আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমার আব্বা, যাকে আমি 'তুমি' বলে ডাকি

আমি যতটুকু জানি সেটুকু শেয়ার করতে পছন্দ করি। সেজন্য এই ব্লগ খুললাম।
আমার আব্বাকে আমি "তুমি" বলে ডাকি। ছবি দেখে বলতে পারেন তাকে কম বয়স্ক দেখাচ্ছে। Age difference কম বলে হয়তো এটা স্বাভাবিক মনে করতেও পারেন।

কিন্তু না, আব্বার বয়স সত্তুর ছাড়িয়ে গেছে। ইয়োগা করার কারণে বয়স কমে গেছে। আসলে আমার আব্বা একটু অন্যরকম। একটা ঘটনা বলি তাহলে পরিস্কার হবে। আমি একদিন স্কুল কামাই দিয়েছিলাম।

আব্বা বাসায় নেই বলে বৈঠকখানায় বসে স্টার মুভিজে একটা মুভি দেখছিলাম। দেখছি প্রায় অনেকক্ষণ। এমন সময় হঠাৎ করেই আব্বা বাইরে থেকে ফিরে এলো। এবং কাকতালীয়ভাবে তখনই একটা অশ্লীল দৃশ্য শুরু হয়ে গেল (বাবা-মা'রা এলেই সবসময় কিভাবে কিভাবে যেন অশ্লীল দৃশ্য শুরু হয়, অন্যসময় ওগুলো ঘাপটি মেরে বসে থাকে। বাবা-মাদের দেখলেই পর্দায় এসে দেখা দেয়! ) আমি চ্যানেল বদলে দিলাম।

অন্য বাবারা হলে কিছু না বলে হয় চুপচাপ হেঁটে চলে যেত নাহয় নাহয় আচ্ছামত বকে দিত। অবশ্য আব্বা আমাকে তখন বকেছিল, কিসের জন্য জানেন? আব্বাকে দেখে চ্যানেল বদলেছি কেন সেজন্য। আব্বা সবসময়ই চায় যেন আমরা আব্বা আম্মার কাছে কোনকিছু না লুকাই। প্রথম যখন আমাদের বাসায় ডিশ (স্যাটেলাইট চ্যানেলের) কানেকশন এলো তখন আব্বা আমাকে বলেছিল - "এখন অনেক নতুন কিছু দেখবি যা অন্য সংস্কৃতির। সেগুলো তাদের সংস্কৃতির বলে তাদের করা মানায়, সেগুলো নকল করিস না।

" অত্যন্ত সোজাসরল এই কথাটিই আমাকে অশ্লীলতা দেখে দেখে বখে যেতে দেয় নি। কত সিম্পল একটা কথা অথচ এটা আমাকে নিজের মত থাকতে উৎসাহ দিয়েছে। উচ্ছৃংখল হওয়া থেকে বিরত রেখেছে। অনেক সন্তানের আচার ব্যবহার দেখলেই বুঝতে পারি তাদের বাবা ডিশ এনেছেন ঠিকই, কিন্তু সেই সঙ্গে সন্তানের মাথাটা "টিউনিং" করেন নি। রাতে আগে আব্বা-আম্মা, আমার ভাই ও আমি একসঙ্গে বসে খেতাম আর টিভি দেখতাম।

মাঝে মাঝে অশ্লীল দৃশ্য এসে পড়লেও সেটাকে স্বাভাবিকভাবেই নিতাম। ভালোটাকে গ্রহণ করার ইচ্ছা থাকতো বলে কখন যে অশ্লীল দৃশ্য শুরু হয়ে শেষও হয়ে যেত বুঝতামও না। কারণ আমরা careই করতাম না। অন্য সংস্কৃতির মানুষ তাদের সংস্কৃতির পালনের জন্য (!) কি করছে সেটা ভেবে কি লাভ। ওটা তাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার! চ্যানেল বদলানোতে আব্বা রাগ করেছিল, কারণ ছোট ছোট জিনিস আড়াল করতে করতে দেখা যাবে বড় কোন ঘটনাও লুকিয়ে রাখার প্রবণতা এসে যাবে আমার মধ্যে, বোধ করি সেজন্য।

সেজন্যই আব্বা আমাকে আগের চ্যানেলে যাবার জন্য ধমক দিয়েছিলো। আব্বা আমাকে ছোটবেলা থেকেই টাকার বিনিময়ে বিভিন্ন কাজ করাতেন। মাঝে মাঝে আব্বার (ব্যায়াম করার) সাইক্লিং মেশিন আবার কখনো রকিং চেয়ার পরিস্কার করে দিতাম। এর বিনিময়ে আব্বা আমাকে টাকা দিতো। আব্বা আমাকে এভাবে টাকার মূল্য শিখিয়েছিলেন।

শিখিয়েছিলেন যে কষ্ট করে টাকা উর্পাজন কত আনন্দের। আব্বা কখনো ঘুষ খায় নি, বোধহয় আব্বাও উর্পাজনের কষ্টটাকে আনন্দ হিসেবেই দেখেছেন। (মানুষটির প্রতি সম্মান চলে আসে, তাই লিখতে লিখতে নিজের অজান্তেই আপনি সম্বোধন করে ফেললাম। ) আমি বুঝি না, সন্তানদের টাকার বিনিময়ে কাজ করানোর বিষয়টা যেখানে আমি এই সেদিন, পশ্চিমা ছবি দেখে শিখি, সেখানে চল্লিশের দশকের এই মানুষটি কিভাবে এটি বুঝলো? আব্বা এত আধুনিক চিন্তাধারার কিভাবে হল জবাব খুঁজে পাই না। আব্বা এতটাই আধুনিক চিন্তাধারার যে টিনএজ বয়সে আমাকে বলেছিলো বয়ঃসন্ধির ব্যাপারে, বলেছিল সবকিছুই স্বাভাবিক, কোনো জিজ্ঞাসা থাকলে করতে।

আমার বন্ধুদের অনেককে জিজ্ঞেস করেছি। নাহ, তাদের বাবারা তাদেরকে এসব বলে নি। বয়ঃসন্ধির আগেই আমি ইংরেজিতে কথা বলতে পারতাম। আর কে শেখাবে, শিখিয়েছে আব্বাই। ছোটবেলা থেকেই গ্রামারের বেসিকস পাকাপোক্ত করার চেষ্টা করেছে, জড়তা কাটানোয় সাহায্য করেছে এই আব্বাই।

এখন এ্যাডভান্সড গ্রামার না শিখেই যে ইংরেজি বলতে পারি এর পিছনে আব্বার হাত আছে। আমি গ্রামার ছাড়া ইংরেজি শেখার পক্ষে, যেমনটা মানুষ মাতৃভাষা শেখে। তবুও, স্কুল-কলেজ ও বর্তমান জীবনে ইংরেজিতে ভাল হবার কারণে জীবনে যত প্রশংসা পেয়েছি তার জন্য আব্বাই দায়ী। যদিও আব্বা গ্রামারের পক্ষে, আমি নই কিন্তু রহস্যজনকভাবে আব্বা আমাকে ইংরেজি শিখতে সাহায্য করেছে। আল্লাহ তাআলার প্রতি অগাধ বিশ্বাস আছে আব্বার।

আব্বা এক অবাক করা ধৈর্যের সাথে আল্লাহকে ধন্যবাদ জানান - প্রায়ই বলতে শুনি "আল্লাহ তুমি আমাকে যেভাবে রেখেছে ভাল রেখেছ। " ক'দিন আগে 'কিভাবে সুখী হওয়া যায় '-এর উপর একটি আর্টিকেল লিখতে গিয়ে আমি এই ধন্যবাদ জ্ঞাপনের ব্যাপারটি পেলাম। জানতে পারলাম যারা তাদের বর্তমান পাওয়া নিয়ে সন্তুষ্ট থাকে, সৃষ্টিকর্তার কাছে কৃতজ্ঞ থাকে তারা নাকি বেশি সুখী হয়। আব্বার সম্পর্কে বলতে থাকলে এই লেখা শেষ হবে না। আল্লাহ, আপনাকে thanks।

আপনি যদি আমাকে নিজের খেয়ালখুশি মত একজন বাবাকে বানিয়ে নেয়ার সুযোগ করে দিতেন তবুও আমি এত ভাল বাবা পেতাম না। আপনার কাছে অনুরোধ তাকে তাড়াতাড়ি কেড়ে নেবেন না। একি? চোখে পানি? আমি না বড় হয়ে গেছি? শেষ কেঁদেছিলাম সেই কবে। থাক এখানেই শেষ করি। - ২৩ মে ২০০৯, রাত ১:৩১
 


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।