আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী বাংলাদেশী চিত্রশিল্পী, মুক্তিযোদ্ধা ও উদ্যোক্তা নিতুন কুণ্ডুর ৭ম মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি

আমি সত্য জানতে চাই
আধুনিক বিশ্বের শিল্পকলা জগতের অন্যতম পথিকৃৎ নিতুন কুণ্ডু। পুরো নাম নিত্য গোপাল কুণ্ডু একজন বাংলাদেশী চিত্রশিল্পী, মুক্তিযোদ্ধা ও উদ্যোক্তা। নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন একজন শিল্পী, ভাস্কর, শিল্প-উদ্যোক্তা সর্বোপরি একজন আদর্শ ও সফল মানুষ হিসেবে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নিতুন কুণ্ডু যথেষ্ট ভূমিকা রাখেন। সার্ক ফোয়ারা, ঢাকা, সাবাস বাংলাদেশ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, কদমফুল ফোয়ারা,ঢাকা প্রমূখ বিখ্যাত ভাস্কর্যের স্থপতি নিতুন কুণ্ডু।

তার মেধা ও শ্রমে অটবি ফার্নিচারের দোকান বিস্তৃত হয় দেশজুড়ে। কঠোর পরিশ্রম আর সততার সঙ্গে ব্যবসা করে প্রয়াত দেশ বরেণ্য ভাষ্কর শিল্পী নিতুন কুণ্ডু তিল তিল করে গড়ে তুলেছিলেন অটবি। তিনি দীর্ঘ তিন দশক দেশের অন্যতম এই বৃহৎ শিল্পপ্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন। জাতীয় পর্যায়ে তিনটি ক্ষেত্রে নিতুন কুণ্ডু বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। একঃ তিনি খ্যাতিমান চিত্র শিল্পী, দুইঃ সফল শিল্পোদ্যোক্তা এবং তিনঃ ভাস্কর।

উপরোক্ত তিনটি ক্ষেত্রে তিনি সমানভাবে দক্ষতার ছাপ রেখেছেন। ডিজাইনের ওপর তিনি দশটি এ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন। আজ এই চিত্রশিল্পী ও মুক্তিযোদ্ধা নিতুন কুণ্ডুর ৭ম মৃত্যুবার্ষিকী। বাঙালী ও বাংলা সংস্কৃতির বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী শিল্পী নিতুন কুণ্ডুর মৃত্যুদিনে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি। (যৌবনে শিল্পী নিতুন কুণ্ডু) নিত্য গোপাল কুণ্ডু ১৯৩৫ সালের ৩ ডিসেম্বর দিনাজপুরে জন্মগ্রহণ করেন।

ছোট্ট বয়সেই ছবি আঁকার প্রতি তার একটা আকর্ষণ ছিল। এই প্রেরণা অবশ্য তিনি পারিবারিক ঐতিহ্য থেকেই পেয়েছিলেন। তাঁর বাবা জ্ঞানেন্দ্রনাথ কুণ্ডু শখ করে ছবি আঁকতেন। তাঁর হাতের লেখাও খুব সুন্দর ছিল। তাঁর লেখাপড়ায় হাতেখড়ি ১৯৪২ সালে স্থানীয় বড়বন্দর পাঠশালায়।

১৯৪৭ সালে তিনি ভর্তি হন দিনাজপুর শহরের গিরিজানাথ হাইস্কুলে। ১৯৫২ সালে তিনি মেট্রিকুলেশন পাস করেন। বাবা-মা আর্থিক সামর্থ্যের কথা চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন স্থানীয় সুবেন্দ্রনাথ কলেজেই ছেলেকে পড়াবেন। কিন্তু নিতুন কুণ্ডুর আর্ট কলেজে পড়ার দুর্বার ইচ্ছে তাঁকে আটকাতে পারেনি। ছবি আঁকার প্রতি তাঁর সৃজনশীলতা থেকেই তিনি আর্ট কলেজে পড়ার সিদ্ধান্ত নেন।

মাত্র ১০ টাকা হাতে নিয়ে তিনি ১৯৫৩ সালে ঢাকায় আসেন। ঢাকায় তখন সুভাষ দত্ত (অভিনেতা) ছাড়া অন্য কোন পরিচিত লোক ছিল না। (দিনাজপুর শহরে শিল্পী নিতুন কুণ্ডুর পৈত্রিক বাড়ি) দিনাজপুর থেকে ঢাকায় এসে তাঁকে প্রথম অনেক ছোট ছোট কাজ করতে হয়েছে। আর্ট কলেজের অধ্যক্ষ শিল্পী জয়নুল আবেদিন তাঁকে ভর্তি করে নেয়ার সময় কয়েকটি শর্ত দিয়েছিলেন, বলেছিলেন পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে সে যেন যোগ্যতার মাপকাঠিটা অর্জন করে নেয়। নিতুন কুণ্ডু সেটা সম্পন্ন করেছিলেন এবং ১৯৫৯ সালে তদানীন্তন ঢাকা আর্ট কলেজে (বর্তমানের চারুকলা ইনস্টিটিউট) থেকে চিত্রকলায় পরিপূর্ণ মর্যাদা নিয়ে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করেছিলেন।

কিন্তু দারিদ্র্যের সঙ্গে তখনও নিরন্তর যুদ্ধ করতে হচ্ছে। (স্ত্রী ও পুত্র-কন্যার সাথে শিল্পী নিতুন কুণ্ডু) ১৯৫৯ সালে নিতুন কুণ্ডু তার জীবন শুরু করেছিলেন ডিজাইনার হিসেবে। সিনেমা হলগুলোর সামনে বাঁশ বেঁধে তার ওপর উঠে বিরাট বিরাট ছবি আঁকতেন তিনি। বিনিময়ে যা পেতেন তা দিয়ে সব কিছু সামাল দিতে পারতেন না। অনেক সময় মুড়ি ও জল খেয়ে তাঁকে কাটাতে হয়েছে।

কিন্তু কোন বাধাই তাঁকে দমাতে পারেনি। প্রত্যেকটি বাধা তাঁকে সাফল্যের শিখরে উঠতে প্রেরণা যুগিয়েছে। ১৯৬২ সালে ইউনাইটেড স্টেটস ইনফরমেশন সার্ভিসেস (ইউসিস) প্রধান ডিজাইনার হিসেবে কাজ শুরু করেছিলেন। ১৯৭০ সালে তোপখানা রোডে বিখ্যাত বিজ্ঞাপনী সংস্থা বিটপীর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন তিনি। (১৯৭১ সালে আঁকা শিল্পীর কালজয়ী পোষ্টার) বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নিতুন কুণ্ডু যথেষ্ট ভূমিকা রাখেন।

১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ইউসিসের চাকরি ছেড়ে দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলেন তিনি। প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের জনসংযোগ বিভাগে তিনি কর্মরত ছিলেন। এসময় প্রখ্যাত চিত্র শিল্পী কামরুল হাসানের সাথে মিলে তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে পোস্টার ডিজাইন ও অন্যান্য নকশা প্রণয়ন করেন। নিতুন কুণ্ডু মুক্তিযোদ্ধা শিল্পী হিসেবে ব্যাপক আলোচিত। মূলত ভাস্কর্যশিল্পী হিসেবে পরিচিতি পেলেও অন্যান্য ক্ষেত্রে কাজ করার ব্যাপারে আগ্রহের শেষ ছিল না তার।

শিল্পী হওয়ার নেশায় ২৪ ঘণ্টা ব্যস্ত থাকতেন। তাঁর প্রণীত পোস্টারগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল সদা জাগ্রত বাংলার মুক্তিবাহিনী ও বাংলার বীর মুক্তিযোদ্ধা। আজীবন একজন শিল্পী হয়েই থাকার প্রবল ইচ্ছা ছিল। তিনি বিশ্বাস করতেন কর্মই মানুষকে বড় করে তোলে। (ঢাকায় নির্মিত শিল্পীর বিখ্যাত শিল্পকর্ম সার্ক ফোয়ারা) বাংলাদেশের ভাস্কর্য শিল্পের ক্ষেত্রে যারা কাজ করেছেন তাঁদের মধ্যে শিল্পী নিতুন কুণ্ডুর নাম প্রথমেই আলোচনায় আসে।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে 'সাবাস বাংলাদেশ' ঢাকার সার্ক ফোয়ারা এবং চট্টগ্রামের 'সাম্পান' ভাস্কর্যটি ছিল নিতুন কুণ্ডুর নির্মিত। এগুলোর নির্মাণ শৈলী, নকশা ও কাঠামোগত রূপায়ণ খুবই আধুনিক মানের। তার উল্লেখযোগ্য ভাস্কর্য ও শিল্পকর্মঃ ১। সার্ক ফোয়ারা, ঢাকা (১৯৯৩), প্যান প্যাসেফিক সোনারগাঁও হোটেলের সামনে অবস্থিত। ২।

সাবাস বাংলাদেশ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৯২) ৩। কদমফুল ফোয়ারা, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ৪। মুর‌্যাল (পিতল), পাকিস্তান এয়ারলাইন অফিস, হোটেল শেরাটন, ঢাকা ৫। ম্যুরাল (তেল রং) জনতা ব্যাংক, ঢাকা ৬। ম্যুরাল (কাঠ, লোহা, পিতল) মধুমিতা সিনেমা হল, ঢাকা ৭।

সাম্পান, ঐতিহ্যবাহী নৌকার প্রতীক, চট্টগ্রাম বিমানবন্দর (২০০১) ৮। জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেটের সম্মুখে ফোয়ারা নির্মাণ। (Weaving Shadow, 2006) এছাড়াও তার উল্লেখযোগ্য কাজ সমূহঃ ১। স্বাধীনতা যুদ্ধের পোস্টার ডিজাইন (১৯৭১) ২। ইন্দিরা মঞ্চ, (স্বাধীনতা যুদ্ধের পর ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশে আগমন উপলক্ষ্যে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নির্মিত মঞ্চ) ঢাকা (১৯৭২) ৩।

বিভিন্ন জাতীয় ট্রফির (প্রতিযোগিতার পুরস্কার) নকশা ও নির্মাণ ৪। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ৫। প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপ ৬। বাংলাদেশ টেলিভিশনের নতুন কুঁড়ি পুরস্কার ৭। প্রেসিডেন্ট শিশু-কিশোর ফুটবল কাপ ৮।

শিল্পমেলা ট্রফি ৯। এশিয়া কাপ ক্রিকেট পুরস্কার ১০। একুশে পদক ১১। বায়তুল মোকাররম মসজিদের অভ্যন্তরের লাইটিংয়ের কারুকাজ স্বাধীনা উত্তর বাংলাদেশে ১৯৭৫ সালে নিতুন কুণ্ডু অটবি লিমিটেড নামক ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন। এখানে আসবাবপত্র থেকে শুরু করে বিভিন্ন অঙ্গনে তাঁর নকশা স্থান পেয়েছে।

অটবি এখন চমৎকার শিল্পরূপ নিয়ে ফার্নিচার শিল্পের এক অনন্য উদাহরণ। তার হাতে গড়া শিল্প প্রতিষ্ঠান অটবি ত্রিশ বছর অতিবাহিত করেছে। অটবি ছাড়াও নিতুন কুণ্ডু নিজেই একটি শিল্প প্রতিষ্ঠান। শিল্পের সর্বোচ্চ মিনারে অবস্থান করা এই শিল্পীকাজের স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন অসংখ্য সম্মাননা। ১৯৫৬-১৯৮৭ সাল পর্যনত্ম একটানা এককভাবে ডিজাইনের জন্য প্রথম পুরস্কার পান তিনি।

১৯৬৫ সালে জাতীয় চিত্রকলা পুরস্কার এবং ১৯৯২ সালে বঙ্গবন্ধু পুরস্কার এবং ১৯৯৭ সালে আর্ট এ্যান্ড কালচারে দেশে সর্বোচ্চ একুশে পদক লাভ করেন। এ ছাড়াও কাজের স্বীকৃতি হিসেবে তিনি পেয়েছেন ডেইলি স্টার-ডিএইচএল শ্রেষ্ঠ উদ্যোক্তা পদক ও অসংখ্য সম্মাননা। (শিল্পীকে একুশে পদক পরিয়ে দিচ্ছেন প্রধামন্ত্রী শেখ হাসিনা) বাঙালী ও বাংলা সংস্কৃতির বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী আজীবন কর্মসংগ্রামী শিল্পী নিতুন কুণ্ডু ২০০৬ সালের ১২ই সেপ্টেম্বর হৃদরোগে আক্রান্ত হন। পরে ১৫ই সেপ্টেম্বর সকালে তিনি বারডেম হাসপাতালে মারা যান। ১৬ই সেপ্টেম্বর পোস্তগোলা শ্মশানে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন করা হয়।

চিত্র শিল্পের ইতিহাসে পাবলো পিকাশো, লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি; ভ্যান গগ, এসএম সুলতান, স্যান্ডি মার্টিস আজ বিশ্বের সকল অগ্রসর চিনত্মায় মানুষের মনে স্থান করে আছেন। নিতুন কুণ্ডুও তাঁর কর্মের মাধ্যমে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম এক উজ্জ্বল কৃতিমান মানুষ হিসেবে অধিষ্ঠিত থাকবেন। আধুনিক বিশ্বের শিল্পকলা জগতের অন্যতম পথিকৃৎ এই মুক্তিযোদ্ধা চিত্র শিল্পী নিতুন কুণ্ডু'র ৭ম মৃত্যুদিন আজ। মৃত্যুদিনে তাঁকে স্মরণ করছি গভীর শ্রদ্ধায়।
 


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.