আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শিলালিপি -৬



১৯৯৭ সাল । আমি আইএসসি পরীক্ষায় গোল্লা মেরে পাশ করলাম । এটাকে ঠিক আমার মানে পাশ বলা চলেনা । সব বিষয়ে পাশ । কতটুকু ক্ষতি যে হয়েছে তাও বুঝতে পারছিলাম না ।

বুকের উপর মদের বোতল নিয়ে ধর্ম সাগরে নৌকায় শুয়ে ছিলাম আমার প্রিয় মেরুন রঙের কাবুলি সেট পরে । কতক্ষন কেটে গিয়েছে জানিনা । ফেরার কোন তাড়া নেই । এক সময় খেয়াল করলাম ঘাটে দাঁড়িয়ে কেউ আমাকে ব্যাকুল হয়ে ডাকছে । নৌকা নিয়ে এগিয়ে গেলাম ।

কে আবার ? আমার ভাই, আমার পিতা , আমার আদর্শ, আমার সকল ইন্দ্রিয় জুড়ে গেঁড়ে থাকা ভাইজান । যার জন্য অবলীলায় এ প্রান আমি উৎসর্গ করতে পারি । এ নিয়ে মনে বিন্দু মাত্র দ্বিধা বা সন্দেহ নেই । অগাস্ট মাস শেষের পথে । আমার যে অভ্যাস টা সবচে খারাপ ছিল তা হল বার্ষিক পরিক্ষার পূর্বের শেষ ১৫ কি ২০ দিন বিরামহীন পড়াশোনা করে সিলেবাস শেষ করতাম ।

সাদামাটা ভাবে পাশ করে পরের ক্লাসে উঠে যেতাম । সর্বচ্চ ভাল রেজাল্ট করার বাসনা তেমন একটা কাজ করত না । আমি নিশ্চিত ছিলাম যে, হাজার চেষ্টা করেও আমি একজন ‘মাকসুদ এলাহি রিয়েল’ হতে পারবো না । আমার মেধার সীমা আমি খুব ভাল করেই জানতাম । আবার এ ভাবনাও মনে কাজ করত যে, আমি যদি রিয়েলের সমান রেজাল্ট করি এবং রিয়েল আমার অবস্থানে চলে আসে তখন আমাদের সম্পর্ক কেমন থাকবে ? আতঙ্কিত বোধ করতাম ।

এরচে এই ভাল আমি তাঁর চক্রে নির্বোধের জীবন যাপন করি । আমরা চির বন্ধু থাকি আর সে ইয়াসমিনের সাথে প্রেম করার প্রত্যাশা না করুক । যদিও আমি নিশ্চিত ভাবেই জানতাম সে আমাকে কষ্ট দেয়ার নির্মম হোলি খেলায় মেতেছে । তাকে আস্কারা দিচ্ছে রিয়াদ, কানা মাসুদ আর অজাত সাব-রেজিসট্রারের বখে যাওয়া ছেলে সুমন । এই কলেজ লাইফে জীবনের যেসব রুঢ় সত্যকে আমি উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছিলাম তাঁর মধ্যে অন্যতম ছিল বন্ধুত্ব ।

ক্লাস ফাইভ থেকে ইন্টার পর্যন্ত আমরা জীবনে কখনো আলাদা বসিনি । কোন ঝড় ঝঞ্জাতেই বিচ্যুত হইনি । কোত্থেকে কোনখানের কোন সুমন এসে সব উলট পালট করে দিল । তাঁর বাবা সাব রেজিসট্রার হয়ে বিস্তর টাকা আয় করতো এবং সে সেই টাকার একটা অংশ গাপ করতো । টাকা কথা বলে চিরন্তন ।

সারা জীবন অর্থ কষ্টে মানুষ হয়েছি কিন্তু এসবের প্রতি কোন মোহ কখনো কাজ করেনি । ২ টাকা হলে আরও ২ টাকা যোগাড় করে রিয়েল কে নিয়ে পুরি খাব এ জাতীয় স্বপ্ন দেখে আমি অভ্যস্ত । কিন্তু সুমনের স্টাইলটা ছিল অন্য রকম । ‘ এই, এই টেবিলে কে আছে? এদিকে আয় । টেবিলটা খুব ভালো মত মুছে গ্লাস ধুয়ে পরিস্কার পানি দিবি, বুচ্ছস ? তাঁর পরে আমার কয়জন আছি দেখ ।

১, ২, ৩, ৮... কয়জন ? ১৬ ? ঠিক আছে সবাইরে গরম পরাটা দে সাথে ঝাল গরুর মাংস । সব টেবিলে ড্রিংকস দে । আর শোন পিয়াজ কাঁচামরিচ আলাদা কেটে ধুয়ে দে । তারপর দাঁড়িয়ে থাকবি । ‘ আমার কাছে যে সামান্য টাকা থাকতো তা দিয়ে বিল দেয়া তো দুরের কথা শেয়ার করার কথাও ভাবতে পারতাম না ।

খাওয়া দাওয়া পর্ব শেষ হতে না হতেই তিন হাজার টাকার মাল চলে আসতো । মাল খেতে খেতে তাস খেল । ক্লান্তি বোধ করলে আবার ও ২ হাজার টাকা বের করে দিত । যা তো কেউ একজন গিয়ে মাল নিয়ে আয় । ‘ সে চাইত রিয়েল ছাড়া বাকি সবাই তাঁর পা চাটা কুকুর হয়ে যাক ।

আর আমি চাইতাম রিয়েল এসবে জড়িয়ে না পড়ুক । আমরা তো ভালই ছিলাম । সব কিছুই চলত সীমার মধ্যে । সিস্টেম টা দাঁড়িয়ে গেল সুমন সব বিষয়ে রিয়েলের মতামত নেয় আর বাকি সবাইকে চাকর বাকর মনে করে । আমি এ দুঃখের কথা অন্য কোন গ্রুপ কে বলতে পারছিনা আবার সইতেও পারছিনা ।

একদিন তো রাগ করে বলেই ফেললাম, তোর মত সমনের সাথে আমরা চলব ভাবিস কি করে ? যা যা মর্নিং শিফটের ছেলেদের সাথে গিয়ে হাঁট । সে আমাকে আতঙ্কিত করে দিয়ে খিল খিল করে হেসে উঠল । ‘ শোন জাকু, তোর মত ছেলেরা হচ্ছে পা চাটা কুকুর কিংবা নিদেন পক্ষে কাকের মত । তুই থাক বা না থাক তোর মত শত ছেলে লাইন দিয়ে বসে আছে আমার সঙ্গ পাওয়ার জন্য । ভাত ছিটালে কাকের অভাব হয়না ।

দেখবি ? চাস দেখতে ?’ এনাফ ইজ এনাফ বলে আমি উঠে দাঁড়ালাম । রিয়েল চল আমরা আমাদের মত থাকি । কই রিয়েল চল না । রিয়েল চশমার ফাক দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, তোর যেতে ইচ্ছে করলে তুই যা । দল বল নিয়ে যাওয়ার মতলব কেন ? আমার হাত থেকে কাগজ কলম বই সব মাটিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ল ।

অবাক অসহায়ের মত ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম । সুমন টিপ্পনী কাটল, কিরে ছাগল মইরা গেলি নাকি ? এই কে আছস এরে একটু পানি খাবা । বই পত্র গুছিয়ে চলে এলাম । সুমন জোরে জোরে চিৎকার করে বলে যেতে থাকলো – ঐ শালা, ঐ মাতারির পোলা তোর রিয়েল আব্বারে লইয়া যা । কান্দিস না ।

কাইন্দা ফায়দা নাই । কলেজের শেষ সময়টা এমন বিচ্ছিন্ন এক বিশ্রী অবস্থার মধ্যে দিয়ে কাটছিল । সেবার খুব শীত পড়েছিল । আপা বাসায় বেড়াতে আসলো । আমার পড়াশোনার প্রতি অনীহা এবং সারাদিন চুপচাপ থাকি দেখে সে কিছুটা চিন্তিত হয়ে পড়েছিল ।

সে চেষ্টা করল বিভিন্ন ভাবে বুঝিয়ে শুনিয়ে কিছু একটু ভালো করা যায় কিনা । আমার মন ভেঙ্গে গিয়েছিল ঘর বাহির সব কিছু থেকে । আমিও চেষ্টা করলাম একটু কিছু করা যায় কিনা । জানুয়ারি মাসের একুশ তারিখের কথা স্পষ্ট মনে আচ্ছে আমার । সকাল থেকেই রোদের দেখা নেই ।

আমি একটা শাল গায়ে চাপিয়ে ১১ টা পর্যন্ত ক্যালকুলাস করলাম । হঠাৎ মনে হল যাই একটু রিয়াদকে দেখে আসি । সে আজ দুই তিন দিন ধরে অসুস্থ । আপাকে বলে কয়ে একটা রিক্সা নিয়ে রেসকোর্স তাঁর বাসার সামনে হাজির হতেই স্থানীয় দোকানি বলল, খবর কিছু পাইছেন ? জিজ্ঞেস করলাম, কিসের খবর? যান যান রিয়াদ ভাইয়ের বাসায় যান । সব খবরই পাইবেন ।

দুরু দুরু বুকে বাসার সামনে হাজির হলাম । একি হাজার হাজার মানুষ এমন ভেঙ্গে পড়ছে কেন ? হল টা কি এখানে ? প্রায় ৬ ফিট লম্বা বিশাল দেহি এই মানুষটাকে তাঁর বৃদ্ধ বাবা খুন করেছে । আমি কোন মতে টলতে টলতে গিয়ে তাঁর মাথার কাছে বসলাম । সম্পূর্ণ সুস্থ স্বাভাবিক দেখাচ্ছে ঘুমন্ত রিয়াদকে । কে বলেছে সে খুন হয়েছে ? প্রায় ত্রিশ পয়ত্রিশ ঘণ্টা পর পুলিশের কাছ থেকে মৃত রিয়াদের কিছু খণ্ড আমরা বুঝে নিলাম ।

এই চরম শীতে শুরু হল ঝড় বৃষ্টি । এমন আবহাওয়ায় মাগরিবের পর আমরা সবাই রিয়াদের পচা গলা লাশ নিয়ে রওনা হলাম ইছাপুরার উদ্দেশ্যে । তাঁর কফিন থেকে যেসব রক্ত এবং পানি ঝরছিল সে গুলো জমা হচ্ছিল আমার জ্যাকেটের উলে । আমার সারা শরীর ভিজে গেল পচা লাশের গন্ধে । জানাজা শেষে লাশ কবর পর্যন্ত নিতে নিতে রাত ১১ টা বেজে গেল ।

গ্রামে ১১ টা মানে নিশুতি রাত । এমন একজনও কি সেদিন ছিল না যে একটা হারিকেন নিয়ে আসতে পারত কবরের পাশে ? ঝড় বৃষ্টি আর অন্ধকারে আমরা লাশ নিয়ে হুড়মুড় করে পড়লাম পাশের অন্য একটা ভাঙ্গা কবরে............ তাঁর ঠিক চার মাস পরে রিয়েলের বিষয় টা নজরে এলো । লোকে বলছিল, রিয়েল পাগল হয়ে গেছে । কুমিল্লা জিলা স্কুলের রিয়েল । যে স্কুলে একজন মাত্র রিয়েল পড়াশোনা করেছিল ।

কালো রোগা এক অসম্ভব পাগলা ঘোড়া । আমি বাসায় শুয়ে শুয়ে শুনলাম । আমি সারাদিন হাঁট শুঁকি । চার মাস আগের সেই পচা রক্তের গন্ধ তখনো যায়নি । সারাদিন ডিউটি করে বাসায় এসে রাত জেগে একটি মানুষ আমার সেবা করে ।

গামছা ভিজিয়ে হাঁত পায়ের তালু মুছে দেয় অবিরত । আমি ঘুমানোর চেষ্টা করি । ঘুম নাই ঘুম নাই......... ২৮ অক্টোবর ২০১৩ ইং রাত ৯ টা ৩৫ মি ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।