আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

রূপসী বাংলা : জীবনানন্দ দাশ

বাস্তবতা ফেরী করে বেড়াচ্ছে আমার সহজ শর্তের সময়গুলোকে

তাকে বলা হয় রূপসী বাংলার কবি, বলা হয় নির্জনতার কবি, বাংলা সাহিত্যের শুদ্ধতম কবিও বলা হয়। তবে রূপসী বাংলার কবি নামেই তিনি বেশি পরিচিত। জীবনানন্দ দাশ , যিনি কবিতায় পঙক্তিতে উঠিয়ে এনেছেন বাংলার রূপকে। বলেছিলেন উপমাই কবিত্ব। বহুমুখী উপমায় বাংলার চিরায়ত রূপকে কে আঁকতে পেরেছে তারচেয়ে বেশি? জীবনানন্দ দাশের (১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৯ দ্র. কবির স্ত্রী লাবণ্য দাশ এর মতে কবির জন্মসাল ১৮৯৮-২২ অক্টোবর ১৯৫৪) জীবদ্দশায় মাত্র সাতটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল।

পরবর্তীতে দেখা যায় কবির আরো বহু কবিতা অপ্রকাশিত। কবির মৃত্যুর পর আরো বেশ কিছু কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। প্রকাশিত হয় কবির লেখা প্রবন্ধ, ছোটগল্প, উপন্যাস। ‘রূপসী বাংলা’ কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হয় কবির মৃত্যুর পর। প্রকাশসময় ১৯৫৭ এর আগষ্ট।

কবিভ্রাতা অশোকানন্দ দাশের সরাসরি তত্ত্বাবধানে কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। রূপসী বাংলা’র রচনাকাল ১৯৩২। জীবনানন্দ দাশ রূপসী বাংলা’র কবিতাগুলো ছিল শিরোনামহীন। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে কাব্যগ্রন্থটির প্রতিটি কবিতার শিরোনাম প্রথম পঙক্তির প্রথমাংশ থেকে থেকে। ধারনা করা হয় রূপসী বাংলা কাব্যগ্রন্থের নামকরণ এবং উৎসর্গ অশোকানন্দের।

‘রূপসী বাংলা’ প্রকাশের সময় অশোকানন্দ দাশ স্বাক্ষরিত (৩১ জুলাই ১৯৫৭) ভূমিকাটি উদ্ধৃত হলো- এই কাব্যগ্রন্থে যে কবিতাগুলি সংকলিত হল, তার সবগুলিই কবির জীবিতকালে অপ্রকাশিত ছিল; তাঁর মৃত্যুর পরে কোনো-কোনো কবিতা বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। কবিতাগুলি প্রথমবারে যেমন লেখা হয়েছিল, ঠিক তেমনই পান্ডুলিপিবদ্ধ অবস্থায় রক্ষিত ছিল; সম্পূর্ণ অপরিমার্জিত। পঁচিশ বছর আগে খুব পাশাপাশি সময়ের মধ্যে একটি বিশেষ ভাবাবেগে আক্রান্ত হয়ে কবিতাগুলো রচিত হয়েছিল। এসব কবিতা “ধূসর পান্ডুলিপি” পর্যায়ের শেষের দিকের ফসল। কবির কাছে ‘এরা প্রত্যেকে আলাদা আলাদা, স্বতন্ত্র সত্তার মতো নয় কেউ, অপরপক্ষে সার্বিক বোধে একশরীরী; গ্রামবাংলার আলুলায়িত প্রতিবেশ-পৃসৃতির মতো ব্যাস্টিগত হয়েও পরিপূরকের মতো পরস্পরনির্ভর।

...’ একনজরে রূপসী বাংলা প্রথম প্রকাশ : আগস্ট ১৯৫৭। প্রকাশক : সিগনেট প্রেস। আকার ডিমাই, ৮+৬২ পৃষ্ঠা। প্রচ্ছদশিল্পী : সত্যজিৎ রায়। মূল্য : তিন টাকা।

উৎসর্গ : ‘আবহমান বাংলা- বাঙালী’। সূচিপত্র- ১. সেইদিন এই মাঠ ২. তোমরা যেখানে সাধ ৩. বাংলার মুখ আমি ৪. যতদিন বেঁচে আছি ৫. একদিন জলসিড়ি ৬. আকাশে সাতটি তারা ৭. কোথাও দেখিনি, আহা ৮. হায় পাখি, একদিন ৯. জীবন অথবা মৃত্যু ১০. যেদিন সরিয়া যাব ১১. পৃথিবী রয়েছে ব্যস্ত ১২. ঘুমায়ে পড়িব আমি ১৩. ঘুমায়ে পড়িব আমি একদিন ১৪. যখন মৃত্যুর ঘুমে ১৫. আবার আসিব ফিরে ১৬. যদি আমি ঝরে যাই ১৭. মনে হয় একদিন ১৮. যে শালিখ ম’রে যায় ১৯. কোথাও চলিয়া যাবো ২০. তোমার বুকের থেকে ২১. গোলপাতা ছাউনীর ২২. অশ্বত্থে সন্ধ্যার হাওয়া ২৩. ভিজে হয়ে আসে মেঘে ২৪. খুঁজে তারে মরো মিছে ২৫. পাড়াগাঁর দু’পহর ২৬. যখন সোনার রোদ ২৭. এই পৃথিবীতে এক ২৮. কত ভোরে দু’পহরে ২৯. এই ডাঙা ছেড়ে হায় ৩০. এখানে আকাশ নীল ৩১. কোথাও মাঠের কাছে ৩২. চ’লে যাব ৩৩. এখানে ঘুঘুর ডাকে ৩৪. শ্মশানের দেশে তুমি ৩৫. তবু তাহা ভুল জানি ৩৬. সোনার খাঁচার বুকে ৩৭. কত দিন সন্ধ্যার ৩৮. এ-সব কবিতা আমি ৩৯. কত দিন তুমি আর ৪০. এখানে প্রাণের স্রোত ৪১. একদিন যদি আমি ৪২. দূর পৃথিবীর গন্ধে ৪৩. অশ্বত্থ বটের পথে ৪৪. ঘাসের বুকের থেকে ৪৫. এই জল ভালো লাগে ৪৬. একদিন পৃথিবীর ৪৭. পৃথিবীর পথে আমি ৪৮. মানুষের ব্যথা আমি ৪৯. তুমি কেন বহু দূরে ৫০. আমাদের রূঢ় কথা ৫১. এই পৃথিবীতে আমি ৫২. বাতাসে ধানের শব্দ ৫৩. একদিন এই দেহ ৫৪. আজ তারা কই সব ৫৫. হৃদয়ে প্রেমের দিন ৫৬. কোনোদিন দেখিব না ৫৭. ঘাসের ভিতরে যেই ৫৮. এইসব ভালো লাগে ৫৯. সন্ধ্যা হয় ৬০. একদিন কুয়াশার ৬১. ভেবে ভেবে ব্যাথা পাব ২২ অক্টোবর ১৯৫৪, শুক্রবার, রাত ১১-৩৫। রূপসী বাংলার কবির মৃত্যু হয়। এ মৃত্যু কবির চেতনাকে নিভিয়ে দিতে পারে নি। কবিতায় কবি বারবার ফিরে আসেন জলসিড়ি নদীটির তীরে।

৫৫তম মৃত্যুদিবসে কবির প্রতি অনেক শ্রদ্ধাঞ্জলি। প্রিয় কবির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ‘রূপসী বাংলা’ কাব্যগ্রন্থটি অনলাইনে তোলা হলো । রূপসী বাংলা ০১. সেই দিন এই মাঠ সেই দিন এই মাঠ স্তব্ধ হবে নাকো জানি- এই নদী নক্ষত্রের তলে সেদিনো দেখিবে স্বপ্ন- সোনার স্বপ্নের সাধ পৃথিবীতে কবে আর ঝরে! আমি চ’লে যাব ব’লে চালতাফুল কি আর ভিজিবে না শিশিরের জলে নরম গন্ধের ঢেউয়ে ? লক্ষ্ণীপেঁচা গান গাবে নাকি তার লক্ষ্ণীটির তরে ? সোনার স্বপ্নের সাধ পৃথিবীতে কবে আর ঝরে! চারিদিকে শান্ত বাতি- ভিজে গন্ধ- মৃদু কলরব; খেয়ানৌকাগুলো এসে লেগেছে চরের খুব কাছে; পৃথিবীর এই সব গল্প বেঁচে র’বে চিরকাল ;- এশিরিয়া ধুলো আজ – বেবিলন ছাই হয়ে আছে। ০২. তোমরা যেখানে সাধ তোমরা যেখানে সাধ চ’লে যাও- আমি এই বাংলার পারে র’য়ে যাব ; দেখিব কাঁঠালপাতা ঝরিতেছে ভোরের বাতাসে; দেখিব খয়েরি ডানা শালিখের সন্ধ্যায় হিম হয়ে আসে ধবল রোমের নিচে তাহার হলুদ ঠ্যাং ঘাসে অন্ধকারে নেচে চলে- একবার- দুইবার- তারপর হঠাৎ তাহারে বনের হিজল গাছ ডাক দিয়ে নিয়ে যায় হৃদয়ের পাশে; দেখিব মেয়েলি হাত সকরুণ- শাদা শাঁখা ধূসর বাতাসে শঙ্খের মতো কাঁদে : সন্ধ্যায় দাঁড়াল সে পুকুরের ধারে, খইরঙা হাঁসটিরে নিয়ে যাবে যেন কোন কাহিনীর দেশে- ‘পরণ- কথা’র গন্ধ লেগে আছে যেন তার নরম শরীরে, কলমীদামের থেকে জন্মেছে সে যেন এই পুকুরের নীড়ে- নীরবে পা ধোয় জলে একবার- তারপর দূরে নিরুদ্দেশে চ’লে যায় কুয়াশায়,- তবু জানি কোনোদিন পৃথিবীর ভিড়ে হারাব না তারে আমি- সে যে আছে আমার এ বাংলার তীরে। ০৩. বাংলার মুখ আমি বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই আমি পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে যাই না আর : অন্ধকারে জেগে উঠে ডুমুরের গাছে চেয়ে দেখি ছাতার মতন বড়ো পাতাটির নিচে ব’সে আছে ভোরের দয়েলপাখি- চারিদিকে চেয়ে দেখি পল্লবের স্তূপ জাম- বট- কাঁঠালের- হিজলের অশথের ক’রে আছে চুপ; ফণীমনসার ঝোপে শটিবনে তাহাদের ছায়া পড়িয়াছে! মধুকর ডিঙা থেকে না জানি সে কবে চাঁদ চম্পার কাছে এমনই হিজল- বট- তমালের নীল ছায়া বাংলার অপরূপ রূপ দেখেছিল : বেহুলাও একদিন গাঙুড়ের জলে ভেলা নিয়ে- কৃষ্ণা দ্বাদশীর জ্যোস্না যখন মরিয়া গেছে নদীর চড়ায়- সোনালি ধানের পাশে অসংখ্য অশ্বথ বট দেখেছিল, হায়, শ্যামার নরম গান শুনেছিল- একদিন অমরায় গিয়ে ছিন্ন খঞ্জনার মতো যখন সে নেচেছিল ইন্দ্রের সভায় বাংলার নদী মাঠ ভাঁটফুল ঘুঙুরের মতো তার কেঁদেছিল পায়।

০৪. যতদিন বেঁচে আছি যতদিন বেঁচে আছি আকাশ চলিয়া গেছে কোথায় আকাশে অপরাজিতার মতো নীল হয়ে- আরো নীল- আরো নীল হয়ে আমি যে দেখিতে চাই;- সে আকাশ পাখনায় নিঙড়ায়ে লয়ে কোথায় ভোরের বক মাছরাঙা উড়ে যায় আশ্বিনের মাসে; আমি যে দেখিতে চাই,-আমি যে বসিতে চাই বাংলার ঘাসে; পৃথিবীর পথে ঘুরে বহুদিন অনেক বেদনা প্রাণে স’য়ে ধানসিড়িটির পথে বাংলার শ্মশানের দিকে যাব ব’য়ে, যেইখানে এলোচুলে রামপ্রসাদের সেই শ্যামা আজো আসে, যেইখানে কল্কাপেড়ে শাড়ি প’রে কোন এক সুন্দরীর শব জন্দন চিতায় চড়ে- আমের শাখায় শুক ভুলে যায় কথা; যেইখানে সবচেয়ে বেশি রূপ- সবচেয়ে গাঢ় বিষণ্ণতা; যেখানে শুকায় পদ্ম- বহু দিন বিশালাক্ষী যেখানে নীরব; যেইখানে একদিন শঙ্খমালা চন্দ্রমালা মানিককুমার কাঁকন বাজিত, আহা, কোনোদিন বাজিবে কি আর ! ০৫. একদিন জলসিড়ি নদীটির একদিন জলসিড়ি নদীটির পারে এই বাংলার মাঠে বিশীর্ণ বটের নিচে শুয়ে রবো; পশমের মতো লাল ফল ঝরিবে বিজন ঘাসে,- বাঁকা চাঁদ জেগে র’বে- নদীটির জল বাঙালি মেয়ের মতো বিশালাক্ষী মন্দিরের ধূসর কপাটে আঘাত করিয়া যাবে ভয়ে ভয়ে- তারপর যেই ভাঙা ঘাটে রূপসীরা আজ আর আসে নাকো, পাট শুধু পচে অবিরল, সেইখানে কলমীর দামে বেঁধে প্রেতিনীর মতন কেবল কাঁদিবে সে সারা রাত,- দেখিবে কখন কারা এসে আমকাঠে সাজায়ে রেখেছে চিতা; বাংলার শ্রাবণের বিস্মিত আকাশ চেয়ে র’বে; ভিজে পেঁচা শান্ত স্নিগ্ধ চোখ মেলে কদমের বনে শোনাবে লক্ষ্ণীর গল্প- ভাসানের গান নদী শোনাবে নির্জনে; চারিদিকে বাংলার ধানী শাড়ি- শাদা শাঁখা- বাংলার ঘাস আকন্দ বাসকলতা ঘেরা এক নীল মঠ-আপনার মনে ভাঙিতেছে ধীরে ধীরে;- চারিদিকে এইসব আশ্চর্য উচ্ছ্বাস- ০৬. আকাশে সাতটি তারা আকাশে সাতটি তারা যখন উঠেছে ফুটে আমি এই ঘাসে ব;সে থাকি; কামরাঙা- লাল মেঘ যেন মৃত মনিয়ার মতো গঙ্গাসাগরের ঢেউয়ে ডুবে গেছে- আসিয়াছে শান্ত অনুগত বাংলার নীল সন্ধ্যা- কেশবতী কন্যা যেন এসেছে আকাশে : আমার চোখের ’পরে আমার মুখের ’পরে চুল তার ভাসে; পৃথিবীর কোনো পথ এ কন্যারে দেখেনিকো- দেখি নাই অত অজস্র চুলের চুমা হিজলে কাঁঠালে জামে ঝরে অবিরত, জানি নাই এত স্নিগ্ধ গন্ধ ঝরে রূপসীর চুলের বিন্যাসে পৃথিবীর কোন পথে : নরম ধানের গন্ধ- কলমীর ঘ্রাণ, হাঁসের পালক, শর, পুকুরের জল, চাঁদা সরপুঁটিদের মৃদু ঘ্রাণ, কিশোরীর চাল-ধোয়া ভিজে হাত- শীত হাতখান, ব্যথিত গন্ধের ক্লান্ত নীরবতা- এরি মাঝে বাংলার প্রাণ : আকাশে সাতটি তারা যখন উঠেছে ফুটে আমি পাই টের। ০৭. কোথাও দেখিনি কোথাও দেখিনি, আহা, এমন বিজন ঘাস- প্রান্তরের পারে নরম বিমর্ষ চোখে চেয়ে আছে- নীল বুকে আছে তাহাদের গঙ্গাফড়িংয়ের নীড়, কাঁচপোকা, প্রজাপতি, শ্যামপোকা ঢের, হিজলের ক্লান্ত পাতা- বটের অজস্র ফল ঝরে বারেবারে তাহাদের শ্যাম বুকে;- পাড়াগাঁর কিশোরেরা যখন কান্তারে বেতের নরম ফল, নাটাফল খেতে আসে ধুন্দল বীজের খোঁজ করে ঘাসে ঘাসে, - বক তাহা জানে নাকো, পায় নাকো টের শালিখ খঞ্জনা তাহা;- লক্ষ লক্ষ ঘাস এই নদীর দু’ধারে নরম কান্তারে এই পাড়াগাঁর বুকে শুয়ে সে কোন্ দিনের কথা ভাবে; তখন এ জলসিড়ি শুকায়নি, মজেনি আকাশ, বল্লাল সেনের ঘোড়া- ঘোড়ার কেশর ঘেরা ঘুঙুর জিনের শব্দ হ’ত এই পথে- আরো আগে রাজপুত্র কত দিন রাশ টেনে টেনে এই পথে- কি যেন খুঁজেছে, আহা, হয়েছে উদাস; আজ আর খোঁজাখুঁজি নাই কিছু- নাটাফলে মিটিতেছে আশ- ০৮. হায় পাখি, একদিন হায় পাখি, একদিন কালীদহে ছিলে না কি- দহের বাতাসে আষাঢ়ের দু’- পহরে কলরব করনি কি এই বাংলায়! আজ সারাদিন এই বাদলের কোলাহলে মেঘের ছায়ায় চাঁদ সদাগর : তার মধুকর ডিঙাটির কথা মনে আসে, কালীদহে কবে তারা পড়েছিল একদিন ঝড়ের আকাশে,- সেদিনো অসংখ্য পাখি উড়েছিল না কি কালো বাতাসের গায়, আজ সারাদিন এই বাদলের জলে ধলেশ্বরীর চড়ায় গাংশালিখের ঝাঁক, মনে হয়, যেন সেই কালীদহে ভাসে : এইসব পাখিগুলো কিছুতেই আজিকার নয় যেন- নয়- এ নদীও ধলেশ্বরী নয় যেন- এ আকাশ নয় আজিকার : ফনীমনসার বনে মনসা রয়েছে না কি?- আছে; মনে হয়, এই নদী কি কালীদহ নয়? আহা, ঐ ঘাটে এলানো খোঁপার সনকার মুখ আমি দেখি না কি ? বিষণ্ণ মলিন ক্লান্ত কি যে সত্য সব;- তোমার এ স্বপ্ন সত্য, মনসা বলিয়া গেল নিজে। ০৯. জীবন অথবা মৃত্যু জীবন অথবা মৃত্যু চোখে র’বে- আর এই বাংলার ঘাস র’বে বুকে; এই ঘাস : সীতারাম রাজারাম রামনাথ রায়- ইহাদের ঘোড়া আজো অন্ধকারে এই ঘাস ভেঙে চ’লে যায়- এই ঘাস : এরি নিচে কঙ্কাবতী শঙ্খমালা করিতেছে বাস: তাদের দেহের গন্ধ, চাঁপাফুল-মাখা স্নান চুলের বিন্যাস ঘাস আজো ঢেকে আছে; যখন হেমন্ত আসে গৌড় বাংলায় কার্তিকের অপরাহ্ণে হিজলের পাতা শাদা উঠানের গায় ঝ’রে পড়ে, পুকুরের ক্লান্ত জল ছেড়ে দিয়ে চ’লে যায় হাঁস, আমি এ ঘাসের বুকে শুয়ে থাকি- শালিখ নিয়েছে নিঙড়ায়ে নরম হলুদ পায়ে এই ঘাস; এ সবুজ ঘাসের ভিতরে সোঁদা ধুলো শুয়ে আছে- কাঁচের মতন পাখা এ ঘাসের গায়ে ভেরেন্ডাফুলের নীল ভোমরারা বুলাতেছে- শাদা স্তন ঝরে করবীর : কোন এক কিশোরী এসে ছিঁড়ে নিয়ে চ’লে গেছে ফুল, তাই দুধ ঝরিতেছে করবীর ঘাসে ঘাসে : নরম ব্যাকুল। ১০. যেদিন সরিয়া যাব যেদিন সরিয়া যাব তোমাদের কাছ থেকে- দূর কুয়াশায় চ’লে যাব, সেদিন মরণ এসে অন্ধকারে আমার শরীর ভিক্ষা ক’রে লয়ে যাবে;- সেদিন দু’দন্ড এই বাংলার তীর- এই নীল বাংলার তীরে শুয়ে একা একা কি ভাবিব, হায়;- সেদিন র’বে না কোনো ক্ষোভ মনে- এই সোঁদা ঘাসের ধূলায় জীবন যে কাটিয়াছে বাংলায়- চারিদিকে বাঙালির ভিড় বহু দিন কীর্তন ভাসান গান রূপকথা যাত্রা পাঁচালীর নরম নিবিড় ছন্দে যারা আজো শ্রাবণের জীবন গোঙায়, আমারে দিয়েছে তৃপ্তি; কোনো দিন রূপহীন প্রবাসের পথে বাংলার মুখ ভুলে খাঁচার ভিতরে নষ্ট শুকের মতন কাটাইনি কাটা হয়ে গেলে মাঠে মাঠে কত বার কুড়ালাম খড়, বাধিঁলাম ঘর এই শ্যামা আর খঞ্জনার দেশ ভালোবেসে, ভাসানের গান শুনে কত বার ঘর আর খড় গেল ভেসে মাথুরের পালা বেঁধে কত বার ফাঁকা হ’ল খড় আর ঘর। ১১. পৃথিবী রয়েছে ব্যস্ত পৃথিবী রয়েছে ব্যস্ত কোন্‌খানে সফলতা শক্তির ভিতর, কোন্‌খানে আকাশের গায়ে রূঢ় মনুমেন্ট উঠিতেছে জেগে, কোথায় মাস’ল তুলে জাহাজের ভিড় সব লেগে আছে মেঘে, জানি নাকো, আমি এই বাংলার পাড়াগাঁয়ে বাধিঁয়াছি ঘর: সন্ধ্যায় যে দাঁড়কাক উড়ে যায় তালবনে- মুখে দুটো খড় নিয়ে যায়-সকালে যে নিমপাখি উড়ে আসে কাতর আবেগে নীল তেঁতুলের বনে- তেমনি করুণা এক বুকে আছে লেগে; বইচির মনে আমি জোনাকির রূপ দেখে হয়েছি কাতর; কদমের ডালে আমি শুনেছি যে লক্ষ্মীপেঁচা গেয়ে গেছে গান নিশুতি জ্যোৎস্না রাতে, -টুপ টুপ টুপ টুপ্‌ সারারাত ঝরে শুনেছি শিশিরগুলো –ম্লান মুখে গড় এসে করেছে আহ্বান ভাঙা সোঁদা ইটগুলো,– তারি বুকে নদী এসে কি কথা মর্মরে; কেউ নাই কোনোদিকে- তবু যদি জ্যোৎস্নায় পেতে থাক কান শুনিবে বাতাসে শব্দ : ‘ঘোড়া চড়ে কই যাও হে রায়রায়ন –’ ১২ ঘুমায়ে পড়িব আমি ঘুমায়ে পড়িব আমি একদিন তোমাদের নক্ষত্রের রাতে শিয়রে বৈশাখ মেঘ-শাদা-শাদা যেন কড়ি-শঙ্খের পাহাড় নদীর ওপার থেকে চেয়ে রবে- কোনো এক শঙ্খবালিকার ধূসর রূপের কথা মনে হবে-এই আম জামের ছায়াতে কবে যেন তারে আমি দেখিয়াছি-কবে যেন রাখিয়াছে হাতে তার হাতে- কবে যেন তারপর শ্মশান চিতায় তার হাড় ঝরে গেছে, কবে যেন; এ জনমে নয় যেন-এই পাড়াগাঁর পথে তবু তিন শো বছর আগে হয়তো বা- আমি তার সাথে কাটায়েছি; পাঁচশো বছর আগে হয়তো বা — সাতশো বছর কেটে গেছে তারপর তোমাদের আম জাম কাঁঠালের দেশে; ধান কাটা হয়ে গেলে মাঠে-মাঠে কতোবার কুড়ালাম খড়; বাঁধিলাম ঘর এই শ্যামা আর খঞ্জনার দেশ ভালোবেসে, ভাসানের গান গুনে কত বার ঘর আর খড় গেল ভেসে মাথুরের পালা বেঁধে কত বার ফাঁকা হল খর আর ঘর।

১৩. ঘুমায়ে পড়িব আমি একদিন ঘুমায়ে পড়িব আমি একদিন তোমাদের নক্ষত্রের রাতে; তখনো যৌবন প্রাণে লেগে আছে হয়তো বা — আমার তরুণ দিন তখনো হয়নি শেষ- সেই ভালো — ঘুম আসে-বাংলার তৃণ আমার বুকের নিচে চোখ বুজে-বাংলার আমের পাতাতে কাঁচপোকা ঘুমায়েছে — আমিও ঘুমায়ে রবো তাহাদের সাথে, ঘুমাব প্রাণের সাধে এই মাঠে — এই ঘাসে — কথাভাষাহীন আমার প্রাণের গল্প ধীরে-ধীরে যাবে-অনেক নবীন নতুন উৎসব রবে উজানের-জীবনের মধুর আঘাতে তোমাদের ব্যস্ত মনে; — তবুও, কিশোর, তুমি নখের আঁচড়ে যখন এ ঘাস ছিঁড়ে চলে যাবে — যখন মানিকমালা ভোরে লাল-লাল বটফল কামরাঙা কুড়াতে আসিবে এই পথে– যখন হলুদ বোঁটা শেফালি কোনো এক নরম শরতে ঝরিয়ে ঘাসের পরে, — শালিখ খঞ্জনা আজ কতো দূরে ওড়ে– কতোখানি রোদ-মেঘ — টের পাবে শুয়ে শুয়ে মরণের ঘোরে। ১৪ যখন মৃত্যুর ঘুমে যখন মৃত্যুর ঘুমে শুয়ে রবো — অন্ধকারে নক্ষত্রের নিচে কাঁঠাল গাছের তলে হয়তো বা ধলেশ্বরী চিলাইয়ের পাশে – দিনমানে কোনো মুখ হয়তো সে শ্মশানের কাছে নাহি আসে – তবুও কাঁঠাল জাম বাংলার- তাহাদের ছায়া যে পড়িছে আমার বুকের পরে — আমার মুখের পরে নীরবে ঝরিছে খয়েরী অশথপাতাত — বইচি, শেয়ালকাঁটা আমার এ দেহ ভালোবাসে, নিবিড় হয়েছে তাই আমার চিতার ছাইয়ে — বাংলার ঘাসে গভীর ঘাসের গুচ্ছে রয়েছি ঘুমায়ে আমি, — নক্ষত্র নড়িছে আকাশের থেকে দূর-আরো দূর-আরো দূর-নির্জন আকাশে বাংলার-তারপর অকারণ ঘুমে আমি পড়ে যাই ঢুলে। আবার যখন জাগি, আমা শ্মশানচিতা বাংলার ঘাসে ভরে আছে, চেয়ে দেখি,-বাসকের গন্ধ পাই-আনারস ফুলে ভোমরা উড়িছে,শুনি-গুবরে পোকার ক্ষীণ গুমরানি ভাসিছে বাতাসে রোদের দুপুর ভরে-শুনি আমি; ইহারা আমার ভালোবাসে- ১৫. আবার আসিব ফিরে আবার আসিব ফিরে ধানসিড়ির তীরে — এই বাংলায় হয়তো মানুষ নয় — হয়তো বা শঙ্খচিল শালিখের বেশে; হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন আসিব এ কাঠাঁলছায়ায়; হয়তো বা হাঁস হব — কিশোরীর — ঘুঙুর রহিবে লাল পায়, সারা দিন কেটে যাবে কলমীর গন্ধ ভরা জলে ভেসে-ভেসে; আবার আসিব আমি বাংলার নদী মাঠ ক্ষেত ভালোবেসে জলাঙ্গীর ঢেউয়ে ভেজা বাংলার এ সবুজ করুণ ডাঙায়; হয়তো দেখিবে চেয়ে সুদর্শন উড়িতেছে সন্ধ্যার বাতাসে; হয়তো শুনিবে এক লক্ষ্মীপেচাঁ ডাকিতেছে শিমুলের ডালে; হয়তো খইয়ের ধান ছড়াতেছে শিশু এক উঠানের ঘাসে; রূপসা ঘোলা জলে হয়তো কিশোর এক শাদা ছেঁড়া পালে ডিঙা রায় — রাঙা মেঘ সাঁতরায়ে অন্ধকারে আসিতেছে নীড়ে দেখিবে ধবল বক: আমারেই পাবে তুমি ইহাদের ভিড়ে – ১৬. যদি আমি ঝ’রে যাই যদি আমি ঝ’রে যাই একদিন কার্তিকের নীল কুয়াশায় যখন ঝরিছে ধান বাংলার ক্ষেতে-ক্ষেতে ম্লান চোখ বুজে, যখন চড়াই পাখি কাঁঠালীচাপাঁর নীড়ে ঠোঁট আছে গুজে, যখন হলুদ পাতা মিশিতেছে খয়েরি পাতায়, যখন পুকুরে হাঁস সোঁদা জলে শিশিরের গন্ধ শুধু পায়, শামুক গুগলিগুলো পড়ে আছে শ্যাওলার মলিন সবুজে- তখন আমারে যদি পাও নাকো লালশাক-ছাওয়া মাঠে খুঁজে, ঠেস্‌ দিয়ে বসে আর থাকি নাকো যদি বুনো চালতার গায়ে, তাহলে জানিও তুমি আসিয়াছে অন্ধকার মৃত্যুর আহ্বান- যার ডাক শুনে রাঙা রৌদ্রেরো চিল আর শালিখের ভিড় একদিন ছেড়ে যাবে আম জাম বনে নীল বাংলার তীর, যার ডাক শুনে আজ ক্ষেতে-ক্ষেতে ঝরিতেছে খই আর মৌরির ধান;- কবে যে আসিবে মৃত্যু; বাসমতী চালে-ভেজা শাদা হাতখান- রাখো বুকে, হে কিশোরী, গোরোচনারূপে আমি করিব যে ম্লান- ১৭. মনে হয় একদিন মনে হয় একদিন আকাশের শুকতারা দেখিব না আর; দেখিব না হেলেঞ্চার ঝোপ থেকে এক ঝাড় জোনাকি কখন নিভে যায়; দেখিব না আর আমি পরিচিত এই বাঁশবন, শুকনো বাঁশের পাতা-ছাওয়া মাটি হয়ে যাবে গভীর আঁধার আমার চোখের কাছে; লক্ষ্মীপূর্ণিমার রাতে সে কবে আবার পেঁচা ডাকে জ্যোৎস্নায়; হিজলের বাঁকা ডাল করে গুঞ্জরণ; সারা রাত কিশোরীর লাল পাড় চাঁদে ভাসে-হাতের কাঁকন বেজে ওঠে : বুঝিব না-গঙ্গাজল, নারকোলনাডুগুলো তার জানি না সে কারে দেবে- জানি না সে চিনি আর শাদা তালশাঁস হাতে লয়ে পলাশের দিকে চেয়ে দুয়ারে দাঁড়ায়ে রবে কি না… আবার কাহার সাথে ভালোবাসা হবে তার-আমি তা জানি না- মৃত্যুরে কে মনে রাখে?-কীর্তিনাশা খুঁড়ে খুঁড়ে চলে বারো মাস নতুন ডাঙার দিকে-পিছনের অবিরল মৃত চর বিনা দিন তার কেটে যায়- শুকতারা নিভে গেলে কাঁদে কি আকাশ? ১৮. যে শালিখ মরে যায় যে শালিখ মরে যায় কুয়াশায়-সে তো আর ফিরে নাহি আসে: কাঞ্চনমালা যে কবে ঝরে গেছে;-বনে আজো কলমীর ফুল ফুটে যায়-সে তবু ফেরে না, হায়;-বিশালাক্ষ্মী: সেও তো রাতুল চরণ মুছিয়া নিয়া চলে গেছে;-মাঝপথে জলের উচ্ছ্বাসে বাধা পেয়ে নদীরা মজিয়া গেছে দিকে দিকে-শ্মশানের পাশে আর তারা আসে নাকো; সুন্দরীর বনে বাঘ ভিজে জুল-জুল চোখ তুলে চেয়ে থাকে-কতো পাটরানীদের গাঢ় এলোচুল এই গৌড় বাংলায়-পড়ে আছে তাহার পায়ের তলে ঘাসে জানে সে কি! দেখে নাকি তারাবনে পড়ে আছে বিচূর্ণ দেউল, বিশুষ্ক পদ্মের দীঘি-ফোঁপড়া মহলা ঘাট, হাজার মহাল মৃত সব রূপসীরা; বুকে আজ ভেরেন্ডার ফুলে ভীমরুল গান গায়-পাশ দিয়ে খল্‌ খল্‌ খল্‌ খল্‌ বয়ে যায় খাল, তবু ঘুম ভাঙে নাকো-একবার ঘুমালে কে উঠে আসে আর যদিও ডুকারি যায় শঙ্খচিল-মর্মরিয়া মরে গো মাদার। ১৯. কোথাও চলিয়া যাব কোথাও চলিয়া যাব একদিন;-তারপর রাত্রির আকাশ অসংখ্য নক্ষত্র নিয়ে ঘুরে যাবে কতকাল জানিব না আমি; জানিব না কতকাল উঠানে ঝরিবে এই হলুদ বাদামী পাতাগুলো-মাদারের ডুমুরের-সোঁদা গন্ধ-বাংলার শ্বাস বুকে নিয়ে তাহাদের;-জানিব না পরথুপী মধুকূপী ঘাস কত কাল প্রান-রে ছড়ায়ে রবে- কাঁঠাল শাখার থেকে নামি পাখনা ডলিবে পেচাঁ এই ঘাসে-বাংলার সবুজ বালামী ধানী শাল পশমিনা বুকে তার -শরতের রোদের বিলাস কতো কাল নিঙড়াবে;-আচলে নাটোর কথা ভুলে গিয়ে বুঝি কিশোরের মুখে চেয়ে কিশোরী করিবে তার মৃদু মাথা নিচু; আসন্ন সন্ধ্যার কাক-করুণ কাকের দল খোড়া নীড় খুঁজি উড়ে যাবে;-দুপুরে ঘাসের বুকে সিদুরের মতো রাঙা লিচু মুখে গুজে পড়ে রবে-আমিও ঘাসের বুকে রবো মুখ গুজি; মৃদু কাঁকনের শব্দ-গোরোচনা জিনি রং চিনিব না কিছু- ২০. তোমার বুকের থেকে তোমার বুকের থেকে একদিন চলে যাবে তোমার সন্তান বাংলার বুক ছেড়ে চলে যাবে; যে ইঙ্গিতে নক্ষত্রও ঝরে, আকাশের নীলাভ নরম বুক ছেড়ে দিয়ে হিমের ভিতরে ডুবে যায়, – কুয়াশায় ঝ’রে পড়ে দিকে-দিকে রপশালী ধান একদিন; – হয়তো বা নিমপেঁচা অন্ধকারে গা’বে তার গান, আমারে কুড়ায়ে নেবে মেঠো ইঁদুরের মতো মরণের ঘরে – হ্নদয়ে ক্ষদের গন্ধ লেগে আছে আকাঙ্খার তবু ও তো চোখের উপরে নীল, মৃত্যু উজাগর – বাঁকা চাঁদ, শূন্য মাঠ, শিশিরের ঘ্রাণ - কখন মরণ আসে কে বা জানে – কালীদহে কখন যে ঝড় কমলের নাম ভাঙে – ছিঁড়ে ফেলে গাংচিল শালিকের প্রাণ জানি নাকো;- তবু যেন মরি আমি এই মাঠ – ঘাটের ভিতর, কৃষ্ণা যমুনায় নয় – যেন এই গাঙুড়ের ডেউয়ের আঘ্রাণ লেগে থাকে চোখে মুখে – রুপসী বাংলা যেন বুকের উপর জেগে থাকে; তারি নিচে শুয়ে থাকি যেন আমি অর্ধনারীশ্বর। ২১. গোলপাতা ছাউনির গোলপাতা ছাউনির বুক চুমে নীল ধোঁয়া সকালে সন্ধ্যায় উড়ে যায়- মিশে যায় আমবনে কার্তিকের কুয়াশার সাথে; পুকুরের লাল সর ক্ষীণ ঢেউয়ে বার-বার চায় সে জড়াতে করবীর কচি ডাল; চুমো খেতে চায় মাছরাঙাটির পায়; এক-একটি ইট ধ্বসে-ডুবজলে ডুব দিয়ে কোথায় হারায় ভাঙা ঘাটলায় এই-আজ আর কেউ এসে চাল-ধোয়া হাতে বিনুনি খসায় নাকো-শুকনো পাতা সারা দিন থাকে যে গড়াতে; কড়ি খেলিবার ঘর মজে গিয়ে গোখুরার ফাটলে হারায়; ডাইনীর মতো হাত তুলে-তুলে ভাঁট আঁশশ্যাওড়ার বন বাতাসে কি কথা কয় বুঝি নাকো, -বুঝি নাকো চিল কেন কাঁদে পৃথিবীর কোনো পথে দেখি নই আমি, হায়, এমন বিজন শাদা পথ-সোঁদা পথ-বাঁশের ঘোমটা মুখে বিধবার ছাঁদে চলে গেছে শ্মশানের পারে বুঝি;-সন্ধ্যা সহসা কখন; সজিনার ডালে পেঁচা কাঁদে নিম-নিম নিম কার্তিকের চাঁদে।

২২. অশ্বত্থে সন্ধ্যার হাওয়া অশ্বত্থে সন্ধ্যার হাওয়া যখন লেগেছে নীল বাংলার বনে মাঠে মাঠে ফিরি একা: মনে হয় বাংলার জীবনে সঙ্কট শেষ হয়ে গেছে আজ; — চেয়ে দেখ কতো শত শতাব্দীর বট হাজার সবুজ পাতা লাল ফল বুকে লয়ে শাখার ব্যজনে আকাঙ্খার গান গায় — অশ্বত্থেরও কি যেন কামনা জাগে মনে : সতীর শীতল শব বহু দিন কোলে লয়ে যেন অকপট উমার প্রেমের গল্প পেয়েছে সে, চন্দ্রশেখরের মতো তার জট উজ্জ্বল হতেছে তাই সপ্তমীর চাঁদের আজ পুনরাগমনে; মধুকূপী ঘাস-ছাওয়া ধলেশ্বরীটির পাড়ে গৌরী বাংলার এবার বল্লাল সেন আসিবে না জানি আমি — রায়গুণাকর আসিবে না — দেশবন্ধু আসিয়াছে খরধার পদ্মায় এবার, কালীগহে ক্লান্ত গাংশালিখের ভিড়ে যেন আসিয়াছে ঝড়, আসিয়াছে চন্ডীদাস — রামপ্রসাদের শ্যামা সাথে সাথে তার; শঙ্খমালা, চন্দ্রমালা : মৃত শত কিশোরীর কঙ্কণের স্বর। (দেশবন্ধু : ১৩২৬-১৩৩২ এর স্মরণে) ২৩. ভিজে হয়ে আসে মেঘে ভিজে হয়ে আসে মেঘে এ-দুপুর — চিল একা নদীটির পাশে জারুল গাছের ডালে বসে বসে চেয়ে থাকে ওপারের দিকে; পায়রা গিয়েছে উড়ে তবু চরে, খোপে তার; — শসাতাটিকে, ছেড়ে গেছে মৌমাছি; — কালো মঘে জমিয়াছে মাঘের আকাশে, মরা প্রজাতিটির পাখার নরম রেণু ফেলে দিয়ে ঘাসে পিঁপড়েরা চলে যায়; — দুই দন্ড আম গাছে শালিখে — শালিখে ঝুটোপুটি, কোলাহল — বউকথাকও আর রাঙা বউটিকে ডাকে নাকো-হলুদ পাখনা তার কোন যেন কাঁঠালে পলাশে হারায়েছে; বউ উঠানে নাই — প’ড়ে আছে একখানা ঢেঁকি; ধান কে কুটবে বলো-কত দিন সে তো আর কোটে নাকো ধান, রোদেও শুকাতে সে যে আসে নাকো চুল তার — করে নাকে স্নান এ-পুকুরে — ভাঁড়ারে ধানের বীজ কলায়ে গিয়েছে তার দেখি, তবুও সে আসে নাকে; আজ এ দুপুরে এসে খই ভাজিবে কি? হে চিল, সোনালি চিল, রাঙা রাজকন্যা আর পাবে না কি প্রাণ? ২৪. খুঁজে তারে মরো মিছে খুঁজে তারে মরো মিছে — পাড়াগাঁর পথে তারে পাবে নাকো আর; রয়েছে অনেক কাক এ উঠানে — তবু সেই ক্লান্ত দাঁড়কাক নাই আর; — অনেক বছর আগে আমে জামে হৃষ্ট এক ঝাঁক দাঁড়কাক দেখা যেত দিন — রাত, — সে আমার ছেলেবেলাকার কবেকার কথা সব; আসিবে না পৃথিবীতে সেদিন আবার: রাত না ফুরাতে সে যে কদমের ডাল থেকে দিয়ে যেত ডাক, — এখনো কাকের শব্দে অন্ধকার ভোরে আমি বিমনা, অবাক তার কথা ভাবি শুধু; এত দিনে কোথায় সে? কি যে হলো তার কোথায় সে নিয়ে গেছে সঙ্গে করে সেই নদী, ক্ষেত, মাঠ, ঘাস, সেই দিন, সেই রাত্রি, সেই সব ম্নান চুল, ভিজে শাদা হাত সেইসব নোনা গাছ, করমচা, শামুক গুগলি, কচি তালশাসঁ সেইসব ভিজে ধুলো, বেলকুড়ি ছাওয়া পথ, ধোয়া ওঠা ভাত, কোথায় গিয়েছে সব? — অসংখ্য কাকের শব্দে ভরিছে আকাশ ভোর রাতে — নবান্নের ভোরে আজ বুকে যেন কিসের আঘাত! ২৫. পাড়াগাঁর দু’পহর পাড়াগাঁর দু’পহর ভালোবাসি — রৌদ্র যেন গন্ধ লেগে আছে স্বপনের; — কোন গল্প, কি কাহিনী, কি স্বপ্ন যে বাঁধিয়াছে ঘর আমার হৃদয়ে, আহা, কেউ তাহা জানে নাকো — কেবল প্রান্তর জানে তাহা, আর ওই প্রান্তরের শঙ্খচিল; তাহাদের কাছে যেন এ-জনমে নয় — যেন ঢের যুগ ধরে কথা শিখিয়াছে এ — হৃদয় — স্বপ্নে যে বেদনা আছে : শুষ্ক পাতা — শালিখের স্বর, ভাঙা মঠ — নক্‌শাপেড়ে শাড়িখানা মেযেটির রৌদ্রের ভিতর হলুদ পাতার মতো স’রে যায়, জলসিড়িটির পাশে ঘাসে শাখাগুলো নুয়ে আছে বহু দিন ছন্দহীন বুনো চালতার: জলে তার মুখখানা দেখা যায় — ডিঙিও ভাসিছে কার জলে, মালিক কোথাও নাই, কোনোদিন এই দিকে আসিবেনা আর, ঝাঁঝরা ফোঁপরা, আহা ডিঙিটিরে বেঁধে রেখে গিয়েছে হিজলে; পাড়াগাঁর দু — পহর ভালোবাসি — রৌদ্রে যেন ভিজে বেদনার গন্ধ লেগে আছে, আহা, কেঁদে কেঁদে ভাসিতেছে আকাশের তলে। ২৬. কখন সোনার রোদ কখন সোনার রোদ নিভে গেছে — অবিরল শুপুরির সারি আঁধারে যেতেছে ডুবে — প্রান্তরের পার থেকে গরম বাতাস ক্ষুধিত চিলের মতো চৈত্রের এ অন্ধকার ফেলিতেছে শ্বাস; কোন চৈত্রে চলে গেছে সেই মেয়ে — আসিবে না করে গেছে আড়ি : ক্ষীরুই গাছের পাশে একাকী দঁড়ায়ে আজ বলিতে কি পারি কোথাও সে নাই এই পৃথিবীতে তাহার শরীর থেকে শ্বাস ঝরে গেছে বলে তারে ভুলে গেছে নক্ষত্রের অসীম আকাশ, কোথাও সে নাই আর — পাব নাকো তারে কোনো পৃথিবী নিঙাড়ি? এই মাঠে — এই ঘাসে ফল্‌সা এ-ক্ষীরুয়ে যে গন্ধ লেগে আছে আজও তার যখন তুলিতে যাই ঢেঁকিশাক — দুপুরের রোদে সর্ষের ক্ষেতের দিকে চেয়ে থাকি — অঘ্রাণে যে ধান ঝরিয়াছে তাহার দু-এক গুচ্ছ তুলে নিই, চেয়ে দেখি নির্জন আমোদে পৃথিবীর রাঙা রোদে চড়িতেছে আকাঙ্ক্ষায় চিনিচাঁপা গাছে — জানি সে আমার কাছে আছে আজো — আজো সে আমার কাছে কাছে। ২৭. এই পৃথিবীতে এক এই পৃথিবীতে এক স্থান আছে – সবচেয়ে সুন্দর করুণ : সেখানে সবুজ ডাঙা ভ’রে আছে মধুকূপী ঘাসে অবিরল; সেখানে গাছের নাম : কাঁঠাল, অশ্বত্থ, বট, জারুল, হিজল; সেখানে ভোরের মেঘে নাটার রঙের মতো জাগিছে অরুণ; সেখানে বারুণী থাকে গঙ্গাপসাগরের বুকে, - সেখানে বরুণ কর্ণফুলী ধলেশ্বরী পদ্মা জলাঙ্গীরে দেয় অবিরল জল; সেইখানে শঙ্খচিল পানের বনের মতো হাওয়ায় চঞ্চল, সেইখানে লক্ষ্ণীপেঁচা ধানের গন্ধের মতো অস্ফুট, তরুণ; সেখানে লেবুর শাখা নুয়ে থাকে অন্ধকারে ঘাসের উপর; সুদর্শন উড়ে যায় ঘরে তার অন্ধকার সন্ধ্যার বাতাসে; সেখানে হলুদ শাড়ি লেগে থাকে রূপসীর শরীরের ’পর – শঙ্খমালা নাম তার : এ- বিশাল পৃথিবীর কোনো নদী ঘাসে তারে আর খুঁজে তুমি পাবে নাকো বিশালাক্ষী দিয়েছিল বর, তাই সে জন্মেছে নীল বাংলার ঘাস আর ধানের ভিতর। ২৮. কত ভোরে- দু’-পহরে কত ভোরে- দু’-পহরে – সন্ধ্যায় দেখি নীল শুপুরির বন বাতাসে কাঁপিছে ধীরে;- খাঁচার শুকের মতো গাহিতেছে গান কোন এক রাজকন্যা- পরনে ঘাসের শাড়ি- কালো চুলে ধান বাংলার শালিধান- আঙিনায় ইহাদের করেছে বরণ, হৃদয়ে জলের গন্ধ কন্যার- ঘুম নাই, নাইকো মরণ তার আর কোনোদিন- পালঙ্কে সে শোয় নাকো, হয় নাকো স্লান, লক্ষ্ণীপেঁচা শ্যামা আর শালিখের গানে তার জাগিতেছে প্রাণ- সারাদিন- সারারাত বুকে ক’রে আছে তারে শুপুরির বন; সকালে কাকের ডাকে আলো আসে, চেয়ে দেখি কালো দাঁড়কাক সবুজ জঙ্গল ছেয়ে শুপুরির- শ্রীমন্তও দেখেছে এমন : যখন ময়ূরপঙ্খী ভোরের সিন্ধুর মেঘে হয়েছে অবাক, সুদূর প্রবাস থেকে ফিরে এসে বাংলার শুপুরির বন দেখিয়াছে- অকস্মাৎ গাঢ় নীল : করুণ কাকের ক্লান্ত ডাক শুনিয়াছে- সে কত শতাব্দী আগে ডেকেছিল তাহারা যখন।

২৯. এই ডাঙা ছেড়ে হায় এই ডাঙা ছেড়ে হায় রূপ কে খুঁজিতে যায় পৃথিবীর পথে। বটের শুকনো পাতা যেন এক যুগান্তের গল্প ডেকে আনে: ছড়ায়ে রয়েছে তারা প্রান্তরের পথে পথে নির্জন অঘ্রানে;- তাদের উপেক্ষা ক’রে কে যাবে বিদেশে বলো- আমি কোনো-মতে বাসমতী ধানক্ষেত ছেড়ে দিয়ে মালাবারে- উটির পর্বতে যাব নাকো, দেখিব না পামগাছ মাথা নাড়ে সমুদ্রের গানে কোন দেশে,- কোথায় এলাচিফুল দারুচিনি বারুণীর প্রাণে বিনুনী খসায়ে ব’সে থাকিবার স্বপ্ন আনে;- পৃথিবীর পথে যাব নাকো : অশ্বত্থের ঝরাপাতা স্লান শাদা ধুলোর ভিতর, যখন এ- দু’-পহরে কেউ নাই কোনো দিকে- পাখিটিও নাই, অবিরল ঘাস শুধু ছড়ায়ে র’য়েছে মাটি কাঁকরের ’পর, খড়কুটো উল্টায়ে ফিরিতেছে দু’একটা বিষণ্ণ চড়াই, অশ্বত্থের পাতাগুলো প’ড়ে আছে স্লান শাদা ধুলোর ভিতর; এই পথ ছেড়ে দিয়ে এ-জীবন কোনোখানে গেল নাকো তাই। ৩০. এখানে আকাশ নীল এখানে আকাশ নীল- নীলাভ আকাশ জুড়ে সজিনার ফুল ফুটে থাকে হিম শাদা- রং তার আশ্বিনের আলোর মতন; আকন্দফুলের কালো ভীমরুল এইখানে করে গুঞ্জরণ রৌদ্রের দুপুর ভ’রে;- বারবার রোদ তার সুচিক্বণ চুল কাঁঠাল জামের বুকে নিঙড়ায়ে;- দহে বিলে চঞ্চল আঙুল বুলায়ে বুলায়ে ফেরে এইখানে জাম লিচু কাঁঠালের বন, ধনপতি, শ্রীমন্তের, বেহুলার, লহনার ছুঁয়েছে চরণ; মেঠো পথে মিশে আছে কাক আর কোকিলের শরীরের ধূল, কবেকার কোকিলের জানো কি তা? যখন মুকুন্দরাম, হায়, লিখিতেছিলেন ব’সে দু’পহরে সাধের সে চন্ডিকামঙ্গল, কোকিলের ডাক শুনে লেখা তাঁর বাধা পায়- থেমে থেমে যায়;- অথবা বেহুলা একা যখন চলেছে ভেঙে গাঙুড়ের জল সন্ধ্যার অন্ধকারে, ধানক্ষেতে, আমবনে, অস্পষ্ট শাখায় কোকিলের ডাক শুনে চোখে তার ফুটেছিল কুয়াশা কেবল। (বাকি কবিতাগুলো কমেন্ট অংশে)

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১২ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।