আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

প্রসঙ্গ কার্টুনিস্ট আরিফঃ নিজ বলয়ের বাইরে অন্য পেশার মানুষের বিষয়েও সরব হোন।

তোমার অস্তিত্বে সন্দিহান, তবু্ও সদাই তোমায় খুঁজি

কাটুনিস্ট আরিফকে মুক্তি দেয়া হয়েছে, নির্বাচন কমিশনের অধীনে সে একটা চাকরীও করছে। আমাদের জাতীয় জীবনের নানা হতাশার মাঝে এ সংবাদটি অবশ্যই আনন্দের। যে কারণে তাকে গ্রেফতার করা হয়েছিলো এবং জেল খাটতে হয়েছিলো তা রাষ্ট্রীয় জীবনে 'মুক্তচিন্তা' প্রতিষ্ঠার বিষয়টি বিবেচনা করলে নিঃসেন্দেহে দুর্ভাগ্যজনক। শুনতে পেয়েছিলাম বাংলাদেশ ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য যারা প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করে তাদের এক সহযোগী সংগঠনের একটি সাহিত্য সাময়িকীতে অনুরূপ একটি কার্টুন ছাপা হয়েছিলো। অবশ্য বিষয়টি নিয়ে তখন তেমনটা উচ্চবাচ্য হয়নি।

উচ্চবাচ্য হয়নি কারণ সর্বস্তরে যারা ধর্মকে যারা প্রতিষ্ঠিত করতে চান এটা ছিলো তাদেরই কর্ম এবং তাদের কোন কর্মকান্ডের মাধ্যমে ইসলাম অবমাননা হয়েছে বা হচ্ছে তা বলা যাবেনা। যাহোক, এগুলো পুরনো কথা। বর্তমানের সুখের অথবা সন্তুষ্টির কথা হচ্ছে আরিফ মুক্ত হয়েছে এবং পুনরায় স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার চেষ্টা করছে। এটা সম্ভব হয়েছে দেশের সাধারণ মানুষের সহানুভুতির পাশাপাশি আরিফ যে পেশার সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলেন সে পেশার অর্থাৎ সংবাদপত্রের সাথে জড়িত ব্যক্তিবর্গের স্বতঃস্ফুর্ত সরব ও নীরব সমর্থন, সহযোগিতা, তদবীর ও তাগিদের মাধ্যমে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে সংবাদপত্র এবং এর সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের এ স্বতঃস্ফুর্ততা নিজ বলয়ের বাইরে সর্বক্ষেত্রেই সমান নয়।

জরুরী অবস্থা জারীর পর আমাদের পুলিশ শান্তি শৃংখলা বজায় রাখতে অতিমাত্রায় তৎপর হয়ে পড়েছে। তারা আগে জাল দিয়ে মাছ ধরতো। এখন পুরো জলাশয় সেচে। বিষয়টি পরিস্কার করে বললে বলা যায় আগে একই মামলার আসামী করা হতো দুই, চার, দশ কিংবা বিশজনের বিরুদ্ধে। এখন একই মামলার আসামী করা সহস্রাধিক লোককে।

শেখ হাসিনার দেশে প্রত্যাবর্তন উপলক্ষ্যে বিমান বন্দরে উপস্থিত হওয়া নামহীন কয়েক হাজার ব্যক্তির বিরুদ্ধে জরুরী আইনে মামলা করা হয়েছে। সদরঘাটে ফেরি স্থানান্তরকে কেন্দ্র করে ঘটনায় অর্ধ লক্ষ নাম না জানা লোককে আসামী করে মামলা করা হয়েছে। এমনি বেশ কয়েকদিন আগে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনকাংখিত ঘটনায় কয়েক হাজার সাধারণ মানুষ ও ছাত্রকে আসামী করে মামলা করা হয়েছে। আমার আশংকা গড়পরতা যতো ছাত্রের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে অতো ছাত্র হয়তো খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে নেইও। শুধু মামলা করা নয়, গ্রেফতারের বিষয়েও আমাদের পুলিশের দক্ষতা আগের চেয়ে অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে।

গতকালকেই অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের এক রিপোর্টে বলা হয়েছে গেল এক বছরে পুলিশ চার লক্ষাধিক লোককে গ্রেফতার করেছে। আমি নিশ্চিত এদের সবাই অপরাধী নয় এবং এই চার লক্ষ লোকের মধ্যে অন্তত চার হাজার আরিফ আছে। শুধু গ্রেফতারই নয়, থানা হাজতে নির্যাতন, হত্যা, ক্রসফায়ারেও আমাদের পুলিশ মহোদয়রা আগের চেয়ে অনেক এগিয়ে গেছে। এই গেল পরশুদিনও খোদ রাজধানীর এক থানাতে পুলিশ নির্যাতন করে দু'জন বন্দীকে মেরে ফেলেছে। অথচ আমাদের সংবাদপত্রগুলো এই সমস্ত নাম না জানা আরিফদের বিষয়ে একবারেই নীরব।

তাদের কোন উচ্চবাচ্যতো নেইই বরং বলা যেতে পারে দেখেও না দেখার ভান করতেছে। নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগকে পৃথক করার দাবিটি দীর্ঘদিনের। দেশের সংবাদপত্র, আইনজীবি সমাজ এ বিষয়ে রাজনৈতিক সরকারগুলোকে বরাবরই তাগিদ দিয়ে আসছিলো। কিন্তু রাজনৈতিক সরকারগুলোর আগ্রহের অভাবে বা সত্যি বলতে আমলাদের অসহযোগীতার কারণে সে সময়ে এই পৃথকীকরণ সম্পন্ন হয়নি। বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করে এই মহান কর্মটি সম্পন্ন করে এবং এই কারণে সরকারের উপদেষ্টাদের কেউ কেউ প্রায়শই কৃতিত্ব নেয়ার প্রচেষ্টা চালান।

কিন্তু বিচার বিভাগ কেমন স্বাধীন হয়েছে তা এর সাথে সংশ্লিষ্টরা এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন। দিন দু'য়েক আগে টিভিতে এক সাক্ষাৎকারে দেশের বিশিষ্ট আইনজীবি ব্যরিস্টার আমিরুল ইসলাম বলেছেন, বর্তমান প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগের আরো অধীনস্থ করা হয়েছে। সবচেয়ে আশংকার কথা হচ্ছে সরকার কর্তৃক স্বাধীনকৃত এই বিচার বিভাগের কর্তাব্যক্তিরা সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতাস্বরূপ সম্ভবত সরকারের ইচ্ছার প্রতি সন্মান দেখিয়েই জরুরী আইনের আওতাধীন মামলায় জামিন চাওয়ার অধিকারটি হরণ করেছে। অথচ জামিন চাওয়া একজন নাগরিকের সাংবিধানীক অধিকার। তাছাড়া কারো বিরুদ্ধে মামলা করা হলেই তিনি অপরাধী হয়ে যাননা।

সুপ্রিম কোর্টের এই আদেশের মাধ্যমে প্রকৃত অর্থে সংবিধানকেই অস্বীকার করা হয়েছে। সর্বশেষে, সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি পদে পূর্বের রাজনৈতিক সরকারগুলোর রীতি অনুসরণ করেই একজন সিনিয়রকে ডিঙ্গিয়ে একজন জুনিয়রকে প্রধান বিচারপতি করা হয়েছে। অথচ এ জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়টিতে আমাদের সংবাদপত্রগুলোতে কোন প্রতিবাদ, বিক্ষোভ নেই। কোন পর্যালোচনা বা বিশ্লেষণধর্মী বক্তব্য নেই। বর্তমান সরকারের যে কাজটি সর্বমহলে প্রশংসিত বা সমর্থিত হয়েছিলো তা হচ্ছে দূর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান।

কিন্তু সময় গড়ানোর সাথে বুঝা গেলো সরকারের এ অভিযান একটি বিশেষ শ্রেণীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ এবং একটি বিশেষ শ্রেণীকে ইচ্ছাকৃতভাবে রেহাই বা অব্যাহতি দেয়া হচ্ছে। বাংলাদেশের মতো একটি অনুন্নত দেশে যেখানে সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠানগুলোর অবকাঠামোর উন্নয়ন সবচেয়ে বেশি জরুরী সেখানে আশ্চর্য্য হলেও সত্যি যে প্রতিরক্ষা খাতেই সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে। এ বরাদ্দ কীভাবে ব্যয় হচ্ছে তা জানার কোন ক্ষমতা সাধারণ জনগণের নেই। এ বিষয়ে দূর্নীতি দমন কমিশনের মাননীয় চেয়ারম্যান একবার বলেছিলেন, সেনাবাহিনীতেও কোন প্রকার দূর্নীতি সংঘঠিত হয়ে থাকলে তার প্রতিষ্ঠান তার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিবে। কিন্তু বলা পর্যন্তই শেষ।

আজ পর্যন্ত এ বিষয়ে দূনীতি দমন কমিশনের কোন অনুসন্ধানের তথ্য আমরা জানতে পারিনি। তাছাড়া এ সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের পর স্বচ্ছতা আনয়নের নামে বেসামরিক প্রশাসনের সর্বত্র সেনা কর্মকর্তাদের প্রেষণে নিয়োগ দিতে শুরু করে। এদের জন্য বেসিকের ২০% অতিরিক্ত প্রেষণ ভাতা প্রদানেরও সিস্টেম চালু হয়। কিন্তু ইতিপূর্বে বেসামরিক প্রশাসনে প্রেষণে কর্মরত সেনা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধেই বিভাগীয় পর্যায়ে অভিযোগের অন্ত নেই। কিন্তু আমাদের সংবাদপত্রগুলোতে এ সংক্রান্ত কোন অনুসন্ধানী প্রতিবেদন নেই।

তারা ব্যস্ত মহামান্য সেনাপ্রধান কবে, কখন, কোথায় ধানতে কাটতে যাচ্ছেন। কোন পাঁচতারা হোটেলে পটেটো ফেস্টিবল উদ্বোধন করতে যাচ্ছেন তা নিয়ে। প্রকৃতপক্ষে আরিফের ভোগান্তির ঘটনাটি আমাদের সমাজের বিচ্ছিন্ন কোন ঘটনা নয়। তবে বর্তমান অবস্থা বিবেচনা করলে এবং অন্যদের সাথে তুলনা করলে তার মুক্তির বিষয়টি অবশ্যই একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা। সামগ্রিক পরিস্থিতিতে তাকে ভাগ্যবানও বলা যেতে পারে।

তার ভাষ্যমতেই বন্দী অবস্থায় পুলিশ তার উপর কোন নির্যাতন চালায়নি। জেলখানায় ড. আনোয়ার হোসেন কিংবা আরাফাত রহমান কোকোর মতো ব্যক্তিত্বদের সান্নিধ্যে সে ছিলো। ব্যারিস্টার সারা হোসেনের মতো বিখ্যাত আইনজীবি তাকে আইনী সহায়তা দিয়েছে, সাহস যুগিয়েছেন। মুক্তি পেয়ে সে নির্বাচন কমিশনে একটি কাজ পেয়েছে। স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার চেষ্টা করছে এবং আমি নিশ্চিত জীবনে সে অনেক বড়ো হবে।

কিন্তু সব আরিফরা এমন ভাগ্যবান নয়। জেলখানার অন্ধকার প্রকোষ্ঠে মারা গেলেও তাদের সংবাদ পত্রিকায় আসেনা। পত্রিকাওয়ালাদের সেই আরিফদের নিয়ে কোন মাথাব্যাথা নেই। এমনকি পুলিশের নির্যাতনে তাদের মৃত্যু ঘটলেও পত্রিকাগুলোতে তা হেডলাইন হয়না। পরিবারের সদস্যদের বাইরে তাদের জন্য কেউ হাহাকার করেনা।

আমার এই পোস্টের বক্তব্যের কারণে আরিফের মুক্তির বিষয়ে আমি অসন্তুষ্ট তা ভাবার কোন অবকাশ নেই। এ বিষয়ে আমার প্রতিক্রিয়া আমি সংশ্লিষ্ট পোস্টে প্রকাশ করেছি। আমার এ পোস্টের মাধ্যমে সংবাদপত্রের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের কাছে আমার অনুরোধ শুধু একটাই, দেশের সার্বিক পরিস্থিতিতে আপনাদের বলয়ের বাইরের পেশাজীবিদের নিয়েও ভাবুন, তাদের নিয়ে লিখুন। সর্বোপরি দেশের সার্বিক সত্য পরিস্থিতি তুলে ধরুন। জাতির তথা রাষ্ট্রের দর্পন হিসেবে আপনাদের কাছে এটা সময়ের দাবী এবং যথার্থভাবেই যৌক্তিক।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।