আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সেইন্ট প্যাট্রিক্স ডে এবং থ্রি মাস্কেটিয়ার্স

.... তবুও আমি স্বপ্ন দেখি ... (স্বপ্ন, বাস্তব এবং ব্লগের সর্বস্বত্ব ব্লগার কতৃক সংরক্ষিত)

সেইন্ট প্যাট্রিক্স ডে ২০০৯-এর প্যারেডের ছবি ডাবলিনে যখন ২০০৭ সনে প্রথম আসি তখন নিতান্তই গোবেচারা ধরনের মানুষ আমি। পরিচিত বলতে সৈকত ভাই এবং ওনার স্ত্রী নদী। মাঝে মাঝে দেখা হলেও নিয়মিত দেখা বা কথা হতো না ওনাদের সাথেও। দূর্বোধ্য আইরিশ উচ্চারন আর জাঙ্কিদের অত্যাচারে রীতিমত কেঁচো হয়ে থাকতাম তখন। তারপর ধীরেধীরে অত্মবিশ্বাস বাড়তে শুরু করলো।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাবগুলোতে যেতে শুরু করলাম। পরপর দুবছর ট্রিনিটির পোস্ট গ্রাজুয়েট রিসার্চ জার্নালের সম্পাদকীয় প্যানেলের সদস্য হলাম। ওদের উচ্চারনটাও খানিকটা রপ্ত করলাম। ইউটিউব এবং অন্যান্য ওয়েব সাইটের সাহায্যে রাগবী খেলার নিয়ম-কানুন শিখলাম এবং আইরিশদের সাথে গলা ফাটিয়ে আমিও নিয়মিত আয়ারল্যান্ডের খেলা দেখতে শুরু করলাম। তবে তখনও একটা অপূর্নতা আমাকে পোড়াতো।

বাংলা বলা হতো না। চার পাশে কেবল আইরিশ আর আইরিশ। ২০০৮ এর অক্টোবরে বাংলাদেশ থেকে ধ্রুব আসলো কম্পিউটার সায়েন্সে মাস্টার্স করতে। ২০০৯ এর জানুয়ারীতে আসলো নাফিস। ফলে সেই অপূর্নতাটা আর রইলো না।

আমরা এখন রীতিমত দল বেঁধে খাওয়া থেকে শুরু করে কম্পিউটার সায়েন্সের কমনরুমে আড্ডাও দেই। মাঝে মাঝে আমি আমাদের তিন জনের এই দলটাকে বলি থ্রি মাস্কেটিয়ার্স। প্রথম যখন আসি তখন মনে হয়েছিল আমি বোধয় এই ক্যাম্পাসে কোনদিন বাংলা শুনতে পাবো না। ভাবতেই অবাক লাগে, আজ ইউরোপের এই ছোট্ট দ্বীপদেশ আয়ারল্যান্ডের ট্রিনিটিতে তিন বঙ্গদেশীয় মাস্কেটিয়ার্স দল বেধে আড্ডা দেয়, ঘুরে বেড়ায়! আজ ছিল ১৭ মার্চ। আয়ারল্যান্ডের জাতীয় জীবনে খুবই গুরুত্বপূর্ন দিন।

সেইন্ট প্যাট্রিক্স-এর মৃত্যুদিবস। সেইন্ট প্যাট্রিক্স হচ্ছেন এদেশের প্যাট্রন সেইন্ট। চারটা ব্রিটিশ হোম নেশনের চারজন প্যাট্রন সেইন্ট রয়েছেন। ইংল্যান্ডের সেইন্ট জর্জ (তার পতাকা তথা সেইন্ট জর্জ ক্রসই ইল্যান্ডের জাতীয় পতাকা), স্কটল্যান্ডের সেইন্ট এ্যান্ড্রু (সেইন্ট এ্যান্ড্রুর ক্রস স্কটল্যান্ডের জাতীয় পতাকা), ওয়েলসের সেইন্ট ডেভিস (সেইন্ট ডেভিস ক্রস ওয়েলসের জাতীয় পতাকা না হলেও, গুরুত্বপূর্ন একটা পতাকা হিসেবে গন্য করা হয়) এবং আয়ারল্যান্ডের সেইন্ট প্যাট্রিক্স। তাঁর পতাকা এক কালে আয়ারল্যান্ডের প্রধান পতাকা ছিল এবং ইউনিয়ান জ্যাকে (ব্রিটিশ ন্যাশনাল ফ্ল্যাগ) এই পতাকাই আয়ারল্যান্ডের প্রতিনিধিত্ব করছে।

এঁরা সবাই ধর্ম প্রচারের জন্য এদেশগুলোতে এসে ছিলেন এবং পরবর্তিতে মানুষের সাথে মিশে এবং শান্তির বানী প্রচার করে সেসব দেশেরই সন্তান হয়ে জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন। সেইন্ট প্যাট্রিক্স এর জন্ম ৩৮৭ খৃষ্টাব্দে অর্থাৎ জিজাস ক্রাইস্টের জন্মের ৩৮৪ বছর পর এবং হযরত মোহাম্মদ (সঃ) এর জন্মের প্রায় দুইশ বছর আগের ঘটনা। তিনি বর্তমান ওয়েলসে জন্মগ্রহন করেন এবং ১৬ বছর বয়সে জলদস্যুদের কবলে পড়ে আয়ারল্যান্ডে নির্বাসিত হন দাস হিসেবে। সেখানে ছয় বছর কাটানোর পর তিনি পালিয়ে ওয়েলসে ফিরে আসেন এবং পরবর্তিতে চার্চ কতৃক ধর্মীয় শিক্ষায় দিক্ষা নেন। আয়ারল্যান্ড থেকে ফিরে আসলেও তাঁর হৃদয় পড়ে ছিল আয়ারল্যান্ডে যেখানে তিনি দেখে এসেছিলেন হিংসা, হানাহানি আর অবিচার।

তাই এদেশের মানুষদের শান্তির বানী শোনাতে তিনি আবার ফিরে আসেন আয়ারল্যান্ডে। পরবর্তিতে জীবনের বাকি সময় এখানেই কাটিয়ে দেন তিনি। ৪৬১ খৃষ্টাব্দের এই দিনে তিনি মৃত্যুবরন করেন। আগেই বলেছি সেইন্ট প্যাট্রিক্স ডে আইরিশদের জীবনে খুবই গুরুত্বপূর্ন। তাছাড়া এসময়টায় পুরো দেশটাকে সাজানো হয় চমৎকার ভাবে।

ফলে ইউরোপের অন্য দেশগুলো থেকেও পর্যটকরা এদিনটা উপভোগ করতে চলে আসে ছুটি নিয়ে। এদিনের অন্যতম প্রধান আকর্ষন জাতীয় প্যারেড। আমাদের যেমন ২৬শে মার্চ বা ১৬ই ডিসেম্বর; আয়ারল্যান্ডের তেমনই ১৭ই মার্চ। নগরকেন্দ্রের মূল রাস্তাগুলোতে যানচলাচল পুরোপুরি বন্ধ থাকে সকাল থেকে। মানুষ পায়ে হেটে ঘুরে বেড়ায় শহরের মূল স্পটগুলো।

প্যারেড দেখা, আনন্দ করা, পাবে/বারে আড্ডা আর আইরিশ হুইসকি, গিনিজের বিয়ার আর বেইলীর কফি - চলতে থাকে সমান তালে। সকালে ঘুম থেকে উঠে পরিকল্পনা করলাম সিটি সেন্টার চলে যাবো। তারপর দেখা যাক কি হয়! ধ্রুবকে ফোন দিয়ে জানালাম দ্রুত আসতে। সে জানালো অন্তত দুঘন্টা সময় লাগবে আসতে। চিন্তা করে দেখলাম আমিও বরং সাওয়ার নিয়ে তারপর বের হই।

সিটি সেন্টার পৌছাতে পৌছাতে প্রায় তিনটা। বাস ট্রিনিটির আর্টস ব্লকের পাশে নামিয়ে দিয়ে বললো আর ঢুকবে না। তবুও স্বস্ত্বির নিঃশ্বাস ফেললাম। অনেক দূরে একবার পুলিশ আটকে ছিল বাসটাকে। পরে কি ভেবে ছেড়েদিল।

মনেমনে ভাবছিলাম ওখান থেকে হাটতে হলে জান শেষ। ট্রিনিটির পাশেই নামানোতে তাই খুশিই হলাম। রাস্তায় মানুষ আর মানুষ। অথচ তখন নাকি ভাঙ্গা মিলনমেলা। আসল মজা সব ১২টার আগেই শেষ হয়ে গিয়েছে।

মনেমনে ভাবলাম, তখন তাহলে কেমন ভীড় ছিল! যাইহোক, বাস থেকে নেমে এলোমেলো হাটতে শুরু করলাম। এলোমেলো হলেও লক্ষ্যহীনতার মাঝে একটা লক্ষ্য এসেই যাচ্ছিল। একটু একটু করে ভীড় ঠেলে আমি স্পায়ার অব ডাবলিনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। এটাকে বলা হয় পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু স্কাল্পচার; আনঅফিসিয়ালী ডাবলিনের জিরো পয়েন্টও এটা। ধ্রুবকে ফোন দিয়ে জানলাম বেচারাকে বাস অনেক দূরে নামিয়ে দিয়েছে।

সে কষ্ট করে হেটে বাকি পথ আসছে। আমি এই ফাকে ছবি তোলা এবং ভিডিও করার কাজ শুরু করলাম। গালে সবুজ, সাদা আর হলুদ রঙ্গের পতাকা অথবা তিনকোনা সবুজ আইরিশ পাতা এঁকে সবাই ঘুরে বেড়াচ্ছে। রাস্তায় ছেলেমেয়েরা রং-তুলি নিয়ে দাড়িয়ে আছে। দুই ইউরো দিলেই এঁকে দিচ্ছে।

অনেকেই ঐতিহ্যবাহী সবুজ আইরিশ হ্যাট পরে ঘুরছে। এদিনে একটা বিশেষ প্রচলন ছিল অনেক আগে। কেউ শরীরের সবুজ কিছু না পরলে চিমটি কাটা হতো। এখন আর সেটা করে না যদিও। তবুও খারাপ লাগছিল।

আমার শরীরের কোন সবুজ পোশাক বা রঙের আঁচড় ছিলনা। চিন্তা করলাম, একদিনের জন্য আইরিশ হলে মন্দ কি? দৌড়ে গিয়ে দোকান থেকে একটা আইরিশ হ্যাট কিনে নিলাম। তারপর আবার শুরু করলাম ভিডিও সেশন। ফাকে ফাকে ফটোতোলা। অলিখিত আইরিশ জাতিরজনক ও'কনেল সাহেবের মূর্তীর উপর অনেকগুলো ছেলেমেয়ে উঠে নাচানাচি শুরু করেছিল।

পুলিশ প্রথমে তাদের থামানোর চেষ্টা করে, পরে নিজেরাও মজা পেয়ে চলে আসে। বেশ কিছু সময় ওখানে দাড়িয়ে ভিডিও করলাম। খানিক পরেই ধ্রুব আসলো। ওকে নিয়ে গেলাম সুপারম্যাকে খাওয়া-দাওয়া করতে। খেতে খেতে নাফিসের ফোনে রিং দিলাম।

কল ভয়েস ম্যাসেজে চলে যায়। ধ্রুব বললো নাফিস নাকি ভোর পাঁচটা পর্যন্ত জেগে ছিল। অতএব সে এখন ঘুমের কোন স্তরে আছে সেটা আমাদের কাছে আর অজানা রইলো না। সুপারম্যাক থেকে বের হয়ে নিজেদের কিছু ছবি তুললাম। আজব সব পোশাকে আইরিশ তরুনীদের দেখে হাসাহাসিও করলাম।

এক মেয়ে একটা টি-শার্ট পরেছে। সেখানে বুক বরাবর দুটো হাতের পাতার ছবি। দেখে মনে হয় কেউ হাত দিতে যাচ্ছে - এরকম! আরেকজনের বুকে লেখা 'কিস মি!'। আমি আর ধ্রুব কিছু সময় হাসাহাসি করলাম। কিসটা কোথায় করার জন্য আহবান জানানো হচ্ছে সেটাই হাসির বিষয়বস্তু।

রীতিমত টিনএ্যাজারদের মত আমরা মজা করতে করতে সিনেওয়ার্ল্ডের দিকে হাটতে লাগলাম। গতকাল ধ্রুব সিনেমা দেখার আনলিমিটেড টিকেট কেটেছে (আমার এবং নাফিসের আগে থেকেই আছে)। ফলে সে এখন মাসে যত খুশি ছবি দেখতে পারবে। একটা অতি জঘন্য ব্রিটিশ মুভি দেখলাম। বৃটেনের সবচেয়ে নামকরা কয়েদীকে নিয়ে ছবিটা বানানো।

গত ৩৬ বছর সে জেলে আছে এবং এখনও মুক্তির কোন ডেড লাইন নেই তার। বিকৃত মস্তিষ্কের এই কয়েদীকে নিয়ে রক্তারক্তির এক ছবি ব্রনসন। ছবি দেখে বের হয়ে আমরা বার্গার কিং-এ বসে আইসক্রিম খাচ্ছিলাম। এসময় নাফিস এসে পৌছালো। অতঃপর থ্রি মাস্কেটিয়ারস এর তিনজন আমরা এক হলাম।

বেশ কিছু সময় বার্গার কিং-এ আড্ডা দিয়ে সন্ধ্যা যখন নামতে শুরু করেছে তখন আমরা ফিরতে শুরু করলাম বাসার উদ্দেশ্যে। ধ্রুব এবং নাফিসকে বিদায় দিয়ে আমি হেটেহেটে ৭৪ রুটের বাস ধরার জন্য ট্রিনির সামনে এসে দাড়ালাম। আমার হাতে তখন এক ডজন কলা, দুই বক্স স্ট্রভেরী এবং এক বক্স লাল-সবুজ মিক্সড আঙ্গুরের স্তুপ। অনেক দিন ফলফলারী খাওয়া হচ্ছে না। তাই রীতিমত বাজারের ব্যাগের এক ব্যাগ ফল কিনে ফেললাম।

বাসার কাছে বাস থেকে নামার পর ইচ্ছে হলো হাসের রোস্ট খেতে! ইচ্ছেকে দমিয়ে রাখা ঠিক না!! অতএব দ্রুত গিয়ে হাসের রোস্ট কিনে তবেই বাসায় ফেরা। খানিক আগে ডাকরোস্ট উইথ মাশরুম এন্ড ব্ল্যাকবিন সস দিয়ে ডিনার শেষ করে এসে ল্যাপটপে বসে মনেমনে ভাবছিলাম - আহ! সেইন্ট প্যাট্রিক্স ডে তাহলে মন্দ কাটেনি! পাঠক আপনার কি মনে হয়? ১৭ মার্চ ২০০৯ ডাবলিন, আয়ারল্যান্ড।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.