আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

চারিদিকে শুধু ভাঙ্গনের শব্দ শুনি..../ইমন।

জ্বলে উঠার অপেক্ষায় নিভু নিভু প্রদীপ।

দেখতে দেখতে আমার লন্ডনে আসার বয়স হল সাড়ে পাঁচ। বিগত পাঁচটি বছরে পেয়েছি কিছু আবার হারিয়ে ফেলেছি অনেক কিছুই। সেটার হিসেবে আপাতত যেতে চাচ্ছিনা। শুধুমাত্র একটি ভুলের কারণে, ছোট্ট একটি ভুলের কারণে আমাকে এখনো এই লন্ডনে বসে বিনিদ্র রাত কাটাতে হচ্ছে।

যদি সেই ভুলটি না হত তবে পড়ালেখার পাঠ চুকিয়ে কবেই দেশে চলে যেতাম। সেটা আর হলো না। তাই এখনো স্বপ্নের এই শহরে আমি স্বপ্নহীন হয়ে পড়ে আছি। তারপরও আশাহত হওয়ার মানুষ আমি নই। কিছুক্ষণ আগে আমার পিচ্চি বোনটার সাথে কথা বললাম।

সে এবার এস.এস.সি দিচ্ছে। বাংলা দ্বিতীয় পত্রের পরীক্ষায় একটু খারাপ হওয়ায় কান্নাকাটি করছিল। অনেক স্বান্তনা দিলাম। মনে পড়ে, ২০০৫ এর জুনে আমি যখন 'আমেরিকান এক্সপ্রেস ব্যাংকে' ইন্টার্নশীপ করতে দেশে গিয়েছিলাম তখন তাকে প্রতিশ্রুতি করেছিলাম ওর পরীক্ষার সময়ে আমি দেশে থাকব। আরো বলেছিলাম সে 'গোল্ডেন এ' পেলে আমি তাকে 'ঢাকা টু লন্ডনে'র একটা ট্যুরের টিকেট উপহার দিব।

আমার দেশে যাওয়া হয় নি। ওর পরীক্ষার আগে এখানে একটা পোষ্ট দেয়ার ইচ্ছে ছিল ( মূলত দোয়া চাইতে)। স্বার্থপর আমি সময়ের অভাবে সেটাও করতে পারি নি। একটিমাত্র বোন আমার। সবার ছোট।

পিচ্চিটার মেডিক্যালে পড়ার স্বপ্ন। তাই সে চট্টগ্রাম কলেজে ভর্তি হবে। কিন্তু সেখানে নাকি 'গোল্ডেন এ' না পেলে ভর্তি পরীক্ষাও দেয়া যাবে না (কতটুকু সত্য জানি না)। সেটা শুনে মনটা অনেক খারাপ হয়ে গেল। সে সবটাতেই এ প্লাস পাবে এমনটাই আশা করছে স্কুলের শিক্ষকরা।

আমার বোনকে নিয়ে আমি অনেক স্বপ্ন দেখি। ভবিষ্যতে আমি যদি কিছু হতে নাও পারি তাতে আমার কোন দুঃখ থাকবে না কিন্তু পিচ্চিটার কোন স্বপ্নভঙ্গ হোক সেটা আমি কল্পনাও করতে পারি না। আমি স্বার্থপর, কুলাঙ্গার ভাই হতে পারি, কিন্তু আমার বোনটা অনেক অনেক ভাল। এই বয়সেই সে আমার জন্য যে কত চিন্তা করে তার কোন হিসেব নেই। বাসায় ফোন করলে দৌড়ে এসে সবার প্রথমে সে ই কথা বলে।

বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পরে গতবছর আমার বাবা ব্যবসায় ত্রিশ লাখ টাকার মত লস দিয়েছেন। সারাজীবন যে বাবাকে অনেক সাহসী হিসেবে জানতাম সে বাবা এখন অনেক ভেঙ্গে পড়েছেন। আপনারা হয়ত ভাবছেন আমার বাবা রাজনীতি করতেন? না, বাবা রাজনীতি করেন না এমনকি ভোটটি পর্যন্ত দিতে যান না। আসলে রাজনীতি করার সময়ই তো বাবার ছিলই না। তার যখন দুবছর বয়স তখন আমার দাদা মারা গিয়েছেন।

দাদীর ভিটেমাটি ছাড়া তেমন কিছুই ছিল না। তাই ছয়বছর বয়স থেকে বাবাকে কাজ করতে হয়েছিল মানুষের দোকানে দোকানে। পড়ালেখা খুব বেশী করতে পারেন নি। অনেকটা কাজী নজরুল ইসলামের মত দোকানে কাজ করে অল্প পড়ালেখা করতে পেরেছিলেন। তারপর নিজে মুদির দোকান দিয়েছেন।

পরে আস্তে আস্তে ব্যবসা বিস্তৃত করলেন। সারাটি জীবন অর্থের পেছনে ছুটেছেন শুধু। সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত ব্যস্ততা। যার কারণে বাবা আমাদের খুব একটা সময় দিতে পারেন নি। তাতে কি? বাসায় তো আমাদের কখনো অভাব অনটন দেখতে হয়নি।

এই এখন বাংলাদেশে যে দূর্ভিক্ষ চলছে তাতেও আমাদের বাসায় কোন অভাব নেই। বাবার সাথে আমি খুব বেশী কথা বলতাম না। কিন্তু, কেন জানি এখন তার সাথে অনেক কথা বলতে ইচ্ছে করে। তার সুদূরপ্রসারী ভবিষ্যত পরিকল্পনা করতে পারার ক্ষমতা আমাকে সবসময় মুগ্ধ করে। ইদানীং আমি ফোনে কথা বললে আমাকে শুধু বলেন দেশের অবস্থা খুব একটা ভালো না।

তারপরও হা-পিত্যেস করেন না। হতে পারে আমি টেনশন করব বলে আমাকে বেশী কিছু বলেন না। দেশের খবর নিতে এখন ইচ্ছে করে না। শুধু কান্না পায়। আমি খুবই দুর্বল মনের মানুষ।

পত্রিকাতে যখন মানুষের হাহাকারের জীবনকথন পড়ি আমি চোখ না মুছে পারি না। যখন ছবিতে দেখি নিম্ম মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষগুলো হাত পাতছে কোন মার্সিডিজ কিংবা কালো গ্লাসের বি.এম.ডব্লিউ'তে তখন হু হু করে কেঁদে উঠে আমার ভেতরটা। তাই এখন আর পত্রিকা পড়ি না। দেশের বন্ধুদের যখন বলি 'আমার এখানে ভালো লাগে না, আমি দেশে চলে যাব, দেশেই সেটলড হব'। তারা হাসিতে উড়িয়ে দেয়।

অনেকে মনে করে আমি ঠাট্টা করছি। এইতো সেদিন বন্ধু টিটোর সাথে কথা হচ্ছিল। কম করে হলেও দশবার বলেছে 'দোস্ত, দেশে আসিস না, এখানের অবস্থা খুবই খারাপ'। গতকাল সিহাব চৌধুরীর সাথে কথা বলছিলাম, সেও একই কথা বলে। তাহলে কি আমরা সুদানের (যে দেশটিকে সবচে গরীব হিসেবে এতদিন জেনেছি) থেকেও গরীব হয়ে গেছি? চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষের কথা বাবার কাছে শুনেছি কিন্তু দেখতে হয় নি।

এখন কি আমরা নিজেদের চোখে আরেকটা দুর্ভিক্ষ দেখব? কে জানে কোন একদিন হয়ত আমার ছেলেমেয়েদের বলতে হতে পারে 'বাছারা আমাদের দেশে দুবার দুর্ভিক্ষ হয়েছিল, একবারের কথা আমরা শুনেছি আরেকবার স্বচক্ষে দেখেছি'। আমার কিছুই ভালো লাগে না। চারিদিকে শুধু ভাঙ্গনের খেলা দেখছি। এখানের বন্ধুদের বলতে গেলে তারা বলে দেশকে নিয়ে এত চিন্তা করে কি করব? কিন্তু আমি যে সারাদিনের ক্লান্তি নিয়েও ঘুমুতে পারি না। কেউ কি আমাকে একটু স্বস্তি এনে দিতে পারে? অন্তত একটা ভাল খবর যেটা শুনে আমি ঘুমুতে যাব।

অন্তত একটি সকালে বাংলাদেশর সীমানায় সূর্য্য উঠবে, অন্তত একটি দিন বাংলাদেশের সাফল্যের কথায় আমার চোখে আনন্দের অশ্র ঝরাবে।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।