আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

চট্রগ্রামে বিয়ে বিচ্ছেদের ঘটনা বাড়ছে আশঙ্কাজনক হারে

বাংলাদেশকে নিয়ে শংকিত
প্রথম আলো থেকে রোকেয়ার বাড়ি হাটহাজারী উপজেলা সদরের ফটিকা গ্রামে। সংসারে তাঁরা ভাইবোন আটজন। বাবা করিম উল্লাহ ট্যাক্সি চালান। গত বছরে ৮ অক্টোবর একই এলাকার ফরিদুজ্জামানের প্রবাসী ছেলে মুরতাজার সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয় স্থানীয় একটি কমিউনিটি সেন্টারে বেশ ধুমধামের সঙ্গে। বিয়েতে দেনমোহর ধরা হয়েছিল দুলাখ টাকা।

বিয়ের পর দু-তিন মাস সুখেই ছিলেন। করিম উল্লাহ জানান, মেয়ের বিয়েতে ধার-কর্জ হয়েছিল প্রায় এক লাখ টাকা। মোট খরচ হয়েছিল তিন লাখ টাকা। বরপক্ষের দাবি অনুযায়ী আসবাবপত্র, ফ্রিজসহ যাবতীয় মালামালও দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তিন-চার মাস না যেতেই এক লাখ টাকা বাবার কাছ থেকে এনে দেওয়ার জন্য রোকেয়ার ওপর চাপ সৃষ্টি করতে থাকে মুরতাজা।

রোকেয়া অপরাগতা প্রকাশ করলে তাঁর ওপর শুরু হয় মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন। এর মধ্যে রোকেয়ার গর্ভে সন্তান আসে। টাকা এনে না দেওয়ায় স্বামী ও শাশুড়ি বিলকিস বেগমসহ পরিবারের অন্য সদস্যরাও রোকেয়ার ওপর নির্যাতন চালায়। অবশেষে ২০০৭ সালের ১২ জুলাই নির্যাতন করে রোকেয়াকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় বাবার বাড়িতে। বাড়ি যাওয়ার এক সপ্তাহ পর রোকেয়ার কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয় তালাকনামার নোটিশ।

এর তিন দিন পরেই রোকেয়া একটি কন্যা সন্তানের জন্ন দেন। পাষন্ড স্বামীর যৌতুকের দাবি মেটাতে না পারায় লন্ডভন্ড হয়ে গেল রোকেয়ার জীবনটা। বাকলিয়া এলাকার আবদুল মজিদের মেয়ে ইয়াসমিনের সঙ্গে একই এলাকার (পূর্ব বাকলিয়া ৩৮/১ বাইলেন) করিম আবদুল্লাহর ছেলে রিফাতউদ্দীনের বিয়ে হয় ২০০৭ সালের ৯ ডিসেম্বর। বিয়ের পর দেখা যায় স্বামী হেরোইনে আসক্ত হয়ে পড়ছে। এ নিয়ে অশান্তির একপর্যায়ে গত ২৮ সেপ্টেম্বর ইয়াসমিন রিফাতকে তালাক দিয়ে দেয়।

এভাবেই যৌতুক, ভরণপোষণ দিতে না পারা, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বনিবনা না হওয়া এবং স্বামী কিংবা স্ত্রীর পরকীয়ার কারণে চট্টগ্রাম নগরসহ জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিয়ে বিচ্ছেদের ঘটনা বেড়েই চলছে। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন সুত্রে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, নগরীর ৪১টি ওয়ার্ডে ২০০৭ সালে বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটেছে এক হাজার ৩৯৪টি, চলতি বছরের নয় মাসে (জানুয়ারি-২৩ সেপ্টেম্বর) এক হাজার ২৮০টি। অপরদিকে, জেলা প্রশাসন সুত্র জানায়−গত বছর চট্টগ্রামের ১৪টি উপজেলায় বিয়ে বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটেছে পাঁচ হাজার ৮৫০টি। চলতি বছর জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নয় মাসে ১৪ উপজেলায় তালাকনামা নিবন্ধিত হয়েছে তিন হাজার ৯০০টি। বিচ্ছেদের প্রাপ্ত পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গ্রামের চেয়ে শহরেই বিচ্ছেদের ঘটনা বেড়েছে।

নগর এলাকার পরিস্হিতি রীতিমতো উদ্বেগজনক। হিসাব করে দেখা যায়, ২০০৭ সালে শহরে প্রতিদিন প্রায় চারটি, ২০০৮ সালে প্রতিদিন প্রায় পাঁচটি বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটছে। অপরদিকে, ২০০৭ সালে চট্টগ্রামের ১৪ উপজেলার প্রতিটিতে গড়ে বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটেছে ৪১৭টি। গ্রামের চেয়ে শহরের চিত্র তিন-চার গুণ বেশি। অনুসন্ধানে জানা যায়, নগরের ৩৮, ৩৯, ৪০ নম্বর ওয়ার্ড ও বাকলিয়া এলাকায় বিচ্ছেদের ঘটনা তুলনামূলক বেশি।

এ ব্যাপারে সিটি করপোরেশনের সালিসি কাউন্সিলের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, ‘চট্টগ্রামের ইপিজেড এলাকায় প্রায় দুলক্ষাধিক নারীশ্রমিক রয়েছেন। এসব এলাকায় বিচ্ছেদের ঘটনা ঘটে অহরহ। ’ এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘ওইসব এলাকায় বেশ কিছু টাউট-বাটপার রয়েছে। তারা কোনো কাজ করে না। একেক জন চার-পাঁচটি বিয়ে করে।

আজ বিয়ে করল তো কাল ভাঙল। ’ আইনজ্ঞরা বলেছেন, নারী ও শিশুনির্যাতন দমন আইনের যথেচ্ছ অপব্যবহার হচ্ছে। একশ্রেণীর নারী শুধু টাকার লোভে একাধিকবার বিয়ের পিঁড়িতে বসছেন। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সামান্য মনোমালিন্য সৃষ্টি হলেই তাঁরা নানা ছলছুতোয় স্বামীসহ পরিবারের নিরীহ লোকদের বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দেয়। ঝামেলা এড়াতে অনেকেই কাবিননামার টাকা পরিশোধ করে হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন।

এভাবেই একপ্রকার বোঝাপড়া হয়ে গেলে কয়েক মাস পর আরেকজনকে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করা হয়। এ ব্যাপারে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী রানা দাশগুপ্ত প্রথম আলোকে বলেন, ‘নারী ও শিশুনির্যাতন আইনের অপপ্রয়োগ হচ্ছে−এটা সত্য। দেখা যাচ্ছে, সামান্য বিষয়ে স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া হয়েছে। অথচ ওই আইনের আওতায় এনে পরিবারের সবাইকে হয়রানি করা হচ্ছে। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক স্থায়ী হয় পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাসের ভিত্তিতে।

কিন্তু আস্থা ও বিশ্বাসের সম্পর্কে এখন ফাটল ধরছে নানা কারণে। শহরে আধুনিকতার নামে বিকৃত রুচির লালন চলছে। গ্রামীণ সভ্যতা ও সংস্কৃতি এখনো বিদ্যমান বলে শহরের চেয়ে গ্রামে বিচ্ছেদের ঘটনা কম হচ্ছে। ’ চট্টগ্রাম জেলা রেজিস্ট্রারের দপ্তর ও সিটি করপোরেশনের সালিসি কাউন্সিলে বিয়ে বিচ্ছেদের বিভিন্ন নথিপত্র ঘেঁটে দেখা যায়, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বনিবনা না হওয়া, স্বামী কর্তৃক স্ত্রীর মৌলিক চাহিদা পূরণ না করা, স্বামী কিংবা স্ত্রী উভয়ের পরকীয়া প্রেম, যৌতুক, স্বামী মাদকাসক্ত হওয়া, বেকারত্ব এবং স্বামীর পরিবারের সঙ্গে মিলেমিশে থাকতে না পারার কারণে বিয়ে বিচ্ছেদের ঘটনা বাড়ছে। যোগাযোগ করলে সমাজবিজ্ঞানী ড. অনুপম সেন বলেন, ‘শহরের চেয়ে গ্রামের মানুষদের মধ্যে সামাজিক মূল্যবোধ বেশি।

এ ছাড়া, শহরের মানুষগুলো বিচ্ছিন্ন থাকেন সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে। গ্রামের মানুষের কর্মকান্ডের একটা স্থায়ী ভিত থাকে। শহরের ব্যাপার অনেকটা রুটলেস বা গতিহীন। ’ অভিজ্ঞমহলের ধারণা, ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইনে তালাক একটি বৈধ কাজ হিসেবে গণ্য হলেও স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদ কারোর কাম্য নয়। এ ব্যাপারে সচেতনতা সৃষ্টির ওপর জোর দিয়েছেন তাঁরা।


 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.