আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

রূপগঞ্জের সহযাত্রী (ছোট গল্প )

বন্ধ জানালা, খোলা কপাট !

মূল গল্পে যাবার আগে খানিকটা ভূমিকা ! এ গল্পটি দিয়ে বাঁধ ভাঙ্গার আওয়াজ-এ আমার গল্পের খাতা খুলছি। গল্প,কবিতা,রস,নিরস,বিরস সব রচনাতেই আমি কলমের আঁচড় দিতে চাই । কিন্তু হয়না কিছুই ! অনেকটা এরকম- ক্লাস ভর্তি উজ্জ্বল সন্তান,ওরা জুড়ে দেবে ফুলস্কেফ সমস্ত কাগজ! আমি বাজে ছেলে,আমি লাষ্ট বেঞ্চি,আমি পারবো না ! ক্ষমা করবেন বৃক্ষ,আপনার শাখায় আমি সত্য পাখি বসাতে পারবো না ! ...........আমার হবে না আমি বুঝে গেছি........ [আবুল হাসান ] তো,ভাইসকল ! দোয়া রাইখেন (বোনসকলও দোয়া রাইখেন, মাইন্ড খাইয়েন না ) ! রূপগঞ্জের সহযাত্রী খুক্ খুক্ খুক্,তিনবার কাশল লোকটি। অল্প অল্প বিরতি নিয়ে তিন গুণন তিন,মোট ন'বার এভাবে কাশল সে। জিরাফের মত গলা লম্বা করে বারিয়ে দিল জানালার বাইরে।

থু করে একদলা থু থু ফেলল। লোকটি আমার সহযাত্রী । মধ্যবয়সী সহযাত্রী। রূপগঞ্জমুখী রূপালি পরিবহনে আমার পাশের আসনটিই তার । রংজ্বলা মলিন চাদরে আপদমস্তক ঢাকা ।

দেখেই কেমন ফেরারী মনে হয় । অবশ্য ফেরারী সে নাও হতে পারে। কৌতূহলী ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলাম,- 'ভাইজানের কি শরীর খারাপ?' 'জি না !' 'অমন কাশছিলেন যে !' 'কাশন যাইব না এমন কতা বাংলাদেশের সম্বিদানে লেহা আছে ?' 'না,তা লেখা নেই !' 'তাইলে কাশলে আপনের অসুবিদাডা কি ?' 'অসুবিধে কিছুই না ! ভাবলাম আপনি অসুস্থ। ' 'হাঃ হাঃ হাঃ ! ভারী হাসির কতা ! আমি অসুস্থ ? আরে ভাই; পুরা দুনিয়া অসুস্থ ! দুনিয়ার ক্যান্সার হইছে !' 'ও আচ্ছা !' বলে চুপ মেরে গেলাম। চুপ না মেরে উপায়ও ছিল না আমার।

সহযাত্রী বহুত উচ্চ মার্গের কথা বলেছে। এমন কথার জবাব আমার ঘিলুতে কুলুবে না ! অবশ্য এই ভেবে স্বস্তি পেলাম, ভাগ্যিস,সে বলেছে দুনিয়ার ক্যান্সার হয়েছে। ক্যান্সারেরতো তবু চিকিত্সা আছে ! যেটার চিকিত্সা নেই সেটা হলো এইডস ! যদি বলতো দুনিয়ার এইডস হয়েছে,তবেতো ভারী মুশকিলের ব্যাপার হতো। নাইনটি ডিগ্রি এ্যন্গেলে লোকটির দিকে তাকালাম । গভীর মনোযোগে দ্রুত সরে যাওয়া গ্রাম্য দৃশ্যগুলো দেখছে সে ।

মনে হচ্ছে শুমার করছে,রাস্তার অদূরে বাড়ীগুলির শুমার । যেন সে এ বিষয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত । মূল সড়কের বাঁ পাশের বাড়ীগুলির সঠিক শুমারি রিপোর্ট প্রদানই যেন বর্তমানে একমাত্র কর্তব্য তার। তার মগ্নতা দেখতে ভাল লাগছে । কিছু মানুষ যখন মগ্নতায় ডুবে যায়,নিমগ্ন ভাবটা হয় দেখার মত ! এরটাও সেরকম ।

ইচ্ছে করেই বিগ্ন ঘটালাম তার। বললাম,-'কটা হলো?' 'কি ?' 'বাড়ী !' 'কার বাড়ী ?' 'রাস্তার পাশের বাড়ী !' লোকটা বড় বড় চোখ করে তাকাল । জ্বলন্ত কয়লার মত লাল দু'চোখ । খুব রাগলে অথবা অতি জ্বরে মানুষের চোখ এরকম লাল হয় ! লোকটা রেগেছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না । রেগেছে হয়তো ।

কারণ,এখন সে পাতার বিড়ি ধরিয়েছে। ভুর ভুর করে বিড়ির গন্ধ এসে লাগছে নাকে । ধূমপায়ীদের এই এক ব্যাপার, রাগে বা টেনশানে ফস্‌ করে নেশাদ্রব্যে আগুন দেয় এরা ! লোকটাকে আরো রাগিয়ে দিতে ইচ্ছে হলো । ইচ্ছে হলো বলি,-'ভাই সাহেব আপনার এই ড্রাকুলা টাইপ চোখ নিয়ে কারো দিকে তাকাবেন না ! লোকজন ভয়ে পেচ্ছাব করে দিতে পারে !' কিন্তু আচমকাই একটি ব্যাপার ঘটল । লোকটির মাথা হেলে পড়ল সিটের ওপর।

জ্ঞান হারিয়েছে সে । পাতার বিড়ির অবশিষ্টাংশ আঙ্গুলে গোঁজা তখনও । তার কপালে হাত দিয়ে চমকে উঠলাম । আশ্চর্য ! এতো প্রচন্ড জ্বর বয়ে বেরাচ্ছে লোকটা ! চাদর খানিকটা সরিয়ে নিলাম তার গা থেকে । তার কোলের ওপর পড়ে আছে এক টুকরো ভাঁজ করা কাগজ ।

তুলে নিয়ে ভাঁজ খুললাম। কাঁচা হাতে লিখা শব্দগুলো পড়তে শুরু করলাম,- বাবা ! মরে গিয়ে মা নিজেকে উদ্ধার করেছেন। পরপারে খাবারের অভাব নেই নিশ্চিত । কিন্তু তার এই অভাগা মেয়েটাকে কেন যে এই নরকে রেখে গেলেন,যেখানে বাবা তার সন্তানের খাবার যোগাতে পারেনা ! চারবেলা ভুখা থেকে খুঁজে খুঁজে এ-ঘরটাতে একটা শিশি পেয়েছি । শিশির তরলগুলো খেয়ে আমিও মার কাছে চলে যাচ্ছি...! সেখানে আমরা ভাল থাকব ! -তোমার মা মণি ! আমার পৃথিবীটা আকস্মিক দুলে উঠল ! ভুকম্পনের মত ।

আচ্ছা,পৃথিবী নামক এ ভূ-খন্ড কি মানুষের কষ্ট দেখতে পায় ! দেখতে পায় বলেই কি অসহ্য হয়ে কেঁপে উঠে মাঝে মাঝে ! হবে হয়তোবা ! স্তম্ভিত আমার চোখের সামনে চিঠিটি ধরা তখনও । লোনা পানির ধারা নামলো চোখে । নীরব সাক্ষী এই বিশাল ভূখন্ডের বাতাসে বিড়বিড় করে ছড়িয়ে দিলাম একটি প্রশ্ন- 'বলোতো পৃথিবী ! কেন এমন হয় ?'

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।