবল সান্ত্বনা দেওয়া হয়েছে।

তাঁর হাতের কাগজে দেখা গেল লেখা_'৫/৪/২০১০'। অর্থাৎ পার হয়ে গেছে এমন এক তারিখ লেখা হয়েছে। অন্যদিকে মুক্তিযোদ্ধা কনু মিয়ার সনদ চলে গেছে অন্য এক মুক্তিযোদ্ধার কাছে। এখন নিজের সনদের জন্য চার-পাঁচ মাস ধরে ধরনা দিচ্ছেন মন্ত্রণালয়ে। কিন্তু এ পর্যন্ত কোনো সদুত্তর পাননি।

দুর্ভোগের শেষ নেই সরেজমিনে দেখা গেল, সাততলা কলাপসিবল গেটের বাইরে দুই শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা লাইনে দাঁড়িয়ে হৈচৈ করছেন। ছোট একটি বারান্দা। তাতে মাত্র ১৭টি প্লাস্টিকের চেয়ার ও তিনটি টেবিল। ছাদের সিলিংয়ে পুুরনো দুটি ফ্যান কোনোমতে ঘুরছে। বয়সের ভারে ন্যুব্জ মুক্তিযোদ্ধারা নিরুপায় হয়ে শুয়ে-বসে আছেন ধুলোময় মেঝে ও সিঁড়িতে।

বোর্ডে সাঁটানো মুক্তিযুদ্ধের আলোকচিত্রগুলো ধুলো জমে ম্লান হয়ে এসেছে। খাবার পানির কোনো ব্যবস্থা নেই। নিজের টাকায় পানি কিনে খেতে নামতে হয় নিচতলায়। পায়খানা-প্রস্রাবখানা নেই তাঁদের জন্য। নানা রোগে আক্রান্ত বয়সী মুক্তিযোদ্ধারা কখনো কখনো বাধ্য হয়ে প্রস্রাব সারছেন রাস্তার পাশে উন্মুক্ত ড্রেনে।

পুল ভবনের কর্মচারীদের হাতেও অপমানিত হতে হচ্ছে এর জন্য। অথচ ভেতরে কক্ষে কক্ষে ফিল্টার পানি, দামি টাইলসে বাঁধানো পায়খানা-প্রস্রাবখানা। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে দামি আসবাবপত্র। স্যাররা খালি দূর দূর করে বেলা তখন ৩টা। পঞ্চম তলার ক্যান্টিনের পাশে দাঁড়িয়ে চায়ে বিস্কুট ভিজিয়ে খাচ্ছিলেন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা আজাহার আলী।

সনদ নিতে এসেছেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের বাঙ্গাবাড়ী ইউনিয়ন থেকে। এই বৈশাখ শেষে পা দেবেন ৭৪ বছরে। '৭১ সালের ২৯ নভেম্বর গুলিবিদ্ধ ডান হাত এখন অকেজো প্রায়। চোখের সামনে শহীদ হয়েছেন সহযোদ্ধা ভাতিজা তৈমুর ও মামাতো ভাই মুকুল। কিন্তু আজও তাঁর সনদ ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার ভাতা জোটেনি।

গেঞ্জিতে হাত মুছতে মুছতে বলেন, 'কারে জিগামু, ভেতরেই তো ঢুকতে দেয় না। স্যাররা খালি দূর দূর করে। ' সচিব কী বলেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব উজ্জ্বল বিকাশ দত্ত কলাপসিবল গেট লাগানো প্রসঙ্গে বলেন, 'কলাপসিবল গেট লাগানো হয়েছে টাউট-বাটপারদের প্রতিহত করতে। সনদ নিয়ে এক ধরনের দুর্নীতি হতো, সেটা বন্ধ করতে। বরং এখন মন্ত্রণালয়কে মুক্তিযোদ্ধাবান্ধব করা হয়েছে।

' মুক্তিযোদ্ধাদের নানা দুর্ভোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'এখানে তো কারো দিনমান বসে থাকার কথা না। কেন বসে থাকবেন? ফরম জমা দিয়ে খোঁজ নিয়ে চলে যাবেন। তাহলেই তো পানি-টয়লেটের দরকার হয় না। ' কিন্তু চার-পাঁচ ঘণ্টার আগে তো তাঁদের কাজ হয় না_এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, 'দেরি তো একটু হবেই। কাজের অনেক চাপ।

আগে গাফিলতি হয়েছে। এর জন্য সহকারী সচিব অলি উল্লাহকে ওএসডি করা হয়েছে। এখন পরিবেশ ভালো। ' সনদ পেতে এত দেরি হয় কেন_জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'যাচাই-বাছাই করতে হয়। ৮০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা নিরক্ষর।

তাঁদের অনেক ভুল থাকে। সেগুলো দেখতে হয়। এতে হয়তো অনেকে ক্ষুব্ধ হন। কিন্তু কোনো উপায় নেই। '


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.