আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ক্ষয়িষ্ণু সময়ের গল্প



আকাশে চাঁদ উঠছে । পূর্ণিমার অকৃপণ আলোয় ভরে যাচ্ছে চারপাশ । নিভৃত পল্লির শ্যামলিমা জুড়ে প্রাণের শিহরন । আমি প্রস্তুতি নিচ্ছি মৃত্তিকা মা’র কোলে শেষবারের মত মাথা রাখব বলে । প্রাণের মুকুরে স্পন্দিত স্বদেশ ! তোমার আকাশ -বাতাস জুড়ে দুষ্টুমিভরা হাসির হেঁয়ালীতে কাঁপন তুলবনা আর ।

শিশিরভেজা শরতের শরীরে আর আঁকবনা ছিপছিপে পায়ের এলোমেলো নকশা । আমিও বাঁচতে চেয়েছিলাম । জ্ঞানের আলোয় ভরে দিতে চেয়েছিলাম আমার ক্ষুদ্র ভূবন । কিন্তু জীবনের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় সময়গুলো গোলকধাঁধায় কেমন করে হারিয়ে গেল বুঝতেই পারিনি । যখন বুঝলাম- আমার আলোকিত সময়গুলোকে যারা অন্ধকার করে দিয়েছিল তাদের বিরুদ্ধে নালিশ জানালাম তোমার সর্বোচ্চ বিবেক 'আদালতে' ! কিন্তু তোমার আদালত আমাকে কী রায় দিয়েছিল জান! বলেছিল-“এটা কোন পৌরাণিক আদালত নয় যে চাইলেই মানুষকে তার হারানো দিন ফেরৎ দিতে পারে !” আমি কাঁদব না হাসব বুঝতে পারছিলামনা ! জীবন থেকে হারিয়ে যাওয়া চারটি বছর ফেরৎ পেতে হারালাম আরো দুটো বছর ।

ততদিনে আমার স্বল্প আয়ের বাবা নিঃস্ব থেকে নিঃস্বতর হয়ে আমার বাবা হওয়ার যন্ত্রনা পুরোপুরি বুঝে গেছেন । ততদিনে আমার আইনজীবী, যিনি সহস্র মামলা জেতা একজন স্বনাম ধন্য ব্যরিস্টার, নিজস্ব নিয়মে বিবেকের জঠরে পদাঘাত করে ভরে নিয়েছেন নিজের থলিটুকু । তোমার সবুজাভ প্রান্তরে বেড়ে ওঠা এই আমি আর কোন স্বপ্ন বুনতে চাইনা । তবু তোমাকে বলে যেতে চাই, আমার নিভৃত প্রস্থানের নেপথ্য কথা । তখন সদ্য কৈশোর পেরোনো এক প্রাণোচ্ছল তরুনী আমি ।

ইন্টারমিডিয়েট দিয়ে মেডিকেলে ভর্তীর জন্য জান-প্রাণ দিয়ে লড়ছি । পরীক্ষার আগে কোচিংয়ের সুত্রে জানলাম প্রশ্নপত্র ফাঁসের কথা। দুই লাখে বিকোচ্ছে আমার ভবিষ্যৎ ! ঐ বয়সে, বিশ্বাস করো, অতটা অসৎ হতে পারিনি। আমার ভেতর রাজ্যের অহংকারী, জেদী আর সৎ মানবীটি বাঁধা দিল । আমি রাজী হলাম না ।

পরীক্ষার হল থেকে বেরিয়ে জানলাম নীলক্ষেতের দোকানে ঐ প্রশ্ন দু'শতেও পেয়েছে কেউ কেউ । আমার মেডিকেলের শিঁকে ছিঁড়লনা সেবার। তবু হাল ছাড়লাম না । পূর্ণোদ্যমে আবার শুরু করলাম । আমার দিন আর রাত গুলো কিভাবে যে পার করেছিলাম আজ আর মনে করতে পারছিনা ।

চোখে তখন একটাই স্বপ্ন মেডিকেলে ভর্তী হব । স্বল্প আয়ের বাবা বেসরকারী মেডিকেলে পড়াতে পারবেন না জানতাম, তাই সরকারী মেডিকেলই ছিল একমাত্র ভরসা । এমন সময় একজন গোয়েন্দা অফিসারের সাথে পরিচয় । সব শুনে তিনি এর একটা বিহিত করার আশ্বাস দিলেন । আমিও আশায় বুক বাঁধলাম ।

উপযাচক হয়ে অনেক তথ্য জোগালাম । একটা সময় তার আগ্রহে ভাটা পড়ল । তিনি যেন প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিষয়টি বেমালুম ভুলে যেতে চাইলেন । তবু আমার পীড়াপীড়িতে একদিন বিরক্ত হয়ে বললেন, “দেখো এর চেয়ে অনেক বড় বড় বিষয় নিয়ে আমাদের ব্যস্ত থাকতে হয় । এ সব ছোট বিষয়ে নজর দেবার সময় কোথায় ? আর তাছাড়া আমাদের হাত-পা বাঁধা ।

চাইলেও আমরা অনেক কিছু করতে পারিনা । ” ও, হাজার হাজার শিক্ষার্থীর জীবন নষ্ট হয়ে যাওয়া আপনাদের কাছে ছোট বিষয় ? জাতির পরবর্তি প্রজন্মকে মেধাহীন, চোর আর অসৎ বানানোর প্রক্রিয়া আপনাদের কাছে গৌণ ! পরেরবারও একই নাটক মঞ্চায়িত হল । হতাশার চাদরে নিজেকে জড়িয়ে পরীক্ষার হলে গেলাম । এবং যথারীতি আউট । একটা সরকারী কলেজে এডমিশন নিলাম ।

আমার দুঃখের রজনী আরো দীর্ঘায়িত হল । কলেজের শিক্ষকদের সাথে বিভিন্ন দাবী -দাওয়া নিয়ে অচলায়তন শুরু হল । বন্ধুরা যখন থার্ড ইয়ার শেষ করছে আমি তখনো সদ্য অনার্সে ভর্তী হওয়া প্রথম বর্ষের ছাত্রী ! ততদিনে জীবনের মোহ ছেড়ে গেছে আমায় । প্রিয়তম বন্ধুটির সাথেও কথা বলতে ভাল লাগেনা । মা-বাবা-ভাই-বোন প্রত্যেককেই কেমন অসহ্য হতে লাগল ।

রাঙ্গামাটির উদার প্রকৃতিতে স্কাউট ক্যাম্প করেও মনে আশা জাগাতে পারলামনা । কিছুদিন কবিতায় মজে থাকতে চাইলাম সেখানেও ব্যর্থ হলাম । এই কালরাত্রির যবনিকা টানতে যখন প্রস্তুতি নিচ্ছি- একজন কবির সাথে দেখা। তিনি আমাকে বেঁচে থাকার পরামর্শ দিলেন । জীবন জয়ের গান শোনালেন ।

অথচ তার কবিতার মেয়েদেরকে তিনি বাঁচাতে পারেননি । নীরাকে আত্মহননের পথ বেছে নিতে হয়েছে । আর ঐ যে সেই মেয়েটি, যার জন্মের আগেই বাবা মারা গিয়েছিল, তাকে তো অন্ধ হয়েই বাকীটা জীবন পার করতে হয়েছে । আমার এই সমালোচনায় কবি বললেন, “ওরা তো বাস্তবের কোন চরিত্র নয় । ওরা এই সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ।

কিন্তু তুমি তো বাস্তব ! তোমাকে হেরে গেলে চলবে কেন ? তোমাকে লড়াই করতে হবে । ” প্রিয় স্বদেশ, তোমার আদালত আমাকে পুরাণের চরিত্র বলে ঠাট্টা করেছে আর তোমার কবি আমাকে বলেছে বাস্তবের নারী । কার কথা বিশ্বাস করব আমি ? দোহাই মাননীয় আদালত, দোহাই মহামান্য কবিবর, দোহাই গোয়েন্দ চীফ, দোহাই ব্যরিস্টার সাহেব আপনারা একটা জাতিকে এভাবে ধ্বংস করে দেবেন না । ভবিষ্যৎ নপুংশক, কাপুরুষ, মেধাহীন জাতি গঠনের এই হীন প্রয়াস আপনারা রুখুন । আমি না হয় পুরাণের নারীর মতই ধীরে ধীরে হারিয়ে যাব অতলে ।

তবু ভবিষ্যতের হাজার হাজার শিক্ষার্থীকে নিশ্চিত আত্মহননের পথ থেকে রক্ষা করুন !

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.