আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নিউজিল্যান্ডের মাওরি-সংস্কৃতি

বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্‌উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ
মাওরিরা নিউজিল্যান্ডের আদি অধিবাসী। ত্রয়োদশ থেকে চতুর্দশ শতকে এরা পলিনেশিয় দ্বীপপুঞ্জ থেকে নিউজিল্যান্ডে এসেছিল। মাওরি ভাষায় ‘মাওরি’ অর্থ - ‘স্বাভাবিক’ বা ‘প্রাকৃতিক’ বা ‘সাদাসিদে’।

আসলেই তাই। নিউজিল্যান্ডের আদি অধিবাসী মাওরিরা যেন প্রকৃতির সন্তান। যা হোক। মাওরিরা নিউজিল্যান্ড কে বলে Aotearoa. মজার কথা হল শব্দটি মাওরি ও অ-মাওরিরাও ব্যবহার করে । কি অর্থ এর? মাওরি ভাষায় এর অর্থ: দীর্ঘ শ্বেতমেঘের দেশ।

কী রোমান্টিক! বোঝা গেল মাওরিরা কেবল সাদাসিদেই নয়-তারা ভারি রোমান্টিকও ছিল! নিউজিল্যান্ডের মানচিত্র। অন্তত ক্রিকেটের জন্য হলেও অষ্ট্রেলিয়ার পাশের এই দ্বীপদেশটা আমাদের পরিচিত। কিন্তু মাওরিরা নিউজিল্যান্ডে এল কোত্থেকে ? পলিনেশিয়ার মানচিত্র। পলিনেশিয়া হল মধ্য ও দক্ষিণ প্রশান্ত সাগরের দ্বীপসমূহের একটি সাবরিজন বা উপঅঞ্চল। এখানে সব মিলিয়ে ১০০০ দ্বীপ রয়েছে।

পলিনেশিয়া। পলিনেশিয়া শব্দটির উদ্ভব দুটি গ্রিক শব্দ থেকে। পোলাস=অনেক; এবং নেসোস=দ্বীপ। দ্বীপের বসবাসকারী জনগনের ভাষা সংস্কৃতি ও ধর্মবিশ্বাসের সাদৃশ্য রয়েছে। আশ্চর্য এই এদের উদ্ভব দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়।

এরা তাইওয়ান হয়ে পলিনেশিয়ায় এসেছে। সময়কাল? প্রতœতাত্ত্বিদের অনুমান: ৫,২০০ বছর আগে। মাইটোকন্ড্রিয়াল ডি এন এ পরীক্ষা এ তথ্যের সত্যতা প্রমান করেছে। ‘আউট অভ আফ্রিকা’ তত্ত্ব মতে আধুনিক মানুষ বা হোমোসাপিয়ান্স ১০০০০০ বছর পূর্বে পূর্ব আফ্রিকা থেকে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। এরপর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মানুষই নানা বর্ণে, ভাষায় ও গোত্রে বিভক্ত হয়ে পলিনেশিয়ায় এসেছিল।

মাওরিদের মৌখিক ইতিহাস বলে যে কোনও এককালে তাদের পূর্বপুরুষেরা হাওয়াইকি থেকে বড় সমুদ্রগামী কেনোতে করে নিউজিল্যান্ড এসেছে। হাওয়াইকি জায়গাটা নাকি পলিনেসিয়া এক মিথিয় ভূমি। মাওরি কেনো । এতে চড়েই ১২৫০ থেকে ১৩০০ খ্রিস্টাব্দ দলে দলে মাওরিরা পলিনেশিয়ার কুক আইল্যান্ড, সোসাইটি আইল্যান্ড ও মারক্যোয়েস আইল্যান্ড থেকে নিউজিল্যান্ডে এসেছিল। তারা নিউজিল্যান্ডে পরিকল্পনামাফিক এসেছিল না দৈবাৎ এসেছিল-তা জানা যায়নি।

নিউজিল্যান্ডের বেলাভূমি; মাওরিরা প্রথমে উপকূলে অবতরণ করে সেখানে বসবাস করতে থাকে। উপকূলে সীলমাছ, ডলফিন ও পাইলট তিমি শিকার করত। সম্ভবত তারা মৎস শিকারে নিজস্ব কৃৎকৌশল উদ্ভাবন করেছিল। মোয়া পাখি। মাওরিরা নিউজিল্যান্ডের পাখিপূর্ণ দ্বীপে প্রথম প্রথম পাখি শিকারও করত।

বিশেষ করে অধুনা বিলুপ্ত মোয়া পাখি। নিউজিল্যান্ড দ্বীপটি অরণ্যময়। তারা অরণ্য কেটে পরিস্কার করে পায় কাঠ ও চাষযোগ্য জমি। কাজেই কৃষিকাজের দিকে ঝোঁকে তারা। কালক্রমে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে।

সম্পদের ওপর অধিকার আরোপে বাধে যুদ্ধ। বাংলাদেশে যেমন জাটকা (নয় ইঞ্চির কম দৈর্ঘের ইলিশ মাছ) নিধনের বিরুদ্ধে কঠোর আইন করছে সরকার। তেমনি পুরোহিরা বিশেষ বিশেষ খাদ্যের ওপর টাপু বা ট্যাবু আরোপ করত। মাওরিদের ধর্ম ছিল মূলত পলিনেশিয় ধর্মের অনুরুপ। তারা মনে করত বিশ্বের সমূদয় প্রকৃতিক উপাদান ও জীবন্ত প্রাণীসমূহ ‘ওয়াহাকাপাপা’ হতে উদ্ভূত।

ওয়াহাকাপাপা হল জেনিয়লজি বা বংশবৃত্তান্ত । এই ওয়াহাকাপাপা-র ধারণাই মাওরিদের ধর্মসংস্কৃতির মূল ভিত্তি। তারা বিশ্বাস করত সবার আছে জীবনীশক্তি বা মাওরি। আর সবই বংশবৃত্তান্ত বা ‘ওয়াহাকাপাপা’ -র অর্ন্তগত । এর কোনও কোনটি আবার উদ্ভূত সময়ের সৃষ্টির পূর্বে।

সমুদ্র ও সকল মাছের অবতার (পারসনিফিকেশন) হল ‘টাঙ্গগারোয়া’। পাখি ও অরণ্যের অবতার হল ‘তানে’। রোপিত উদ্ভিদ, কৃষিকাজ ও শান্তপ্রিয় কর্মকান্ডের অবতার হল ‘রোনগো’। কারও কারও মতে মাওরিদের পরম অবতার হলেন ‘লো’। টাট্টু।

এটি মাওরিসংস্কৃতির অন্যতম ভিজুয়াল বৈশিষ্ট্য। মুখভরা টাট্টুকে বলা হয় মোকো। মেয়েরা অবশ্য মোকো করতে পারে না। তাদের অনুমতি নাক থুতনি আর ওপরের ঠোঁট অবধি। মাওরিসমাজে শিকার আর চাষবাস করত পুরুষাভ ।

আর বীজ বুনত মেয়েরা, মেয়েরা রান্নাবান্নাও করত, সেই সঙ্গে করত সেলাইয়ের কাজ । মাওরিরা একত্রে করত চাষ, খাদ্য সংগ্রহ ও যুদ্ধ। মাটির কাজ, টাট্টু, এবং কাঠ খোদায়ের কাজ করত নির্বাচিত দক্ষ শিল্পীরা। কাঠ ছাড়াও পাথর ও হাড়ের ওপর খোদাই করা হত। মাওরিরা বাস করত কাঠের বাড়িঘরে, আর সে বাড়িঘরের নানা স্থানে খোদাই করা হত।

তারা অলংকৃত পোষাক পড়ত। কাঠখোদাইয়ের কাজ মাওরি গ্রামগুলি থাকত দূর্গ। প্রহরীরা গ্রাম পাহারা দিত। মাওরিরা নানা গোত্রে ছিল বিভক্ত । তবে প্রত্যেক গোত্রই অভিন্ন পূর্বপুরুষ থেকে উদ্ভূত।

‘ওয়াকা’ হল গোত্রীয় কনফেডারেশন। গোত্রের সদস্যদের বলা হত ‘হাপু’। বড় ছেলেই হত সম্পদের উত্তরাধিকারী। মাওরি গোত্র প্রধানকে বলা হত আরিকি। ইউরোপীয় সভ্যতার স্পর্শে পরিবর্তিত মাওরি নারী মাওরি ভাষায় শ্বেতাঙ্গদের বলা হয় পাকেহা।

মাওরিরা অষ্টাদশ শতক থেকে ইউরোপীয় পাকেহাদের সংসর্গে আসে। প্রথম প্রথম সংঘর্ষ বাধাই স্বাভাবিক । এক ইউরোপীয় নাবিক মাওরি প্রধানের ছেলেকে চাবুক দিয়ে মারার পর মাওরিরা ৬৬ জন ইউরোপীয় কে অপহরণ করে জিম্মি করে পরে হত্য করে । বেঁচে যাওয়া অনেকেই মাওরিদের নরখাদক (ক্যানিবাল) বলে উল্লেখ করে। মাওরি পরিবার মাওরিরা মানুষের মাংস খেত কি না তা বলতে পারছি না তবে তারা ভেড়া, শূকর এবং মুরগীর মাংস খেত।

তারা পাখি ও ইঁদুরের মাংসও খেত; আর খেত আলু আর মিষ্টি আলু। মাটিতে গর্ত করে পাথর ফেলে সে পাথর আগুনে তাতিয়ে নিয়ে রান্না করা হত। বাঁধাকপির পাতা দিয়ে গর্তের মুখ ঢেকে দিত যাতে খাবার পুড়ে না যায়। খাবার ঢেকে রাখার হত ভেড়ার চামড়ার তৈরি ঢাকনিতে। এ ধরনের ঐতিহ্যবাহী মাওরি রান্নাকে হ্যাঙ্গি বলে।

বর্তমানকালের ছবি ১৮৪০ থেকে ১৮৯০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে মাওরিরা ইউরোপীয় সমাজে মিশে যেতে থাকে। ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দের দিকে তারা খ্রিষ্টান ধর্ম গ্রহন করে। চার্চ অভ ইংল্যান্ড এবং রোমান ক্যাথলিক চার্চ-এই দুই গির্জেরই সদস্য হত তারা। বর্তমানে মাওরিরা ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হচ্ছে। এ সংখ্যা ২০০১ সালে ৯৯ জন থেকে ৭০৮ জনে উন্নীত হয়েছে।

হাকা। বা যুদ্ধনৃত্য। আগে যুদ্ধের পূর্বে হাকা নাচা হত। এখন নিউজিল্যান্ড রাগবি টিম খেলার আগে হাকা নাচে। আর এভাবেই ... বর্তমানকালের নিউজিল্যান্ডবাসীর মাওরি-সংস্কৃতির চর্চা।

২০০০ সালে মাওরিদের সংখ্যা ছিল ৫৯৯,০০০- যা নিউজিল্যান্ডের জনসংখ্যার মোট ১৫.৭। এদের বেশির ভাগই বাস করে নিউজিল্যান্ডের নর্থ আইল্যান্ডে। অনেকেই অকল্যান্ড, ওয়েলিংটন প্রভৃতি বড় শহরে বাস করে। এরা ইংরেজি ও মাওরি ভাষায় কথা বলে। ছবি ও তথ্য: ইন্টারনেট ও মাইক্রোসফট এনকার্টা।


 

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.