আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ক্লান্তিহীন জনস্রোত

ঘুমাতে ভালবাসি সব রাজাকার ও যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে শাহবাগের প্রজন্ম চত্বরে ক্লান্তিহীন জনস্রোত অব্যাহত ছিল। তারুণ্যের প্রতিবাদে টানা পঞ্চম দিনও উত্তাল ছিল গোটা এলাকা। যুদ্ধাপরাধী রাজাকারদের ফাঁসির দাবিতে শাহবাগে গণজাগরণে পঞ্চম দিনেও ঢল নামে নবীন-প্রবীণের। ধারাবাহিক এ আন্দোলনে শরিক হচ্ছে বিভিন্ন বয়সী মানুষ। এ আন্দোলন নবীন-প্রবীণের ঐক্যের বাহুডোরে এক করেছে কয়েক প্রজন্মকে।

সে ঐক্যের টানে শাহবাগ মোড়ে গতকালও নেমেছিল জনতার ঢল। সমবেত জনতার মিছিল আর স্লোগানে বারবার উচ্চারিত হয়েছে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবি এবং সে দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত ঘরে না ফেরার অঙ্গীকার। গতকাল সকাল থেকেই স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত থাকে এ চত্বর। প্রজন্ম চত্বরের অগ্নিঝরা এসব স্লোগান একাত্তর না দেখা নতুন প্রজন্মকে দিয়েছে সেই উত্তাল অগ্নিঝরা দিনগুলোর স্বাদ। শাহবাগ মোড়ের প্রজন্ম চত্বরে সমবেত হওয়া অনেকেই আছেন, যারা কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে এসে আর ঘরমুখো হননি।

নাওয়া-খাওয়া ভুলে রাত-দিন এক করে তারা প্রজন্ম চত্বরে আছেন দাবির প্রতি অনড় হয়ে। আন্দোলনের চিত্র : শুক্রবার মহাসমাবেশে জামায়াত-শিবির ও যুদ্ধাপরাধীদের বয়কট করে শাহবাগ প্রজন্ম চত্বরে অবস্থানের যে আহ্বান জানানো হয় তার সঙ্গে মিল রেখে শুক্রবার সারা রাত হাজারো তরুণ-যুবক এখানে রাত কাটায়। তারা এর আগে থেকেই এমনি ধারাবাহিকভাবে রাতেও আন্দোলন করে আসছিলেন। আন্দোলনকে গতিশীল রাখতে তারা মশাল জ্বালিয়ে, মোমবাতি প্রজ্বলন করে বিভিন্ন প্রতিবাদী গান, স্লোগান, পথনাটক, গণস্বাক্ষরতার মধ্য দিয়ে পুরো রাত পার করেন। চার দিন ধরে শাহবাগ মোড়ে রাত কাটানো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আরাফাত রহমান মানবকণ্ঠকে বলেন, ‘বন্ধুদেরসহ আমি চারদিনই শাহবাগ মোড়ে কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে রাত কাটিয়ে আন্দোলনকে গতিশীল রাখতে চেষ্টা করছি।

আমাদের কোনো ক্লান্তি নেই। ’ কবির সুমনের ‘গণদাবি’ দিয়ে পঞ্চম দিনের সূচনা: গতকাল শনিবার পঞ্চম দিনের গণআন্দোলন শুরু হয় পশ্চিমবঙ্গের শিল্পী কবীর সুমনের শাহবাগ নিয়ে লেখা ‘গণদাবি’ গান দিয়ে। শনিবার ভোরের আলো ফোটার আগেই দিনের কর্মসূচি শুরু করে আন্দোলনকারীরা। সকালে আন্দোলনের শুরুতেই শাহবাগ চত্বরে সুমনের গান বেজে ওঠে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনের মাইকে। ভারতীয় বাঙালি গায়ক ও গীতিকার কবির সুমনের কলকাতায় বসে লেখা গানটি শুনেই উদ্দীপ্ত হন সমবেত মানুষ।

‘গণদাবি’ নামের ১২ লাইনের গানটি মাইকে বেজে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে উপস্থিত জনতাও কণ্ঠ মেলায়। মঞ্চের বাইরের মঞ্চ : মূল জাগরণ মঞ্চের বাইরে শাহবাগে শত শত মঞ্চ। সবার দাবি একটাই রাজাকারের ফাঁসি চাই। জাদুঘরের সামনে পারস্পরিক গভীরতার লক্ষ্যে (পাগল) নামে একটি সংগঠন বসে আছে তাদের সামনের একটি প্ল্যাকার্ডে লেখা ‘নরক থেকে ইয়াহিয়া তোর জন্য অপেক্ষা করছে কসাই’। একটু দক্ষিণে বসে আছে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থীরা, তার সঙ্গে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থীরা বসে আছেন একই দাবি নিয়ে।

বাউল সংগঠন পালাকার গান গাইছে বিচারের দাবিতে। মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কেন্দ্রীয় সংসদ সেই একাত্তরের স্লোগানে মুখরিত করে রাখছে এলাকা। স্বাধীনতা প্রজন্ম পরিষদের সামনে এক মুক্তিযোদ্ধার গলায় ফাঁসির দাবির প্ল্যাকার্ড। একই দাবিতে বসে আছে আহসান উল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, নর্দান ও ইউল্যাব ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা গিটার মাটিতে ফেলে অভিনব প্রতিবাদ করছে। প্রতিবাদ জানাচ্ছে মুক্তিযোদ্ধা সংহতি পরিষদ, হিউম্যান এইড ফাউন্ডেশন, বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সংগঠনসহ কয়েকশ’ সংগঠন।

চারুকলার সামনে গান গাইছেন তীরন্দাজ অবিচার প্রতিরোধ মঞ্চের শিল্পীরা। তার সামনে ১০০/৫০ ফুটের বিশাল পতাকা টানানো হয়েছে মাথার ওপর। রাজপথের পাশাপাশি সাইবার যুদ্ধও চলছে: তরুণরা যখন রাজপথে তখন সাইবার পরিসরে ছোট রাজাকার (শিবির) যেন সাইবার মাধ্যমে অপপ্রচার চালাতে না পারে তাই তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোও দখলে রাখছে। এজন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চলচ্চিত্র সংসদ, সাংবাদিক সমিতি, স্লোগান একাত্তর এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আইটি সোসাইটির একঝাঁক তরুণ জাদুঘরের উল্টোপাশে আইল্যান্ডের ওপর বসে জামায়াতের বিরুদ্ধে লড়ছে অনলাইনে। রাস্তা জুড়ে ব্যঙ্গ আলপনা: গণআন্দোলনকারীরা টিএসসি থেকে শাহবাগ, শাহবাগ থেকে কাঁটাবন, শেরাটনের সামনের সড়ক, মৎস্য ভবনের সামনের সড়ক পর্যন্ত কাদের মোল্লাসহ রাজাকারদের ফাঁসির দাবিতে ব্যঙ্গচিত্র আঁকছেন।

মানুষের পায়ের চাপে পিষ্ট হয়ে এই খুনি-ধর্ষকরা আরও বেশি ঘৃণার অনলে দগ্ধ হবেন-এ চিন্তা থেকেই ব্যঙ্গচিত্রগুলো আঁকছেন বলে জানান আন্দোলনকারীরা। গণসংগীত আর স্লোগানের তালে চলে আন্দোলন : প্রজন্ম চত্বরের গণজাগরণ মঞ্চ থেকে গত চারদিনের ধারাবাহিকতায় ভেসে এসেছে তীব্র স্লোগান। স্লোগানের ভাষায় শাণিত উচ্চারণে ধ্বনিত হয়েছে ফাঁসির দাবি। স্লোগান থামতেই শুরু হয় গণসংগীত। দুপুর রোদের প্রখরতা মাথায় নিয়েও চত্বরে গোল হয়ে বসে থাকেন সবাই।

দুপুর দেড়টায় মাইক্রোফোন হাতে নেন গণসংগীত শিল্পী শাহাবুদ্দিন। ‘আমরা সবাই বাঙালি’ গানের সুর তুলতেই গেয়ে ওঠে হাজারো কণ্ঠ। একে একে চারটি গান গেয়ে শোনান তিনি। এছাড়া গান স্লোগানের ফাঁকে ফাঁকে চলমান আন্দোলন নিয়ে কবির সুমনের ‘গণদাবি’ গানটিও মাইকে বাজানো হয়। তা শুনে আরো বেশি উজ্জীবিত হয়ে ওঠেন আন্দোলনকারীরা।

৭৫ বছর বয়সী নির্মলা সরকার। বয়সের বাধাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে তিনি এসেছেন পুরান ঢাকার সূত্রাপুর থেকে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে একাত্ম হতে। তিনি বলেন, ‘একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের মাত্র ১৩ দিন আগে রাজাকারদের সহায়তায় পাকবাহিনী আমার শ্বশুরকে হত্যা করে এবং আমাদের বসতবাড়ি পুড়িয়ে দেয়। তাই জীবন সায়াহ্নে আমার একটাই প্রত্যাশা-‘চিহ্নিত সকল যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি দেখে যাওয়া’। বিকেলের দিকে লোকজন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে স্লোগানের গর্জনও বাড়তে থাকে।

এ সময় দেখা যায় স্লোগান দিতে গিয়ে হুট করে এক ব্যক্তি মাথা ঘুরে পড়ে যায়। ব্যক্তিটি হলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা কবি জয়নাল আবেদিন। তিনি এসেছেন বিক্রমপুর থেকে, আন্দোলনে শরিক হতে। সামান্য শুশ্রƒষার মধ্যেই তিনি আবারো সুস্থ হয়ে উঠে প্রথমেই স্লোগান দিলেন ‘কাদের মোল্লার ফাসি চাই। ’ এ সময় তিনি বলেন, ‘৪২ বছর পর মুক্তিযুদ্ধ ফিরে পেয়েছি।

এখনো যুদ্ধ চলছে। এবারের যুদ্ধেও আমরা জয়লাভ করব। ’ নিরাপত্তা জোরদার : বিভিন্ন সময় বেশ কয়েকবার আন্দোলনের কেন্দ্র গণজাগরণের মঞ্চ থেকে ঘোষণা দেয়া হয় যে শিবির কর্মীরা নাশকতা সৃষ্টির জন্য আন্দোলনে আগত মানুষের সঙ্গে মিশে গেছে। তারা যেকোনো সময় নাশকতা ঘটাতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে গতকাল দুপুর ১২টায় আন্দোলনের সার্বিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা পরিদর্শনে আসেন ঢাকা মহানগর পুলিশের কমিশনার বেনজির আহমেদ।

এ সময় তিনি শাহবাগ এলাকায় দায়িত্ব পালনরত পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেন। পরে প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘এ আন্দোলনে নিরাপত্তাবলয় এখন নিñিদ্র। কোনো নাশকতাকারী যাতে সংঘাত ঘটাতে না পারে সেজন্য পুলিশ সতর্ক আছে। অতিরিক্ত পুলিশ রিজার্ভে আছে। ’ আসলেন তবে বক্তব্য দেননি মতিয়া চৌধুরী : শাহবাগে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে ছাত্র-জনতার চলমান আন্দোলনে সংহতি প্রকাশ করেছেন গণআন্দোলনের অগ্নিকন্যাখ্যাত আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী।

গতকাল সন্ধ্যা ছয়টার দিকে তিনি আন্দোলনস্থল শাহবাগে গণজাগরণ চত্বরে আসেন। সেখানে তিনি হাত নেড়ে হাজার হাজার আন্দোলনকারীর প্রতি সমর্থন জানান। তবে কোনো বক্তব্য রাখেননি মতিয়া চৌধুরী। এর আগে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কয়েক নেতা গণজাগরণ চত্বরে বক্তব্য দিতে এসে তোপের মুখে পড়েন। তবে ব্যতিক্রম ঘটে মতিয়ার বেলায়।

আন্দোলনকারীরা তাকে করতালির মাধ্যমে স্বাগত জানায়। মতিয়া চৌধুরী পাঁচ মিনিট আন্দোলনস্থলে অবস্থান করেন। তিনি এ সময় মাইক হাতে স্লোগান দেয়া এক তরুণ আন্দোলনকারীর মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ ছিল চোখে পড়ার মতো : গতকাল সকালে ইব্রাহিম মেডিকেল কলেজ ও ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের দল শাহবাগের তারুণ্যের দাবির সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে। ঢাকা মেডিকেল কলেজের ইন্টার্ন চিকিৎসকরাও এর সঙ্গে যোগ দিয়েছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগের একদল শিক্ষার্থী ক্লাস বর্জন করে শাহবাগের সমাবেশে যোগ দেন। সমাবেশে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চারুকলা ইনস্টিটিউশনসহ অন্যান্য বিভাগ ও রাজধানীর বিভিন্ন স্কুল-কলেজ ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অংশ নেয়। ছাড়বে না কেরানীগঞ্জের জনগণ : কাদের মোল্লা কেরানীগঞ্জের গণহত্যার যে অভিযোগে অব্যাহতি পেয়েছেন সেখানকার জনগণ অবস্থান নিয়েছে বঙ্গবন্ধু মেডিকেলের সামনে। কেরানীগঞ্জ মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ব্যানারে এ এলাকার জনগণের দাবি আদালতের রায় আমরা মানি না। আমাদের স্বজন হত্যার ন্যায় বিচার আমরা চাই।

‘মায়ের অপমানের শোধ নেব’ : ‘মা তোমাকে যারা অপমান করেছে তাদের রক্ত দিয়ে তোমার পা ধুয়ে দেব’- চল্লিশোর্ধ এক লোক গণস্বাক্ষরের জন্য রক্ষিত বিশাল ক্যানভাসে লিখে স্বাক্ষর করেন। লাখ লাখ স্বাক্ষর জমা হয়েছে এ ক্যানভাসে। আরেক তরুণ লিখেছে ‘শাহবাগের আন্দোলন ২০১৩-এর মুক্তিযুদ্ধ, একাত্তরপরবর্তী প্রজন্ম এর বীর সেনা’। সংহতি জানালেন যারা : পঞ্চম দিনেও শাহবাগে চলমান এই আন্দোলনের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেছেন বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষেরা। এদের মধ্যে রয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা গওহর রিজভী, শিক্ষাবিদ অধ্যাপক আনিসুজ্জামান ও অধ্যাপক রফিক উল্লাহ খান, ব্যবসায়ী আনিসুল হক, কবি শাহানা, ছায়ানটের শিল্পীবৃন্দ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.