আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

স্বপ্নচোর- ১২ তম পর্ব

দ্যা ব্লগার অলসো.....

‘জানি না কেন এখনো আপনার সাথে বসে আছি আমি। নিজের কাছে নিজেকে দারুণ ছোট মনে হচ্ছে। ’ ম্যাকডোনাল্ডস এর আলো-আঁধারিতে বসে আছে জয় ,সাথে ‘আপন অপরিচিতা’, কথাটা ওই বললো। ‘ছোট মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক। তবে সেটা ভেবে অযথা নিজেকে কষ্ট না দিয়ে ঠিক করুন কি করবেন।

’ ‘বুঝতে পারছিনা কি করব, কি করা উচিত। যেখান থেকে এসেছি, সেখানে ফিরে যাবার ইচ্ছে বা রাস্তা, কোনটাই আমার নেই। ’ কিছু বললনা জয়, ওর জানতে ইচ্ছে করলো, কেন বাড়ি থেকে পালালো মেয়েটা। তবে জিজ্ঞেস করার দরকার হলোনা, নিজে থেকেই বলতে লাগলো ও। ‘খুব বড়লোকের মেয়ে আমি।

আমার বাবার কতো টাকা তা বোধহয় তিনি নিজেও জানেননা। আমার মা নেই, তিনি মারা যাবার পর বাবা আর বিয়ে করেননি। আমাকে নিয়েই তার দিন কেটে যাচ্ছিলো। খুব ছোট একটা ব্যবসা ছিলো তার। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে সেই ব্যবসাটাকে আস্তে আস্তে বড় করেছেন, নিয়ে গেছেন একেবারে পাহারের চূড়োয়, শীর্ষস্থানে।

টাকার পাহারে চড়তে গিয়ে তিনি তার একমাত্র কন্যাকে পর্যন্ত ভুলে যান, ভুলে যান মাতৃহারা মেয়েটার মায়ের অভাবও তাকেই পূরণ করতে হবে। তবুও এ পর্যন্ত সব ঠিকই ছিলো। এরপর......’ কথা শেষ করতে পারলনা মেয়েটা, ঝরঝর করে কাঁদতে শুরু করলো। অপ্রস্তুত বোধ করলো জয়, মেয়েটা ওকে ডোবাবে নাকি। ‘কন্ট্রোল ইওরসেলফ, প্লীজ।

’ নিজেকে সামলে নিলো মেয়েটা, শুরু করলো আবার,-‘বড় হওয়ার পর থেকেই দেখছি বাবা কেমন যেন অন্যরকম হয়ে গেছেন। বাবা মদকে খুব ঘৃণা করতেন, অথচ সেই মদ তিনি বাসায় পর্যন্ত খেতে শুরু করেন। আমার প্রতি তার ভালোবাসাও ফিকে হয়ে এলো। আমি কি করছি, না করছি, পড়ালেখা কেমন হচ্ছে, কোনকিছুর প্রতিই তার নজর নেই। কাজ, অফিস, পার্টি এসবের মাঝেই ডুবে রইলেন।

তারপর একদিন রাতে, বাবার সাথে প্রায় আমারই বয়সী একটা মেয়ে বাসায় এলো। ’ এ পর্যন্ত এসেই আবার ফোঁপাতে শুরু করলো মেয়েটা। ‘বুঝতে পারছি, আপনার কষ্ট হচ্ছে। আমি তো এসব শুনতে চাইনি। ’ অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে বললো জয়।

‘না, আপনি শুনতে না চাইলেও আমাকে বলতে হবে, নিজেকে হালকা করার জন্য। সেই রাতে মেয়েটা বাবার সাথেই একরুমে থাকলো। যে বিছানায় মা-বাবা থাকতেন, সেটাকে বাবা অপবিত্র করলেন। আমি যে একটা মানুষ ঘরের মধ্যে আছি, তিনি সেটা খেয়ালই করলেননা। এরপর মেয়েটা প্রায়ই আমাদের বাসায় আসতে শুরু করলো।

চলাফেরা করতে লাগলো এমনভাবে, যেন সেই এ বাড়ির কর্ত্রী, এমনকি আমার উপর পর্যন্ত সীমাহীন খবরদারি করতে লাগলো সে। সবকিছু সহ্য করে চলছিলাম কোন উপায় নেই বলে। তারপর দুদিন আগে বাবা আমাদের সংসারের কফিনে শেষ পেরেকটা ঠুকে দিলেন, আমাকে বললেন- তিনি মেয়েটাকে বিয়ে করছেন, আমি যেন তাকে আমার নতুন মা হিসেবে ‘সমাদর’ করি। ’ এখন মেয়েটা ফোঁপাচ্ছেনা, তবে দুচোখ বেয়ে ঝরছে অশ্র“। ‘অনেক ভেবে দেখলাম, ও বাড়িতে থাকা আমার পক্ষে আর সম্ভব নয়।

বন্ধু-বান্ধবীদের কাছে কি করে মুখ দেখাবো সেই চিন্তায় অস্থির হয়ে গেলাম। আত্মীয়-স্বজন কারো কাছে যাবার প্রশ্নই আসেনা, কারণ বাবার এ জুলুমে তারাও মদদ যোগাচ্ছিলো। এর পেছনে যুক্তিও ছিলো- তারা প্রায় সবাই বাবার মুখাপেক্ষী ছিলো। তাই এভাবে রাস্তায় বেরিয়ে পড়া ছাড়া আমার আর কোন উপায় ছিলোনা। ’ কথা শেষ করে থামলো মেয়েটা, এখনো দুচোখ জুড়ে দুঃখের প্লাবন বয়ে চলেছে।

‘‘মানুষের কাছ থেকে মানুষের ছায়া সরে যায়, এই যে অসীম ক্ষত, এই যে ফুলের আর্তনাদ, ওপারে উঠেছে চাঁদ, কিছুপরে রাত্রি ভোর হবে এ এক মৃত্যুর দৃশ্য গোলাপ বিষাদে ঝরে পড়ে!’’ জয়ের মনে কবিতার চরণগুলো ঘুরপাক খেতে লাগলো। অপরিচিতার কান্না এমনই বিচিত্র এক অনূভুতির সৃষ্টি করলো ওর মনে, মনে হলো বিষাদে ঝরে পড়া গোলাপটা ওই মেয়েটাই। খুব ইচ্ছে করলো ওর মাথায় হাত রাখতে, বলতে-‘পৃথিবীতে সবাই দুঃখী, যাদেরকে দেখে মনে হয় সুখী, তারা প্রকৃতপক্ষে তা নয়, সুখের অভিনয় করছে মাত্র। ’ ‘আই’ম সরি, এক্সট্রিমলি সরি। ’ মুখে বলল জয়।

খাওয়া পর্ব শেষ হওয়ার পর চুপচাপ বসে রইলো ওরা অনেকক্ষণ। জয় বুঝতে পারছেনা কি করে মেয়েটাকে বলবে যে, ও তাকে সাহায্য করতে চায়। দ্বিধা-দ্বন্ধের দোলাচলে দুলতে লাগলো ও। তবে একটু পরেই এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেল, অপরিচিতাই ওকে সুযোগটা করে দিল। ‘আপনি কে আমি জানিনা, তবে অল্প সময়ের পরিচয়ে আপনাকে যতোটুকু চিনেছি, তাতে মনে হয়েছে, আপনার মতো মানুষ খুব কমই আছে এই পৃথিবীতে।

আপনি আমার জন্য যতোটুকু করেছেন, তার সিকিভাগও যদি অন্য কেউ করতো তাহলে হয়তো এতোক্ষণে প্রতিদান চেয়ে বসতো, দিতে না চাইলে জোর করে আদায় করে নিতো। অন্তর থেকে ধন্যবাদ আপনাকে। এবার আমি যাব। ’ বলে উঠে দাঁড়াল মেয়েটা। ‘প্লীজ যাবেন না, বসুন, আপনাকে আমার কিছু বলার আছে’, বসল অপরিচিতা, একটু থেমে শুরু করল জয়, ‘ঠিকই বলেছেন, উপকারি তার উপকারের প্রতিদান তো চাইতেই পারে।

আর যে উপকার পেল তার উচিত অবশ্যই তার চাওয়া পূরণ করা, যদি সে অকৃতজ্ঞ না হয়। ’ চেহারায় প্রশ্নবোধক চিহ্ন নিয়ে তাকিয়ে রইল মেয়েটা। ‘আমিও একটা উদ্দেশ্য নিয়ে আপনার উপকার করেছি বলতে পারেন। আর এখন আমি তার প্রতিদান চাইব। ’ মেয়েটার প্রতিক্রিয়া হলো দেখার মতো।

চেহারা পুরো ফ্যাকাসে হয়ে গেছে, চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে জয়ের দিকে। ‘জানি না আপনি কথাগুলো কিভাবে নেন, তবু আমাকে বলতেই হবে। আপনার সাথে দেখা হওয়ার আগ পর্যন্ত ভাবতাম পৃথিবীতে আমিই সবচাইতে দুঃখী মানুষ। আপনার কাহিনী শোনার পর আমার সে ধারণা ভেঙ্গে গেছে। হয়তো পৃথিবীতে সুখী মানুষের চাইতে দুঃখীর সংখ্যাই বেশি।

আর ওদের কাতারে আমিও একজন। দুঃখের পরেই আসে সুখ, কিংবা সুখের পরে দুঃখ, আরো অনেকের মতো আপনার বেলায় কথাটা সত্যি হলেও আমার বেলায় এটা একেবারেই মিথ্যা। জন্ম থেকেই দুঃখ আমার সঙ্গী। আপনি যদি শুনতে চান তাহলে শোনাতে পারি। ’ আস্তে করে সম্মতিসূচক মাথা ঝাঁকাল মেয়েটা।

তারপর ওকে নিজের জীবনকাহিনী শোনাল জয়। আলোর কথাও বলল ওকে, তবে এড়িয়ে গেলো ওর অন্ধকার জীবনের কথা, কেন যেন মনে হলো সেই কথা শুনলে মেয়েটা এক্ষুণি চলে যাবে। ‘মাঝে মাঝে আমার মনে হয় একদিন আমার জীবনেও আনন্দ আসবে, আসবে আলোর বারতা। আর কেন যেন মনে হচ্ছে সেদিন আর খুব বেশি দুরে নয়। বলেছিলাম না, আপনাকে সাহায্য করার পেছনে আমার একটা উদ্দেশ্য ছিল।

সেটা আর কিছুই নয়, আপনি দেখতে হুবহু আলোর মতো। টার্মিনালে আপনাকে দেখে আমি চিৎকার করে উঠেছিলাম আপনার মনে নেই? সত্যি বলতে কি, আমার এখনো মনে হচ্ছে আপনি আলোই। অনেকদিন ধরে এ শহরের উপর বিতৃষ্ণা জন্মে গেছে আমার। ইট, পাথর, সিমেন্টের এ শহরকে মরুভুমির চাইতেও রুক্ষ, নির্মম মনে হয়। বৃষ্টিস্নাত রাজপথে আপনাকে দেখে এক পলকের জন্য এ মরুভুমিকে স্বর্গ মনে হয়েছিলো আমার।

মনে হয়েছিলো এ শহর পৃথিবীর বেহেশত কাশ্মির এর চাইতেও হাজারগুন বেশি সুন্দর। আর যে কথাটা বলা সবচাইতে বেশি প্রয়োজন; কোথায় যেন শুনেছিলাম, দুঃখ যদি পাথর হতো তাহলে জমতে জমতে আকাশ ছুঁতো। দুঃখ পাথর নয়, দুঃখ বরফ। আর এই বরফ তখনই গলে যখন সে ভালোবাসার উষ্ণ ছোঁয়া পায়। ’ মন্ত্রমুগ্ধের মতো জয়ের কথা শুনছিলো মেয়েটা।

সে থামতেই মেয়েটা সরাসরি ওর চোখের দিকে তাকালো, উন্মুখ হয়ে কিছু বলতে চেয়েও থেমে গেলো, ওর ব্যাকুল দৃষ্টি অন্তর দিয়ে অনুভব করলো জয়। সেই সাথে একটা কথা ভেবে অবাক হলো, কি এমন আছে মেয়েটার মাঝে, যা ওর ভেতর থেকে নিংড়ে নিচ্ছে সমস্ত দুঃখ , কষ্ট, গ্লানি আর স্বপ্ন। কি এমন সম্মোহনী শক্তি যা ওর ভেতরের সবকিছু বের করে নিয়ে একেবারে অন্তঃসারশূন্য করে দিচ্ছে ওকে? ‘আর’, আবার শুরু করলো ও, ‘ভালোবাসা বিলানোর জিনিস, লুকিয়ে রাখার নয়। জীবনের সাথে যুঝতে যুঝতে আমি এখন পোড় খাওয়া মানুষ। এতোটাই পোড় খাওয়া যে, স্বপ্ন দেখতেও ভয় পাই এখন।

আমি জানি, জলাশয়ে ভেসে থাকা কচুরিপানার ফুলকেই কেবল হাত বাড়িয়ে নিতে পারি আমি, দামি ফ্লাওয়ার ভাসে শোভা বর্ধনকারী,ডেফোডিল কিংবা রজনীগন্ধা আমার জন্য নয়। ‘তবে’, বলেই চলেছে জয়, ‘আপনাকে দেখে আমার দামী ডেফোডিল কিংবা মূল্যহীন কচুরিপানা কোনটাই মনে হয়নি। মনে হয়েছে, আপনি বিষাদে ঝরে পড়া গোলাপ, আন্তরিক পরিচর্যা যাকে আবার সুন্দর করে তুলতে পারে। ’ এ পর্যন্ত এসে আবার থামল জয়, মনে মনে কি যেন ভাবল, তারপর আবার শুরু করল-‘যদি আমি সেই দায়িত্বটা নিতে চাই, যদি আপনার দুঃখের ভার নিজের কাঁধে তুলে নিতে চাই, তাহলে আপনি কি আমাকে অনুমতি দেবেন?’ এতক্ষণ জয়ের কথা শুনতে শুনতে বিভোর হয়ে গিয়েছিলো মেয়েটা, চোখ ছলছল করছিলো জলে, এবার বাঁধভাঙা কান্নায় ভেঙে পড়লো। কিছুক্ষণ আপন মনে কাঁদলো, জয় বাঁধা দিলোনা।

কাঁদুক, তাতে অন্তত কিছুটা হলেও হালকা হবে কষ্টের বোঝা। খানিকপর থামলো মেয়েটা, কাঁপা কাঁপা হাতটা রাখলো জয়ের হাতের উপর, তারপর হঠাৎ করেই আবার হাত সরিয়ে নিলো। কিছু বলার জন্য মুখ খুলতে যাবে, তাকে থামিয়ে দিলো জয়, বলল-‘আপনি হয়তো ভাবছেন, এ কয়েক ঘন্টার পরিচয়ে কাউকে ভালোবাসার কথা বলা, দুঃসাহসের পর্যায়ে পরে। আমাকে ভুল বুঝবেন না, আপনার দুর্বলতার সুযোগ নেওয়ার কোন ইচ্ছে আমার নেই। ’ মেয়েটা সজোরে মাথা নাড়লো, বোঝাতে চাইল ও আসলে মোটেও সেরকম কিছু বলতে চায়নি।

‘যদি ভেবে থাকেন, যে নিজেই কষ্টের মাঝে ডুবে আছে আকন্ঠ, সে কি করে আরেকজনের দুঃখের ভাগ নিবে। ভাববেন না, আপনার কষ্টের বোঝা হালকা করার জন্য মনে মনে প্রস্তুত আমি। আর আমার উপর যদি আস্থা রাখতে না পারেন, তাহলে সমস্যা নেই, আপনার যেখানে খুশি যেতে পারেন, আমি বাধা দেবোনা। ’ কয়েক মুহুর্ত চুপ করে রইলো মেয়েটা, তারপর মাথা নোয়ালো, নিচের দিকে তাকিয়ে বললো-‘আমি কোথাও যাচ্ছিনা। ’ হাসল জয়, পাওয়ার আনন্দে উদ্বেলিত সারা দেহ-মন।

খানিকপর ও বললো-‘একটা মজার ব্যাপার কি জানেন? প্রায় সারাটা দিন আমরা একসাথে কাটালাম, অথচ এখনো আমরা একে অপরের কাছে অপরিচিতই রয়ে গেলাম। এনিওয়ে, আমি জয়। ’ ‘আমি জেবা। ’ চলবে.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।