আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কে আদিবাসী? বাঙালি ও বাঙলার বিবর্তন প্রসঙ্গ - দ্রাবিড় জাতি ২য় পর্ব



আফ্রিকা থেকে যাযাবর শিকারী গোষ্ঠির আকেটি দল সেন্ট্রাল এশিয়ায় গিয়ে সম্মুখীন হয় পর্বত সংকুল এলাকার। প্রায় ৩০ হাজার বছর পুর্বে এদের অনেকে ঘুরতে ঘুরতে পৌছায় ভারতের সিন্ধু নদীর তীরবর্তী অঞ্চলে এবং সেখানে স্থাপন করে বসতি। এই নরগোষ্টির বিস্তৃতি ছিল লাইবেরীয়া থেকে উপমহাদেশ পর্যন্ত। এরা দেখতে মধ্যম থেকে লম্বাকৃতির ছিল, গায়ের ও চোখের রং ছিল কালো থেকে হালকা বাদামী, এদের মাথা ও মুখাবয় ছিল দীর্ঘ। ধারণা করা হয় প্রায় ১০ হাজার বৎসর পুর্বে (খ্রীস্টপূর্ব ৮৫০০-৭০০০) মধ্যপ্রাচ্যের উর্বর জমিতে বিচরণকারী শিকারজীবি যাযাবরেরা পুরাতন জীবনধারা বাদ দিয়ে চাষাবাদ ও পশুপালন শুরু করে।

যাযাবর জীবনযাপন ছেড়ে দিয়ে ঘরবাসী হওয়ায় মধ্যপ্রাচ্যে ইউফ্রেটিস ও টাইগ্রীস (ফোরাত ও দজলা) নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলে (বর্তমান ইরাক সহ সিরিয়া ও ইরাণের কিয়দংশ) মেসোপটামিয়ায় ( মেসোপটামিয়া একটি গ্রীক শব্দ। এর শব্দার্থ হচ্ছে ''দুই নদীর মধ্যবর্তীস্থান'') খ্রীস্টপূর্ব প্রায ৪ থেকে ৫ হাজার বৎসর পূর্বে সুমেরীয় সভ্যতা আত্মপ্রকাশ করে। এরা তাদের নগরীতে দালান কোঠা নির্মান সহ পানি ও পয়ঃ নিস্কাশনের ব্যবস্থা করেছিল। তাদের সভ্যতার অবশেষ দেখে অনুমান করা হয় যে তারা ছিল দক্ষ, রুচিবান ও ঐশ্বর্যশালী। মাটির টালির মধ্যে তাদের লিপি কৌশল আবিস্কৃত হয়েছে।

তাদের লিপিকে কিউনিফর্ম বলে অভিহিত করা হয়। সুমেরীয়রাই প্রথম লেখার পদ্ধতি আবিস্কার করে। এই নরগোষ্ঠির পূর্বাঞ্চলীয় শাখার ভারতীয় অধিবাসীদের দ্বারা (খ্রীস্টপূর্ব ৩২৫০ থেকে ২৭৫০ খ্রীস্টাব্দ পর্যন্ত) সিন্ধু নদীর অববাহিকায় সভ্যতার পত্তন হয। মহোঞ্জদারো ও হরপ্পার সভ্যতা এদেরই অবদান। এদেরকে ভাষার ভিত্তিতে দ্রাবিড় জাতি বলে আখ্যায়িত করা হয়।

দ্রাবিড় জাতির পত্তনকৃত এই সভ্যতার উত্তরকালে উপমহাদেশে আর্যজাতির আগমণ ঘটে। দ্রাবিড় জাতি সম্পর্কে কেউ কেউ একটি বড় ধরণের ভুল করে থাকেন। তারা দ্রাবিড় জাতি আর অস্ট্রিক নরগোষ্ঠিকে একজাতি হিসাবে অথবা এক নরগোষ্ঠি হিসাবে বিবেচনা করেন। হার্বাট রিজলী আদি অস্ট্রেলীয় ও নিগ্রোবটু উভয় জাতিকে দ্রাবিড় হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন। আবার অনেকের মধ্যে এমন ধারণা বিদ্যমান আছে যে দ্রাবিড়রা একটি নরগোষ্ঠি এবং বাংলাদেশের অধিবাসীরাও মূলত দ্রাবিড় শ্রেণীভুক্ত।

সেজন্য দ্রাবিড় জাতি সম্পর্কে সামান্য আলোচনার প্রয়োজন আছে। ৭ম শতাব্ধীতে কুমারীলা ভট্ট কর্তৃক রচিত তন্ত্রভর্তৃকা গ্রন্থে সংস্কৃত ভাষায় সর্বপ্রথম ’দ্রাবিড়’ শব্দের ব্যবহার দেখা যায়। কর্মসুত্রে দাক্ষিণাত্যে আগত ক্যাথলিক পাদ্রী রবার্ট ক্যলডওয়েল সংস্কৃতের অনুসরণে ''দক্ষিণ ভারতের লোকজন'' বোঝাতে ইংরেজীতে দ্রাবিড় শব্দটি ব্যবহার করেন। পরবর্তীতে তার ব্যবহৃত দ্রাবিড় শব্দটি সর্বত্র গৃহিত ও ব্যবহৃত হতে থাকে। দ্রাবিড় জাতি বলতে মূলত কোন নরগোষ্ঠি বুঝায় না।

দ্রাবিড় জাতি বলতে অস্ট্রালয়েড পরবর্তী ও আর্য পূর্ববর্তী উপমহাদেশে আগমণকারী ও একটি ভাষার দ্বারা প্রভাবিত একাধিক গোষ্ঠিভুক্ত জনসংহতিকে বুঝায়। হরপ্পা ও মহোনঞ্জদারোতে প্রাপ্ত নরমুন্ড পরীক্ষা করে দেখা গেছে সেখানে যেমন দীর্ঘমুন্ড, সুদৃঢ় ও বলিষ্ঠ গড়নের মানুষের চিহ্ন পাওয়া গেছে, তেমনি খর্বাকৃতির দীর্ঘ নাসিকা, ধনুকের মতো বঙ্কিম ও উন্নত কপালের অপেক্ষাকৃত দুর্বল গড়নের মানুষের চিহ্নও পাওয়া গেছে। মধ্যপ্রাচ্যের নরগোষ্টির এই দ্রাবিড় জাতির সাথে অস্ট্রিক জাতির তেমন বিবাদ বিষম্বাদের কথা জানা যায় না। ফলে সম্প্রীতির কারণে তাদের মাঝে অধিকহারে জাতিগত মিশেল হয়ে সম্ভবত একটি ধোয়াচ্ছন্ন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। ঐ সময়ে উপমহাদেশে অস্ট্রিক ভাষা মুন্ডার ব্যাপক প্রভাব থেকেও এ বিষয়টি অনুমান করা যায়।

আবার দ্রাবিড় ভাষার সাথে অস্ট্রিক ভাষার বিভিন্ন সঙ্গতি থেকেও দ্রাবিড় ও অস্ট্রিকদের মধ্যে মিলমিশের ব্যাপকতা প্রতীয়মান হয। এই মিশেলের বিষয় থেকেই হার্বাট রিজলী অস্ট্রালয়েড নরগোষ্টিকে দ্রাবিড় জাতির সাথে গুলিয়ে ফেলেছেন। সেজন্য তার বক্তব্য সর্বগ্রাহ্য হয়নি। দ্রাবিড় একটি ভাষার নাম। দ্রাবিড় ভাষার মধ্যে বর্তমানে প্রচলিত প্রধান ভাষাসমূহ হচ্ছে তামিল, কানাড়া (কর্ণাটক ও কেরালায় প্রচলিত), মালয়ালাম (কেরালায় প্রচলিত), তেলেগু (উড়িষ্যায় প্রচলিত), টুলু , কুরুক (মতভেদে অস্ট্রিক ভাষাজাত) প্রভৃতি।

এর মধ্যে বাংলাদেশে কুরুক ভাষার প্রচলন আছে। উত্তর বঙ্গ ও শ্রীহট্টের চা-বাগানে বসবাসরত ওরাও উপজাতির ভাষা কুরুক। দ্রাবিড়রা নগর সভ্যতার পত্তন করে। সিন্ধু উপত্যকায় দ্রাবিড়দের তৈরী প্রায় হাজার খানেক নগর ও বসতি আবিস্কৃত হয়েছে। ধারণা করা হয পাঞ্জাবে অবস্থিত হরপ্পা নগরে (লাহোর থেকে প্রায় ১২০ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত) প্রায ৪০ হাজার এবং সিন্ধু প্রদেশে অন্তর্গত এবং সিন্ধুনদী তীরবর্তী মহোঞ্জদারোতে (করাচী থেকে প্রায় দুইশত মাইল উত্তর-পূর্বে) প্রায় ৩৫ হাজার লোক বাস করত।

দুটি নগরই প্রায একই ধরণের পরিকল্পনায় নির্মিত। সেখানে সারিবদ্ধভাবে দোতালা বাড়ী, কক্ষ সংলগ্ন বাথরোম, পয়ঃনিস্কাশনের ব্যবস্থা, জনপথ, গুদাম ঘর, প্রার্থনা গৃহ, বাজার, বড় কূপ, আলকাতরার প্রলেপ দিয়ে পানি নিরোধের ব্যবস্থা সহ সুইমিং পুল ও গণ শৌচাগারের ব্যবস্থা ছিল। তাদের বাড়ী ঘরগুলো দুর্গন্ধ, শব্দ ও চোরের উৎপাত থেকে মুক্তরাখার কৌশল অবলম্বন করে ইটের দ্বারা তৈরী করা হয়েছিল। তারা ওজন ও পরিমাপের একক জানত এবং বিভিন্ন বিষয়ে বিভিন্ন সীলমোহর ব্যবহার করার কৌশলও আযত্ব করেছিল। দ্রাবিড়রা তূলা, গম, সব্জী ইত্যাদির চাষ জানত এবং গরু লালন পালন করত।

তারা তামা ও ব্রোঞ্জের ব্যবহারও জানত। হরপ্পা ও মহোঞ্জদারো, উভয় ধ্বংসপ্রাপ্ত নগর থেকে উন্নতমানের মৃৎপ্রাত্র পাওয়া গেছে। এসব তাদের সুখী ও বিলাসী জীবন যাপনের প্রমাণ। ধ্বংসস্তপ থেকে প্রায় নৃত্যরতা একটি মূর্তি পাওয়া গেছে। অবশ্য এখনো এ মূর্তি সম্বন্ধে গবেষণা চলছে।

তবে অপর একটি মূর্তি দেখে সকলেই সেটিকে পুরোহিতের মূর্তি বলে সায় দিয়েছেন। ফলে সিন্ধুসভ্যতার লোকজনের মধ্যে ধর্মচর্চার প্রামাণ পাওয়া যায়। তবে সে ধর্ম কিরূপ ছিল, তা এখনো নিরূপণ করা যায়নি। সিন্ধুসভ্যতার লোকজন ব্যবসা বাণিজ্যেও পারদর্শী ছিল। তাদের বাণিজ্য মিসর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।

এই সিন্ধুসভ্যতা খ্রীস্টপুর্ব ৩৩০০ সালে শুরু হয়ে খ্রীস্টপূর্ব ১৬০০ সালে সমাপ্ত হয়। সিন্ধুসভ্যতা ধ্বংসের কারণ হিসাবে ভিন্ন ভিন্ন মত রয়েছে। কেউ মনে করেন যে খরা ও বন্যা উভয় কারণে সিন্ধুসভ্যতা ধ্বংস হয়েছে। তবে জনপ্রিয় মতবাদ হচ্ছে যে আর্যরা যাযাবরে জীবনযাপন করত, তারা নগর জীবনে অভ্যস্ত ছিলনা। আর্যরা নগর জীবনের গুরুত্ব উপলব্ধী না করায়, তারা এসব অঞ্চল করায়ত্ব করার সময় ব্যাপক ধ্বংস লীলা চালায় এবং দ্রাবিড়রা আত্মরক্ষার্থে ক্রমাণ্বয়ে দক্ষিণ ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করে সেখানে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করে।

সিন্ধ সভ্যতা ধ্বংসের জন্য ঐতিহাসিকগণ আর্যদেরকেই দায়ী করেন। ফে. ফ্রাঙ্কলিন তার হিস্টরিজ টাইমলাইন গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন,''খিস্টপূর্ব ১৫০০ অব্দে উত্তম-পশ্চিম থেকে আসা আর্যদের আক্রমণে এই সভ্যতা ধ্বংস হয়ে যায়(^ সুত্র ৪)। '' দ্রাবিড়রা অবশ্য প্রায় হাজার বছর আর্য জাতিকে প্রতিরোধ করে। পরাজয় বরণ করলেও দ্রবিড়দের উন্নত সভ্যতা ও সংস্কৃতি আর্যদেরকে অনেকাংর্শে প্রভাবিত করে। অনেক দ্রাবিড় দেবতা, যাদেরকে আর্যরা অসুর বলে হেলা করত, কালক্রমে তারাও আর্যদের আরাধ্য দেবদেবীর স্থানে সমাসীন হয।

তবে আর্যরা দ্রাবিড়দেরকে সম্মানের চোখে দেখত না। দ্রাবিড়রা পরাজিত হলে আর্যরা তাদের অনেককে দাসদাসী হিসাবে ব্যবহার করে এবং চারটি শ্রেণীতে লোকজনদেরকে বিভাজন করে নিজেরা উচ্চ শ্রেণীতে আসন নিয়ে দ্রাবিড়দেরকে শুদ্র বা নিম্নতম শ্রেণীতে নিক্ষেপ করে। তবে আর্য সমাজপতিদের বিধানের বাইরেও আর্যদের সাথে দ্রাবিড়দের রক্ত সম্পর্কিত সম্পর্ক স্থাপিত হয এবং অতি ধীরে একটি মিশেলের আয়োজন চলতে থাকে। এই মিশেল শুধু নারী পুরুষে নয়, ভাব, ভাষা, সভ্যতা ও সংস্কৃতিতেও অল্পবিস্তর প্রভার বিস্তার করে। পক্ষান্তরে দ্রাবিড়রা যে সব জায়গায় আশ্রয় গ্রহণ করে, সেখানে তাদের অস্ট্রিক জাতির সাথে সন্মিলন হয়।

এ সন্মিলনের মধ্যদিয়েও দ্রাবিড় সমাজ ও অষ্ট্রিক জাতির পারস্পরিক ভাব বিনিময় ও মেলামেশায় শংকরায়নের বিক্রিয়া শুরু হয। উপমহাদেশে বিভিন্ন জাতির এই সন্মিলনই উপমহাদেশ বাসীর একটি বড় বৈশিষ্ঠ। প্রসঙ্গক্রমে এ কথাও উল্লেখ করা উচিত যে সিন্ধুসভ্যতাকে দ্রাবিড়দের সভ্যতা হিসেবে চিহ্নিত করা হলেও, হরপ্পা ও মহোঞ্জদারোসহ অন্যান্য স্থানে যেসব লিপি পাওয়া গেছে, তার পাঠ আজো উদ্ধার করা যায়নি। প্রাপ্ত লিপি সমুহের পাঠোদ্বার হলে, ইতিহাস যদি পাল্টে যায়, তাহলেও বিস্ময়ের ব্যাপার হবেনা। তবে সিন্ধুসভ্যতা যে আর্যদের নয়, তার বড় প্রমাণ আছে।

আর্যরা যাযাবর শ্রেণীর লোক ছিল আর হরপ্পার অধিবাসীগন ছিল গৃহী। আর্যরা অশ্ব ব্যবহারে পারদর্শী ছিল। কিন্ত সিন্ধুসভ্যতার লোকজন অশ্বের বিষয়ে ছিল অজ্ঞ। কে আদিবাসী? বাঙালি ও বাঙলার বিবর্তনঃ প্রসঙ্গ - অস্ট্রালয়েডঃ ১ম পর্ব সুত্র নির্দেশিকাঃ ^ ৪ দিলীপ দেবনাথ, ইতিহাসের খেরোখাতা, দিব্যপ্রকাশ, ঢাকা, ২০০৬

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.