আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কবিতার পাঠকসমাচার / কাজী মহম্মদ আশরাফ



কবিতা বিষয়ে, কবিতার পাঠক-পাঠিকা বিষয়ে একটা চমৎকার লেখা। ব্লগে শেয়ার করার জন্য এখানে তুলে দিলাম। ........................................................................................ কবিতার পাঠকসমাচার কা জী ম হ ম্ম দ আ শ রা ফ ------------------------------------------------------------------- বিশ্বসাহিত্যের সাম্প্রতিক কবিতা নিয়ে অনেকেই হতাশা ব্যক্ত করেন। সব যুগেই সমকালীন কবিতা নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে, কবিতা তাতে গতিহীন হয়ে পড়েনি; কিন্তু এখনকার প্রশ্নগুলো শুনতে গতানুগতিক মনে হলেও এর গুরুত্ব অস্বীকার করা যাচ্ছে না। অভিযোগগুলো এমন, ১. প্রায় দেড় যুগ ধরে কবিতায় নোবেল প্রাইজ দেয়া হচ্ছে না।

২. বুকার, ম্যানবুকার, পুলিৎজার, অরেঞ্জ, কমনওয়েলথ প্রভৃতি পুরস্কার কথাসাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা করছে, কবিতায় জন্য এমন বড় ধরনের পুরস্কার নেই। ৩. প্রকাশকরা কবিতার বই প্রকাশ করতে আগ্রহী নন। ৪. কবিতার পাঠকও কমে গেছে। ৫. মিডিয়ার টক শোতে কিংবা সাম্প্রতিক কোন ঘটনা-দুর্ঘটনা প্রসঙ্গে কথাসাহিত্যেকদের আলোচনা ও মন্তব্য গুরুত্বসহকারে সম্প্রচারিত অথবা প্রকাশিত হয়, সেখানে কবিরা উপেক্ষিত। ৭. সাম্প্রতিক বিশ্বসাহিত্যে কোন বিশ্বকবি নেই, এখনও জীবিত নোবেলবিজয়ী কবিরাও নন।

বেশিরভাগ বিশ্বপরিচিত কবিই আঞ্চলিক। অর্থাৎ স্বজাতিতে তারা যতটা সাড়া জাগাতে পারেন, আন্তর্জাতিকভাবে তা পারেন না। তাই সম্প্রতি খুব বেশি কিংবা উল্লেখযোগ্য অনুবাদ কাব্যগ্রন্থও চোখে পড়ে না। এমন আরও প্রশ্ন প্রায়ই শুনতে হয়। অনেক আলাপ-আলোচনা করেও সব প্রশ্নের সন্তোষজনক উত্তর পাওয়া যায়নি।

প্রকাশনা তথ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণকারী একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে পেশাগত দায়িত্ব পালন করার অভিজ্ঞতায় দেখেছি, প্রকাশনা সংক্রান্ত অভিযোগগুলো সত্য। বরং আরও কিছু গোপন সত্য লুকানো আছে বিষয়টিতে। যে প্রকাশক বেশি সংখ্যক কবিতার বই প্রকাশ করেন, তাকে অন্যের বিদ্রুপের শিকার হতে হয়। অনেক বড় প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান কবিতার বই প্রকাশই করে না এখন। এ অবস্থা থেকে মুক্তির পথ কী? এক দশক আগে কবি মোহাম্মদ রফিকের এক গদ্যে পড়েছি, পাশ্চাত্যে মাত্র দুইশ’ কপি বিক্রি হলেই একটি কাব্যগ্রন্থ বেস্ট সেলার বলে গণ্য হয়।

আশঙ্কাজনক প্রশ্ন জাগে মনে, তবে কি বাক্সময় যুগের পুঁথির মতো লেখ্য যুগের কবিতাও বিলুপ্তির দিকে এগুচ্ছে? বাংলা সাহিত্যের হাজার বছরের ইতিহাসে ১২০০-১৩৫০ পর্যন্ত সময়কে বলা হয় অন্ধকার যুগ। ১৭৬০ সালে ভারতচন্দে র মৃত্যুর পর থেকে ঈশ্বরগুপ্তের আবির্ভাবের আগ পর্যন্ত ৭০ বছরব্যাপী সময়কেও অন্ধকার যুগ বলা হয়। ইংরেজি সাহিত্যেও জিওফ্রে চসারের মৃত্যুর পরে দেড়শ’ বছরব্যাপী অন্ধকার যুগ বিরাজ করেছিল। তবে কি বর্তমান বিশ্বসাহিত্যেও কবিতার ভুবনে অন্ধকার নেমে এসেছে? সুধীন্দ নাথ পঞ্চাশের দশকেই বিশ্বকবিতা নিয়ে হতাশা ব্যক্ত করেছিলেন। বুদ্ধদেব বসু বরিস পাস্তরনাক ছাড়া আর কোন সমকালীন বিশ্বকবির কবিতা নিয়ে কাজ করেননি।

বিষ্ণু দে অবশ্য সমকালীন এলিয়ট-স্পেন্ডার নিয়ে কাজ করেছেন। ষাটের দশকে হাসান হাফিজুর রহমান প্রশ্ন করেছিলেন, ‘এলিয়টের পরে আর কোন ও বিশ্বকবি নেই কেন?’ আশির দশকে অমিয় চক্রবর্তীও একই ধরনের প্রশ্ন করেছিলেন। তবে তিনি রবার্ট ফ্রস্টকে বড় কবি হিসেবে দেখেছেন। শামসুর রাহমান ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র ছিলেন; তিনিও রবার্ট ফ্রস্ট ছাড়া আর কোনও সমকালীন কবির কবিতা নিয়ে কাজ করেননি। সৈয়দ আলী আহসান সমকালীন কবির বিদেশী কবিতা অনুবাদ করেছেন।

খুব বেশি গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। তবে এদেশের কবিদের এমন মনোভাব সত্ত্বেও লোরকা, নেরুদারা বিশ্বকবি হিসেবে এদেশের পাঠকদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছেন। কিন্তু পাঠকের উল্লিখিত অভিযোগের উত্তর সমকালীন বিশ্বকবিতার প্রেক্ষাপট থেকে পাওয়া যায় না। বিষয়টা অন্যভাবেও ভেবে দেখা যেতে পারে। না, কবিতা বিলুপ্ত হবে না।

নাট্যসাহিত্যও প্রাচীন একটি ধারা। অনেক আঘাতের পরেও সে টিকে আছে। প্রথমত উপন্যাসের আবির্ভাবে সবাই ভেবেছে, এক মলাটে এত কিছুসহ জীবন-সমাজ সব কিছু পাওয়া যাচ্ছে; এখন আর কেউ থিয়েটারে গিয়ে নাটক দেখবে না। চলচ্চিত্রের উদ্ভাবনের পরে এসেছে দ্বিতীয় আঘাত। এর পরে টেলিভিশনের বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান সম্প্রচার শুরু হলে আরেকটা আঘাত আসে।

সব আঘাত সহ্য করে এখনও সে টিকে আছে। কবিতার ওপর এমন দৃশ্যমান কোন আঘাত এসেছে বলে মনে হয় না। কারণ অন্তর্গত। অনেকটাই কবির নিজের কাছে। কার জন্য লেখেন প্রশ্ন করলে নাট্যকাররা বলেন, দর্শক-শ্রোতাদের জন্য।

গল্পকার-ঔপন্যাসিককে প্রশ্ন করলে বলেন, পাঠকের জন্য। প্রাবন্ধিক-কলামিস্ট-গবেষকও তা-ই বলেন। গীতিকারকে প্রশ্ন করলে জানান, তিনি শ্রোতার জন্য রচনা করেন। কিন্তু কবিদেরকে প্রশ্ন করলে বেশিরভাগ কবিই বলেন, নিজের জন্য লেখেন। যারা পাঠককে ধার না ধেরে শুধু নিজের জন্য লেখেন তাদের কবিতার বেশিরভাগই খুব দ্রুত কালের ধুলোয় ঢাকা পড়ে যায়।

লেখার সময় পাঠকের কথা ভাবেন না, প্রকাশের পরে কেন তবে পাঠকের বিরুদ্ধে বিমুখতার অভিযোগ? পাঠকের সঙ্গে সেতুবন্ধ রচনা না করতে পারলে কোন সাহিত্যই টিকে থাকতে পারে না। কবি ও পাঠকের মাঝে অনেক প্রকার সেতু তৈরি হতে পারে। যেমন : ১. বড় কাগজ, ছোট কাগজ, সাময়িকী : কবির দায়দায়িত্বের পরে আসে এসব কাগজের সম্পাদকদের দায়িত্ব। বড় কাগজগুলো পাঠক ঘেঁষা বলে অতি তরল কবিতা দিয়েও পাতা ভরেন। এতে প্রকৃত কবিতা মূল্য হারায়।

ছোট কাগজগুলো পাঠকের কথা মনে রাখে না। তাই তাদের মাধ্যমে কবিতা সব পাঠকের কাছে যেতে পারে না। ২. ওয়েবসাইট, ব্লগ সাইট, অনলাইন ম্যাগাজিন : ইথারে ভেসে বেড়ানো এসব মাধ্যম কবিতা পাঠকের কাছে সেতুবন্ধ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। প্রযুক্তির প্রসারে এ পদ্ধতি সহজ হলেও ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের মধ্যেই তা সীমাবদ্ধ। কবির নিজের ওয়েবসাইট-ব্লগ সাইটের কাজ সম্পাদিত হয় না।

তাই কবির স্বেচ্ছাচারিতার কাছে পাঠক-ব্রাউজার দায়বদ্ধ। সুসম্পাদিত হলে অনলাইন ম্যাগাজিনের মতো ওয়েবসাইট-ব্লগ সাইটও কবিতাকে একশ্রেণীর পাঠকের কাছে নিয়ে যেতে পারে। ৩. আবৃত্তির অ্যালবাম : আবৃত্তি শিল্পীরা এর মাধ্যমে কবিতাকে জনপ্রিয় করে তুলতে পারেন। ৪. কাব্যগ্রন্থ : প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করেন পাঠকের কাছে বিক্রয়যোগ্যতা যাচাই করে। অতি জনপ্রিয় কবি ছাড়া অন্যদের কাব্যগ্রন্থ বাজারে চালানো কঠিন, তাই প্রকাশকরা আজকাল এ ব্যাপারে অতিসতর্ক।

অনেক কবি নিজেই নিজের কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করেন বিশেষ করে তরুণরা। এগুলোরও সম্পাদনায় দুর্বলতা থাকে। বাজারজাত করাও ব্যক্তির পক্ষে সম্ভব হয় না। ৫. সভা, সেমিনার আলোচনা : একটা সময় ছিল যখন সভা-সেমিনার ভালো কবি ও কবিতার জন্য ছিল বিরক্তিকর। বর্তমানে তা প্রয়োজনীয়।

আলাপ-আলোচনা, আড্ডা-আসর, মতবিনিময় সভা লেখক-পাঠকের মধ্যে সুসম্পর্ক রচনা করতে পারে। কবি ও পাঠকের মধ্যবর্তী সেতুবন্ধগুলো দিয়ে যা চলাচল করছে তার গ্রহণযোগ্যতা পূর্বশর্ত। পাঠক যদি সেতু পেরিয়ে কবিতার দুর্গে প্রবেশ করে নিজের জন্য কিছু খুঁজে না পান, তাহলে দ্বিতীয়বার আর সেখানে যেতে চাইবেন না। অন্যকেও অনুপ্রেরণা দেবেন না। পাঠকের অংশগ্রহণ না থাকলে শুধুই কবির ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার মূল্য পাওয়া যায় না।

অতিমাত্রার আত্মকেন্দি ক, রোমান্টিক ভাবালুতাদুষ্ট কবিতায় পাঠকের আগ্রহ কম। এদেশে যাদের বই ভালো বিক্রি হয়, এমন দুই প্রজন্মের দুই কবির কবিতা নিয়ে সারাদিন ধরে আলোচনা করে এর জনপ্রিয়তার কারণ নির্ণয়ের চেষ্টা করে এই তথ্য পেয়েছি। শামসুর রাহমান ঈশ্বরগুপ্ত আর রবীন্দ নাথের পরেই প্রচুর কবিতা লিখেছেন। তার যেসব কবিতার স্বাদ বার বার নানা মাধ্যমে পাঠক গ্রহণ করে সেসব কবিতায় পাঠকের অংশগ্রহণের সুযোগ রয়েছে। স্বাধীনতা নিয়ে লেখা কবিতাগুলো পৃথিবীর যে কোন ভাষায় অনুবাদ করলে পাঠক আপন বলে মেনে নিতে পারবেন।

সুনির্দিষ্ট কোন দল বা জাতির পক্ষে লেখা হয়নি। যে কবিতা কয়েক লাখ তরুণের মনের কথাকে প্রকাশ করতে পারে, তার পাঠকপ্রিয়তা অনিবার্য। অসামান্য প্রতিভার অধিকারী হয়েও অনেকে এ গুণ আয়ত্ত করতে পারেন না। মৃত্যুর পর তাদের কাব্যগ্রন্থ সচরাচর কোথাও পাওয়া যায় না (স্মারক রচনাবলি ছাড়া)। ব্যঞ্জনা কিংবা গীতিময়তার অভাব, ভাষাগত অস্থিরতা কবিতাকে অনেকটাই পাঠকবিমুখ করেছে।

তবে কবিতা বিলুপ্ত হবে না। অন্ধকার যুগও প্রমাণিত হবে না। নাটক, উপন্যাস, ছোটগল্পসহ যেসব সাহিত্যধারা এখন জনপ্রিয় সেসবের জনপ্রিয়তার কারণ অনুসন্ধান করে দেখা যেতে পারে। যদিও উপন্যাসের সঙ্গে কবিতার তুলনা চলে না। কারণ এ ধারাটি শুরুতেই সব ভাষাতে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে।

কিন্তু নাটকের টিকে থাকার যোগ্যতা খুঁজে দেখা যেতে পারে। অতিমাত্রার রোমান্টিক জগৎ থেকে বেরিয়ে এসে এলিয়টের মতো কিছুটা ক্ল্যাসিকধর্মিতা অর্জন করা যেতে পারে। তবে সবকিছুই নির্ভর করছে শামসুর রাহমানের একটি কথার ভেতর তিনি বলেছিলেন, জীবন পাঠ করো মানুষ, পাঠ করো তবেই মানুষের কাছে যেতে পারবে। ------------------------------------------------------------------------- দৈনিক যুগান্তর সাময়িকী / ১৫ মে ২০০৯ শুক্রবার ছবি - মিলানী পপল


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।