আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শিকার



শপিং মলের সাম্নের লম্বা ফাঁকা জায়গাটা দিয়ে ধীরে ধীরে গাড়ী চালিয়ে আসার সময় বাচচাটাকে দেখতে পেল শেরিডান। ‘কাজিনটাউন’ লেখা নিয়ন সাইনটার নিচের মেইন দরজাটা ঠেলে বেরিয়ে আসলো ছেলেটা। বয়স বড়জোর তিন থেকে পাঁচ হবে। চেহারায় এমন একটা অভিব্যক্তি, যার সাথে শেরিডান ভালভাবেই পরিচিত। না কাঁদার চেষ্টা করছে বাচ্চাটা, কিন্তু একটু পরেই কাঁদা শুরু করবে।

একমুহূর্তের জন্য একটু থাম্লো শেরিডান, নিজের উপর একটা হাল্কা বিরক্তি অনুভব করলো...যদিও যতবার এক্টা করে বাচ্চা তুলে নেয়, অনুভূতিটা ততই একটু একটু করে গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে। প্রথমবার এক সপ্তাহের জন্য ঘুমাতে পারেনি। খালি চিন্তা করত ওই বিশাল থলথলে তুর্কিটার কথা, নিজেকে মিস্টার উইজার্ড বলে পরিচয় দেয়। খালি ভাবত ব্যাটা বাচ্চাগুলোকে নিয়ে কি করে। “নৌকাভ্রমনে যায় ওরা, মিস্টার শেরিডান”, তুর্কিটা বলেছিল ওকে, কিন্তু কথাটা শোনাত এরকম – নৌকা বরমনে জায় অরা, মিশটার শারডান।

তুর্কিটা হাসত। হাসিটা বলত, নিজের ভাল চাইলে এই ব্যাপার আর কিছু জিজ্ঞেস করবি না। কোন ধরনের আন্‌চলিক টান ছাড়াই পরিস্কারভাবে বুঝিয়ে দিত। শেরিডান আর কখনো জিজ্ঞেস করেনি। কিন্তু তার মানে এই না যে এটা নিয়ে ভাবত না।

বিশেষ করে পরেরদিকে। ছটফট করত। ভাবত আরেকবার যদি সবকিছু নতুনভাবে শুরু করার সুযোগ পেত, তাহলে ওই প্রলোভনের হাত থেকে বেচে যেত। দ্বিতীয়বার প্রায় একিরকম..তিনবারের বার আরেক্টু কম...আর চারবারের বার ওই ‘নৌকা বরমন’, আর শেষের দিকে বাচচাগুলোর ভাগ্য নিয়ে ভাবা প্রায় ছেড়েই দিয়েছিল । মলের সামনে প্রতিবন্ধীদের পার্কিং স্পেসেগুলোর একটাতে ওর ভ্যানটাকে রাখলো শেরিডান।

ল্যাংড়া-লুলাদের জন্য সরকার যে লাইসেন্স প্লেট দেয় তার একটা ওর গাড়ীতেও সাটানো আছে। প্লেটটা তারকাছে সোনার মতই দামি, কারন মল পুলিশদের সন্দেহ করা থেকে বিরত রাখে ওটা। আর জায়গাগুলো সুবিধাজনক, প্রায় সবসময় খালি পড়ে থাকে। এই কাজে নিয়ম হল সবসময় ভান করবা তুমি কিচ্ছু খুজতাস না, আর কামের একদুইদিন আগেই লুলাদের এক্টা প্লেট চুরি করে নিবা। কিন্তু এসব হাবিজাবি চিন্তা করার সময় নাই; দৌড়ের উপর আছে সে।

আর ওই বাচ্চাটা বিশাল কিছু সমস্যার সমাধান করে দিতে পারে। গাড়ী থেকে বের হয়ে বাচ্চাটার দিকে এগলো, বাড়তে থাকা এক ভীতি নিয়ে এদিক ওদিক তাকাচ্ছিল বাচ্চাটা। হ্যা, বয়স পাঁচই হবে, ছয়ও হতে পারে – বেশ রোগা। কাচের দরজা ভেদ করে বেরিয়ে আসা ফ্লুরসেন্টের কড়া আলোয় বাচ্চাটাকে কাগজের মত সাদা দেখাচ্ছিল, শুধু ভয়ে নয় মনে হয় শারীরিক ভাবেও অসুস্থ। শেরিডান মনে হলো প্রচন্ড ভয়ের জন্য ওরকম লাগছে।

ওই চেহারা দেখলেই সে চিন্তে পারে, গত দেড়-দুই বছর ধরে আয়নার দিকে তাকিয়ে অনেকবার ওই চেহারা দেখেছে সে। আশান্বিত চোখে চারপাশের লোকজনের দিকে তাকাচ্ছিল বাচ্চাটা। কেনাকাটার জন্য অস্থির লোকজন মলে ঢুকছে, প্যাকেটে বোঝাই হয়ে বেরিয়ে আসছে। হতবুদ্ধি চেহারা। যেন মাদকাসক্ত।

তাদের পরিত্ৃপ্তি দিয়ে মনে হয়। টাফস্কিন জিন্স আর পিটসবার্গ পেংগুইন্স টি-শার্ট পরা। সাহায্যের জন্য কাউকে খুজছিল। এমনকেউ যে ওকে দেখেই বুঝবে কোন সমস্যা হয়েছে। জিজ্ঞেস করবে – কি, আব্বুকে হারিয়ে ফেলেছ? অথবা জিজ্ঞেস করতে পারে - বন্ধু খুঁজছ ? আমি এসে গেছি, এগিয়ে আসতে আসতে মনে মনে বল্লো শেরিডান।

আমি এসে গেছি, আব্বু – আমিই তোমার বন্ধু হব। প্রায় হাতের নাগালে চলে আসছিল বাচ্চাটা, এমন সময় একটা মল-পুলিশকে ধীরপায়ে দরজার দিকে এগিয়ে আসতে দেখল শেরিডান। হাটতে হাটতে পুলিশটা পকেটে হাত ঢুকালো, মনে হয় সিগারেটের প্যাকেটের জন্য। ব্যাটা বাইরে এসে বাচ্চাটাকে দেখলে, ফস্কে যাবে নিশ্চিত শিকারটা। শাআলা।

যাকগে বাচচাটার সাথে তো আমাকে কথা বলতে তো দেখবে না ব্যাটা। নইলে ঘটনা আরো প্যাচ খেত। শেরিডান একটু পিছু হটে এসে পকেট হাতড়াবার ভান করতে লাগলো, যেন দেখছে গাড়ীর চাবিটা নিয়ে এসেছে কিনা। ওর চকিত দ্ৃষ্টি ছেলেটা থেকে সিকিউরিটি পুলিশ, পুলিশ থেকে আবার ছেলেটার উপর ঘুরতে লাগলো। ছেলেটা কাঁদতে শুরু করেছে।

তবে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে না। এখনো না আরকি। ‘কাজিন্টাউন’ এর লাল আলোয় প্রতিফলিত গোলাপী বড় বড় পানির ফোটা ওর গাল গড়িয়ে নামতে লাগলো। ইনফরমেশন বুথে দাড়াঁনো মেয়েটা হাত তুলে পুলিশটাকে থামিয়ে কিছু একটা বল্লো। মেয়েটা দেখতে আকর্ষনীয়, কালো চুল, বয়স পঁচিশের মত হবে; আর পুলিশটার সোনালী চুল, মুখে গোঁফ।

পুলিশটা হেসে কনুইয়ে ভর দিয়ে দাঁড়াল। শেরিডানের মনে হলো ওদেরকে দেখে ম্যাগাজিনের পেছনের সিগারেটের বিজ্ঞাপনের মত লাগছে। সালেম স্পিরিট। লাইট মি লাকি। ও এখানে মরতে বসেছে আর ওরা ওখানে পিরিতের আলাপ লাগিয়েছে – আজকের সন্ধ্যায় কোন কাজ আছে তোমার, আমার সাথে যাবে নাকি নতুন রেস্টুরেন্টাতে, এরকম আরো সব ফালতু বক্কর-ঝক্কর।

এখন মেয়েটাও ওর সাথে টাঙ্কি মারছে। ভাল ভাল। হঠাৎ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেল্ল শেরিডান, চান্সটা সে নেবে। বাচচাটার বুক টান খাচ্ছে। চিৎকার করে কান্না শুরু করার সাথে সাথে কেউ না কেউ ওকে লক্ষ করবে।

ষাট ফুট দূরে পুলিশ নিয়ে শেরিডান কাজ করা পছন্দ করে না, কিন্তু চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে মিস্টার রেজীর মার্কারের ব্যবস্থা করতে না পারলে বিশাল দুই পালোয়ানের সাথে দেখা হওয়া আছে কপালে। দেখা হবার সাথে সাত্থে ওর দুই হাতে অপারেশন চালাবে ওরা। কয়েকটা এক্সট্রা কনুই যোগ করবে প্রত্যেক হাতে। বাচচাটার কাছে হেঁটে গেল ও। বড়সড় একটা লোক সে, সাধারন ভ্যান হেউসেন শার্ট আর খাকি প্যান্ট পরা।

চওড়া, সাধারন চেহারার। প্রথম দৃষ্টিতে দয়ালু বলেই মনে হয়। বাচচাটার উপর ঝুকলো সে, হাত হাটুর কিছু উপরে রাখা। ফ্যাকাসে ভয় খাওয়া চেহারাটা তুলে শেরিডানের দিকে তাকাল বাচচাটা। পান্নার মত সবুজ দুটো চোখ, অশ্রুজলে ধোয়া, আলোতে প্রতিফলিত হয়ে সেই রঙ আরো জোরাল হয়ে উঠেছে।

“কি আংকেল, আব্বুকে হারিয়ে ফেলেছ?” শেরিডান জিজ্ঞেস করলো। “দাদুভাই,” চোখ মুছে বল্লো বাচচাটা। “দা...দা...দাদুভাইকে খুঁজে পাচ্ছিনা!” এইবার ফোঁপাতে লাগলো, মলে ঢুকতে যাবার সময় হাল্কা উদবেগ নিয়ে তাকালো একটা মহিলা। “ইটস অলরাইট,” বল্লো শেরিডান, মহিলা চলে গেল। সান্তনা দেবার জন্য একটা হাত রাখলো ছেলেটার কাধে, একটু ডানদিকে সরিয়ে নিল ওকে...ভ্যানের দিকে।

তারপর ভেতরের দিকে তাকাল। পুলিশটার মুখ এখন ঠিক মেয়েটার মুখের পাশে। মনে হচ্ছে আজকের রাতে মেয়েটার ভাগ্য সিগারেটের বিজ্ঞাপন্টার থেকেও মজার হবে। শেরিডান রিল্যাক্স হলো। এই মুহূর্তে রাস্তার ওইপারের ব্যাঙ্কে ডাকাতি ঘটে গেলেও ওই পুলিশের কোন খবর হবে না।

বাম হাতের খেল হতে শুরু করেছে ব্যাপারটা। “দাদুভাইয়ের কাছে যাব!” কাদছিল বাচ্চাটা। “অবশ্যই যাবে, অবশ্যই যাবে,” শেরিডান বললো। “আমরা ওকে খুজে বের করব। কোন চিন্তা কোর না।

“ বাচচাটাকে আরেকটু ডানে সরিয়ে নিল সে। ছেলেটা মুখ তুলে তাকাল ওর দিকে, হঠাৎ আশান্বিত। “পারবেন? আপনি পারবেন আঙ্কেল?” “আবার জিগস!” শেরিডান বল্লো, সানন্দে দাঁত বের করে হাসলো সে। “হারান দাদুভাইদের খুজে বার করা...বলতে পারো আমার একটা স্পেশালিটি। “ “তাই?” বাচচাটা একটু করে হাসলো, চোখ থেকে তখনো পানি ঝরছে।

“আলবাত”, শেরিডান বল্লো, চট করে দেখে নিল মলের ভেতরে পুলিশটাকে, প্রায় দেখাই যাচ্ছে না (আর পুলিশটাও যদি এখন এদিকে তাকায়, শেরিডান আর বাচচটাকে বলতে গেলে দেখতেই পাবে না), ব্যাটা এখনো পুরো মজে আছে। সে জিজ্ঞেস করলো। “আংকেল, তোমার দাদুভাই কি পরে ছিল?” “একটা স্যুট,” বল্লো ছেলেটা। “ও সবসময় একটা স্যুট পরে থাকে। একবার খালি দেখেছিলাম জিন্স পড়তে।

” এমনভাবে বল্লো যেন ওর দাদুভাইয়ের সম্বন্ধে এসব শেরিডানের জানা উচিত। “নিশ্চই কালো স্যুট পড়েছিল, তাই না”, শেরিডান বল্লো। চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো ছেলেটার। “আপনি দেখেছেন! কোথায়?” আগ্রহের সাথে দরজার দিকে ফিরতে গেল। কান্না ভুলে গেছে।

কোনমতে ওই ফ্যাকাসে চেহারার ছোড়াটাকে পাকড়ে ধরা থেকে নিজেকে সামলে নিল শেরিডান। ওটা মস্ত বড় ভুল হয়ে যাবে। লোকজনের চোখে পড়বে। এমনকিছু করা যাবে না যেটা মানুষজন পরে মনে করতে পারে। ওকে আগে ভ্যানে তুলতে হবে।

ভ্যানের উইন্ডশিল্ড ছাড়া সব সান-ফিল্টার কাচ। জানলায় মুখ ঠেকিয়ে না তাকালে ভেতরে কি হচ্ছে বোঝা অসম্ভব। খুব তাড়াতাড়ি ওকে ভ্যানে তুলতে হবে। ছেলেটার হাতটা ছুল সে। “আমি ওকে ভেতরে দেখিনি, আংকেল।

ওইখানে দেখেছি। ” অজস্র গাড়ীতে ভরতি পার্কিং লটের অপরদিকে সে আংগুল তুলে দেখাল। একদম শেষ মাথায় একটা এক্সেস রোড, আর তারপরে ম্যাকডোনাল্ডের হলদে জোড়া বাঁক। “দাদুভাই ওখানে কেন যাবে?” এমনভাবে জিজ্ঞেস করলো ছেলেটা যেন শেরিডান অথবা দাদুভাই – অথবা দুজনেরি – মাথা খারাপ হয়ে গেছে। “জানি না,” শেরিডান বল্লো।

মাথায় এক্সপ্রেস ট্রেনের গতিতে ছূটে চলছিল চিন্তাগুলো। এইরকম মুহূর্তে সবসময়েই তার যেমন হয় । হাতে বেশি সময় নাই । ভাওতাবাজী বন্ধ করে হয় কাজ উদ্ধার করতে হবে, নাহয় ভালোয় ভালোয় ছেড়ে দিতে হবে। দাদুভাই।

বাপি না, আব্বু না, দাদুভাই। বাচচাটা তাকে শুধরে দিয়েছে এ ব্যাপারে। শেরিডান সিদ্ধান্ত নিল। “আমি কিন্তু সিওর উনিই ছিলেন। কালো স্যুট পড়া বুড়ো ভদ্রলোক।

সাদা চুল...সবুজ টাই...” “দাদুভাই তো নীল টাই পড়ে ছিল”, ছেলেটা বল্লো। “ও জানে আমার নীলটাই খুব পছন্দ। “ “হ্যা, নীল হতে পারে,” শেরিডান বল্লো। “এই লাইটের আলোয় কে বলতে পারে? আস, ভ্যানে উঠে পড়। উনার কাছে পৌছে দেব।

“ “আপনি ঠিক ত যে ও দাদুভাই ছিল? কারন ওর তো ওখানে যাবার কথা না যেখানে ওরা –“ শেরিডান কাঁধ ঝাকালো। “দেখ বাবা, যদি মনে হয় ওটা উনি না, তাহলে তুমি ওনাকে খুজতে থাক। দেখ খুজে পাও কিনা। “ গটগট করে হেটে রওনা দিল সে ভ্যানের দিকে। টোপ গিলছে না বাচচাটা।

একবার ফিরে যাবার কথা ভাবল, আবার চেষ্টা করার জন্য। কিন্তু অনেকক্ষন ধরে চলছে ব্যাপারটা – মানুষের নজরে পড়ে এমন সাক্ষাৎ ন্যুনতম পর্যায় রাখতে হবে, নাহলে কপালে হ্যামারটন বে তে বিশবছর। অন্য আরেকটা মলে যাওয়াই ভাল। হয়ত স্কটারভিলে। অথবা – “দাঁড়ান, আংকেল!” বাচচাটা ডাক দিল।

ভয়ার্ত স্বর। স্নিকারের হাল্কা ধুপধুপ শব্দ হলো। “দাড়ান! ওকে বলে ছিলাম আমার পিয়াস পেয়েছে, বোধহয় ড্রিংক আনতে ওখানে গেছে। দাঁড়ান!” শেরিডান ঘুরলো, মুখে হাসি। “সত্যি সত্যি তোমাকে ছেড়ে চলে যেতাম না আঙ্কেল।

“ ছেলেটাকে ভ্যানে কাছে নিয়ে গেল, বছর চারেকের পুরোন ভ্যানটা, অদ্ভুত এক্টা নীল রঙ করা। দরজা খুলে বাচচাটার দিকে তাকিয়ে হাসল। অনিশ্চিতভাবে ওর দিকে তাকাল ছেলেটা। ওর মলিন চেহারায় সবুজ চোখজোড়া সাঁতরে বেড়াল, মখমলের ছবিতে আঁকা কোন উদ্বাস্তু শিশুর চোখের মত বড় বড়, সস্তা সাপ্তাহিক ট্যাবলয়েডগুলোর বিজ্ঞাপনে যেরকম থাকে, যেমন ন্যাশনাল এনকুইরার আর ইন্সাইড ভিউ। “আমার বৈঠকখানায় সুস্বাগতম ছোট্টবন্ধু,” শেরিডান বল্লো।

একেবারে স্বাভাবিক দেখতে এক্টা হাসি উপহার দিল। ব্যাপারটা একেবারে গা শিরশির করা, সে এত ভাল হয়ে উঠেছে এটাতে। বাচ্চাটা উঠে পড়ল। জানলো না, প্যাসেঞ্জার ডোর বন্ধ হবার সাথে সাথে চিরকালের মত ব্রিগস শেরিডানের সম্পত্তি হয়ে গেল সে। জীবনে খালি একটাই সমস্যা ছিল ওর।

মেয়েমানুষের সমস্যা না, যদিও স্কার্টের খসখসানি কিংবা সিল্কের মোজার মসৃনতা যেকোন পুরুষের মতই পছন্দ করত। পাগলাপানিরও সমস্যা না, যদিও সন্ধ্যায় দুই-তিনটা ড্রিংকের জন্য পরিচিত ছিল। শেরিডানের সমস্যা – বলতে পার মরন নেশা – ছিল তাস। যেকোন ধরনের তাস, খেলাটাতে বাজি ধরা গেলেই হ্ল। চাকরি, ক্রেডিট কার্ড, মায়ের রেখে যাওয়া বাড়ী হারিয়েছে এই তাসের পেছনে।

তবে কখনো, মানে এখনপর্যন্ত, জেলে যায়নি। কিন্তু প্রথমবার যখন মিস্টার রেজীর সাথে ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ল, জেল তার তুলনায় মনে হল ফুলসয্যা। ঐরাতে একটু ক্ষেপে গিয়েছিল সে। পরে বুঝেছিল, প্রথমেই যদি হেরে যাও, সেটাই ভাল। প্রথমেই হেরে গেলে তুমি হাল ছেড়ে দেবে, বাসায় যাবে, টিভি দেখবে, তারপর ঘুমাতে চলে যাবে।

কিন্তু প্রথমে যখন একটু জিতবে, তাড়া করতে থাকবে। সেইরাতে তাড়া করেছিল শেরিডান, শেষ করেছিল সতের হাজার ডলার ঋন করে। বিশ্বাসই করতে পারছিল না; হতবুদ্ধি অবস্থায় বাসায় ফিরে গিয়েছিল, ঋনের বিশালত্বে অনেক্টা অনুপ্রানিত হয়েই। যেতে যেতে গাড়ীতে বসে নিজেকে বলে যাচ্ছিল, মিস্টার রেজীর কাছে সাতশ না, সাত হাজার না, সতের হাজার টাকা বাকি তোমার। যতবারি ব্যাপারটা চিন্তা করছিল ফিক করে হেসে রেডিওর ভলিয়ুমটা বাড়িয়ে দিচ্ছিল।

কিন্তু ঐ ফিকফিক হাসি বন্ধ হয়ে গেছিল পরের রাতেই, যখন ওই দুই গরিলা – টাকা পরিশোধ না করলে যারা তার হাতদুটো মজার মজার সব নতুন ভংগিতে বাকানোর ব্যবস্থা করবে -- মিস্টার রেজীর কাছে ওকে নিয়ে আসল। “শোধ করে দেব” সঙ্গেসঙ্গে হড়বড় করে বলা শুরু করলো। “সব শোধ করে দেব, শোনেন, কোন সমস্যা না, খালি কয়েকদিন সময় দেন, বড়জোর একসপ্তা, দুইসপ্তা হাতে রেখে – “ “ফালতু কথাবার্তা ছাড়, শেরিডান” মিস্টার রেডি বল্লো। “আমি –“ “চোপ্‌। একসপ্তাহ সময় দিলে, তুই কি মনে করস আমি জানিনা কি করবি? বন্ধুর কাছে গিয়ে কয়েকশ ডলারের জন্য হাত পাতবি, যদি হাত পাতার মত কোন বন্ধু এখনও থেকে থাকে।

বন্ধু খুজে না পেলে মদের দোকানে গিয়ে পড়ে থাকবি...কোমরে যদি এখনো জোর থাকে। তবে আমার সন্দেহ আছে, কিন্তু তোর পক্ষে সবি সম্ভব। “ মিস্টার রেজী সামনে ঝুকলো, থুতনি ঠেস দিল হাতে। হাসল। টেড ল্যাপিডাসের গন্ধ আসছিল তার গা থেকে।

“ আর যদি দুইশ ডলার যদি খুজেও পাস, ওটা দিয়ে কি করবি?” “আপনাকে দিয়ে দেব,” হড়বড় করে বলেছিল শেরিডান। এতক্ষনে প্রায় কেদে ফেলার পথে। “সাথে সাথে আপনাকে দিয়ে দেব!” “না, দিবি না,” মিস্টার রেজী বল্লো। “ওটা নিয়ে আবার আসরে যাবি, বাড়াবার জন্য। যা দিবি তা হচ্ছে কতগুলা ফালতু ওজুহাত।

এইবার অনেক ওপরে হাত দিয়ে ফেলসস তুই, অনেক, অনেক উপরে। “ শেরিডান আর কান্না ধরে রাখতে পারল না। সশব্দে কাদতে লাগল। “ওরা তোকে অনেকদিনের জন্য হাস্পাতালে ফেলে রাখার ব্যবস্থা করে দিতে পারে,” চিন্তিতমুখে বল্লো মিস্টার রেজী। “দুইহাতে এক্টা করে নল ঢুকানো থাকবে, আরেক্টা নাক দিয়ে বার হয়ে আসবে।

“ আরো জোরে কাঁদতে লাগল শেরিডান। “আমি খালি এইটাই করতে পারি,” ভাজ করা এক্টা কাগজ ঠেলে দিল শেরিডানের দিকে। “এই ব্যাটার সাথে তোর মিল আছে। ব্যাটা নিজেকে মিস্টার উইজার্ড বলে ডাকে, তোর মতই আস্ত একটা হারামজাদা। এখন ভাগ এখান থেকে।

এক সপ্তা পরে আবার তোকে এখানে আনব, আর তখন এই ডেস্কে তোর মার্কার থাকবে। হয় ওগুলো কিনে নিবি নাইলে আমার লোক যন্ত্র ব্যবহার শুরু করবে। আর বুকার টি কি বলে জানস ত, একবার যখন ওরা শুরু করে, মনের আশ না মেটা পর্যন্ত ওরা চালাতে থাকে। ” তুর্কিটার আসল নাম লেখা ছিল ভাজ করা কাগজটাতে। তার সাথে দেখা করতে গিয়েছিল শেরিডান।

তারপরে বাচচাদের আর ‘নৌকা বরমন’ সম্বন্ধে জানলো। মিস্টার উইজার্ডও একটা অঙ্ক জানিয়েছিল। মিস্টার রেজীর মার্কারগুলোর দাম থেকে তা বেশ বড়সড়ই। তখন থেকেই মলের আশেপাশে ঘুরাঘুরি শুরু শেরিডানের। কাজিনটাউন মলের পার্কিং লট থেকে বের হলো সে, ট্রাফিকের জন্য আপেক্ষা করল, তারপর এক্সেস রোডের অপরপ্রান্তে গিয়ে ম্যাকডোনাল্ডের রাস্তায় ঢুকলো।

প্যাসেঞ্জার সিটের একেবারে সামনে বসেছিল বাচচাটা, হাত টাফস্কিনের হাটুতে রাখা, চোখ টনটনে সজাগ। শেরিডান বিল্ডিংটার দিকে এগোল, ড্রাইভ-থ্রু লেইনটা এড়াবার জন্য বড় একটা বাঁক নিল, তারপর যেতে থাকল। “আমরা পেছনের দিকে যাচ্ছি কেন?” বাচচাটা জিজ্ঞেস করলো। “ঘুরে অন্য দরজাগুলোতে যেতে হবে আমাদের,” শেরিডান বল্লো। “মাথা ঠান্ডা রাখো আঙ্কেল।

মনে হলো ভেতরে দেখলাম উনাকে। ” “দেখেছেন? সত্যি সত্যি দেখেছেন?” “হ্যাহ, মোটামুটি নিশ্চিত। “ আশ্চর্য সুন্দর এক স্বস্তি যেন মুখটা ধুয়ে দিল বাচচাটার । এক মুহুর্তের জন্য একটু দূঃখবোধ হল শেরিডানের – আরে কসম খোদার ও কখনো ত কোন দানব বা উম্মাদ কোনটাই ছিল না। কিন্তু প্রত্যেকবার মার্কারের পরিমান যে বাড়তেই থাকে।

আর ও যদি গলায় দড়িও দেয় হারামির বাচচা মিস্টার রেজীর তাতে কোন মর্মযাতনা হবে না। এবার ত আর সতের হাজার না, বিশ হাজারো না, এমনকি পচিশ হাজারো না। এবার হচ্ছে একবারে পয়ত্রিশ হাজারের মামলা। অবশ্য যদিনা সামনের শনিবারে হাতে নতুন কয়েক সেট কনুই লাগাবার খায়েশ না থেকে থাকে। ট্রাশ কম্পাক্টরের পেছনে এসে ভ্যানটা থামলো ।

কেউ পার্ক করে নেই এখানে। ভাল। ম্যাপ ট্যাপ রাখার জন্য গাড়ীর দরজার সাথে একটা রাবারের ব্যাগ লাগান ছিল। বাম হাত বাড়িয়ে ওটা থেকে একজোড়া স্টিলের হাতকড়া বের করে আনলো। কড়াগুলো খোলা।

“আঙ্কেল আমরা এখানে থামলাম কেন?” বাচচাটা জিজ্ঞেস করলো। কন্ঠস্বরে ভয়টা ফিরে এসেছে, তবে এবার তার প্রকৃতি অন্যরকম। হঠাৎ করেই বুঝতে পেরেছে মলের জনারন্যে দাদুভাইকে হারানোটাই ওর জন্য সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ঘটনা নাও হতে পারে। “না, এখানে থামছি না আসলে,” সহজভাবে বল্লো শেরিডান। দ্বিতীয়বার এইকাজ করতে গিয়ে বুঝেছে ভীত অবস্থায় একটা ছয় বছরের বাচচাকেও হেলা সুযোগ নেই।

দ্বিতীয় বাচচাটা ওর বীচিতে লাথথি মেরে আরেকটু হলে পালিয়ে যাচ্ছিল। “মনে পড়ে গেল গাড়ী ছাড়ার সময় চশমাটা পড়তে ভুলে গেছি। আমার ত লাইসেন্স চলে যাবে। তোমার পায়ের কাছে চশমার খাপটাতে আছে ওটা। পাশের দিকে খোলে খাপটা।

ওটা দেবে একটু?” বাচ্চাটা খালি খাপ্টা নেবার জন্য সাম্নের দিকে ঝুকলো। শেরিডান ঝুকে বাচচাটার বাড়ানো হাতটাতে ফট করে হাতকড়াটা লাগিয়ে দিল। আর ঝামেলা শুরু হলো তারপরেই। একটু আগেই না চিন্তা করল ছয় বছরের একটা বাচ্চাকেও হেলা করা একটা বাজে ভুল? ছোকড়াটা এক্টা নেকড়ের বাচচার মত যুদ্ধ করলো। এমন এক পেশীশক্তি নিয়ে মোচড়াতে থাকলো আগে না দেখলে শেরিডান বিশ্বাসই করত না।

বেঁকেচুরে, লাফিয়ে, টানাটানি করে দরজার দিকে যাবার চেষ্টা করলো। হাপাতে হাপাতে মুখ দিয়ে পাখির মত অদ্ভুতস্বরে চিৎকার করতে থাকল। হাতলের নাগাল পেয়ে ধাক্কা দিয়ে খুলে ফেলল দরজাটা। কিন্তু হেডলাইট জ্বললো না – দ্বিতীয় খ্যাপে বের হবার সময় ওটা নষ্ট করে দিয়েছে শেরিডান। বাচচাটার পেংগুইন টি-শার্টের গোল কলারটা ধরে টেনে ভেতরে নিয়ে আসলো।

প্যাসেঞ্জার সিটের পাশে এক্টা স্পেশাল লোহার রডের সাথে অন্য কড়াটা লাগাতে গেল, পারলো না। বাচচাটা দুইবার ওর হাত কামড়ে দিয়েছে। রক্ত বেরোচ্ছে। বাপরে, দাতগুলো একেবার ক্ষুরের মত ধারাল। ব্যাথাটা একবারে গভীরে পৌছে পুরো হাতে একটা ধাতব যন্ত্রনা ছড়িয়ে দিয়েছে।

বাচচাটার মুখে একটা ঘুষি মারল সে। সিটের মধ্যে পড়ে গেল ও, হতবুদ্ধি, ঠোঁটে আর থুনতিতে শেরিডানের রক্ত, টি-শার্টের গলায় ঝরে পড়ছে। অন্য কড়াটা রডে লাগিয়ে নিজের সিটে গড়িয়ে পড়লো শেরিডান। ডান হাত মুখে নিয়ে চুষতে থাকল। প্রচন্ড যন্ত্রনা।

মুখ থেকে হাতটা সরিয়ে ড্যাশলাইটের আবছা আলোতে দেখতে লাগল। দুটা চিকন কাটা দাগ, দুই ইনচি লম্বা প্রত্যেকটা, কবজি থেকে আঙ্গুলের গাটের ঠিক আগ পর্যন্ত। সরু ধারায় রক্ত বের হয়ে আসছিল। তারপরও, বাচচাটাকে আরেকবার মারবার ইচ্ছা হলো না। এই জন্যে না যে তুর্কিটার মাল খারাপ হয়ে যাবে ।

অবশ্য ব্যাটা তাকে এ ব্যাপারে সাবধান করে দিয়েছিল – মাল খারাব ত পয়সাও খারাব – তেলতেলে স্বরে বলেছিল তুর্কিটা। না, লড়াই করার জন্য দোষ দেয়না বাচচাটাকে – সে নিজেও ত একি কাজই করত। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ক্ষতটাতে সংক্রমন রোধ করতে হবে, মনে হয় ইঞ্জেক্শন নিতে হতে পারে। কোথায় যেন পড়েছিল মানুষের কামড় নাকি সবথেকে জঘন্য। বাচ্চাটার সাহসে মুগ্ধ না হয়ে পারল না।

গাড়ী চালিয়ে হ্যাম্বার্গার স্ট্যান্ড পার হয়ে, ড্রাইভ-থ্রু উইন্ডো পার হয়ে এক্সেস রোডে ফিরে আসল। বাম দিকে মোড় নিল। তুর্কিটার টালুডা হাইটসে খামার টাইপের বিশাল একটা বাড়ী আছে, শহরের একবারে কিনারায়। ঘুরপথে ওখানে পৌছাবে শেরিডান, ঝুকি নেবার কোন দরকার নেই। ত্রিশ মাইল।

পৌনে একঘন্টা, নাহলে বড়জোর একঘন্টা লাগবে। ‘কাজিন্টাউনে শপিং করার জন্য ধন্যবাদ’ লেখা একটা সাইনবোর্ড পেরোল। বামে মোড় নিল। ধীরে ধীরে ভ্যানটাকে আইন্সম্মতভাবে কাঁটায় কাঁটায় ঘন্টায় চল্লিশ মাইল বেগে নিয়ে আসল। পেছনের পকেট থেকে একটা রুমাল বের করে ডান হাতের পেছনে জড়িয়ে নিল।

তারপর মনোযোগ দিল হেডলাইটের আলোতে। প্রত্যেক বাচচার জন্য তুর্কিটার ওয়াদা চল্লিশ হাজার। সেটার কাছে তাকে নিয়ে যাচ্ছিল আলোগুলো। “পরে কাঁদবেন,” বাচ্চাটা বলে ঊঠলো। শেরিডান অধৈর্য্যভাবে ওর দিকে তাকালো।

স্বপ্ন দেখছিল, পর পর বিশ দান জিতেছে, আর মিস্টার রেজী তার পায়ে মাথা গুজে পয়সা চাইছে, দরদর করে ঘামছে ব্যাটা, অনুনয় করছে থামার জন্য, কি করা যায় ব্যাটাকে, পিষে ফেলবে? বাচচাটা আবার কাদছিল, চোখের পানিতে এখনো সেই অদ্ভুত গোলাপী আভা, যদিও মলের উজ্জ্বল আলো থেকে ওরা এখন অনেক দূরে। কোন ছোঁয়াচে রোগটোগ নাইত বাচচাটার, শেরিডান চিন্তা করল। কিন্তু এখন অনেক দেরি হয়ে গেছে এসব ভাবার, মাথা থেকে সরিয়ে দিল চিন্তাটা। “দাদুভাই যখন আপনাকে খুজে বের করবে তখন কাদবেন,” ব্যাখ্যা করল বাচচাটা। “হ্যাঁ, হ্যাঁ,” সিগারেট ধরাল শেরিডান।

স্টেট রোড ২৮ থেকে মোড় নিয়ে দুই লেনওয়ালা নামহীন এক্টা কাঁকর বিছানো রাস্তায় উঠলো। বামদিক এখন দীর্ঘ জলাভূমি, ডানদিকে ঘন জংগল। বাচচাটা হাতকড়া ধরে টান দিল, ফোঁপানোর মত একটা আওয়াজ করলো। “ওরকম করো না, কোন লাভ নাই। “ তারপরো, বাচচাটা আবার টান দিল।

এইবার গোঙ্গান, প্রতিবাদী একটা আওয়াজ হলো। শব্দটা পছন্দ হলো না শেরিডানের। ঘাড় ফিরিয়ে তাকিয়ে প্রচন্ড অবাক হয়ে দেখল সিটের পাশের লোহার মোটা রডটা – যেটা সে নিজের হাতে ঝালাই করে লাগিয়েছে – পুরো বেঁকে গেছে। আরিশশাআলা! ভাবল সে। ক্ষুরের মত দাত, এখন দেখি মোষের মত জোরও।

অসুস্থ অবস্থায়ই যদি এই হাল হয়, আল্লা বাচাইসে, সুস্থ অবস্থায় ওকে পাকড়াও করতে যাইনাই। ঘাড় ধরে টেনে আনল ওকে, “থাম!” “না, থামব না!” আবার হাতকড়াটা ধরে টান দিল বাচচাটা। শেরিডান দেখল লোহার রডটা আরেকটু বেকে গেল। ওরে আল্লা, একটা বাচচা ছেলে এটা করে কিভাবে? প্রচন্ড ভয়ে। উত্তর দিল নিজেকে।

ওই জন্য করতে পারছে। কিন্তু অন্য বাচচারা কখনো এটা করতে পারেনি, খেলার এই পর্যায় এসে ওদের অনেকেই এর থেকেও ভয়ে ছিল। ড্যাশের মাঝখানের গ্লোভ কম্পার্টমেন্ট খুলে একটা সিরিঞ্জ বের করে আনল। তুর্কিটা দিয়েছে এটা, তবে সাবধান করে দিয়েছে নিতান্ত দরকার না হলে ব্যবহার না করতে। ড্রাগস, তুর্কিটা বলেছিল (ব্যাটা বলে ড্রক্স) মাল খারাপ করে দিতে পারে।

“এটা দেকস?” কোনা চোখে সিরিঞ্জটার দিকে তাকিয়ে মাথা নোয়াল বাচচাটা। “দেব নাকি ঢুকিয়ে এটা?” সঙ্গে সঙ্গে দুপাশে মাথা নাড়লো বাচচাটা। যত শক্তি থাকুক না কেন সব বাচচাই সুঁই প্রচন্ড ভয় পায়। শেরিডান খুশি হ্ল। “এইত বুদ্ধিমান ছেলের মত কথা।

এটা তোমাকে একদম অজ্ঞান করে দিতে পারে। “ ও থামল। বলতে চাচ্ছিল না – আরে ও ত আসলে খারাপ লোক না, কসম খোদার, যদি আজ ওর গলায় দড়ি বাধা না থাকত – কিন্তু বলে ফেল্ল। “তোমাকে মেরেও ফেলতে পারে। “ বড় বড় চোখে ওর দিকে তাকাল বাচচাটা, ঠোঁট কাঁপছে, গাল ভয়ে কাগজের মত সাদা।

“তুমি হাতকড়া টানাটানি বন্ধ করবে, আমি সুঁইটা সরিয়ে নেব। ঠিক আছে?” “ঠিক আছে,” বাচচাটা ফিসফিস করে বল্ল। “কসম?” “হ্যা,” ঠোট অল্প ফাক করল বাচচাটা, সাদা দাতগুলো দেখা গেল। একটাতে শেরিডানের রক্তের দাগ লেগে আছে। “মায়ের কসম?” “আমার কোন মা নেই।

“ “বাল,” শেরিডান বল্লো, প্রচন্ড বিরক্ত, আবার গাড়ি চালাতে লাগল। আরেকটু জোরে চালাতে লাগল এখন। মেইন রোড ছেড়ে চলে এসেছে বলে না। বাচচাটা ভুতুড়ে। ওকে তুর্কির কাছে দিয়ে, টাকা নিয়ে কেটে পড়তে চাচ্ছিলো শেরিডান।

“দাদুভাইয়ের গায়ে অনেক শক্তি, আংকেল। ” “তাই?” জিজ্ঞেস করলো। মনে মনে বল্লোঃ নিশ্চই আব্বু, বুড়ামিয়া মনে হয় বৃদ্ধাশ্রমের একমাত্র ব্যক্তি যে ওর লোহাটা দিয়ে বুকডন মারে, ঠিক না? “ও আমাকে খুজে বের করবে। ” “আচ্ছা। “ “ও আমার গন্ধ পায়।

“ শেরিডান বিশ্বাস করলো। বাচচাদের গন্ধ সে পায়। তার আগের খ্যাপগুলো থেকে একটা জিনিস শিখেছে সে, ভয়ের একটা গন্ধ আছে। কিন্তু এইটা অবাস্তব – বাচচাটার গন্ধটা যেন ঘাম, কাদা আর উত্তপ্ত ব্যাটারি এসিডের এক মিশেল। শেরিডান আরো নিশ্চিত হল, কিছু একটা গন্ডগোল আছে বাচচাটার...কিন্তু শিগগিরীই মি. ঊইজার্ডের সমস্যা হয়ে যাবে এটা, ওর না।

জানালার কাচটা অল্প নামাল, বামদিকে যতদূর চোখ যায়, বিস্তীর্ণ জলাভুমি। চাঁদের ভাঙ্গা ভাঙ্গা আলোয় জলাবদ্ধ পানি চিকচিক করছে। “দাদুভাই উড়তে জানে। “ “হ্যাআ”, শেরিডান বল্লো, “কয়েক বোতল ভদকা পেটে পড়লে একবারে ঈগলের মত উড়ে। “ “দাদুভাই –“ “অনেক হয়েছে দাদুভাই দাদুভাই, এবার চুপ কর, ঠিক আছে?” বাচচাটা চুপ করলো।

আরো চার মাইল এগোনর পর বামের জলাভূমিটা আস্তে আস্তে বড় হয়ে খালে পরিনত হলো। খালের উওর দিক ঘেষে চলে যাওয়া একটা শক্ত মাটির রাস্তায় মোড় নিল শেরিডান। এখান থেকে আর পাচ মাইল পশ্চিমে গিয়ে ডান দিকে মোড় নিলেই হাইওয়ে ৪১, আর তারপর টেলুডা হাইটের সোজা রাস্তা। খালের দিকে এক পলক তাকাল, জোৎস্নায় রূপালি একটা চাদর বিছান যেন...তারপর হঠাৎ জোৎস্না হারিয়ে গেল। যেন ঢাকা পড়ে গেছে।

মাথার উপরে একটা ঝাপ্টানো শব্দ, দড়িতে টাঙ্গানো বড় বড় চাদরের মত। “দাদুভাই!” বাচচাটা চিৎকার করলো। “চোপ্‌, কোন পাখিটাখি হবে। “ কিন্তু হঠাৎ ভয় পেয়ে গেল। প্রচন্ড ভয়।

বাচচাটার দিকে তাকাল। ঠোট সরে গিয়ে দাতগুলো আবার বেরিয়ে এসেছে বাচচাটার। ঝকঝকে সাদা। বড় বড়। না...ঠিক বড় না।

বড় বল্লে ভুল হবে। লম্বা। বিশেষ করে উপরের দুইপাশের দুটা। কি যেন নাম ওগুলোর? শ্বদন্ত। হঠাৎ আবার চিন্তা দ্রুত গতিতে চলতে লাগল ওর, যেন প্রচন্ড গতিতে ছুটে চলেছে সে।

আমি ওকে বলে ছিলাম আমার পিয়াস পেয়েছে। দাদুভাই ওখানে কেন যাবে যেখানে ওরা – (খায়? ও কি খায় বলতে চাচ্ছিল?) ও আমাকে খুজে বের করবে। ও আমার গন্ধ পায়। দাদুভাই উড়তে জানে। ভ্যানের ছাদে কিছু একটা ধপ করে বসে পড়লো।

“দাদুভাই!” বাচচাটা আবার চিৎকার করলো, আনন্দে উম্মত্তপ্রায়। হঠাৎ শেরিডান আর সামনের রাস্তা দেখতে পেলনা – বিশাল এক ঝিল্লিময়, শিরাউপশিরায় পূর্ণ ডানা উইন্ডশিল্ডটা পুরোপুরি ঢেকে ফেলেছে। দাদুভাই উড়তে জানে। শেরিডান চিৎকার করে সজোরে ব্রেক কষলো, যাতে ছাদ থেকে ছিটকে সামনে এসে পড়ে ওটা। লোহায় চাপ পড়া সেই গোঙ্গান, প্রতিবাদী শব্দটা আবার ওর ডানদিক থেকে আসলো, তবে এবার কট করে একটা শব্দ অনুসরন করল।

মুহুর্ত পরে বাচচাটার আংগুলগুলো ওর মুখ আচড়াতে লাগলো, গালের চামড়া ছাড়িয়ে ফেল্ল। “দাদুভাই, ও আমাকে চুরি করেছে!” পাখির মত কন্ঠে ছাদের দিকে তাকিয়ে কানফাটানো স্বরে চিৎকার করতে লাগল বাচচাটা। “ও আমাকে চুরি করেছে, ও আমাকে চুরি করেছে, বাজে লোকটা আমাকে চুরি করেছে!” বাবু তুমি এখনও বুঝলে না, শেরিডান ভাবল। অন্ধের মত হাতড়ে সিরিঞ্জটা খুজে বের করল। আমি বাজে লোক না, এক ঝামেলায় আটকে গেছি শুধু।

তারপর একটা হাত, হাতের চেয়ে শিকারি পাখির নখরের সাথে বেশি মিল, সাইড উইন্ডো ভেঙ্গে ঢুকে ওর মুঠ ছিড়ে সিরিঞ্জটা বের করে নিল – সেই সাথে দুইটা আঙ্গুলও। এক মুহূর্ত পরে দাদুভাই ড্রাইভার সাইডের দরজাটা ফ্রেম থেকে টেনে খুলে ফেলল, কব্জাগুলো উজ্জ্বল কিছু অর্থহীন ধাতবখন্ড এখন। শেরিডান এক বিশাল ঢেউ খেলতে থাকা একটা হাতকাটা কোট দেখতে পেল, বাইরে কালো, ভিতরে লাল সিল্ক, আর প্রানীটার টাই...আসলে গলাবন্ধ, নীলই বটে –ঠিক যেমন বলেছে ছেলেটা। দাদুভাই সজোরে টান দিয়ে শেরিডানকে গাড়ী থেকে বের করে আনল, নখরগুলো ওর জ্যাকেট আর শার্ট ভেদ করে ঘাড়ের মাংসের গভীরে বসে গেছে। দাদুভাইয়ের সবুজ চোখদুটো হঠাৎ রক্তগোলাপের মত লাল হয়ে গেল।

“আমার নাতি নিনজা টার্টলের পুতুল চাচ্ছিল দেখে আমরা মলে এসেছিলাম,” ফিসফিস করে বললো দাদুভাই, তার নিঃশ্বাসে মাছিবসা পচা মাংসের গন্ধ। “টিভিতে দেখায় যেগুল। সব বাচচারা চায়। ওকে ঘাটানো উচিত হয়নি তোমার। আমাদেরকে ঘাটানো উচিত হয়নি তোমার।

” কাপড়ের পুতুলের মত কাঁপছিল শেরিডান। ভয়ে চিৎকার করে আবার কেঁপে উঠলো। শুনতে পেল দাদুভাই বাচচাটাকে নরম গলায় জিজ্ঞেস করছে এখনো পিয়াস লাগছে কিনা। শুনতে পেল বাচচাটা বল্ল হ্যা, খুব, বাজে লোকটা ওকে ভয় পাইয়ে দিয়েছে, গলা তার শুকিয়ে কাঠ। থুতনির নিচে অদৃশ্য হবার আগে এক সেকেন্ডের জন্য দাদুভাইয়ের বুড়ো আঙ্গুলের নখরটা দেখতে পেল সে।

রুক্ষ, মোটা। কিছু বোঝার আগেই ওই নখ দিয়ে ওর গলা কেটে ফেলা হল, আর দৃষ্টিশক্তি ঝাপসা হয়ে আসার আগে শেষ দেখতে পেল, বাচচাটা হাতদুটো পেয়ালার মত করে স্রোতটা ধরার চেষ্টা করছে। যেমনভাবে ছোটবেলায় শেরিডান গরমের দিনে বাসার পেছনের কল থেকে পান করার জন্য হাতদুটো পেয়ালার মত করে ধরত। আর দাদুভাই, শান্তভাবে ছেলেটার চুলে হাতবুলিয়ে দিচ্ছে। পিতামহসুলভ ভালবাসায়।

[স্টিফেন কিং এর ‘পপ্সি’ গল্পের ভাবানুবাদ]

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।