আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

স্মৃতির পাতা থেকে: হারানোর বেদনা

একজন আমি, একজন হারিয়ে যাওয়া এবং একজন দূর প্রবাসী

প্রায় ৬ মাস আগে আমার ভাইয়েরা সেই অজানা দুনিয়ায় পাড়ি দিয়েছে। প্রত্যেকদিনই আমি চিন্তা করতাম সেই দিন এর কথা লিখতে, কিন্তু আমার দ্বারা তা সম্ভব হয়নি। সেই দিন থেকে আমার প্রধান লক্ষ্য ছিল আমি যদি বাঁচতে চাই তাহলে সেই ১৪ই সেপ্টেম্বর এর কথা মনে করা যাবে না, যদিও আমার চারপাশের শুভাকাংখীরা আমাকে সেই দিনের কথা লিখতে বলতো। আজ আমি তাদের জন্য , আমার মা-বাবার জন্য এবং সর্বোপরী আমার দুই ভাইয়ের জন্য সেই ঘটনা লিখতে বসেছি। বুধবার ১৩ই সেপ্টেম্বর, ২০০৬ রাতের বেলা আমাদেরকে কক্সবাজারের জন্য রওয়ানা হওয়ার কথা ছিল।

আমি এবং আমার বাবা আমার কাজিন নাহিদ যে কিনা আমাদের সাথে যাবে, তাকে নিয়ে সন্ধ্যাবেলা বাসায় পৌছালাম। আমার মনে আছে, ঐদিন আমার লাস্ট এনএসইউ এডভাইসিং ছিল। বাসায় পৌছানোর পর আমি আমার জামাকাপড় জলদি ঘোছাতে লাগলাম। আমাদের বাস রাত ১০টার সময় ছাড়ার কথা। কিন্তু ৯টা বেঁজে গেলেও ছোট মামা এসে পৌছায়নি।

আমার এবং সাদ-এর খুবই বিরক্ত লাগছিল। অবশেষে মামা এবং আমার মা-এর বান্ধবী এবং তার ছেলে এসে পৌছালে আমরা রওয়ানা দেই বাস স্ট্যান্ডের দিকে। আমরা প্রায় ৮ জন ছিলাম। বাবা বাস কাউন্টার পর্যন্ত আমাদের সাথে আসেন। তিনি আমাদের সাথে কক্সবাজার যাচ্ছিলেন না।

বাবার তার দুই ছেলের সাথে এই শেষ দেখা ছিল। ১৪ই সেপ্টেম্বর আমরা সকাল ৭টার দিকে কক্সবাজারে এসে পৌছাই। আমাদের রেস্ট হাউজ মানুষ দিয়ে ভর্তি ছিল। তাই আমাদের কে প্রথমবারের মত হোটেলে থাকতে হয়। সাদ এবং ছোট মামা রিটার্ন টিকেট কাঁটতে চলে যান ।

এরপর যখন সাদ ফেরত আসে তখন সে ও আফিফ বিচে যাওয়ার জন্য লাফাতে থাকে। সাদ আসলে কক্সবাজারে আসার জন্য উদগ্রীব ছিল এবং পুরো প্ল্যানটাই তার করা। কিন্তু আমি তখন সৈকতে যেতে চাচ্ছিলাম না কারন বাসে আসার সময় ঠিকমত ঘুম না হওয়ায় আমরা সবাই ক্লান্ত ছিলাম। তাই আমি তাদেরকে দেরী করানোর সর্বাত্মক চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু ১০.৩০ এর দিকে আমি রাজি হয়ে যাই এবং তাদের সাথে সৈকতের দিকে চলে যাই।

ঐদিন খুব উজ্জ্বল ছিল। আমি, নাহিদ সাদ আর আফিফ পানিতে নামি আর আমার মা,তার বান্ধবী এবং ছোট মামা সৈকতে বসে আমাদেরকে লক্ষ্য করছিল। এটা আমার কাজিন নাহিদ এর প্রথম কক্সবাজার-এ আসা। আমরা চারজন মিলে হৈহুল্লোড় করছিলাম। আমার ভাই সাদ যখন আমার সাথে থাকে তখন আমি অনেক হাল্কা অনুভব করি।

এরপর আমরা আর এক দিকে চলে যাই যেখানে পানি অনেক শান্ত ছিল কিন্তু অস্বাভাবিক হল দুই দিকে থেকেই ঢেউ আসছিল। এরপর ১১.৩০ এর দিকে আমি আম্মুর কাছে চলে আসি। সাদ আমাকে আরো কিছুক্ষন থাকতে বলছিল কিন্তু আমার ত্বক পুড়ে যাওয়ার ভয়ে চলে আসি। এসময় রাজিব(মার বান্ধবীর ছেলে) যায় ওদের ওখানে এবং ওদের ছবি তুলে( ওকে ধন্যবাদ আমার দুই ভাইয়ের শেষ দুটি ছবি তুলার জন্য। ) ।

এরপর আমি যখন আম্মুর কাছে যাই আম্মু তখন বলতে থাকে ওরা এতো দূরে গেছে কেন,যদিও আমি কিছুই দেখতে পারছিলাম না। এরপর আম্মু আর রোজি খালা ওদের দিকে দৌড়াতে শুরু করেন আর আমি থেকে যাই ব্যাগ দেখে রাখতে। আমি একটুও চিন্তিত ছিলাম না এবং কোনো খারাপ চিন্তাই আমাকে স্পর্শ করে নি। আমরা এর আগেও কক্সবাজারে এসেছি এবং এটাই তো স্বাভাবিক যে তারা পানিতে খেলাধুলো করছে। আমার বিন্দুমাত্র জ্ঞান ছিল না যে ওখানে কি হচ্ছে।

দূর থেকে কিছু লোকের ভীর দেখতে পারছিলাম। আমি আবার ও বোকার মত কাজ করি। নাহিদ এরমধ্যে কয়েকবার আমার কাছে এসে বলে যে প্রার্থনা করতে কারন সাদ আর আফিফ কে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তখনও আমি অবস্থা বুঝতে পারিনি। আমি ওখানে বসেই মা এবং মামার জন্য বসে থাকি।

কিছুক্ষন পর রাজিব এসে মোবাইল চায় আমার বাবা কে ফোন করার জন্য এবং আমাকে আম্মুর কাছে যেতে বলে। আমি খুবই অবাক হই যে কেন আমাকে আম্মুর কাছে যেতে হবে এবং আম্মু এমন করছে কেন? নিশ্চয় ভাইয়ারা কোথাও আছে এবং তারা ফিরে আসবে। আমি তখন কি করব না করব তাই চিন্তা করছিলাম। কিছুক্ষনের মধ্যেই আমাদের রেস্ট হাউজ থেকে লোক আসে। এরপর স্থানীয় লোক আর সাংবাদিকদের ভীরে এলাকা ভরে যায়।

সবাই কেমন জানি অদ্ভুত প্রশ্ন করছিল। এইসময় আমার ওদেরকে চড় মারতে ইচ্ছা করছিল। ওরা কেন এতো খারাপ চিন্তা করছে? আমার ভাইদের তো কিছুই হয়নি । আমার আম্মুকে এরমধ্যে রেস্ট হাউজে নিয়ে যাওয়া হয়েছে এবং আমাকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিলো। আমার ব্রেইন আমাকে আর কিছু চিন্তা করতে দেয়নি।

আমি শুধু সামনের সমুদ্রের দিকে চেয়ে ছিলাম এবং আমার ভাইয়েরা কোথায় থাকতে পারে তাই চিন্তা করছিলাম। “তারা কি করছে এই বিশাল অন্ধকার সমুদ্রে?” আম্মু এবং সবাই সুরা ইয়াসিন পড়ছে এবং আমাকেও পড়তে বলছে। আমি চেষ্টা করেছি কিন্তু মনোযোগ দিতে পারছিলাম না। সবাই আমাদের কে স্বান্তনা দিচ্ছিল যে সর্বাত্নক চেষ্টা করা হচ্ছে। বন বিভাগ, সেনা বিভাগ আর পর্যটনের সবাই খুঁজতে ব্যস্ত ছিল।

আমি যখনই চোখ খুলতাম বিশাল সমুদ্রটাকে আমার চোখের সামনে দেখতে পেতাম। আর আমার ভাইয়ারা যেখান থেকে হারিয়েছে ওখানে তখন একটা লাল নিশান উড়ছে,। এভাবেই রাত পার হয়ে যায়। ১৫ সেপ্টেম্বর ফজরের নামাজ পড়ে মামা আবার সৈকতে যায় তাদের খুজতে। ঢাকা থেকে জুলফিকার ভাই এবং তানভীর ভাই এসেছেন।

বাবু ভাই এসেছেন চটগ্রাম থেকে। তারা বলল খালারা এবং মামারা কক্সবাজারের পথে আছে। হঠাৎ সেখানে একটি পুলিশ ভ্যান হাজির হয়। ইন্সপেক্টর মামার সাথে কিছু নিয়ে আলোচনা করছিলেন। আমি শুনার চেষ্টা করি।

কিন্তু তারা আমাকে দেখে ফেললে দূরে চলে যায়। এই সময় সব খারাপ চিন্তা আমার মাথায় ভীড় করতে থাকে। দুপুরের মধ্যে খালা এবং মামারা এসে পৌছায়। তারা আমাকে এবং আম্মুকে যত দ্রুত সম্ভব কক্সবাজার থেকে চলে যেতে বলে কারণ বাবার শরীর ভালো ছিলো না আর বাকী লোকের ভাইয়াদের নিয়ে আসবে বলেন। আমি বর্ননা করতে পারবো না কেমন লাগছিলো যখন আমরা কক্সবাজার ফেলে চলে যাচ্ছি।

মনে হচ্ছিল ভাইয়াদের চিরতরে রেখে যাচ্ছি বিশাল সমুদ্রের বুকে। বাবা মার জন্যই আমি এটা করি এবং এটাই ছিল আমরা সবচেয়ে অসহায় যাত্রা। আমরা এয়ারপোর্ট থেকে বেইলি রোডের বাসায় রাত ১১টার দিকে পৌছাই। আমি কখনোই আমাদের বাসার ভেতরে বা সামনে এতো লোকের ভীড় দেখেনি। গাড়ি থেকে নামার সময় আমি শুনতে পাচ্ছিলাম যে কেউ কেউ বলছে আমাকে ভালো করে ধরতে, কারন আমি নাকি পুরো রাস্তাটা হেটে যেতে পারবো না।

কি আজব কথা? এই সময় আমার কাজিনরা এসে আমাকে আমার ঘরে নিয়ে যায়। বাসায় ঢুকেই আমি বাবার খোঁজ করছিলাম। সবাই বলল যে, বাবা ধারে কাছেই আছে এবং পরে আসবে। আমি তখন মাটিতে বসেছিলাম এবং আমার কাজিনরা আমাকে ঘিরে ছিল। তারা বারবার কি হয়েছিল তা জিজ্ঞেস করছিল।

আমি চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু কথা বলতে পারিনি। সময় অতিবাহিত হয়ে যাচ্ছিল আর আমি অপেক্ষা করছিলাম কখন ভাইয়াদের নিয়ে আসা হবে। আমি পরে জানতে পেরেছিলাম যে, সবাই আমার অবস্থা দেখে ভয় পেয়েছিল। কারন আমি কথাও বলছিলাম না আবার কাঁদছিলামও না। এই সময়, শিহাব ভাই এসে জোর করে আমাকে কয়েকটা অষুধ খাইয়ে দিল এবং কিছুক্ষন পর আমি নিজেকে ঘুমানো থেকে বিরত রাখতে পারি নি।

১৬ই সেপ্টেম্বর সকালে আমার ঘুম ভেংগে যায় বিভিন্ন ফোনের আওয়াজে। আমি বুঝতে পারলাম সারারাত কেউ ঘুমাই নি। বড় খালা ফোনে কাকে জানি বলছিলেন,”না আমি নাজনু(আম্মু)কে বলতে পারবো না কি হয়েছে। “ এরপর সাকিব ভাই বারডেমে কফিন নিয়ে কি যেন বলছিলেন। আবার আমাকে দেখে তারা চুপ হয়ে যায়।

আল্লাহ! আমি বুঝাতে পারবো না আমি তখন কেমন অনুভব করছিলাম। আমার মন বুঝতে পেরেছিল কি হয়েছে কিন্তু আমি তা মানতে পারছিলাম না। এরপর আমাকে যা বলা হয়েছে ভালো মেয়ের মত সব কিছুই করেছি। মুখ হাত ধুঁইয়ে, জামা বদলে আম্মুর ঘরে গেলাম। আমাকে বলা হয়েছিল বাবা মার সামনে কাঁদতে না।

আমি তাও করলাম। আমার চারপাশের লোক তখন তাদের সর্ব শক্তি প্রয়োগ করছিল যাতে আমি কাঁদি। এরপর সেই মুহুর্ত এলো। আমাকে বলা হল বাইরে গিয়ে ভাইয়াদের শেষ বারের মত দেখতে............আমার সাহস হয়নি তাদের দেখতে...আমি তাদের ভিন্ন ভাবে দেখেছি সবসময়...আমি কেমনে তাদের ওভাবে ঘুমাতে দেখব? আমি জানি এর পরে যখনই আমি ওদের দেখব ওরা আমার সামনে সেই আগের মতই থাকবে। আমার পুরো মনে আছে আমি কেমনে আমার ঘরের কোনায় বসেছিলাম এবং আমার বন্ধু আর কাজিনরা আমাকে ঘিরে ছিল।

ওখান থেকে আমি দেখতে পারছিলাম আমার ঘরের সামনে শেড এর নিচে শত শত লোক আর তাদের মাঝে দুটি কফিন । আমার বাবা মা সব কিছুই দেখছিল। আমি জানি তারা আল্লাহর দুটি বিশেষ সৃষ্টি। অবশেষে , তারা আমার দুই ভাইয়া কে নিয়ে চলে গেল। সকল ঘটনা- আমার দুই ভাইয়ের আকস্মিক অন্তর্ধানের কারন তখন পরিষ্কার হয়েছে।

আমি তাদের যেখানে রেখে এসেছিলাম তার নিচে এক বিশাল সুরঙ্গ ছিল। যা হয়েছিল তা হল, হঠাৎ করে তাদের নিচের বালি সরে যায় এবং ভাইয়ারা ভারসাম্য রক্ষা করতে না পেরে নিচে পড়ে যায়। নাহিদও তাতে পড়েছিল কিন্তু সে হাত উঠাতে পেরেছিল বলে রাজিব তাকে বাচাতে পারে। কিন্তু আমার দুই ভাইয়া এই সুযোগটাও পায়নি। নাহিদ আফিফকে শেষ বার যখন দেখেছিল তখন সে সাদকে বাচাতে যাচ্ছিল এবং বলছিল-“ভাইয়া, আমি আসছি!” কেউ জানে না এরপর কি হয়েছিল, তারা বাঁচার জন্য কি করেছিল।

আল্লাহ! মাঝে মাঝে অমানবিক পরীক্ষাও নেয়। তাদের দুজনকে দুটি ভিন্ন দিকে পাওয়া যায়। সাদকে মহেশখালী দ্বীপে পাওয়া যায় পরের দিন সকাল ৯টার দিকে। আর আফিফকে পাওয়া যাইয় ৩টার দিকে হিমছড়িতে পাওয়া যায়। এর আগের দিন আফিফ নাহিদ কে বলছিল-“নাহিদ আপু, আমরা কালকে ৩টায় হিমছড়ি যাবো!”


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।