আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমাদের পণ্ডিত স্যার

বৃথা হয়রানি

১. পৃথিবীর সবচেয়ে লম্বা মানুষটাকে আমি চিনতাম। প্রতি বছর মাঘ-ফাল্গুনে আমাদের বাসায় কালী পূজা হতো। বাত্সরিক কালী পূজা। সে এক ধুন্ধুমার কাণ্ড। এক লেখায় এতো কিছু তুলে ধরা দুস্কর।

টানা এক মাস ধরে চলত যোগাড়-যন্ত। পূজার দিন সকাল সকাল বাবা বিছনা থেকে তুলে বলির পাঁঠার মতো দাঁড় করিয়ে দিতেন কলতলায়। অন্যদিন হলে চিত্কার চেঁচামেচি করে বাড়ি মাথায় তুলে নেয়া যেত। কিন্ত্ত আজ কালী পূজা। সব অন্যায়-অত্যাচার মুখ বুজেঁ সহা ছাড়া উপায় নাই।

স্নান সেরেই দৌড়-ঝাঁপ। কাজের কোনো শেষ নেই। কলা-পাতা কাটো রে। ঘটের জন্য মাটি আনো। বেল-পাতা, দূব্বা তো চাই।

বলার আগেই তুশ পুড়িয়ে ছাই করে রাখতে হবে। সব কিছু ঠিকঠাক না পেলে বাবার ঝাঁড়িতে বাড়িতে থাকা দায় হয়ে পড়বে। বাসায় উত্সব উত্সব ভাব। পাড়ার মা-মাশীরা বসে গেছেন বাটনা-কুটনায়। মুগ ডাল ভাজার গন্ধে চারদিক ম-ম করছে।

দিদিরা বসে বসে শিউলি আর গাঁদা ফুল দিয়ে একটার পর একটা মালা গাঁথছে। সন্ধ্যা ঘনালেই শুরু হতো আসল মজা। ধুপের ধোঁয়ায় চারদিকে সাদা হয়ে যেত। বাইরের পাহাড়ী কুয়াশা আর ঘর থেকে বেরিয়ে পড়া ধোঁয়া অমাবস্যার রাতে এক অদ্ভূত হৃদ্যতায় মেতে উঠত। কখনো মনে হতো সেটা কোনো দেও-দানবের মূর্তি।

কিংবা অন্য কোনো অভূতদৃশ্য বস্তু। ভয়ে বুকটা কেঁপে উঠত। তখন হয়ত আমাকে আরো ভয় দেখানোর জন্য বেজে উঠত শত্রু-তাড়ানি শঙ্খ, সঙ্গে দাদরা তালে কাঁসা। এমনি এক ভীতিকর পরিবেশে একটা লকঝকে সাইকেলে করে এক দীর্ঘকায় পুরুষ আসেন আমাদের গেটে। পরনে সফেদ ধূতি-পাঞ্জাবি।

কাঁধে একটা কাপড়ের থলে। অবচেতনে হঠাত্ তাকে দেখলে ভয়ে ভিমরী খাবার দশা হয়। বাবা থাকেন সবসময় গেটের দিকে চোখ পেতে। তাকে দেখা মাত্র ‌কত্তা মশায় এসেছেন বলে বাসার সবাইকে ডাকাডাকি শুরু করেন। এই কত্তা মশা‌য়ই করেন পুজো।

আমাদের স্কুলের হেডপন্ডিত কাম একমাত্র হিন্দু ধর্ম শিক্ষক। তারপর শুরু হতো পূজা। কালো কুচকুচে কালি মূর্তিটার সামনে ধবধবে ফরসা এক আর্য পুরুষ শালু গায়ে শুরু করতেন মন্ত্রপাঠ। কি এক অধরা ছন্দ, মাধূর্য ছিল তার কণ্ঠে। মুহূর্তে আমি হারিয়ে যেতাম কোথাও।

এ যেন আজকালের কোনো ঘটনা নয়্, হাজার বছর আগে কোন নৃপতির দরবারে বসে অশ্বমেধ যজ্ঞ দেখছি। আম কাঠ আর ঘিয়ে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠত যজ্ঞ। ফটফট একটা আওয়াজ হতো। আমাদের পন্ডিত মশাই আরো বেশি রুদ্র, আরো বেশি ভয়ংকর হয়ে উঠতেন মন্ত্র পাঠে। তার ঋজু গৌর শরীরটা এক সময় শুয়ে পড়ত কালী মূর্তির পায়ের কাছে।

আর ভয় যেন তখন চূড়ান্ত রূপ নিত। এতো ঋজু এতো দীর্ঘ মানুষ তখনো আর একটি দেখিনি। এখনো দেখিনি। আমার চোখে পৃথিবীর দীর্ঘতম মানব। ২. ক্লাস সেভেনে এক পরীক্ষায় সংস্কৃতে বিশাল এক ডিম্ব পেয়ে বসি।

পুরোপুরি ডিম্ব; মানে শূন্য। অবাক করা ব্যাপার। খারাপ হতে পারে তাই বলে শূন্য পাওয়ার তো কিছু নেই। ব্যাপারটা স্যারের দৃষ্টিতে আনলে তিনি জানান আমি সংস্কৃত পরীক্ষাই দেইনি। আমি অবাক।

আমার সেই ক্ষুদ্র মাথা দিয়ে বারবার তাকে বোঝাবার চেষ্টা করলাম আমি পরীক্ষা দিয়েছি। এই ওই প্রশ্নের আনসার করেছি। শেষমেশ পরীক্ষার এটেনডেন্স শিট আনা হলো। সেখানে স্পষ্ট আমার সই আছে। তিনি আমার মাথায় হাত দিয়ে বললেন, খাতাটা বোধ হয় হারিয়ে গেছে।

কোনো চিন্তা করিস না আমি পরের পরীক্ষায় তোকে পুষিয়ে দেব। পরের পরীক্ষায় ৫০-এ ৪৫ না ৪৭ পেয়েছিলাম। মজার ব্যাপার আমি ওতো আনসারও করিনি সেবার। ৩. এই আর্য সুপুরুষটি আমাদের স্কুলের গণ্ডিতে এলে আরেক রূপ নিতেন। বৌদ্ধ-খ্রিস্টান আর হিন্দুদের ক্লাস হতো হল রুমে; এক সাথে।

তিন চারটা ক্লাসের ছেলেরা এক হয়ে আড্ডা-টাড্ডা মেরে করে ফেলত ক্লাসটা। স্যার চেয়ারে হেলান দিয়ে আপন মনে ঘুমাতেন। তার ঘুম ভাঙ্গলেই হতো যত সমস্যা। তখন ধরে বসতেন একটা না একটা মন্ত্র। দু-চারটা মন্ত্র তাই সবসময় রিজার্ভে রাখতে হতো।

...হরে মুরারে মধু কৌটো ভারে... এসএসসি পরীক্ষার মাস খানেক পর ধর্ম ক্লাসের মজাটাই ছিল আলদা। স্যারের চোখের ঘুম যেত টুটে। চেহারায় অনিচ্ছার আঁকি-বুকি থাকত, তারপরো অখণ্ড মনোযোগে খাতাগুলো দেখতেন। নম্বর বসাতেন। একটা খাতা কাটা হয়ে গেলে এগিয়ে দিতেন আমাদের দিকে।

আমাদের কাজ ছিল যোগ করে মোট কত হলো তা তাকে জানানো। একবার এভাবে নম্বর গুণতে গিয়ে কে যেন পেয়েছিল ১০৫! পরে এ গল্প যাকেই বলেছি সে পেট ঠেলে হেসেছে। এমনই সরল একজন মানুষ ছিলেন পণ্ডিত স্যার। ৪. আমাদের আগের ব্যাচের মঞ্জু ভাই বোর্ড স্ট্যান্ড করেছিলেন। ভালো মাস্টার নাই ডাস্টার নাই একটা স্কুলের জন্য এতো বিরাট ব্যাপার।

তাই ধুমধাম করে একটা সংবর্ধনার আয়োজন করা হয়েছিল। ছাত্রদের পক্ষ থেকে আমি স্পিচ দিয়েছিলাম। স্পষ্ট মনে আছে। আমার স্পিচের পর খুব তালি পড়েছিল। আর সবার শেষে বক্তব্য রেখেছিলেন আমাদের হেড স্যার।

স্কুলটার অবস্থা তখন খুবই নাজুক। মারাত্মক শিক্ষক সংকট। একেকজন ৬টা-৭টা করে ক্লাস নেন। ক্লাসরুমগুলো বর্ষায় আর ব্যবহারের উপযোগী থাকে না। হেড স্যার খুব ইনিয়ে বিনিয়ে সেসব কথা বললেন।

শেষ পর্যায় বললেন, আমাদের হেড পন্ডিত মশায় দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে এখানে শিক্ষকতা করছেন। তিনি একজন বিএ বিএড কাব্যতীর্থ। বোর্ডে বাঙলা-সংস্কৃতের হেড এক্সামিনার। যোগ্যতা থাকার শর্তেও দীর্ঘ চাকরি জীবনে তিনি একটাও পদোন্নতি পাননি। এখনো তিন ভারনাক্যুলার টিচার হিসেবে কাজ করছেন।

স্যারের কথা শুনে তো আমরা অবাক। চারদিকে পিনপতন নীরবতা। এমনই এক দমবন্ধ করা পরিবেশ এ দীর্ঘকায় গৌরাঙ্গ পুরুষ নতমস্তকে কেটে পড়লেন। আমার খুব কষ্ট হলো। ৫. গত পুজোয় চট্টগ্রাম গিয়েছিলাম পরিবারের সবার সঙ্গে উত্সব করতে।

আমার ধর্মে-টর্মে খুব একটা মতি নেই। কারণ বড়ো কিছু হওয়ার স্বপ্ন এ জীবনে কখনোই দেখিনি। অলৌকিকভাবে হুটহাট কিছু পেয়ে যাওয়াতেও আমার কোনো আগ্রহ নেই। ফলে আমার জীবনে ঈশ্বরকে খুশী রাখার কখনো কোনো প্রয়োজনবোধ করিনি। এরকম একটা ধর্মহীন মানুষও কিছু কিছু ক্ষেত্রে খুব ধর্মনিষ্ঠ হয়ে পড়ে।

এই যেমন দূর্গা পূজার অঞ্জলি নেয়ার ব্যাপারটা আমার অসম্ভব ভালো লাগে। আমি আর দশজনের মতো চোখ বুজেঁ পুরোহিতের সঙ্গে সুর মিলিয়ে অঞ্জলি জপি না। ওঁ বিল্ল্বপত্রো নম:-ও বলি না। শুধু কান পেতে বৈদিক মন্ত্রগুলো শুনি। শত শত অশ্বের খুরোধ্বনি পাই।

শুনি খাইবার গিরিপথে তলোয়াড়ের টুঙটাঙ। বীরের হুংকার। আমার ভালো লাগে। আমি মগ্ন হই। বিশেষ করে পন্ডিত স্যারের পুরুষোচিত কণ্ঠের কারণে।

এবার নবমীতে গিয়ে দেখি মণ্ডপে স্যার নেই। উনার পরিবারের লোকজনের কাছে শুনলাম পুজোর মণ্ডপে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। ঘরে চিকিত্সা চলছে। সব শুনে আমার মনে হলো তার ব্লাডপ্রেশার নেমে গেছে। এখনই দুধ-ডিম খাওয়ানো দরকার।

পরিবারের লোকজনকে তা বলতে তারা উত্কণ্ঠার সঙ্গে বললেন, মরে গেলেও তিনি এখন কিছু খাবেন না যতক্ষণ না পুজো শেষ হচ্ছে। দিন দুয়েক আগে খবর পেলাম স্যার মারা গেছেন। আমার চোখে শুধু ভাসছে সেই সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে নি:শব্দে বেরিয়ে পড়া লোকটার ছবি।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.