আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নিত্য সংলাপ-২

ইমরোজ

লালনময় সন্ধ্যায় আজকে দুপুর দেড়টার দিকে একটা টিউশনি ছিল। এছাড়া সারাদিন বাসাতেই ছিলাম। টিউশনি করে শেষ করে ধানমন্ডির ভেতরের রাস্তা দিয়ে হেটে আসছিলাম। সামনে পরল আট নম্বর ব্রীজ। ওপাশে ডিঙ্গি আর এপাশে হলো মুক্তমঞ্চ।

রবীন্দ্র সরোবর। পাশ কাটিয়েই চলে যাচ্ছিলাম। কিন্তু গান বাজনার আওয়াজ শুনে কী হচ্ছে না দেখে পারলাম না। ঢুকে দেখি বিশাল আয়োজন। চারুকলার শিক্ষার্থীরা লালন ভাস্কর্য ভাঙ্গার প্রতিবাদে অনুষ্ঠান করছে।

চারুকলায় পড়ুয়া আমার একবন্ধুর সাথেও দেখা হয়ে গেল। আয়োজন বিশাল। আর আনুশেহ, বুনো, অর্ণব, কৃষ্ণকলি সকলেই সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তারপর দেখি আসলে সেখানে শুধু চারুকলার ছেলেমেয়েরাই নয় আরও অনেকে আছে। ইস্ট-ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি, নর্থসাউথ, শান্তামরিয়ম ইউডা সহ অনেক ইনিভার্সিটি ছেলে মেয়েরাই আছে।

প্রত্যেক ইউনিভার্সিটি থেকে আলাদা আলাদা করে বক্তব্য দিল ছাত্ররা। ভর দুপুর থেকে তখন বিকাল হবার সময়। এদিকে স্টেজে একটা গান দিয়ে অনুষ্ঠান তখন শুরু হয়ে গেছে। "জাত গেল, জাত গেল বলে..." গানটি বাউলের কণ্ঠে শুনে আমার কেমন যেন নেশাময় লাগল চারিদিক। গানেও যে নেশা থাকতে পারে তা কখনও আগে জানতাম না।

এদিকে আছরের আযান পড়ার সাথে সাথে শিল্পীরা সাময়িক বিরতি নিল। তারপরে একটা নাম না জানা ব্যান্ডের পারফর্মেন্স দেখলাম। তাদের গানে দুইটা লাইন মাথা থেকে আর বেরই হচ্ছে না। লাইন দুটো এরকম, "মাঝে মাঝে এমন হয় তখন ভাংচুড়ের সময়"। ঐ একই ব্যান্ডের আরেকটা গানও মনে আছে।

"রাত যায় আসে রাত, দিন গেছে পালিয়ে..." এমনই চমৎকার একটা বিকেল কাটাতে আমার বেশ ভাল লাগছিল। ওদিকে আকাশে তাকিয়ে দেখি মেঘগুলো সাইরাস হয়ে হাতছানি দিচ্ছে। লেকের এপার ওপারে বসে মাঝ ধরছেন লোকজন। সব মিলিয়ে একটা উৎসবমুখর পরিবেশ। বিভিন্ন বক্তার বক্তব্যে একথা স্পষ্ট বাংলাদেশে মৌলবাদীদের কোন স্থান নেই।

এইখানে ধর্মের দোহাই দিয়ে চলে না। বক্তারা বর্তমান সরকারের বিমূর্ততা নিয়েও প্রশ্ন করতে ছাড়লেন না। আমিও তাদের সাথে কণ্ঠ মিলালাম। এদিকে সময় কেটে যাচ্ছে...তখন একজন বাউল এলেন। সুদূর কুষ্টিয়া থেকে তার আগমন।

তাকে বলা হয়, "রক বাউল"। তার কণ্ঠে লালনের দুটা গান শুনে এসেছি। কিন্তু সেটা অন্যরকম। অন্যকারও গলায় এমন নেশাময় লাগে না। হঠাৎ যেন মনে হলো, লালনের ভাষ্কর্য ভাঙ্গতে গিয়ে লালনের আদর্শকে আরও উগ্রে দিয়েছেন মৌলবাদী গোষ্ঠি।

লালন এখন এখন দেশময় ছড়িয়ে যাবে। লালনের গান আর তার দর্শন পেয়ে প্রতিটি মানুষ আবেগ ফিরে পেল যেন। সবাই রক বাউলের গানের তালে তালে নেচে উঠছিলেন। রক বাউল একেবারেই গ্রাম্য লোক। তাকে বসন দেখে অবাক হচ্ছিলাম।

সাধারণ মানুষ তিনি। গানের মাঝখানে মাঝখানে যে কথাগুলো বললেন তার কিছু কথা এরকম, "আমাদের দেশে অনেক সমস্যা, আপনারা মারামারি করে আরও সমস্যা সৃষ্টি করবেন না। " তারপরে বললেন, "সাইয়ের গানে মানুষের প্রতি ভালবাসার কথা আছে, সাইয়ের গানে আছে ঈশ্বর প্রেম আর চিরন্তন দর্শন, সেগুলো বুঝতে পারলে নিজেকে আরও মানবিক করে তোলা যায়..." গ্রাম্য অশিক্ষিত একজন লোকের মুখে এই কথা শুনে আমার স্কুল বিদ্যা, কলেজ বিদ্যা যেন ফেল মারল। আমি তো থ মেরে গেলাম। লালনের সাধনা তাকে কতটা পরিপূর্ণতা দিয়েছে।

আশ্চর্য সুন্দর এক অনুভূতি তখন। গান গেলেন, "এইসব দেখি কানার হাটবাজার..." আসলেই আমরা চোখ থাকতেও অন্ধ হয়ে ফিরছি। আমাদের ফিরিয়ে নিতে লালন সাইয়ের গানগুলো এখন যেন উজ্জীবিত হচ্ছে। মানুষ আরও বেশি চমৎকৃত হচ্ছে লালনের ভান্ডার দেখে যেন। আমি এমনি এক লালনময় সন্ধায় "এসব দেখি কানার হাটবাজার..." শুনতে শুনতে বাড়ি ফিরলাম।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।