আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বোতলে সংবাদ

ভালো আছি

জ্যাক উরাম। পেশায় রেস্টুরেন্ট কর্মী। জ্যাক সময় পেলেই ঘুরতে চলে যান দূরের কোন সমুদ্র তীরে। এভাবে ঘুরতে ঘুরতে একদিন ক্যালিফোর্নিয়ার সমুদ্র সৈকতে একটা বোতল খুঁজে পান তিনি। ছিপি লাগানো বোতলের ভিতর একটা ভাঁজ করা চিঠি।

বোতলের ছিপি খুলে জ্যাক চিঠিটা বের করে নিলেন। চিঠির ভাঁজ খুলেই রীতিমত থ হয়ে গেলেন। এই মুহুর্ত থেকে তিনি আর রেস্টুরেন্ট কর্মী নন, তিনি এখন এক ধনী লোক। হ্যাঁ, চিঠিতে লেখা ছিল, যে এই বোতলটি খুঁজে পাবে সে হবে ১২ মিলিয়ন ডলারের ভূ-সম্পত্তির মালিক! অবিশ্বাস্য ব্যাপার, তাই না? সে যা হোক । শত শত বছর আগে মানুষ কিন্তু এমনিভাবে বোতলের মাধ্যমেই সংবাদ পাঠাত।

আর এসব সংবাদের বিষয়বস্তু থাকত খুবই সাধারণ ধরনের। তবে জ্যাক উরামের প্রাপ্ত সংবাদটি একটু ব্যতিক্রমী। কারন এ পর্যন্ত বোতলের মাধ্যমে যত সংবাদ পাওয়া গেছে তার মধ্যে জ্যাক কর্তৃক প্রাপ্ত বোতলের সংবাদটিতে কেবল অঢেল অর্থপ্রাপ্তির কথা বলা হয়েছে। বোতলের মাধ্যমে প্রাপ্ত সংবাদের বেশিরভাগই দুঃখ অথবা সুখ নিয়ে। এই সংবাদ যেমন কারও কারও জীবনধারা পাল্টে দিয়েছে, তেমনি কিছু সংবাদ আবার সমুদ্র স্রোতের গতিপথ নির্ণয়ে বিজ্ঞানীদের অনেক সহায়তা করেছে।

১৯৭৯ সালের বড় দিনের ঘটনা। লস এঞ্জেলসের ক্যালিফ শহরের বাসিন্দা জন এবং দোদি পেকহাম প্রমোদভ্রমণে মেক্সিকো থেকে হাওয়াই যাচ্ছেন। এই সময়ে তারা একটি চিঠি লিখলেন। পুরো ঠিকানাসহ চিঠিটি বোতলবন্দি করে প্রশান্ত মহাসাগরের উত্তাল জলরাশিতে ভাসিয়ে দিলেন। কিছু দিন পরের ঘটনা।

ভিয়েতনামের কমিউনিজম উদ্বাস্তু শিবির থেকে পালিয়ে আসা নেগুয়েন ভ্যোন হোয়া বোতলটি কুড়িয়ে পেলেন। বোতলটি পাওয়া গেল দক্ষিণ চীন সাগরে। হোয়া ফিরে এলেন থাইল্যান্ডে। এখানে বসেই পেকহামের ঠিকানায় চিঠি লিখলেন তিনি। হোয়া এবং পেকহামের মধ্যে প্রায় দু’বছর চিঠি লেখালেখি চলে।

এরই মাঝখানে হোয়া তার স্ত্রী আর ১৬ মাস বয়সী ছেলেকে নিয়ে আমেরিকায় পাড়ি জমালেন। আমেরিকাতে থাকা খাওয়ার ব্যবস্থাসহ নাগরিকত্ব পাওয়ার ক্ষেত্রে পেকহাম হোয়া ও তার স্ত্রী-সন্তানকে যথাসাধ্য সহযোগিতা করলেন। মেক্সিকো উপসাগর থেকে যে উষ্ণ সমুদ্রস্রোত উত্তর ইউরোপের দিকে চলে গেছে, তার গতিপথ নির্ণয় করবার জন্য আমেরিকার বিখ্যাত বিজ্ঞানী বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন এক সময় বোতল ব্যবহার করতেন। বিজ্ঞানী ফ্রাঙ্কলিনের এই পথ অনুসরণ করে মায়ামির পোর্টল্যান্ড থেকে স্কুল ছাত্র জিওফ হাইট একবার মেক্সিকো উপসাগর থেকে নেমে আসা উষ্ণ সমুদ্রস্রোতে একটি বোতল ভাসিয়ে দিয়েছিলেন। সংবাদসহ জিওফ হাইটের ছেড়ে দেওয়া এই বোতলটি দু’বছর পরে ফ্রান্সে পাওয়া গিয়েছিল।

সমুদ্রস্রোতের গতিবিধি পর্যবেক্ষণের জন্য বহু বছর ধরেই আমেরিকার নৌ-বাহিনীর মহসাগরীয় অফিস বোতল ব্যবহার করে আসছে। তারা সমুদ্রে ভাসমান বিভিন্ন বাণিজ্যিক জাহাজ এবং ইউএস নৌ-বাহিনীর দায়িত্বরত জাহাজের ক্যাপ্টেনদের উদ্দেশ্যে বোতলের মধ্যে একটি ছাপানো ফরম ব্যবহার করতেন। মূলত যে স্থানে ক্যাপ্টেনরা এই বোতল পেতেন সেই স্থানের অক্ষাংশ এবং দ্রাঘিমাংশ কত তা জানবার উদ্দেশ্যেই ফরমে ক্যাপ্টেনদের কাছে সুনির্দিষ্ট নির্দেশ থাকত। তথ্যগুলো ফরমে লেখবার পর ক্যাপ্টেনরা তা নৌ-বাহিনীর সদর দফতর ওয়াসিংটন ডিসিতে পাঠিয়ে দিতেন। অনেক জাহাজের ক্যাপ্টেনরা আবার দীর্ঘ ভ্রমণে থাকবার সময় আত্মীয়স্বজনদের সাথে যোগাযোগের জন্য বোতলের মাধ্যমে ‘বোতল মেইল’ করতেন।

এক্ষেত্রে যারা এই বোতল মেইল হাতে পেতেন তাদের কাছে অনুরোধ থাকত তারাও যেন মেইল করেন। বোতলের মাধ্যমে প্রাপ্ত সংবাদ মাঝে মধ্যেই বিভিন্ন ধরনের রহস্যময় ঘটনার জট খুলতে সাহায্য করত । ৭০ বছর আগের কথা। আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েন্স আয়ার্স থেকে অস্ট্রেলিয়ার উদ্দেশ্য ছেড়ে যাওয়া একটা জাহাজ হঠাৎ করেই হাওয়া হয়ে গেল । ব্যাপারটা নিয়ে চারদিকে তুমুল হৈ চৈ শুরু হয়ে গেল ।

কারণ হঠাৎ হাওয়া হয়ে যাওয়া এই জাহাজটি মোটেও কোন সাধারণ জাহাজ ছিল না। বিখ্যাত পাঁচ মাস্তুল বিশিষ্ট ‘কোবেনহান’ নামের এই জাহাজটিতে ডেনমার্কের কয়েকশো নাবিক প্রশিক্ষণরত ছিল। ৬ বছর পরের ঘটনা। বোভেদ দ্বীপের প্রায় ১,৬০০ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিম উত্তমাশা অন্তরীপের কাছে মাছ ধরবার সময় এক জেলে তার জালে একটি বোতল পেলেন। বোতলের মুখ খুলতেই তার ভিতর থেকে বেরিয়ে এল একজন নৌ-ক্যাডেটের প্রতিদিনের জীবনযাত্রার কাহিনী।

নৌ-ক্যাডেট লিখেছে, ‘আমরা বিপদের মুখোমুখি। জাহাজের সামনে বিশাল এলাকা জুড়ে বরফের পাহাড়!’ তারপর কয়েকদিন পরে আবার লিখেছে, ‘আমরা জাহাজ ছেড়ে দিয়েছি । একটু পরে দুর থেকে দেখতে পেলাম, দুটো বরফ পাহাড়ের মাঝখানে আমাদের জাহাজটি ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেল। ’ নৌ-ক্যাডেট তার জীবনযাত্রার কাহিনী শেষ করেছে এভাবে। ‘এখন তুমুলভাবে তুষারপাত হচ্ছে।

তুষারপাতের সাথে পাল্লা দিয়ে বইছে ঝড়োবাতাস। ভাগ্যে কী আছে তা আমার জানা হয়ে গেছে। একটু পরেই সাগরের উত্তাল ঢেউ আমাদেরকে হয়তো পৃথিবীর কোন এক প্রান্তে নিয়ে যাবে। ’ ১৯৩৩ সাল। এ বছরেই আটলান্টিক মহাসাগরে ভাসতে ভাসতে দুম করে হাওয়া হয়ে গেল ‘সাক্সিলবি’ নামের আর একটি জাহাজ।

এই জাহাজটির ভাগ্যে কী ঘটেছিল তা অবশ্য আজও এক অজানা রহস্য। তবে পরের বছরই ওয়েলসের অ্যাবিরাভোন শহরের এক গ্রামের কাছে একটি কোকের বোতল পাওয়া যায়। এই বোতলের ভিতরে একটি ছোট্ট চিরকুট। চিরকুটে লেখা ছিল, ‘এস.এস সাক্সিলবি আইরিশ উপকুলে কোথাও ডুবে গেছে। ভাই-বোন এবং দিনার প্রতি ভালবাসা রইল-জো ওকানি!’ জো ওকানির এই বিদায় বার্তাটি পাওয়া গিয়েছিল তার গ্রামের কাছেই।

কারণ অ্যাবিরাভোন ছিল তার নিজের শহর। আসলে বোতল ভর্তি যে সব সংবাদ পাওয়া যেত তা যে কেবল হতাশায় ভরপুর থাকত তা কিন্তু নয়। বরং কোন কোন সংবাদ মাঝে মাঝে আশার আলোও দেখাত। একবার এক বৃটিশ যাত্রীবাহী জাহাজের নাবিক অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার পথে একটি বোতল কুড়িয়ে পেলেন। বোতলের মুখ খুলে এক সুদর্শন নাবিকের ছবিসহ তার চিরকুট পাওয়া গেল।

চিরকুটে লেখা ছিল, ‘আমি একজন সুন্দরী স্ত্রী খুঁজছি। ’ যাত্রীবাহী জাহাজের এক মহিলা নাবিক সুদর্শন ওই নাবিকের ঠিকানায় একটি চিঠি পাঠিয়েছিলেন। মজার ব্যাপার এর কিছুদিন পরেই তারা বিয়ে করেছিল। ১৯৪০ সালের কথা। জর্জ ফিলিপস নামের এক ভদ্রলোক প্রায় ১৫ হাজার বোতলের মধ্যে ধর্মীয় বার্তা দিয়ে প্রশান্ত মহাসাগরে ছেড়ে দিলেন।

যারা পরে ধর্মীয় বার্তবাহী এই সব বোতল কুড়িয়ে পেয়েছিলেন তাদের অনেকের কাছ থেকেই মি. ফিলিপস ধন্যবাদসূচক জবাব পেয়েছিলেন। এক দম্পতি তো জর্জ ফিলিপসের পাঠানো ধর্মীয় বার্তায় অনুপ্রাণিত হয়ে তার চার্চে যোগদান করেছিলেন। এ রকম একটি বোতল উত্তর আফ্রিকার কাছে কুড়িয়ে পেয়েছিলেন এক আমেরিকান সৈনিক। ব্যতিক্রমধর্মী এই ধর্মীয় প্রচারণার জন্য সৈনিকটি ফিলিপসকে প্রশংসাসহ শুভেচ্ছা পাঠিয়েছিলেন । অবাক ব্যাপার হলো, বোতলগুলো প্রায় ৯ হাজার মাইল পথ পাড়ি দিয়েছিল।

আর এই ঘটনার পর থেকে ফিলিপসের পরিচিতি হয়েছিল, সাত সাগরের বোতল যাজক হিসাবে। একটি বোতলে বন্দি করা হয়েছিল এক ঐতিহাসিক খবর। প্রায় ৫০০ বছর আগে ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে সাগরে ফেলা ওই বোতলটি আজও কেউ খুঁজে পায়নি। হারিকেন ঝড়ের মুখে পতিত যে জাহাজটি থেকে বোতলটি সাগরে ফেলা হয়েছিল তার ক্যাপ্টেন ভেবেছিলেন জাহাজটি ডুবে যাবে। তাই ডুবে যাওয়ার আগে তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তার সাগর ভ্রমণের কাহিনী তিনি লিখে রেখে যাবেন।

তবে কাঠের পিপায় ঢুকিয়ে বোতলবন্দি ওই ভ্রমণকাহিনী সাগরে ফেলবার আগেই পুরো কাহিনী জাহাজটির গতিমাপক যন্ত্রেও রেকর্ড করে নিয়েছিলেন । পরে অবশ্য সেই জাহাজটি হারিকেনের হাত থেকে রক্ষা পায়। ক্যাপ্টেনও বেঁচে যান। কে সেই ক্যাপ্টেন? ক্রিস্টোফার কলম্বাস।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।