আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ক্ষুদ্রঋণ ও তার প্রভাব: প্রসঙ্গ গিরগিটি

উন্মাদ খুলির পৃষ্ঠাগুলি

বাংলাদেশে ক্ষুদ্রঋণের কারবার খুব পরিচিত। ক্ষুদ্রঋণ বিষয়ক বিভিন্ন মূল্যায়ন ও গবেষণা পত্র পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, যেসমস্ত পরিবার ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করেছেন তাদের ওপোর ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এই প্রভাব পড়েছে উক্ত পরিবারসমূহের আয়-উপার্জনের ক্ষেত্রে। ক্ষুদ্রঋণের গ্রহীতাদের মতামত থেকেই এই বিষয়গুলি বের হয়ে আসতে দেখা যায়। বিভিন্ন গবেষণালব্ধ তথ্য বিচার বিশ্লেষণ করে দেখলে দেখা যায় যে বাংলাদেশে ক্ষুদ্রঋণ কার্ষক্রম শুরুর দিকে এর ইতিবাচক প্রভাব বেশিমাত্রায় কার্যকর হয়েছিল।

এই ঋনকার্যক্রমের প্রভাব নারীদের ওপোর সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেছে। তাদের ক্ষমতায়নের দ্বার উন্মোচিত হয়েছে। এযাবৎ ক্ষুদ্রঋণ বিষয়ক যেসমস্ত গবেষণা সম্পন্ন হয়েছে সেগুলোতে দেখা গেছে যে নারীর ওপোর ক্ষুদ্রঋণের প্রভাব খুবই ইতিবাচক। যেসকল পরিবারের নারীরা ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করেছেন সেসকল পরিবারের আয়-উপার্জনমূলক কার্যক্রম, সচেতনতা বৃদ্ধি, বিদ্যালয়গামী শিশুদের বিদ্যালয়গমনের হার বৃদ্ধি এবং পরিকল্পিত পরিবার গঠনে সচেতনতা আগের তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে। এমন কি পরিবারের ভিতরে বিভিন্ন বিষয়ে সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়ায়ও নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পেয়েছে।

দারিদ্র্য বিমোচন বাংলাদেশের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ এর বিষয় যা সরকারি নীতিনির্ধারকগণ এবং বেসরকারি অনেক প্রতিষ্ঠান এটা মোকাবেলা করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। গত দুই দশকে বাংলাদেশে দারিদ্র্য পরিস্থিতি কিছুটা হলেও কমতির দিকে। তারপরও এখনো অনেক মানুষ দারিদ্র্য অবস্থার ভিতর দিনাতিপাত করছে। দারিদ্র দূরীকরণের প্রত্যয় নিয়ে বাংলাদেশে সত্তর দশকের মাঝামাঝিতে যেসব বেসরকারি সংস্থা কার্যক্রম শুরু করেছিলেন তাদের উদ্দেশ্য পুরোপুরি সফল না হলেও গরিব মানুষের সংখ্যা সামান্য হলেও কমেছে, নারীদের জীবন যাপনে-কর্মে আগের তুলনায় কিছুটা হলেও পরিবর্তনের হাওয়া লেগেছে। নারীরা এখন আর ঘরের ভিতর বন্দি হয়ে থাকেন না।

তাদের কাজের পরিধি যেমন অল্প হলেও বেড়েছে সেই সাথে তাদের ক্ষীণকণ্ঠস্বরও পরিবর্তনের তালে তালে বাড়া শুরু করেছে। এ বিষয়গুলো চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে বিভন্ন গবেষণাগুলোর সারমর্মে। ক্ষুদ্রঋণের প্রভাবে বাংলাদেশে গ্রামীণ সমাজের অনেক দরিদ্র্য পরিবারের আয় বেড়েছে। সামাজিক জীবনে এইসব পরিবারগুলির অবস্থান আগের থেকে একটু স্বচ্ছলতার মুখ দেখা শুরু করেছে। ক্ষুদ্রঋণের প্রভাব ও এর মূল্যায়ন বিষয়ক লেখাজোখা বাংলাদেশের আঙিনা ছেড়ে পশ্চিমা শিল্পোন্নত দেশগুলোতেও ছড়িয়ে পড়েছে।

ক্ষুদ্রঋণ এমন একটি ধারণা যে ধারণা গত দুই দশকে বিশ্বব্যাপী খুবই দ্রুততার সাথে পরিচিতি লাভ করেছে। ক্ষুদ্রঋণ বিষয়ক আলোচনা করতে গেলে প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনুসের নাম সর্বপ্রথমেই আলোচনায় চলে আসে। তিনি ১৯৭০ সালের দিকে স্থানীয় গরিব জনগণের ভেতর ক্ষুদ্রঋণের কার্যক্রম শুরু করেন। তখন এই ক্ষুদ্রঋণের ধারণা এত ব্যাপক ছিল না, ওই সময় সর্বত্রই মহাজনী ঋণব্যবস্থার প্রচলন ছিল, যে ব্যবস্থা এখনো দাপটের সাথে টিকে আছে, যদিও ক্ষুদ্রঋণের একটা উদ্দেশ্য ছিল দারিদ্র্য কমানোর পাশাপাশি ভয়াবহ মহাজনী ঋণব্যবস্থার হাত থেকে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ মুক্তি পাবে। কিন্তু সে উদ্দেশ্য এখনো পুরোপুরি পূরণ হয়নি।

সারা বিশ্বেই সরকার পরিচালিত ব্যাংকগুলো সমাজে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে ব্যাংকিং সেবার আওতায় নিয়ে আসতে পারেনি, উপরোক্ত নানা ধরণের দুর্নীতি, অসাধুতা ও শটতায় ভরপুর সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো সমাজের প্রভাবশালী জনগোষ্ঠীর নিরাপদ অর্থনৈতিকভাবে বিকশিত হওয়ার একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে উঠেছে। যেখানে গরিব মানুষের প্রবেশাধিকার সহজলভ্য নয়। এই প্রাতিষ্ঠানিকতার বিপরীতেই ক্ষুদ্রঋণের যাত্রা শুরু করেছিলেন প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনুস। তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন গরিবলোকের ব্যাংক হিসেবে পরিচিত ‘গ্রামীণ ব্যাংক’। এই প্রতিষ্ঠানের গরিব শ্রেণীর ঋণগ্রহীতারা সময় মতো ঋণ পরিশোধ করেন।

অনেকে এই ঋণ নিয়ে তাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটিয়েছেন। এর বিপরীত মতও আছে যে ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম গরিব মানুষের ঘাড়ে ঋণের জোয়াল দিয়ে দিয়েছে যে জোয়াল থেকে তারা বের হতে পারছে না। এই মতের অনুসারী খুব বেশি না। তবে এটা ঠিক যে ক্ষুদ্রঋণের সুফলতা অর্থনীতিবিদদেরকে পূর্ণবার চিন্তার পরিসর তৈরিতে সহায়তা করছে। গরিবজনগণ কিভাবে টিকে থাকার লড়াই করছে, কিভাবে দারিদ্র্য পরিস্থিতি মোকাবেলা করছে, কিভাবে তারা সম্পদ অর্জনে ভূমিকা রাখছে - এ বিষয়গুলা নিয়ে আলোচনার যে ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়েছে সেবিষয়গুলো নিয়ে এখন নতুন চশমার কাচে ফেলে ভাবার সময় এসেছে।

বর্তমান বাজার ব্যবস্থার দুর্বলতা গরিবদের পক্ষে কোন সুফলতা এনে দিচ্ছে না, সেখানে ক্ষুদ্রঋণ তাদেরকে জীবন যাপনের ক্ষেত্রে লড়াই করার মানসিকতা তৈরিতে প্রস্তুত করে তুলছে বলে ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে যারা কাজ করছেন তারা এ বিষয়ে জোরের সঙ্গেই বলে থাকেন। এই কথাটা কী ধাব্বাবাজির মতো শুনায় না? গত আড়াই দশকে বাংলাদেরে আনাচে কানাচে ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম ছড়িয়ে পড়েছে। এই কার্যক্রমে দরিদ্র পরিবারের নারীদের অংশগ্রহণই সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশের সমাজ কাঠামোয় নারীরা এখনো সবচেয়ে অধস্তন পর্যায়ে, তারা অসহায় জীবনযাপন করেন আমরা সবাই জানি। তারপরও এই সমাজ কাঠামোর ভিতরও নারীর ক্ষমতায়নে কিছুটা হলেও ক্ষুদ্রঋণের ভূমিকা আছে তা কেউ অস্বীকার করবে না।

এটা অস্বীকার করলে তা একতরফা হবে। বাংলাদেশের উন্নয়ন পরিমন্ডলে এই নারীদের ভূমিকা এখন আর খাটো করে দেখার কোন বিষয় নয়। অর্থনেতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে এইসব নারীদের ভূমিকাও আমাদেরকে স্বীকার করতে হবে। গুরুত্ব দিতে হবে। নারী শুধু এখন আর গৃহস্থালীর ঘেরাটোপের ভিতর আটকানো অবলা-অবোধ নয়।

ক্ষুদ্রঋণের প্রভাবকে কিছু গবেষক যেভাবে টেনে টুনে লম্বা করে দেখান, তাতে মনে হয়, এইটার জন্যই বাংলাদেশের উন্নয়ন পরিসরে গরিবলোকেরা দিনকে দিন ভালোর দিকে যাচ্ছে। আমার মত, এইসব গিরগিটিরা সঠিক কথা বলেন না। এরা যা বলেন তা বাড়িয়ে বলেন। আমি গত ১০-১২ বছর গবেষণা কাজ উপলক্ষ্যে বহু গ্রাম এলাকায় ভ্রমণ করেছি, আলাপ-আলোচনা করেছি সাধারণ মানুষের সাথে, যারা ঋণ কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করেছে এমন পরিবারের মানুষদের সাথেও কথা বলে দেখেছি, তাদের অবস্থা পরিবর্তনে এই ঋণ কার্যক্রমের খুব বেশি ভূমিকা নাই। বরং কৃষির ভূমিকা অনেক, সেই সাথে অকৃষি-খাত বিকাশের ভূমিকাও বেশ গুরুত্বপূর্ণ।

আপনাদের কী মত?

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.