আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গৃহকর্মী!

রাজাকার-যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলুন

গৃহকর্মী নির্যাতনের খবর প্রায়শই সংবাদপত্রে কিংবা টিভিতে দেখা যায় ইদানিং। শুধু নির্মমতা নয়, নির্যাতনের ধরণ দেখে আতকিংত হতে হয়। ইলেকট্রিক শক দেয়া ও গরম ইস্ত্রি দিয়ে গায়ে ছ্যাঁকা দেয়ার মতো নারকীয় ঘটনা ঘটে গৃহকর্মীর ওপর। যারা এই কাজগুলি করে, তারা যে সুস্থ মস্তিস্কের নয়, তা সহজেই বোঝা যায়। এই অসুস্থতা ঘরে ঘরে বিরাজমান।

কেউ আমরা দেখি, কেউবা না দেখার ভান করে স্বাভাবিক (!) জীবনযাপন করি। আজকের যায় যায় দিনে লিজা নামের এক গৃহকর্মীর খবর এসেছে, যাকে ইস্ত্রি দিয়ে গায়ে ছ্যাঁকা দিয়েছেন গৃহকত্রী (?)। ঘটনাটি ঘটেছে তাল্লু স্পিনিং মিলের শিল্পপতি শহিদুল ইসলাম খোকনের উত্তরার বাসায়। ঘটনাটি ঘটিয়েছেন ওনার স্ত্রী। তথ্য না জানলেও আমরা ধরে নিতে পারি, তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের গন্ডি পেরিয়েছেন কিংবা ব্যাচেলর কিংবা ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত ওনার শিক্ষার সার্টিফিকেট আছে।

কিন্তু এই সার্টিফিকেট ওনাকে মানুষকে মানুষ হিসাবে বিবেচনা করার শিক্ষা দেয়নি (অবশ্য আমাদের শিক্ষা এটা কখনোই দেয় না কিংবা আমাদের শিক্ষা হতে আমরা এটা অর্জন করতে পারি না)। গতকাল এক ডাক্তার দম্পত্তির গৃহকর্মীর ওপর নারকীয় নির্যাতনের চিত্র টিভিতে দেখেছি। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বেডে সেই গৃহকর্মী ভালভাবে কথাই বলতে পারছিল না। এই ডাক্তারী সার্টিফিকেটও তাদের মানুষ করতে পারেনি (অবশ্য এমবিবিএস পড়ানো হয় ডাক্তার হওয়ার জন্য, মানুষ হওয়ার জন্য নয়)। লিজাকে নির্যাতনের বিষয়ে যায় যায় দিনের সাংবাদিক মোবাইলে তাল্লু স্পিনিং মিলের এমডিকে ফোন করলে তিনি নির্যাতনের কথা অস্বীকার করে বলেন, ‌তার গায়ে চর্মরোগ ছিল, সেকারণে তার হাতে পায়ে ঘা হয়েছে (?????)।

আমরা যারা শিক্ষার সার্টিফিকেট নিয়ে একটু সমাজসচেতন হওয়ার প্রমাণ রাখার চেষ্টা করি, তারা কাজের মেয়ে কিংবা বুয়া কিংবা মেইড সারভেন্ট কিংবা কাজের বেটি ইত্যাদিগুলোর অপসারণ করে সুন্দর নাম দেয়ার চেষ্টা করেছি, গৃহকর্মী। সুন্দর প্রচেষ্টা, অন্ততঃ এটার মাধ্যমে নিপীডিত কাজের মেয়েদের কিংবা ছেলেদের একটা সামাজিক মর্যাদা দেয়া হয়েছে। কিন্তু সেই স্বীকৃতি মিলেনি এখনো। যার জন্য আইন করার জন্য আমরা চেষ্টা করছি; শুনছি আইনও নাকি হয়ে যাবে খুব শিঘ্রই। কিন্তু সেই আইনে কি বলা থাকবে, কিভাবে মানুষ নামের অমানুষগুলোর মানসিকতার পরিবর্তন ঘটবে? আমার পরিচিত একজনের বাড়ীতে কাজের মেয়ে, সরি! গৃহকর্মী এনে দিয়েছিলাম গ্রাম হতে।

নিয়ে আসার আগে বলেছিলাম, তার বিয়ের খরচ দেয়া হবে। তারপর......। বেড়াতে যেতাম সেই বাড়ীতে। জানতে পারি, কাজের মেয়েটি (গৃহকর্মী!) খুবই ফাঁকিবাজ। সুযোগ পেলেই কাজ ফাঁকি দেয়, চুরি করে এটা ওটা খায়।

ভাগ্য ভাল অন্য কিছূ চুরি করা অভিযোগ পাইনি। এটা ছিল গৃহকত্রীর অভিযোগ। গৃহকর্মীর কোন অভিযোগ ছিল না। শুধু চোখ-মুখ বন্ধ রেখে নিরবে এসব কথা শুনে যেত, আর চোখভরা নৈরাশ্যমূলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতো। সেই দৃষ্টিতে যে অনেক অভিযোগ জমা আছে, তা বুঝতে পারতাম।

কারণ নিজের চোখের সামনেই দেখেছি, চোখ-মুখ-দাঁত খেচিয়ে চুলের মুঠি ধরে ঝাকানি দিয়ে উচ্চস্বরে বকাবকি করতো গৃহকত্রী। তারচেয়ে একধাপ এগিয়ে সেই গৃহকত্রীর ৪ বছরের মেয়ে। নির্যাতন করার মতো বয়স তার হয়নি, কিন্তু তার অর্ডার করার ধরনেই একজন আগামী নির্যাতকের যে জন্ম হচ্ছে, তা বুঝতে পারতাম। সেই মেয়ে নির্যাতন করতে না পারুক, নির্যাতন করতো গৃহকত্রী। কারণ মেয়ের অর্ডার সময়মতো পালন করা হয়নি।

নিজের চোখেই দেখেছি, সেই ঘটনা। কেন অর্ডার সময়মতো পালন করা হয়নি, তার কারণটা কেউ জানতে চায়নি। কিন্তু আমি এমনিতেই জানতে পেরেছি। কিভাবে? বাসায় আমার আগমন হওয়াতে গৃহকত্রী চা বসাতে বলেছেন। সেই চা করছেন গৃহকর্মী।

ঘর হতে গৃহকত্রীর মেয়ের চিৎকার, এ্যাই আমাকে পানি দিয়ে যা। মিনিট পাঁচেক স্বাভাবিক অবস্থা! তারপর হঠাৎ লক্ষ্য করলাম, গৃহকত্রীর মেয়ে রাগে টকটকে লাল হয়ে গেছে, আর চিৎকার করে রান্নাঘরে গিয়ে গৃহকর্মীকে ধাক্কা দিয়ে বলছে, এ্যাই তোর কাছে না আমি পানি চেয়েছি। দিসনি কেন বল! দিসনি কেন বল! মেয়ের চিৎকার শুনে মা প্রায় দৌডে গেলেন রান্নাঘরে। মায়েরও অভিযোগ শুনতে পেলাম, এ্যাই মেয়ে আমার মেয়েকে না খাইয়ে মেরে ফেলবে। এ্যাই তোর কাছে না ও পানি চেয়েছে।

দিসনি কেন বল? দিস নি কেন বল? বার বার একই কথা শুনতে পেয়ে আমিও এগিয়ে গেলাম রান্নাঘরে। গিয়ে দেখলাম, গৃহকত্রী একবার চুলের মুঠি ধরে টানছে, তো আরেকবার গাল ধরে টানছে, আর বলছে, এই দিসনি কেন বল, এই দিসনি কেন বল! গৃহকর্মী নির্বাক। শুধু চুল, নাক, মুখ, গাল টানাটানিতে এদিক ওদিক দুলছে। রান্নাঘরে হঠাৎ আমার আগমন হওয়াতে নিজের সাথে নিজেই খিস্তি করতে করতে লাগলেন গৃহকত্রী। আমরা আবার চলে এলাম ড্রয়িংরুমে।

কত অভিযোগ গৃহকর্মীর নামে। এ্যাই মেয়েকে ভাল কাপড়-চোপড় দিচ্ছি, আমরা যা খাই তা খাওয়াচ্ছি, যা চৌদ্দজনমে চোখে দেখতো না; তাও কাজে ফাঁকি দেয়া, সময় পেলেই ঘুমিয়ে পড়ে, চুরি করে মেয়ের খাবার খেয়ে নেয়, ইত্যাদি ইত্যাদি। তারপর এলো আমার চা পানের সময়। চা আর নাস্তা নিয়ে এলেন গৃহকর্মী। এগুলি আমাকে খেতে হবে! আমি গৃহকর্মীর দিকে চেয়ে রইলাম কিছুক্ষন যদি কিছু বলে।

নাহ! কোন অভিযোগ নেই তার। ভদ্রলোক বলে কথা, আমিও চা-নাস্তা গলদধরন করলাম। তারপর একদিন সুযোগ বুঝে গৃহকর্মীকে বললাম, চল তোকে বাড়ীতে দিয়ে আসি। এতো নির্যাতন সহ্য করে এখানে আর থাকিস না। কিন্তু গৃহকর্মী সেটাতে রাজী নয়।

তারকথা, মারধর করে করুক, এখানে তো তিনবেলা খেতে পাই, বাড়ীতে গেলে তো একবেলা খেয়ে, কখনো কখনো না খেয়ে থাকতে হয়। শুধু রাতে যদি ঘুমাতে দিত, তাহলে ভাল হতো। জিজ্ঞাসা করে জানলাম, রাত দুটোতে ঘুমিয়ে আবার ভোর পাঁচটায় উঠতে হয় সেই গৃহকর্মীকে। তাই ঘুম আসে। আর ঘুম আসলেই মারধোর।

এই অবস্থা আমার নিজের দেখা। যদিও বিয়ে পর্যন্ত সেই মেয়েকে ঐ বাসায় রাখা হয়নি। তার মা এসে নিয়ে গেছে। আর তার বিয়ের খরচ দেয়া হয়নি। গৃহকর্মীদের এই অবস্থা।

আমার আপনার চারপাশে চলছে এই ঘটনা। সেই দিনের আমার নিরবতা আজও আমাকে পীড়া দেয়। তাই কোন গৃহকর্মীর ওপর নির্যাতন হলে অন্ততঃ এখন আমি আর চুপ করে থাকি না, মৌখিক প্রতিবাদ করি। পরবর্তীতে সেই বন্ধু, আত্মীয় কিংবা বসদের যে ঘৃণা করি, সেটা বুঝিয়ে দেয়ার চেষ্টা করি। প্রতিবাদ এ পর্যন্তই।

আসুন না, সবাই আমরা এদের ঘৃণা করি, বুঝিয়ে দেয়ার চেষ্টা করি। সামাজিকভাবে বয়কট করি এবং অন্যান্যদের বয়কট করার জন্য উৎসাহিত করি।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.