আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

তাঁর ক্ষুদ্রাকৃতির ছায়া ও পলায়নকারিদের পদছাপ

উন্মাদ খুলির পৃষ্ঠাগুলি

বাঁশের চোঙের মধ্যে পানি জমে ছ্যাদলার মতো হয়ে উঠেছে, তার গায়ে জমা রেখেছে সে তাঁর স্মৃতি-সম্ভার। এক টুকরো পেয়ারায় দাঁতের কামড়ও বাদ নেই, আর আছে মিহি স্পর্শের শুকানো বকুলের গন্ধ। কত দিন ভেবেছে আর না, এবার ভেঙে ফেলবে এই চোঙা, স্মৃতি-সম্ভার চোখের পাতার নিচে ঝুলিয়ে রেখে কি লাভ? শুধু শুধু পরাণের তলে হাঁসের ঝাঁক ভেসে যাওয়া দেখার কোন মানে নেই! তার’চে বুনো ফুল ভাল। তার চোখের পাতায় ভ্রমণ অনেক ভালো, ভালো আরো টিপাইমুখী বাঁধ আন্দোলনকারীদের মুখ। তেল-গ্যাস রক্ষা কমিটির মধ্যে ঢুকে মাথায় লাল ফেট্টি বেধে রাস্তার উপর রোদ হয়ে থাকা অনেক অনেক ভালো।

দেহ-মন উজাড় করে দেওয়া হে খোলা হাওয়া তোমার পেটের ভিতর আমাকে নাও, হাতে তুলে দাও কাটা রাইফেল, তীরধনুকের আগাটা আমার বদলিয়ে দাও হে নগর পুলিশ। তোমাদের দাঁতাল হাসিতে একটু খানি আমাকে ঝুলিয়ে রাখো, তারপর, ধপ্ করে ফেলে দাও রাস্তার কালো পিচে। আমি একটু নাচতে চাই। দলীয় ব্যানারে ব্যানারে ছেয়ে গেছে শহরের সমস্ত ফাঁকা জায়গা, আমার কোন জায়গা নাই, কত কবি, গল্পকার ধানের শিষে, নৌকাই গড়িয়ে পড়ছে, কাস্তে-কোদালে হুহু করে উড়তেছে, ঝরতেছে। আমাকে একটু আশ্রয় দাও ওহে কালো মানুষের চোয়াল? আমার কি কোন গতি হবে না? নাও নাও আমাকে খুবলে খুবলে গর্ত করো, টুকরো টুকরো করো, দোয়েলের শিস যদি পারো তার উপর ছড়িয়ে দাও।

তারপর, একটু বলো, নাচো হে বন পালোয়ান! এইসব তাঁর ভাবনার মধ্যে উথলে ওঠে। আর বুকটা হু হু করে ওঠে। হাতের মুঠোর ভিতর উড়ে আসে মেঘ সুন্দর। দিগন্ত ঘেষা শাদা সিংহদের কেশোর দুলানো ছায়া এসে ঘাড়ের উপর নিঃশ্বাস ফেলে। আর সে চুপ হয়ে নিজের ভিতর সেধিয়ে যেতে থাকে, চোখের সামনে পুকুর ঘাটের লাল পাগুলো কালো পাগুলো স্পষ্ট স্পষ্ট হতে হতে আবার মিলিয়ে যাই দিগন্তের শাদাতে।

সে আরো গুটিয়ে নেই নিজের ভিতর নিজেকে। মাঠের রোদের মধ্য পিছনের দিকে তাকালেই খুলে পড়ে স্মৃতির ন্যাপথোলিন। ছড়িয়ে পড়ে তার ঘ্রাণ সামনে, ডানে ও বামে। তখন আর প্রবাহমান থাকে না দেহভরা আগুনের হলকা। থেমে থাকে।

ঊর্ধ্বমুখীন চিন্তার বাঁকগুলো শক্ত বাহুর মতোন পাক খেতে খেতে মিশে যেতে থাকে সেই শাদা দিগন্তের সিংহের কেশোরে। বুকের ভিতর লোমকূপের অন্দর মহলে ছলকে ছলকে ওঠে শিহরণ। যত বাড়ে এই শিহরণের গতি ততই ছোট হতে থাকে তাঁর ছায়া। ছোট হতে হতে মিশে যেতে থাকে মাটির নোলকে। নোলকে মিশে গেলে তাঁর আনন্দ লাগে।

পুরনো ঘড়ার গলায় কখনো কখনো নকশা হয়ে ঝুলে থাকে আর ঝুলে থেকেই সে সব দেখতে পছন্দ করে। ডুমুর গাছের তল থেকে অনেক পোকা-মাকড়ের শব্দ ভেসে এসে তাঁর কানের কাছে ফিস ফিস করে বলে, কেমন আছো? এসময় সে কোন কথা বলতে পারে না। শুধু চুপ করে থাকে। তাদেরকে নকশার দাগে তুলে এনে স্পর্শ করে, আঙুলের সমস্ত রোদপুকুর ভরে ওঠে উষ্ণ হাঁসে। তবু কিরকম এক বেদনার মতোন অনুভূতি সারা দেহজুড়ে গভীর রাতের বৃষ্টিভেজা শব্দের ঢেউ হয়ে উপরের দিকে ওঠে আবার নিচের দিকে নামে, তখন মনে হয় সবুজ প্রান্তরের ভিতর দাঁড়িয়ে আছে যেন কেউ একজন, তাঁর জন্য সেও দাঁড়িয়ে আছে, মনে হয় হলুদ ক্ষেতের মধ্যে পালক থেকে খসে পড়া সময় সে, হাসির শব্দ দূর থেকে ভাসতে ভাসতে কাছে আসে, পায়ের পাতার কাছে কিছুক্ষণ থেকে আবার উড়ে যায়।

এমনি এমনি বাম হাত ডান হাতের ভেতর আঙুলগুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করে, সমুদ্র ঢেউয়ের মতোন মনের মধ্যে কে যেন উঁকি দিয়েই আবার মিলিয়ে যায়, অথৈ পানিতে। তখন কেমন এক আকষর্ণ অনুভবের রূপের সাথে এক হয়ে যায়, মায়া লাগে। মনে হয়, কাছের কেউ দূরে গিয়ে বহুদিন পর ফিরে এসেছে। তাঁর সকল দৃশ্যে মনে হয় মেঘ হয়ে যায়। এরকম তৃষ্ণার গান ভাসলে পরিত্যক্ত মনোভূমিতে চারা গাছের পাতায় অনেক রোদ জমে।

তারপর গভীর আলিঙ্গনে ঝরতে থাকে তাদের সুর, দেহসুরার পাত্র উপচিয়ে যেতে চায়। আর সেইসাথে উড়ে যায় তাদের গ্রাম পুরনো ছ্যাদলা ধরা পোস্ট কার্ডের পৃষ্ঠার মতোন। তার ধারণ ক্ষমতা উপচে পড়ছে দিন দিন,নানা পরিবর্তনের হাওর গিলে খাচ্ছে আগের সবকিছু, কিছু কিছু খেয়ে ফেলেছে। হলুদ এলিটের টাই দ্বারা নির্মিত দারিদ্র্য রেখার নিচে শুয়ে থাকা মৃত্তিকার সরল মানুষেরা এখন প্রতিদিন ভিড় করছে শহরে। শ্যামল শস্যের গা বেয়ে বেয়ে ঝরে পড়া শিশিরের মতোন তাদের মন বিজ্ঞাপনের ঘোড়ায় চড়ে দিকবিদ্বিক ছুটছে টাকার জন্যে।

টাকা এখন সব কিছুর মান দন্ডরুপে বিরাজমান,টাকার গন্ধে মানুষ এখন ঘুমিয়ে থাকে,জাগে,প্রেম ভালবাসা সব টাকার দখলে চলে গেছে,তারপরও সে,এর বিপরীতে নিজের শামুক স্বভাবের গহীন অরণ্যে ডুবে আছে,সে শহরে প্রথমে যে দিন পা দিয়েছে,সেদিনই সে টের পেয়েছে,এখানে সে নিছক আগন্তক। একা। উদ্ভ্রান্ত। নিজের সঙ্গেই নিজের বোঝা পড়া করতে হবে,এ জাগাতে সে বা তাঁর চৌদ্দ গোষ্ঠীর কেউই আগে কখনও আসেনি, বা তাদের কারো সাথেই শহরের অন্য বা অপরের সঙ্গে কোন রকমের সংযোগ বা সংযুক্ততা নেই,সেই প্রথম। কেমন আলুথালু,উদ্ভ্রান্তভাবে সে শহরে এসে শহরের হাবভাব পুরোপুরি আস্তস্থ করতে পারে নি এখনো।

কারণ,সে যে জীবন পদ্ধতির ভিতর দিয়ে বড় হয়েছে বংশ পরম্পরায়,সে জীবন পদ্ধতির সাথে এখানকার জীবন পদ্ধতির কোন মিল নেই,সবই অমিল গোলমেলে কেমন ধাঁধার মত ঠেকে। সে যেভাবে বড় হয়েছে বংশ পরম্পরায় যৌথতার ভিতর দিয়ে তা সে তাঁর ভাবনার ছহি স্বরূপ মনে করে। এজন্য সে তাঁর জীবন যাপনের প্রক্রিয়াটাকে খুবই গুরূত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে এবং সে অনুযায়ি চলাফেরা করার চেষ্টা করে। যদিও সে হোচট খেতে খেতে বেড়ে উঠছে,শিশুর মত হাটা শিখছে,তারপরও সব কিছুই দেখছে সে ভাবের মধ্যে থেকে,ভাবই তাঁর কাছে আসল তছবি দানা। তাই সে তাঁর স্বভাবের দরোজা জানালা সব সময় বন্ধ রেখে স্বতন্ত্র থাকতে চাই,যাতে অন্যভাব ফাট করে ঢুকে না পড়ে এই ভয়ে।

শহরে আসার পরে যার যার সাথে তাঁর পরিচয় ঘটেছে তারা সব তাঁর মতো পরিবার থেকেই এসেছে,তবে পার্থক্য আছে,তা হলো তাদের এখানে আসার আগে পরিবারের কেউ না কেউ এসেছে,গেড়ে বসেছে কোন না কোন ভাবে। শহরের পাঠ শিক্ষা নিয়ে ফিট হয়ে গেছে শহরের হালচালের সঙ্গে। সে তাই অনেকটা এক ঘরে,একলা একলা থাকে। তাঁর গায়ে এখনো মাটির গন্ধ, ফসলের গন্ধ। সে যেভাবে বেঁচে আছে ,সেভাবে, সে বেঁচে থাকতে চাই না, কিন্ত বেঁচে থাকার ভঙ্গিটাকে বদলাতেও পারে না।

এই নিয়ে সে নিজের সঙ্গে অবিরত যুদ্ধ করে যাচ্ছে, জীবন টাকে বদলাতে চাচ্ছে নিজের মতো করে। সে অন্য যে কোন ব্যক্তি থেকে আলাদা, প্রত্যেক ব্যক্তিই তাই, সমাজের কোন ব্যক্তির সাথে কোন ব্যক্তির পুরোপুরি মিল নেই, স্বভাবে- আচরণে, কারণ সবার বেড়ে ওঠা একই রকম না-সাংস্কৃতিক বোধও অভিন্ন নয়। সে, পথে চলতে চলতে এই সব নিয়ে গভীর ভাবে ভাবে, এর ফলে তাঁর ভাবনায় অগনিত মানুয়ের মুখমণ্ডল ঝাপসা হতে হতে একসময় নিজের মুখের মতো ঠেকে আর তখনি কুয়াশার জালে সমস্ত স্বপ্ন এসে জড়ো হয় মিছিলের ভঙ্গিমায়, অজস্র সাপের ফণার মত স্বপ্নেরা শহরের পথে পথে দিকহীনভাবে ঘুরতে থাকে, এ সময় তাঁর শ্যামল ছায়ার মত নরম চেতনার নানা অনুষঙ্গগুলি একটা আলাদা রীতি ব্যবস্থার রূপ নেয়, যা, তাঁর কাছে সরল জীবন যাপনের আসল প্রক্রিয়ার মতো মনে হয়, যৌথতার মত ঠেকে। শহরের কুটিল জীবন যাপনের পদ্ধতির বিপরীতে-এরকমভাবে সে, আলাদা একটা ভঙ্গিমা তৈরি করতে চাই নিজের মতো করে, যা একদম তার নিজের মতো হবে, নিজের মন মতো, যার মধ্যে নিজের জগৎ চেনাজানা সব পরিবেশ ভাব ভাষা একাকার হয়ে থাকবে, যার ভিতর নিজের চেতনকে অবলোকন করতে পারবে, ভুলগুলো শুধরে নেবে, র্সূযের আলোর মতো বোধের জলে স্বপ্নের পায়রাগুলো উড়ে বেড়াবে আর রাক্ষস পুরির সব দরোজাগুলির রিমোট কন্ট্রোল তাঁর হাতের মুঠোয় থাকবে। এই রকম তাঁর ইচছা, এই মত সে নিজে পোষণ করে, সাথে সাথে সে ভাবে এই মত সকলের মত হয়ে উঠুক তা সে চাই, তবে তা চাপিয়ে দিয়ে নয়, তা যেন সবার চেতনার মনোনিবেশে দোহার মতো মনে হয় এই সে মনে মনে চিন্তা করে।

সেই সাথে সে ভাবে তাঁর মতো কেউ কেউ তো আছে, তাদের রূপও তাঁর মতো গানও তাঁর মতো সব ভাল বাসা তবে তাঁর মতো হবে। এই প্রকল্প তাঁর মনে সে গেঁথে রাখে আর ভাবতে থাকে ভাবের মধ্যে থেকে। আর তাঁর ভঙিমার ভিতরে যে যে প্রেম ভজনা রূপ রতনের মানভঙ্গি জগৎ পরিভ্রমণে আছে তার মতো রসের আধার সাইঁজির চরণে বাজে, সে বাজনার ভিতর জগতের সমস্তসুবিবেচনা সাম্য ধর্মের গান হয়ে ওঠে আর সাইঁজির মনের মতো যে জীবন সে চাই; সে জীবন পদ্ধতির রূপ ওই গানের স্বরের ভিতর বিরাজিত, তা, এই জামানার সকলকে সে জানিয়ে দিতে চায়, তা যেন সকলকে জানিয়ে দেয় সে জীবনের মনের মত গান জীবন ভরে তোলে ভাবের মধ্যে থেকে, সে গানের ভাবের মধ্যে যেন গাঙচিল ওড়ে, ঘুঘু পাখির ডাক যেন থাকে, তা সে মনে প্রাণে চায়, আর গানের বাতাসের মধ্যে যে সমস্ত প্রাণ উজাড় করা ভাব আছে তা যেন গভীর বনের মধ্যে অসংখ্য পাখির মধুর কলতান হয়, এই সে ভাবে, আর দেহ কাঠের ঘরের জানালায় যে যে মারফতি রঙ যে যে গানের কলি কলতানে মেতে থাকে, তাদের মন পবনের আসল রূপ নারীর মত আদি ছহি-এই ভাব সে বুকে ধরে আছে বংশ পরম্পরায়, তা গুহাকালের সোনা ঝরা সকালের আভার মত সম্প্রসারিত কৌম সমাজের দেহে পরিবাহিত; মাছের কাটার প্রতি বিড়ালের থাবার মতো অন্ধকার, কোটি বছরের হরমোনের ন্যায়। তাঁর মন কাঞ্চন গুহা রাত্রির স্বপ্নীল চিলের-ডানার লাবণ্য ছড়ায়। আর তাঁর ক্ষুদ্রাকৃতির ছায়া ও পলায়নকারিদের পদছাপে ভাসতে থাকে শহরের সব খুকুমণি...


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.