আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নোয়াখালীতে নেই নোয়াখালী



অবিভক্ত ভারতবর্ষে তখন ইংরেজ শাসন। ১৮৮২ সালের ২৩ মার্চ। ইংরেজ গভর্নর দ্বিতীয় হেস্টিংস ভুলুয়া রাজ্যের ১৩টি পরগনা নিয়ে নোয়াখালী জেলার ফরমান জারি করেন। যে স্থানের নামে সেদিন নোয়াখালীর নামকরণ সে স্থানই ছিল নোয়াখালী জেলা সদর, হেডকোয়ার্টার্স বা প্রশাসনিক কেন্দ্র। কিন্তু এখন নোয়াখালীতে নোয়াখালী নেই।

নোয়াখালী সদরের নাম মাইজদী, আর সদর থানার নাম সুধারাম। তাই নোয়াখালী জেলা সদর যেতে হলে বলতে হয় মাইজদী যাব। আর জেলা সদরে অভিযোগ বা নিরাপত্তার জন্য খুঁজে নিতে হয় সুধারাম থানা। কিন্তু কেন নোয়াখালীতে নোয়াখালী নেই, তা খুঁজে নিতে হয় স্থানীয় ইতিহাস ও সাহিত্যের কাছে। লোকমুখে শুনতে হয় ভাঙাগড়ার নানা কাহিনী।

অসংখ্য খাল আর মেঘনাবাহিত এ জেলার সবাই জানেন এ প্রবচন : ‘হাট-বাজার নদী-খাল/নারিকেল সুপারি তাল ভাঙা-গড়া চোরাবালি/নাম তার নোয়াখালী। ’ দেশের দক্ষিণাঞ্চলে বঙ্গোপসাগরের কোলঘেঁষে মেঘনাবক্ষের জনপদ ‘নোয়াখালী’র এ পরিচয় লোকমুখে চালু আছে সুদূর অতীত থেকেই। নদীবিধৌত এ জেলার সুজলা-সুফলা শস্য-শামলা উর্বর ভূমি আর মানুষের জীবনপ্রবাহের পরিচয় পাওয়া যায় এমন অসংখ্য প্রবচন, গল্প, কবিতা, গান আর উপন্যাসে। নদীর ভাঙা-গড়ার মতোই এখানকার মানুষের জীবনেও সব সময় ছিল সংগ্রামী ধাক্কা। এ জেলার মানুষের আতিথেয়তা আর ধর্মপরায়ণতার সুখ্যাতিও প্রাচীনকালের।

তাই এখানে রাজশাসক আর পর্যটকদের পদচারণার নানা ঘটনা ইতিহাস হয়ে আছে। মোগল শাসকরা দিল্লি জামে মসজিদের নকশা অনুকরণে এখানে তৈরি করেছেন বজরা শাহী জামে মসজিদ। মহাত্মা গান্ধীর আগমনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে গান্ধী আশ্রম। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম একাধিকবার সভা করেছিলেন মাইজদী শহরের হরিনারায়ণপুরে। রামের আগমন স্থান চৌমুহনীর রামতীর্থ, কমলাদীঘি ও দমদমাদীঘি নিয়ে নানা লোককাহিনীতে সমৃদ্ধ নোয়াখালীর সুখ্যাতি রয়েছে উপমহাদেশে ইসলাম ধর্ম প্রচার-প্রসারের পীঠস্থান হিসেবেও।

জানা যায়, এখানকার সংগ্রামী মানুষের বিশেষ অবদান ছিল ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামে। ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতা সংগ্রামেও এখানকার নেতৃত্ব ছিল উচ্চকণ্ঠ। ভাষা শহীদ সালাম, সার্জেন্ট জহুরুল হক, বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিন, বীর-উত্তম শাহ আলমসহ অসংখ্য গুণীজনের বীরত্বগাথায় সমৃদ্ধ নোয়াখালীর জনপদ। জানা যায়, ভুলুয়া রাজ্যের অন্তর্গত নোয়াখালীর ইতিহাস হাজার বছরের। তবে এ অঞ্চলের ফসল আহরণ, রাজস্ব আদায় এবং প্রজা নিয়ন্ত্রণের সুবিধার্থে ইংরেজ গভর্নর হেস্টিংস ১৩টি পরগনা নিয়ে নোয়াখালী জেলা গঠনের ফরমান জারি করেন।

কিন্তু যে স্থানকে কেন্দ্র করে নোয়াখালী নামকরণ হয়েছে সেটি এখন আর জেলার কেন্দ্রস্থল নেই। জানা যায়, নোয়াখালী জেলার বর্তমান কেন্দ্রস্থল মাইজদীর দক্ষিণে সোনাপুর পেরিয়ে ছিল মূল নোয়াখালী সদর। সেখানে ছিল রেসকোর্স মাঠ, ঐতিহাসিক মসজিদ, খ্রিস্টানদের বিখ্যাত গির্জা, পুলিশলাইনসহ অনেক স্থাপনা। কিন্তু মেঘনার ভাঙনে ১৯৪০ সালে হারিয়ে যায় মূল শহর ও জেলা সদর। পরে উত্তর দিকে সরিয়ে মাইজদীতে গড়ে তোলা হয় জেলা শহর।

এখানেই গড়ে ওঠে প্রশাসনিক সব কার্যালয়। আর সুধারাম থানা মর্যাদা পায় সদর থানা হিসেবে। তাই এখন দূর-দূরান্তের কেউ নোয়াখালী যেতে হলে বলতে হয় মাইজদী যাব। এদিকে একদা যে মেঘনা নোয়াখালী শহর বিলীন করেছে সে মেঘনা আবার তা ফিরিয়ে দিয়েছে চর হিসেবে। তবে সেখানে আর গড়ে ওঠেনি কোনো শহর।

নাম হয়েছে নোয়াখালী ইউনিয়ন। কিন্তু সে নোয়াখালীর খোঁজ কেউ নেয় না। বর্তমান জেলা শহরের ১৮ কিলোমিটার দক্ষিণে সেই চরেও এখন ঘনবসতি। জেগে ওঠা চরে প্রায় ৩৫ বর্গকিলোমিটার আয়তনের নোয়াখালী ইউনিয়নকে ভেঙে এখন ধর্মপুর নামে নতুন ইউনিয়নও করা হয়েছে। বর্তমানে নোয়াখালী ইউনিয়নে স্থাপিত হয়েছে নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

নোয়াখালী বেড়াতে গেলে অনেকেই এখন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস দেখতে যায়। কিন্তু সেই আদি নোয়াখালীর খবর কেউই নেয় না। জানা যায়, পুরনো সেই নোয়াখালী শহরের জেগে ওঠা চরগুলোও সরকারি মালিকানা পায়নি। সরকারের উদাসীনতায় সব জায়গাই ব্যক্তিদখলে চলে গেছে। পুরনো সেই নোয়াখালী সম্পর্কে জানতে কথা হয় নোয়াখালী ইউনিয়নের গত ১৪ বছরের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট আবদুর রহমানের সঙ্গে।

স্থানীয় বাসিন্দা অ্যাডভোকেট রহমান পুরনো সেই শহরের জন্য তার অনেক আক্ষেপের কথা জানিয়ে বললেন, ইতিহাস-ঐতিহ্য সংরক্ষণের উদ্যোগ কেউ নেয় না। তাই ঐতিহাসিক জেলা শহরটি উদ্ধার করা যায়নি। তা কেবল চর হিসেবেই তালিকায় স্থান পেয়েছে। তিনি জেলা শহর চিহ্নিত করতে অনেকবারই প্রস্তাব রেখেছিলেন বলে জানান। জেলা শহরের দক্ষিণে এখন ৫০ বর্গকিলোমিটার বিস্তীর্ণ জনপদ।

হাতিয়ার দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরে জেগেছে প্রায় দুইশ’ কিলোমিটার নতুন চর। সাগরকন্যা হয়ে জেগেছে নিঝুম দ্বীপ। চরাঞ্চলে গড়ে উঠেছে ফসলের ভাণ্ডার। বাণিজ্যিক ঝামেলামুক্ত নিরিবিলি শহর মাইজদী। নোয়াখালীর চৌমুহনী একসময়ের প্রকাশনা ব্যবসা ও সরিষার তেলের জন্য বিখ্যাত ছিল।

পুঁথিঘর চৌমুহনী সবারই পরিচিত নাম। সে সুখ্যাতি হয়তো নোয়াখালী হারাচ্ছে। কিন্তু নোয়াখালী শহর হয়ে দক্ষিণের শস্যভাণ্ডার, খরস্রোতা মেঘনা ও নিঝুম দ্বীপের চিত্রাহরিণ দেখতে সবারই একবার নোয়াখালী বেড়ানোর সাধ জাগবে। ভালো লাগবে নোয়াখালীর রাজনীতির কেন্দ্রস্থল টাউন হল মোড়ের আড্ডায়, পৌর হল, শিল্পকলা একাডেমি, শিশু একাডেমি, জেলা জামে মসজিদের ঘাট, শহীদ মিনার বা কোর্টপার্কে বসে সময় কাটাতে। একদা শান্তির জনপদ নোয়াখালীতে যদিও এখন চরদখল, টেন্ডারবাজি, খালদখল, সন্ত্রাস মাদকাসক্তি এবং গডফাদারদের নানা কাহিনী শোনা যায়, তা সত্ত্বেও জেলায় ওইসব আড্ডাস্থলে গেলে ঠিকই শোনা যাবে এ অঞ্চলের জনপ্রিয় লোকসঙ্গীত : ‘আংগো বাড়ি নোয়াখালী—রয়াল দিস্টিক ভাই, হেনী-মাইজদী-চৌমুহনী—নাম কি হুনেন নাই?’ Click This Link


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.