আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ছেলেটির প্রিয় ঋতু বর্ষা নয়

লিখতে ভাল লাগে, লিখে আনন্দ পাই, তাই লিখি। নতুন কিছু তৈরির আনন্দ পাই। কল্পনার আনন্দ। ছেলেটির প্রিয় ঋতু বর্ষা নয় মোহাম্মদ ইসহাক খান বাংলাদেশে জন্মেছে অথচ বর্ষা, বৃষ্টি আর ব্যাঙের ডাক ভালোবাসে না, এমন মানুষ বোধহয় নেই। অন্তত আমি এতদিন তাই ভাবতাম।

কোন ঋতু নিয়ে সবচেয়ে বেশি কবিতা, গল্প, উপন্যাস, গান ইত্যাদি লেখা হয়েছে, যে কাউকে জিজ্ঞেস করলে এক কথায় বলে দেবে, অবশ্যই বর্ষা। টিনের চালে ঝমঝম বৃষ্টির শব্দ শুনতে শুনতে "আজি ঝর ঝর মুখর বাদর দিনে" গানটি শুনতে কার না ভাল লাগে? কবি প্রতিভার উন্মেষ ঘটে বর্ষাকালে। সবাই "নবধারা জলে অবগাহন" করে ধন্য হয় এই ঋতুতে। বিবর্ণ ধূসর ঝলসে যাওয়া গাছের পাতা সজীব হয়ে ওঠে বর্ষার প্রথম বৃষ্টির ফোঁটাটির স্পর্শ পেয়ে। "মীনগুলি হীন হয়ে ছিল সরোবরে, এখন সুখে তারা জলক্রীড়া করে" - জাতীয় অসংখ্য কবিতার পঙক্তি খুঁজলেই পাওয়া যাবে।

তাছাড়া বৃষ্টির পানি গায়ে লাগালে ঘামাচি মরে যায়, এসব ছোটখাটো কারণ তো আছেই। বর্ষার বন্দনা করতে করতে কবি-সাহিত্যিকেরা বোধহয় এককথায় পচিয়েই ফেলেছেন। তবে বিষয়টি পুরনো হয় নি। এখনো বর্ষা এলে আর সবার মতো আমারও "চিত্তে দোলা লাগে", "চেনা শোনার কোন বাইরে, যেখানে পথ নাই, নাই রে" - নামক স্থানে আমার হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করে। ভাবতাম, আর সবাই বুঝি আমার মতোই চিন্তা করে।

কিন্তু ঐ ছেলেটির সাথে কথা বলে আমার আক্কেলগুড়ুম হয়ে গেছে। ছেলেটি রাস্তার ওপাশের সরু গলিটাতে থাকে। কানাগলি, অন্ধগলি, ভূতের গলি, যা খুশি এটাকে বলা যেতে পারে। সূর্যের আলো অল্পই পৌঁছয় বলে একটা স্যাঁতস্যাঁতে ভাব সবসময় সেখানে গুমোট মেরে থাকে। আমি ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, বর্ষা এলে ওর কেমন লাগে।

তাতে সে চোখমুখ কুঁচকে যে বিকট মুখভঙ্গি করেছিল, সেটা আমার এখনো মনে আছে, ভাবতেই গায়ে কাঁটা দেয়। গলির মুখে পাড়ার ছেলেপুলের সাথে ক্রিকেট খেলে সে। ইট দিয়ে বানানো স্ট্যাম্প, টেপ পেঁচানো টেনিস বল, কাঠের ব্যাট। এখানেই দুর্দান্ত দ্বৈরথ হয় পাড়ার ব্রেট লি আর টেন্ডুলকারদের, জন্ম হয় নব্য ক্রিকেট প্রতিভার। কত বাসার কাঁচের জানালা বল মেরে ভেঙে দিয়ে তারা গালিগালাজ খেয়েছে ঠিকঠিকানা নেই।

ঐ তো, পাশের বাড়িটার জানালায় এখনো একটা গোল ফুটো হয়ে আছে, ঠিক একটা টেনিস বলের সাইজের। ফুটোটার চারপাশের কাঁচে ফাটল ধরেছে। একজন দুরন্ত ব্যাটসম্যানের ভয়াবহ ছক্কার ফসল এটা। বলটা পাওয়া যায় নি অবশ্য, কুটনী বুড়ি বাড়িওয়ালী রেখে দিয়েছে। সমস্যা হল, এই গলি একটু বৃষ্টি হলেই তলিয়ে যায়, ড্রেন উপচে নোংরা পানি এসে ভাসিয়ে নিয়ে যায় গলি।

এখানে যে একটা সরু পথ আছে, কারো বোঝার সাধ্য থাকে না। ছেলেটির প্রিয় ক্রিকেট খেলা তাই বর্ষার শুরুতেই বন্ধ হয়ে যায়। কাজেই সে বর্ষা পছন্দ করে না। ছেলেটির সাংঘাতিক ঠাণ্ডার ধাত। বৃষ্টির এক ফোঁটা পানি গায়ে পড়েছে কি পড়েনি, সে কুপোকাত।

যখন অন্য সবাই হৈচৈ করতে করতে বৃষ্টিতে উদোম গায়ে ভিজছে, তখন সে মুখ গোমড়া করে ঘরের জানালার পাশে বসে আছে। কখন আকাশ পরিষ্কার হবে, দু'দিন সময় নিয়ে গলি শুকোবে, আর সে তার ব্যাট নিয়ে আবার ক্রিকেট খেলতে যেতে পারবে। একবার বেকায়দায় পড়ে বৃষ্টিতে ভিজে সাতদিন নিউমোনিয়াতে আক্রান্ত অবস্থায় চিৎপাত হয়ে পড়ে ছিল। বর্ষা ঋতুর প্রতি বিতৃষ্ণার জন্য বোধহয় এই একটি কারণই যথেষ্ট। আরও আছে।

বর্ষা এলেই গলির মুখে যে বড় রাস্তাটা (সাকুল্যে দশ ফুট চওড়া), সেটাতে বিপুল উদ্যমে খোঁড়াখুঁড়ি শুরু করে ঢাকা ওয়াসা। নানা সমস্যা, পানির লাইন লিক হয়ে গেছে, নতুন লাইন যাচ্ছে, অথবা সুয়ারেজ লাইনের সাথে পানির লাইন মিশে গেছে, এসব সমস্যা সমাধানের জন্য বর্ষা ঋতুই আদর্শ, কারণ এই সময়ে মাটি না খুঁড়লে মানুষের ভোগান্তিটা ঠিকমতো হয় না। গর্ত খুঁড়ে শ্রমিকেরা মাটি তুলে সাজিয়ে রাখে রাস্তায়, আর তাতে দখল হয়ে যায় সেই "বড় রাস্তার" শতকরা নব্বই ভাগ, বাকি দশ ভাগ দিয়ে কোনমতে মানুষজন নাক চেপে চলাচল করে, কারণ তুলে রাখা "মাটি" নামক বস্তুটির চেহারা এবং সুবাস ঠিক মাটির মতো নয়! ছেলেটি তো ছোট বয়সে একবার বমিই করে দিয়েছিলো। এখনো সহ্য হয় না, পেট গুলিয়ে আসে। এই কাজ নিরন্তর চলছে, সেই যে শুরু হয়েছে আর শেষ হয় নি, প্রতি বর্ষায়, নিয়ম করে হয়ে আসছে।

আর যখন পানির লাইন মেরামত হয়ে যায়, তখন রাস্তায় থাকে বিরাট বিরাট ফাটা জায়গা, সেখানে জমে থাকে পানি, চলাচলের ঠাঁই যায় কমে। ছেলেটি যে দুই চোখে বর্ষা দেখতে পারে না, এটাও তার একটা শক্তিশালী কারণ। বড় বড় কারণ যেমন আছে, তেমনি ছেলেটির কাছে আছে ছোট ছোট তুচ্ছ কারণ, আছে কিছু স্মৃতি, যাকে ঠিক সুখস্মৃতি বলা চলে না, যেটা ভুলে যেতে পারলেই খুশি হয় সে। এক তুমুল বৃষ্টিস্নাত রাতে ঘুটঘুটে অন্ধকারে বাড়ি ফেরার সময় সে যখন ছপছপ শব্দ তুলে গলিতে ঢুকেছে, হাঁটু পানি ভেঙে এগিয়ে যাচ্ছিলো নিজের ঘরের দিকে, তখন সে মুখ খোলা ম্যানহোলে ঘূর্ণি তুলে পানি ঢোকার সরসর শব্দটা ঠিক ঠাহর করতে পারে নি। কাজেই যখন ময়লা পানিসহ গর্তটা ওকে সহ টান দিলো, তখন সে হঠাৎ লক্ষ করলো, পায়ের নিচের মাটি সরে যাচ্ছে।

তবে কপাল ভাল, সাঁতার জানতো বলে তার পথের সমাপ্তি বুড়িগঙ্গার "অর্ধতরল" কালো পানিতে হয় নি, হাঁচড়ে পাঁচড়ে উঠে পড়তে পেরেছিল। কিন্তু নিজেকে বাঁচাতে গিয়ে ওর পাঁচশো টাকা দামের নতুন স্যান্ডেল জোড়া আর হাতের লেডিস ছাতাটা (ছাতার আবার পুরুষ আর নারী কী?) কোথায় যে ভেসে গেল, আর খুঁজেই পেলো না ছাই। বলা বাহুল্য, ওর সে রাতেই গা কাঁপিয়ে জ্বর এলো, এবং রইলো পুরো চারদিন। বৃষ্টিতে ভিজে, নাকি স্যান্ডেল আর ছাতার শোকে, সে ব্যাপারে অবশ্য সে নিশ্চিত নয়। এহেন সব কারণে ছেলেটির সবচেয়ে বিতৃষ্ণার এবং অপছন্দের ঋতু হচ্ছে বর্ষা।

সে বলেছে, সাধ্য থাকলে সে পৃথিবী থেকে এই সিজনটাই উঠিয়ে দিত। আমি অবশ্য পাণ্ডিত্য ফলানোর জন্য ওকে গম্ভীর গলায় "কৃষিভিত্তিক বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে বর্ষা ঋতুর বিপুল অবদান" শীর্ষক একটি সারগর্ভ বক্তৃতা দিতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু সে শুরুতেই আমাকে থামিয়ে যা বলল, তার সারমর্ম হচ্ছেঃ বর্ষা ওসব কবি-সাহিত্যিকদের ব্যাপার, যাদের পেটে ভাত আছে, খাওয়াপরার কোন কষ্ট নেই, সকালে উঠে হাঁটু পর্যন্ত পানি-কাদা ভেঙে যাদের কর্মস্থলে পৌঁছতে হয় না। বর্ষা ওসব মানুষের জন্য, যারা মগভর্তি গরম চা নিয়ে সুপরিসর ব্যাল্কনি থেকে হাত বাড়িয়ে বৃষ্টির পানি স্পর্শ করে, গরম কম্বলে শরীর জড়িয়ে আরাম করে শুয়ে কিংবা বসে কবিতা-গল্প এসব লেখে, বর্ষাবন্দনা করে, যাদের কাছে পাঁচশো টাকা দামের স্যান্ডেল হারানো কোন বড় বিষয় নয়। বর্ষা ঐ সব লোকদের জন্য, যারা গলিতে ক্রিকেট খেলতে না পারলে দুঃখিত হয় না। বর্ষাবিলাস, নবধারা জলে স্নান, এসব আমজনতার জিনিস নয়, উঁচুতলার জিনিস।

বর্ষা গরীবের নয়, ধনীর। যে ফেরিওয়ালার ব্যবসা বৃষ্টি নামলেই লাটে ওঠে, যে মজুর বৃষ্টির দিনে কাজ পায় না বলে উপোষ থাকে, তার জন্য বর্ষা নয়। আমি জবাব দিতে পারিনি। ছোকরার রাগটা পড়ুক, তারপর দেখা যাবে। (২৫ ডিসেম্বর, ২০১২) ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।