আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থী।(১)



আমাদের যাদের জন্ম পঞ্চাশের দশকে তাদের সামনে রাজনৈতিক ভাবাদর্শ হিসেবে বামপন্থা অনেকটা জায়গা জুড়ে। আমাদের যাদের যৌবনের সাথে সত্তরের দশক জড়িত তাদের বেশীরভাগেরই কোনো না কোনো ভাবে বামপন্থার সাথে হাত মিলিয়ে নিজেকে চেনার নানা ছোট বড় অধ্যায় আছে। আছে মৃত্যু জেলখানা অত্যাচার উচ্ছেদ----আছে স্বপ্নভঙ্গ হতাশা নেশা ----আছে ডুবে যাওয়া----আছে হারিয়ে যাওয়া--ইত্যাদি। অস্বীকারের উপায় নেই পাথেয় হিসেবে যে মূল্যবোধ-- আমাদের মধ্যে যারা পরবর্তীতে বেঁচে ছিলাম বা আছি তারা তা ঐ বামপন্থার কাছ থেকেই পেয়েছিলাম। কিন্তু সময় বড় নির্মম এবং গতিময়।

প:বঙ্গে বামপন্থার কার্যকরী সূত্রপাত কম্যুনিস্ট পার্টির হাত ধরে । কিন্তু পন্থা অনুযায়ী প্রাক্‌স্বাধীনতা যুগে এই উপমহাদেশে জনপ্রিয়তার নিরিখে কংগ্রেসের সংগে কখনোই তার তুলনা করা যায়নি। খুব সীমিত জনভিত্তি নিয়েই তাদের ঐ যুগে কাজ করতে হয়েছিলো । ভারতবর্ষের মত বিশাল ব্যাপক এবং বিচিত্র একটা দেশে একটা মতবাদ নিয়ে কাজ শুরু করার আগে তার যে পরিমান তৃণমূল পর্যায়ের জরিপ সন্ধান এবং গবেষণার প্রয়োজন ছিলো তা তখন বা পরেও কখনো হয়েছে বলে আমার মনে হয়নি। একটি উপনিবেশে তখন কোন্‌ লড়াই প্রাধান্য পাবে তা নিয়ে ব্যাপক স্ববিরোধিতা দেখা গেছে ।

সম্ভবতঃ তা থেকে এখনো আজকের অসংখ্য কম্যুনিষ্ট দলগুলোর কেউই মুক্ত নয়। ফলতঃ তাদের কার্যকলাপ মাঝে মাঝে বুমেরাং হয়েছে বইকি। সত্তরের দশক যেন দ্বিধা দ্বন্দ্ব বিদীর্ণতার দশক । যাকে বলা হয় নক্সাল আমল। আমরা তখন সদ্য দাড়িগোফ গজানো তরুণ।

কলেজে পড়ি। সকালে বিকেলে পাই মৃত্যুর খবর । --- এই ওদিক দিয়ে যাস্‌ না ওখানে একটা বডি পড়ে আছে----হৈ হৈ করে হয়ে গেল কলেজ বন্ধ ---কাছাকাছি মার্ডার হয়েছে---ইত্যাদি। কে মরল, কোন দলের , কারা মারল----আমরা ভেতরে ভেতরে কাঁপতে থাকা পশুর মতো কিছুটা তৃপ্তি অথবা দুঃখ পাওয়ার চেষ্টা করতাম যখন শুনতাম কম্যুনিষ্টপার্টির কেউ মরেনি বা মরেছে। আমাদের মত ভাসমান শ্রেণীটি বুঝে উঠতে পারতামনা কীভাবে আত্মরক্ষা করা যায় ।

বিপদ চারপাশে--বোমা গুলি শ্রেণীশত্রু পুলিশ খোচর । রাত শুরু হতে না হতেই বোমায় কাঁপছে শহর। তার মধ্যে মানুষের আত্মরক্ষা করে করে ঘরে ফেরা---পুলিশের ধারালো চোখের সামনে দিয়ে নেহাতই অপরাধীর মতো। আমরা সাধারণতঃ পুলিশের মুখোমুখি হতে চাইতামনা। কারণটা আমাদের বয়স।

তখন ঐ বয়সটাকেই যেন সন্দেহ করে বসেছে । তা ছাড়া আত্মরক্ষার তাড়নায় আমাদের অনেকের পকেটেই ছোট বড় চাকু থাকতো। পুলিশের মুখোমুখি বাধ্যত কখনো হয়ে গেলেই দেখা গেছে যে সারা গা টিপে টিপে সার্চ করতে। কখনো ইচ্ছা হলে তুলে নিত ভ্যানে। তারপর থানায় নিয়ে গিয়ে------।

ফলে শহরের রাস্তায় পুলিশ দেখলেই গলি দিয়ে পালানো ছিলো আমাদের অভ্যেস। কেড্‌স জুতো পায়ে আমাদের অতর্কিত হরিণ গতির সংগে ভারী পুলিশের পারার কথা না। শহরে মধ্যে এটাই আমাদের সুবিধে ছিলো। রাতের পর রাত কোনো শোক মৃত্যু দুঃস্বপ্ন এক জায়গায় বসে থাকেনি । আমরা আর কত দৌড়বো---আমাদের কি আর বাঁচা নেই---দম নেয়ার মতো বাতাস যে ক্রমে কমে আসছে ।

---আর আমাদের স্বপ্নেরই বা কী হলো ? বিপ্লবের স্বপ্ন---কত জন যে কত ভাবে সেই স্বপ্ন দেখিয়েছে---তারা ছিলো আমাদের আদর্শ ---তাদের কথা কি মিথ্যে হবে! খুব করুণ মনে হলেও আমাদের মাথায় বাসা বাঁধা সরল সাদাসিদে স্বপ্নের খুব দ্রুত জলাঞ্জলী হয়ে গেল। রাষ্ট্রের সাঁড়াশী আক্রমনে সব ছত্রখান । এক কথায় প:বঙ্গের সক্রিয় নকসাল যুগের শেষ মোটামুটি ৭২এই । এই বিপ্লবের ডাক দেয়া হয়েছিলো যে ইস্তাহারের ভিত্তিতে তা চাক্ষুষ করতে আমার অন্ততঃ সময় লেগেছিলো পরের দুইটি দশক। কলকাতার ফুটপাতে পাওয়া গিয়েছিলো সেই তখনকার নিষিদ্ধ বস্তুটি।

কিনে এনেছিলাম সেই মূল্যবান দলিলটি। সেটি পড়তে পড়তে বুঝতে পারছিলাম একটা ভয়াবহ মন্দার সুযোগ বুঝে একজন/বা কয়েকজন মানুষ কত হাজার হাজার মানুষের ক্ষতির কারণ হয়েছিলেন। হ্যাঁ উনি চারু মজুমদার। সংক্ষেপে "সি এম"। রাষ্ট্রের শ্রেণীচরিত্র বিশ্লেষণ এবং রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আন্দোলন সশস্ত্র না সংসদীয় --৪৭এর আগের ধারা চলবে, না ৪৭এর পর নতুন ধারা প্রয়োজন---কৃষি বিপ্লব না শ্রমিক কৃষক ঐক্যের বিপ্লব--বিপ্লবের জন্য প্রাথমিক ভাবে প্রয়োজনে দা কুড়োল খুন্তি তীর ধনুক বর্শা বল্লম---এসব নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে ।

তাতে প্রাণ যাবে। আর এইসকল মৃত্যু হবে শহীদের এবং তা অবশ্যই ঐতিহাসিক । ধর্মের যেমন পরজন্ম তেমনি রাজনীতির এই অমরত্ব। দলিলটি পড়ার পর আমার একটি দীর্ঘশ্বাস আমাকেই ব্যঙ্গ করে চলে গেল। আর হাজার হাজার বিদেহী মানুষের নিঃশব্দ আর্তনাদে ভারী চরাচর ছেড়ে আমি প্রকৃতই নিজের কাছ থেকে পালাতে চাইছিলাম।

যাক্‌ পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতের কম্যুনিষ্টদের ইতিহাস লিখতে বা বলতে চাইনা। তবে শিরোনাম যেহেতু "পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থী"আমি ক্রমশঃ এই বঙ্গের তাদের শাসনে ফিরে আসবো। অবশ্য ভারতে কম্যুনিষ্টদের মধ্যে বঙ্গীয়রা একাই প্রায় ৮০ শতাংশ। ফলে-----। (ক্রমশঃ)


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.