আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

একবিংশ শতাব্দীর মোসাহেবী

আমি এমন এক সাধারন মানুষ হতে চাই যে অসাধারন হবার পেছনে দৌঁড়ায়না এবং বিনা প্রশ্নে কিছু গ্রহন করেনা ।

বারশো শতকের কোন এক বসন্তে রাজ্যের রাজা খোশমেজাজে থাকিলে তিনি আদেশ করিলেন পন্ডিতবর্গ সমেত রাজ্যের সকল কবিকূলকে তাহার সভায় আসিয়া উপস্থিত হইতে । সেই বছরে কোষাধজ্ঞে প্রভূত পরিমাণ সম্পদ আসিয়া জড় হইয়াছে । এই দেখিয়া উৎফুল্ল রাজা মনঃস্থির করিলেন পন্ডিতবর্গ সমেত কবিকূলকে ডাকিয়া তাহাদের নিকট নিজের তারিফমাখা কাব্য শুনিবেন । রাজা আরো ঘোষণা করিলেন যেই কবি তাহাকে নিয়া সবচাইতে উৎকৃষ্ট মানের কাব্য রচনা করিবেন তাহাকে তিনি তাহার রাজ্যের মন্ত্রী বানাইবেন ।

সরাসরি রাজ্যের সভায় তাহার নিয়মিত উপস্থিত থাকিবে । সভার দিনে গোটা রাজ্য হইতে সকল কবিকূল , পন্ডিতবর্গ আসিয়া উপস্থিত হইলেও গণেশ নামক এক হতদরিদ্র কবির অনুপস্থিতির খবর রাজাকে ক্রোধে অস্থির করিয়া দিলো । তাহার মনে হইতে লাগিলো বেটা ইচ্ছা করিয়া রাজার খোশমেজাজের সুযোগ গ্রহণ করিয়া তাহাকে ছোট করিয়াছে । রাজা পেয়াদা পাঠাইয়া জানিতে চাহিলেন গণেশ নামক সেই হতচ্ছাড়া কবির অনুপস্থিতির হেতু কি । পেয়াদারা সকল খবরাখবর নিয়া আসিয়া রাজাকে জানাইলো যে গণেশ সরাসরি মুখের উপর বলিয়া দিয়াছে কারো পছন্দমাফিক কাব্য রচনা করিলে তাহা আর কাব্য থাকেনা ।

সেই রচনা স্রেফ মোসাহেবীতে পরিণত হইয়া কাব্যের জগতে লুটোপুটি খাইতে থাকে । কাব্যের মর্মকে স্পর্শ করিতে হইলে কারো পছন্দমাফিক কাব্য রচনা করা কোন কবির পক্ষে সম্ভব নহে । সে হতদরিদ্র হইতে পারে কিন্তু কাব্য রচনার নামে কারো মোসাহেবী করিতে পারেনা । রাজা সব শুনিয়া তেলেবেগুনে জ্বলিয়া উঠিলেন । প্রথমে ভাবিলেন নিমেষের মধ্যে সেই কবির মস্তক কর্তন করিয়া নিজের পোষা কুকুরকে তাহার মাংস খাওয়াইবেন ।

দীর্ঘসময় যাবত এমন এক তীব্র ইচ্ছা রাজাকে মোহাচ্ছন্ন করিয়া রাখিলো । কিন্তু রাজার অতীব বুদ্ধিমান সেনাপতি রাজাকে ভিন্ন এক পরামর্শ প্রদান করিলেন । এক সময় সেনাপতি সাহেব নিজে টুকটাক কাব্যচর্চা করিতেন বিধায় স্পষ্টতই জানিতেন কবি হোক কি বিদ্বান তাহারা প্রত্যেকেই বাসনা করিয়া থাকে যেন তাহাদের লেখা বা বিদ্যা যেন পাঠক কর্তৃক পৌঁছায় । নিজেদের বিদ্যা , লেখা ইত্যাদি সমূহ অন্য মানুষে না দেখিলে কিংবা অধ্যয়ন না করিলে কবি হোক কিংবা পন্ডিত তাহারা মনে মনে এমনিতেই মরিয়া যায় । কাজেই সেনাপতি মস্তক ছিন্ন করবার চাইতেও নির্মম কোন উপায়ে সেই বেয়াড়া কবিকে শায়েস্তা করিবার প্রস্তাবনা রাজার নিকট পেশ করিলেন ।

রাজা সেই প্রস্তাবনা শুনিয়া সেনাপতির বুদ্ধির তারিফ না করিয়া পারিলেন না । আসলেই তো , সেই কবিকে কি এমনি এমনি সহজে ছাড়িয়া দেওয়া যায় ? তাহাকে পিষে মারিতে হইবে , যন্ত্রণা দিয়া শেষ করিতে হইবে । রাজা সেই মোতাবেক গণেশ বাদে আর সকল কবিকূল এবং পন্ডিতবর্গকে অর্থ , বিত্ত , ক্ষমতা দ্বারা তাহাদের রাজার নিকট আজীবন কৃতজ্ঞ রাখিবার ব্যবস্থা করিলেন । তাহারা রাজার পোষা কুকুরের ন্যায় রাজার তাবেদারী করিতে লাগিলো । অন্যদিকে গণেশকে এই শাস্তি প্রদান করিলেন যে তাহার কোন প্রকারের কাব্য তার রাজ্যে প্রচার অথবা প্রকাশ নিষিদ্ধ ।

গণেশ মৃত্যুভয়ে আদপেই ভীত ছিলোনা কিন্তু রাজার এই আদেশ তাহাকে প্রচন্ডরুপে বিধ্বস্ত করিয়া ছাড়িলো । গনেশ মানসিকভাবে দিনে দিনে ভাঙ্গিয়া যাইতে লাগিলো । তাহার কাব্য পড়িবার মতো মানুষই যদি না থাকে তবে কি হইবে ? সে কি নিয়া বাঁচিবে ? গণেশের আর বেশী দিন এই দুর্যোগ সহ্য করিতে হইলোনা । গ্রীষ্মের এক সকালে নিজ গৃহের সামনে তাহার মৃতদেহ দেখা গেলো । সেই দেহে দারিদ্র্যের ছাপ স্পষ্ট দৃশ্যমান ছিলো ।

রাজা খবর শুনিয়া আমোদে চোখ বুজিলেন । সেই সময় থেকে নিমেষে যখন একবিংশ শতাব্দী এসে আমাদের মনোজগত সব আচ্ছন্ন করে বসে আছে তখন রাজার জায়গায় আসীন হয়েছে প্রতিষ্ঠান । রাজার ন্যায় কোন সাকার আকৃতি তার নয় কিন্তু প্রভাব ততটাই ভয়ংকর । বরং বলা যায় তার চাইতেও বেশী । সেই প্রতিষ্ঠান সমূহের হর্তাকর্তারা অতি অমায়িক , হাস্যজ্জ্বল , পরিষ্কার পোশাক পরা ভদ্রলোক ।

কিন্তু যেহেতু প্রাতিষ্ঠানিকতার প্রভাব চারিদিকে এক্সপান্ড করবার প্রতিজ্ঞায় নিজেদের নিয়োজিত রেখেছেন তাই তারা আদিকালের রাজার ন্যায় সরাসরি নিজেদের গুণকীর্তন করবার জন্য লেখা অর্ডার করেন না । তারা লেখককূলকে লেখার বিষয়বস্তু নির্ধারণ করে দিয়ে আনন্দে দিনানিপাত করেন । তারা সম্পূর্ণরুপেই ওয়াকিবহাল তাদের মন পছন্দের বিষয়বস্তুর লেখা নিয়েই লেখকরা তাদের দরজার সামনে ভিক্ষুকের মতো দাঁড়িয়ে থাকবে ঘন্টার পর ঘন্টা । যেই সিস্টেম তারা তৈরী করে বসে আছেন এর থেকে বের হবে সাধ্য কার ? তারা লেজ নাড়াতে বলবেন , তাদের পছন্দমাফিক লেজ নাড়াবে অজস্র বাধ্যগত লেখক । সাহিত্যের সাথে বীমা কোম্পানীর দলিলের তফাৎ বিস্মৃত হওয়া এক পাল দালাল লেখকের মাঝ থেকে দুই তিন জনকে পুরষ্কৃত করে বাকিদের পরবর্তী সময়ের জন্য আবার লাইনে দাঁড় করিয়ে দাও ।

একেবারে নিঁখুত এক হিসাব , চুলচেরা ভুল হবার কোন সম্ভাবনা নেই । এমনই এক ক্রান্তিকালে হাফিজ একবিংশ শতাব্দীর সাহিত্যজগতের এই নোংরা খোলনলচে যখন অনুধাবণ করতে সক্ষম হলো সে কিন্তু গণেশের মতো দিনের পর দিন বিপর্যস্ত হয়ে দিন কাটিয়ে মারা পড়েনি । বছর দশেকের পরেও যেহেতু কারো পছন্দমাফিক লেখা সে কখনো লেখেনি তাই অবশেষে কোণঠাসা হয়ে পড়লে কলম পেষাই বন্ধ করে দিয়ে নিজের ভালোবাসার অপমৃত্যু ঘটিয়ে দিলো । হাফিজ মাথানত না করার সন্তুষ্টি নিয়েই লেখার ইতি টেনে দিয়েছিলো ।



এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.