আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমাদের শিশুরা



এডিডাসের বিজ্ঞাপনী শ্লোগানটা চমৎকার, ইমপসিবল ইজ নাথিং, তবে আমার নিয়মিত মনে হয় এই বাক্যটা অসম্পূর্ণ, সম্পূর্ণ বাক্যটা হবে ইম্পসিবল ইজ নাথিং ইন বাংলাদেশ। এখানে যেকোনো মুহূর্তে যেকোনো কিছুই ঘটা সম্ভব, অসম্ভবের পায়ে মাথা কুটে জীবন যাপন করে রবীন্দ্রনাথ, আপমার বাঙালী হয়ে উঠতে না পারা বাংলাদেশীরা অসম্ভব যেকোনো কিছুই সহজে গ্রহন করে নেয়। বাংলাদেশে গর্ভধারণ অপরাধ বিবেচিত হয়, এখানে গর্ভধারণের অপরাধে মেয়েদের চাকুরিচ্যুত হতে হয়। কোথাও শিশুবান্ধব পরিবেশ নেই, গর্ভবতী এবং শিশুসন্তানের মায়ের জন্য উপযোগী পরিবেশ নেই। বাংলাদেশের গৃহকর্মীরাও অনেক ভালো আছে এই বিবেচনায়, তারা শিশুসন্তানকে নিয়ে ঘরে ঘরে গেরোস্থালী কাজ করতে পারে, তবে গার্মেন্টস, যেখানে একক ভাবে প্রচুর নারী শ্রমিক কাজ করে, সেখানের মানবহিতৈষি ব্যবসায়ীরা শিশুদের যত্নে কোনো ব্যবস্থা রাখে নি, তারা ৫০০০ টাকা দন্ডী দিয়ে বরং গর্ভবতীদের চাকুরিচ্যুত করে ফেলে।

বেসরকারী অফিসে মাতৃত্বকালীন ছুটির বন্দোবস্ত থাকলেও সেটা ৪ মাসের ছুটি। এরপর সদ্যপ্রসুতি মাতাকে কাজে যোগ দিতে হয়। মাতা কাজে আসলে সারাদিন শিশুকে রেখে আসবে কার জিম্মায়? অধিকাংশ ডে কেয়ার সেন্টার ১ বছরের বেশী বয়েসী শিশুদের রাখতে চায়, এবং সেগুলোও মানসম্মত নয়। কর্মজীবি মহিলাদের জন্য কোনো ব্যবস্থাই নেই। একটাই বিকল্প হতে পারে নিরুদ্বিগ্ন মা যদি সন্তানের মঙ্গল চান তবে তাকে সন্তান জন্ম দেওয়ার পরে ১ বছর গৃহবন্দী জীবনযাপন করতে হবে।

বাংলাদেশ বিকলাঙ্গতা যেখানে পূজনীয় এবং বিকলাঙ্গতা যেখানে পূঁজি, আমাদের শিশুদের প্রতি মমত্ববোধের বাণিজ্যিক মূল্য আছে। আমরা সদ্যজাত শিশু কাঁখে ঘোরা মায়েদের অধিকতর ভিক্ষাপ্রদানে আগ্রহী, ঢাকা শহরের রাস্তায় শিশু ভাড়া করে ভিক্ষা করছে এমন মায়েদের সংখ্যা কম নয়। জনৈক কর্মজীবি নারী, তার শিশুসন্তানের বয়েস ৮ মাস। বেসরকারী অফিসে কাজে যোগদান করেছেন, বাসায় শিশু সন্তানকে কাজের মেয়ের জিম্মায় রেখে আসেন। তার নিয়মিত জীবনযাপনের সময় ভাগ করা, তিনি সকালে ৮টায় বাসা থেকে বের হয়ে যান, ফিরে আসেন ৬টা বাজে।

কোনো একদিন তিনি বাসা ফিরলেন ৬টার আগেই। এসে দেখলেন বাসা ফাঁকা। ঘরে গৃহপরিচারিকার জিম্মায় শিশুকে রেখে নিশ্চিত মনেই তার কর্মজীবন চলছিলো, তবে আজ হঠাৎ করেই তিনি উদ্বিগ্ন বোধ করলেম ঘরে কাউকে না পেয়ে। তবে বেশীক্ষণ অপেক্ষা করতে হয় নি তাকে, তিনি ঘরে পৌঁছানোর কিছুক্ষণ পরেই পৌঁছালো গৃহপরিচারিকা। সারাদিন শিশু দেখে রাখবার অবসর সময়টাকে এই উদ্ভাবনকুশলী গৃহপরিচারিকা অর্থনৈতিক ভাবে ব্যবহার করেছে।

সে শিশুটিকে নিয়ে ভিক্ষায় বের হয়েছিলো। পরিশ্রমবিমূখ বাংলাদেশীরা ভিক্ষাবৃত্তিকে শিল্পে পরিনত করেছে। মানবিক অনুভুতি এবং মানবিক আবেগের যতটুকু সম্প্রসারণ সম্ভব সবটুকুই করা হয়েছে বাংলাদেশে। এই মানবিক অনুভুতিটাকে ব্যবহার করতে পারঙ্গম বাংলাদেশের পরিশ্রমবিমূখ মানুষেরা। বিকলাঙ্গ মানুষ স্বউদ্যোগী হয়ে এখানে উপার্জনক্ষম হয়ে উঠে, তারা রাস্তায় ভিক্ষা করতে নেমে যায়।

আমি অন্ধ গরীব বাবা, আমার দেখার কেহ নাই, কর্কশ কণ্ঠে গান গেয়ে ভিক্ষা করতে রাজী তারা, তবে একটু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নিয়ে, একটু পরিশ্রম করে উপার্জন করতে তাদের তীব্র অনীহা কাজ করে। এই মহিলার সন্তানকে ভিক্ষাবৃত্তিতে ব্যবহারের জন্য আমরা আমাদের সংস্কারকে দায়ী করবো না কি আমাদের এই গৃহপরিচারিকাকে দায়ী করবো? বাড়তি আয়ের অনৈতিক সুযোগ গ্রহনে বাংলাদেশীরা কখনও পিছিয়ে এসেছে নৈতিকতার পীড়ণে, এমন দৃশ্য কি বাংলাদেশ দেখেছে? বাৎসল্য আমাদের অন্ধ করে, তবে কর্মজীবি এই মহিলার উপলব্ধিকেও ফেলে দিতে পারি না, তার এখন মনে হয় যৌথ পরিবারে থাকলে অন্তত এই অনর্থ ঘটতো না। তিনি গৃহপরিচারিকাকে ছাটাই করেছেন, তবে বিকল্প কোনো ব্যবস্থা কি তার আছে? ঢাকা শহরের ডে কেয়ার সেন্টারগুলোর বিরুদ্ধে অভিযোগের অন্ত নেই। অবশ্য বাংলাদেশের কোন সেবা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে নিয়মহীনতার অভিযোগ নেই। জটিল একটা পারস্পরিক নির্ভরতার ভিত্তিতেই বিভিন্ন উপায়ে মানিয়ে চলবার শিক্ষাটা আমরা এখান থেকে নিয়মিতই পাই।

আস্থার সাথে তারা নিজেদের কাজ করবে না, ডে কেয়ার সেন্টারের বুয়ারা শিশুদের বরাদ্দ খাদ্য নিজেরা খেয়ে ফেলছে, খেলনা নিয়ে চলে যাচ্ছে, শিশুদের অবহেলা করছে, এমন ভীতিপ্রদ উদাহরণের পর কেউ আগ্রহ নিয়ে নিজের সন্তানকে ডে কেয়ার সেন্টারে রাখতে চাইবে না। এই ঘটনাটা জেনেও শিউরে উঠি না ঠিক মতো। বরং অসহায় বোধ করি, ভিক্ষায় নিযুক্ত এই শিশুদের অধিকাংশকেই স্বল্প মাত্রার সিডেটিভ দেওয়া হয়। এই সিডেটিভের প্রভাবেই তারা নির্জীব পড়ে থাকে ভাড়া খাটা মায়ের কোলে। তাদের নেশাসক্ততা তাদের অপরাধ নয় বরং যারা তাদের ভাড়ায় ব্যবহার করছে এবং যারা তাদের বাণিজ্যিক ব্যবহার করছে এইসব বড় মানুষের অনৈতিকতার কারণেই একদম শৈশবেই নেশাসক্ত হয়ে পড়ছে এই শিশুরা।

শিশুদের বাণিজ্যিক ব্যবহার নতুন করে শেখালো মাদকপাচারকারীরা। তারা মাদক পরিবহনের সময় নিজেদের সন্দেহের উর্ধ্বে রাখতেই একটা শিশুকে ভাড়া নিয়ে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে। সুস্থ স্বাভাবিক শিশুদের তুলনায় দউর্ভাগা বিকলাঙ্গ শিশুরা। আমাদের শৈশব কেটেছে ছেলেধরা আতঙ্কে। অধিকাংশ দুপুরেই আমরা ঘুমাতে চাইতাম না, ঘরের নিরাপদ বিছানার চেয়ে আকর্ষণীয় ছিলো নির্জন রাস্তা, দুরের মাঠ, সে সময় আমাদের মায়েরা বলতো খবরদার বাইরে যাবি না, দুপুর বেলা ছেলে ধরা ঘাড়ে বস্তা নিয়ে ঘুরে, ধরতে পারলেই বস্তায় পুড়ে নিয়ে চলে যাবে, পরে হাত পা ভেঙে ভিক্ষায় লাগাবে, না তো কিডনী বেঁচে দিবে।

আমাদের বাইরের নির্জন দুপুর মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখতো, ছেলে ধারার আতঙ্ক মনে রেখেই গা ছমছম উত্তেজনায় আমরা দুপুরে মায়েদের চোখ এড়িয়ে সারা পাড়া ঘুরে বেরাতাম। অভিযোগ ছিলোই, তবে প্রকৃত অপরাধীদের কখনই গ্রেফতার করা সম্ভব হয় নি। বাংলাদেশে এখনও ভিক্ষাবৃত্তির জন্যই শিশুদের বিকলাঙ্গ করা হয়। যদিও বাংলাদেশের নারী ও শিশু নির্যাতন বিরোধী আইনে বিকলাঙ্গতার কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে তবে মৃদু সিডেটিভ দিয়ে শিশুদের মাদকাসক্ত করে মানসিক বিকলাঙ্গ করে দেওয়ার বিরুদ্ধে তেমন শক্ত আইনী পদক্ষেপ নেই। আমাদের মানসিক বিকলাঙ্গ মানুষদের প্রতি আমাদের কঠোর ব্যবহার, আমাদের উদাসীনতা এবং আমাদের নির্মমতার চিহ্ন প্রতিদিন চোখে পড়ে।

শিশু হারিয়ে যাবে এই আশঙ্কায় মা শিশুকে শেকল বেধে রাখে বাংলাদেশে, বিকলাঙ্গ শিশুকে শেকলে বেধের ভিক্ষাবৃত্তিতে বাধ্য করে, এবং সেই মানসিক বিকলাঙ্গ শিশু অন্যসব তথাকথিত মানসিক ভাবে সুস্থ ছেলেদের হাতে নির্যাতিত হয়, আহত হয়। আমাদের সুস্থতা প্রকাশিত হয় আমাদের শব্দে, পাগল, ভেক ধরা, লেলুয়া, বিভিন্ন শব্দ আমাদের অভিধানে আছে যা দিয়ে আমরা মানসিক বিকলাঙ্গ শিশুদের চিহ্নিত করি। আমাদের অমানবিকতার শেষ নেই, তাই এমনও ঘটনা ঘটে যেখানে একজন অটিস্টিক শিশুকে একজন মাহিলা আক্রমন করে। আমাদের শিশুদের প্রতি মমত্ববোধ ২ টাকা ভিক্ষায় প্রকাশ না করে বরং সামাজিক ভাবেই প্রকাশিত হোক। আমারা এমন একটা সম্প্রদায় তৈরি করি যারা মমত্ববোধের প্রকাশ রাখবে নিয়মিত জীবন যাপনে, নিজের সন্তানকে দুধে ভাতে রেখে শিশু গৃহপরিচারিকাকে গরম পানিতে ঝলসে না দিয়ে বরং সবার প্রতি সমান দৃষ্টি প্রদান করতে শিখি আমরা।

আমরা এমন একদল মানুষ নির্মান করি যারা শিশুদের সুস্থ এবং সঠিক বিকাশে সক্ষম, যেখানে একজন শিশু পারিবারিক ভাবে শিখবে সকল মানুষ তথাকথিত সুস্থ ভাবে জন্ম নেয় না, কেউ কেউ একটু পিছিয়ে পড়ে জন্ম নেয়, তাদের স্বাভাবিক ভাবে গ্রহন করলে তারাও একদিন স্বাভাবিক মানুষের পাশে নিজেদের সঠিকভাবেই স্থাপন করতে পারবে, তারা পারিবারিক এবং সামাজিক বোঝা নয় বরং নিজের যোগ্যতায় রাষ্ট্রের উপযুক্ত নাগরিক হিসেবে তৈরি হতে পারবে।


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।