আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

চট্টগ্রাম থেকে – ১৫ই জুন



(১৬ই জুন সকাল) : আমরা ঢাকায় ফিরে এসেছি । আমি খুব করে চাচ্ছিলাম আমরা যা দেখেছি তার একটি স্পষ্ট ছবি সবার কাছে তুলে ধরতে । কিন্তু সত্যিকারের একটা নরকের মাঝে তিনদিন থেকে এসে আমার মস্তিষ্কও কিছুটা বিধ্বস্ত । কত মানুষকে যে ফেলে এসেছি সে নরকের মাঝে, একা । এই আরামের জীবনে ফিরে আসার আগে প্রতিটি চোখের পানি যদি মুছে ফেলা যেত, প্রতিটি মুখে যদি দিয়ে আসা যেত একটুকরো হাসি, যদি বলা যেত আমরা আবার ফিরে আসবো তোমাদের মাঝে ! কত ভালোই না হত সেটা ।

মাঝরাতের আগে থেকেই বৃষ্টি শুরু হয়েছে; টিপটিপ করে নয় রীতিমতো ঝুম বৃষ্টি । যে মানুষগুলো স্মৃতিতে পাকাপাকিভাবে স্থান করে নিয়েছে ধ্বংসের বিভৎস কিছু ছবি আর নৃশংস কিছু শব্দ ; আমি নিশ্চিত তারা আজ সারারাত আর ঘুমাতে পারবে না । তারা তো আমাদের কাছে আর শুধুমাত্র ধ্বংসের শিকার কিছু মানুষ নয়, তারা আমাদের বন্ধু, ভাই ; এক ধরণের আগ্রহ আর ভালোবাসা নিয়ে আবার যাদের দেখা পাবার জন্য আমরা বসে আছি । লেবুবাগান সম্ভবত সবচাইতে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা গুলোর একটি । জল কাদায় মাখামাখি হয়ে যাবার প্রস্তুতি নিয়েই আমরা লেবু বাগান পৌঁছলাম কিন্তু কোন ত্রাণতৎপরতা দৃষ্টিগ্রাহ্য হলো না ।

অথচ একদিন আগেই, যখন মাথার উপর ছিল উজ্জল সূর্য, আমরা দেখেছি অনেক সংস্থা ত্রাণ নিয়ে এগিয়ে এসেছে । আজ কেউ নেই এর কারণ কি তাহলে এই যে বৃষ্টিতে ভেজাটা খুব স্বস্তিকর নয় ? যে মানুষগুলো হারিয়েছে তাদের আপনজন, তাদের সর্বস্ব; রোদ আর বৃষ্টি তো তাদের কাছে কোন ব্যাপার নয় ! তাদের সাহায্য প্রয়োজন এখনই এবং তা স্বল্পমেয়াদী নয়, দীর্ঘ সময়ের জন্য । গতকাল বিকেলে নূরজাহানের দেহ খুঁজে পাওয়া গেছে । ফাহিনূর আর তার ভাই অন্তত মর্যাদার সাথে চিরনিদ্রায় শুইয়ে দিতে পারবে তাদের মাকে । কিন্তু লেবু বাগানের শূণ্যতাটা আজ বড় বেশী লাগলো ।

গতকালও যেখানটা ছিলো সেনাবাহিনীর জওয়ান, অগ্নিকর্মী আর সাধারণ মানুষের পদচারণায় মুখর, আজ তাই পরে আছে রিক্ত, হতশ্রী চেহারা নিয়ে । দ্রুত জমে ওঠা পানি নিষ্কাষণের ব্যবস্থা করতে বৃষ্টির মাঝেই মানুষগুলো বের হয়ে এসেছিলো । তখনই প্রথমবার পাহাড় ধ্বসে পড়ে এবং চাপা দেয় তাদেরকে । আর্তচিৎকারে ছুটে আসে আরো মানুষ আর এর পরপরই আরো তিনজায়গায় পাহাড় ধ্বসে জ্যান্ত কবর দিয়ে ফেলে সবাইকে । বেঁচে যাওয়ারা চিরজীবন বহন করে যাবে সেই দুঃসহ স্মৃতি, প্রিয়জনের বাঁচাও বাঁচাও চিৎকার ।

শত চেষ্টা করেও যাদের একজনকেও বাঁচানো গেলো না, শুধু খুঁড়ে বের করা গেলো তাদের প্রাণহীন দেহ । পুরো কাহিনী বলে ফেলাটা আমার পক্ষে সম্ভব নয়, এত নিষ্ঠুর বাক্য গঠনের মত শক্তিশালী আমি নই । যা বলতে পারছি তা পুরো ঘটনার কিছু টুকরো মাত্র । যাই হোক, আমার মনে হয় যাদের আসলেই সাহায্য প্রয়োজন তাদের কয়েকজনকে আমরা চিহ্নিত করতে পেরেছি । স্থানীয় সমাজও এ ব্যাপারে একমত ।

যৎসামান্য কিছু অর্থ দিয়ে এসেছি তাদের জিনিসপত্র কিনবার জন্য, আর কথা দিয়ে এসেছি ফিরে যাবার, ব্লগ কমিউনিটিকে নিয়ে নতুন করে তাদের জীবন গড়ে তুলবার । ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করতে আমরা যাইনি, সে জন্য সুসংগঠিত পেশাদার সংস্থা রয়েছে । আমরা শুধু কথা দিয়ে এসেছি দুঃখি কিছু মানুষকে তিনমাস পূর্ণ সহায়তা দেবার । বাড়ি ভাড়া, বাড়ির জন্য নিত্য প্রয়োজনীয় আসবাব ও দ্রব্যাদি, কাপড় এবং অবশ্যই প্রয়োজনীয় অর্থ সাহায্য আমরা দেব, যেন তারা ইত্যবসরে ভালো কোন চাকুরির খোঁজ করতে পারে । এই অন্ধকার সময়ে তাদের পাশে থাকাটা পরবর্তীতে মাথা তুলে দাঁড়াবার রসদ জোগাবে ।

ব্লগ কমিউনিটি এখন তাদের পরিবারের নতুন কিছু সদস্যকে পাবে, তাদের ছবি ও ইতিহাস যতটুকু সম্ভব আমরা উপস্থাপন করব । সম্ভবত এই প্রচেষ্টার সবচেয়ে বড় ফসল হবে একটি সংগঠিত ব্লগ কমিউনিটি, যারা পরবর্তীতে সাড়া দেবে আরো বড় দুর্যোগে, পাশে এসে দাঁড়াবে দুর্দশাগ্রস্থ মানুষদের । দুঃসময়ে হাতে হাত রেখে সান্তনা দেয়া, তাদের মনে এই অনুভূতির জন্ম দেয়া যে ‘আমি একা নই’, ভবিষৎতের বন্ধু হিসেবে পাশে পাবার আশ্বাসের চাইতে বড় সাহয্য আর কি হতে পারে ? হূমায়ূনের ভাইদেরকে দেখতে তৃতীয়বার হাসপাতালে যাবার পর প্রথমবারের মতো তাদের মুখে ফুটে উঠেছিলো এক টুকরো হাসি ; নিশ্চয়ই এই ভেবে যে তাদের পাশে থাকার মত কেউ আছে ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.