আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নেপালে একপাল ২

যে কাজটি পাঁচ মিনিটেই করে ফেললে ল্যাঠা চুকে যায়, সেই কাজটি করার আগে আমার ন্যূনতম পাঁচদিনের আলসেমি লাগে। এক বন্ধু বলেছিলো আমি নাকি লতিফ ভাইয়ের চেয়ে বেশি লেইটার, তাই 'লেইট লতিফ' বাদ দিয়ে 'লেইট নজরুল' চালু করার সময় এসেছে। আমি তাতে অবশ্য কোনো আপত্তি করি না। যথাসময়ে কোনো কাজ আমি করেছি, এই রেকর্ড কেউ দেখাতে পারবে না। যানবাহনের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা।

ঘরকুনো আমি যে কয়বার সময়বাঁধা প্লেন ট্রেন বাসে উঠেছি প্রতিবারই শেষ মুহূর্তের দৌড়াদৌড়িতে। সিঙ্গাপুর থেকে ফেরার পথে তো প্লেন মিস করেই ফেলেছিলাম প্রায়। সবচেয়ে বড় ঘাপলাটা হয়েছিলো একবার কোলকাতা থেকে ফেরার পথে। ভোরবেলা বাস, আমরা তিন বন্ধু। আমাকে গণপিটুনি দিয়েও অন্য দু'জন ঘুম থেকে তুলতে না পেরে স্রেফ কোলে করে বাসে নিয়ে তুলেছিলো।

আমার ঘুম ভেঙ্গেছিলো একেবারে সীমান্তে এসে!
নেপাল যাওয়ার সময়ও রাস্তায় সহযাত্রীদের ফোনের পর ফোন, এয়ারলাইন্স কর্তৃপক্ষ নাকি বলেছে সব যাত্রী আগেভাগে এলে নাকি এক ঘন্টা আগেই প্লেন ছেড়ে দেবে, আমি কেন এতো দেরি করছি? অগত্যা দৌড়ঝাঁপ করে এয়ারপোর্টে ঢুকলাম, তারপর শুধু বসে থাকা। প্রখর রৌদ্র পার হয়ে সোনালী বিকেল পার হয়ে যায়, আমরা কেবলই বসে থাকি। একবার সবাইকে দাপিয়ে নামিয়ে বাসে তুললো, তারপর সেই বাস রানওয়ের আশেপাশে কিছুক্ষণ ঘুরেফিরে দূর থেকে 'ঐ দেখা যায় তালগাছ ঐ আমাদের গাঁ' এর মতো করে ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের চেহারাসুরত দেখিয়ে আবার টার্মিনালে ফেরত নিয়ে এলো। যান্ত্রিক ত্রুটি। তারপর আবারো কেবলই বসে থাকা।

অনেকেই বলেছিলো ইউনাইটেড নাকি কখনো লেইট করে না, সিডিউল টাইম থেকে কয়েক ঘন্টা দেরিতে ছাড়ে শুধু।
আমার ধারনা ছিলো আমিই পৃথিবীর সেরা লেইটার। বুঝলাম ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের কাছে আমি রীতিমতো নস্যি! "লেইট নজরুল" এর বদলে এবার ব্যাপারটা "লেইট ইউনাইটেড" করা যেতে পারে।
কথা ছিলো নেপালে নেমে সূর্য বিদায়ের দৃশ্য দেখতে দেখতে আমরা নাগরকোট যাবো। তার বদলে আমরা টার্মিনালে বসেই ডুবি ডুবি সূর্য দেখলাম।

ক্ষুধা লেগে গেছে, কিন্তু একবার যেহেতু তিন চার কিস্তি দেহহাতানি থুক্কু তল্লাসী পার হয়ে ঢুকেছি আবার বের হবার অনুমতি নেই, এমনকি টয়লেটেও যাওয়া যাবে না! বোঝো এবার! তবু কেউ কেউ বিশেষ অনুরোধ উপরোধ করে প্রয়োজনীয় কাজ সেরে নিলো। রাহিনের মা খাবার নিয়ে এসেছিলেন, সেগুলোই ভাগাভাগি করে খেলাম আমরা কয়েকজন। নিজেরা ছাড়াও অন্য যাত্রীদের ভীড়েও কয়েকজন পরিচিত ছিলো, তাদের সঙ্গেও আড্ডা হলো। কিন্তু অপেক্ষার সময়ে আড্ডাও জমে না। বিরক্তিটাই জমে কেবল।


এরশাদ আমলে একবার সপরিবারে কুষ্টিয়া থেকে ঢাকা ফিরছিলাম। তখন যোগাযোগ ব্যবস্থার এতো উন্নতি হয়নি। সেলফোন নেই, সকালের খবরের কাগজ ঢাকার বাইরের লোকে হাতে পেতো সন্ধ্যায়, বিটিভি চালুই হতো বিকেলে। নিউজ স্ক্রল থাকার তো প্রশ্নই ওঠে না। এসব নানাবিধ কারনে আমরা কেউই জানতে পারিনি যে তিনদিনব্যাপী অবরোধ/হরতাল! কুষ্টিয়া থেকে আরিচা পর্যন্ত এসে হাজার হাজার লোক আটকে গেলাম।

বাড়ি ফেরার কোনো উপায় নেই। আর তখনকার হরতাল বেশ স্বতস্ফূর্ত হতো, মানে আমজনতা নিজেরাই পালন করতো হরতাল, পিকেটার লাগতো না। ফলে গাড়ি ঘোড়া কিছু নাই। আমরা স্থানীয় এক স্কুলে পিকনিক করে কাটিয়ে দিলাম দুদিন। এয়ারপোর্টে বসে থাকতে থাকতে ছোটবেলার সেই ঘটনাটা মনে পড়ে গিয়েছিলো।

আর মনে পড়েছিলো টম হ্যাঙ্কস এর দ্য টার্মিনাল সিনেমাটার কথা। ধরেই নিয়েছিলাম রাতটা বুঝি এখানেই কাটাতে হবে।
তারপর অবশেষে এলো সুখবর, আবারো বাসে তোলা হলো আমাদের। যদিও আমরা তখনো নিশ্চিত না প্লেন পর্যন্ত যাওয়া যাবে কি না। কিন্তু আমাদের মতো কুশিল যাত্রীদের মুখে ছাঁই দিয়ে বাস ঠিক হাজির হলো প্লেনের দরজায়।

কিন্তু এ মা... এ কী! মনে হলো যেন ঢাকা আরিচা রোডের হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্য মুড়ির টিনের দু'পাশে কেউ ডানা লটকে প্লেন বানিয়ে দিয়েছে। ছোটমোটো একটা প্লেন। কী আর করা? তাতেই চেপে বসলাম। কিন্তু হায়, আমরা না বিজনেস ক্লাসের যাত্রী? কোথায় কী? কিসের বিজনেস কিসের ইকোনোমি, সের দরে সবাই গাদাগাদি। এসি নাই, দরদর করে ঘামতে লাগলাম।

চিপাচিপি অবস্থা। ভয়াবহ। আমার জীবনে আমি খুব বেশি উড়োজাহাজে চড়িনি, কিন্তু যতটুকুই চড়েছি, এরচেয়ে বাজে যে কিছু আর সম্ভব না সেটা বুঝে গেছি। আমাদের মধ্যে এমনকি নিধিও এর আগে উড়োজাহাজে চড়েছে, শুধু আঁকাইন পলাশ ছাড়া। বেচারার এটাই প্রথম বিমান ভ্রমণ।

তার জন্য মায়াই লাগলো।
আগে জানতাম নেপাল যেতে লাগে চল্লিশ মিনিট, উঠে জানলাম এই প্লেনের যেতে লাগবে পৌনে দুই ঘন্টা! এই গরমে এই বিমানে পৌনে দুই ঘন্টা কাটানোর চেয়ে আবার টার্মিনালে ফিরে যাওয়াটা আরামের। তবু কিছু যেহেতু করার নেই চুপ করে বসে থাকলাম। যদিও অন্য দুষ্টু যাত্রীসঙ্গীরা বলাবলি করছিলো যে প্লেনে উঠেছি বলেই নেপাল যেতে পারবো সেই গ্যারান্টি নাকি নেই। দেখা যাবে একটু পরে নামিয়ে দেবে।

অথবা নেপাল পর্যন্ত যেতে পারলেও সেখান থেকে আবার ফেরত পাঠিয়ে দেবে। মুড়ির টিন কি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরনের অনুমতি পায়? যাহোক, ততক্ষণে ব্যাপক ক্ষুধা লেগেছিলো, অপেক্ষায় আছি খাবারের। সুন্দরী বিমানবালা [ঈমানবালা না কিন্তু] এসে খাবারের প্যাকেট দিয়ে গেলো, হাভাতের মতো খুলে খাদ্যের বদলে তব্দা খেতে হলো। মটরদানা, আমসত্ব, ক্যান্ডি ইত্যাদি মিলিয়ে যে খাদ্যবস্তু, সেগুলো খাওয়ার চেয়ে না খাওয়াই ভালো। আর ওয়ান টাইম ইউজের গ্লাসে দু'ফোটা চোখের জল থুক্কু খাবার পানি! কাস্টার্ড কেক আর জুসটুকুই খেলাম।

একজন হিসাব করে দেখলো বাক্সের ভেতরের খাবারের মোট মূল্য ৪৪ টাকা। এতো বদনাম করছি বলে ভাববেন না যেন ইউনাইটেড এয়ারলাইন্স এত্তোগুলা খারাপ, বিমান চলার ঘন্টাখানেক পর থেকে কিন্তু এসির সুবাতাস পেয়েছি আমরা।
যাহোক, একসময় নেপাল এয়ারপোর্ট দেখা গেলো। বিমান অবতরণ করলো। আমরা নামলাম।

নেমে দেখি এয়ারপোর্টের সব দোকানপাট বন্ধ! আমরা ক'টা মোটে যাত্রী, তাদেরই দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়িয়ে কোনোরকমে পার হতে হলো। বাইরে তখন গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি।
নেপালে আমাদের অভ্যর্থনাকারী প্রমোদ'দা দু'টো মাইক্রোবাস, একটি প্লেকার্ডে আমার নাম আর চেহারাভর্তি হাসি নিয়ে অপেক্ষা করছেন সেই বিকেল থেকে। পরদিন ধর্মীয় আচার, তবু পরিবার ফেলে দীর্ঘ অপেক্ষা। আমরা ডলার ভাঙ্গাতে পারিনি শুনে নিজের পকেট থেকে নয় হাজার নেপালী রুপি ধার দিলেন আপাতত চলার জন্য।

আর জানালেন পৃথিবী এখন নীরব হয়ে গেছে, কোথাও খাবার পাওয়া যাবে না! হোটেলে ফোন করে একটু ডাল ভাতের ব্যবস্থা করে আবারো হাসিমুখে বিদায় জানালেন। আমরা চললাম অন্ধকার পাহাড়ি রাস্তা ধরে।
উঠছি কেবল উঠছি। যতোই উপরে উঠছি উঁচু থেকে আলোকোজ্জ্বল কাঠমান্ডু শহরটাকে দেখতে ভালো লাগছিলো। ভালো লাগছিলো পাহাড়ের গায়ে জোনাক পোকার মতো জ্বলে থাকা বিন্দু বিন্দু আলোগুলো।

আমরা যাচ্ছি তো যাচ্ছি। হঠাৎ খেয়াল করলাম এই সম্পূর্ণ যাত্রায় আর কোনো ব্যক্তি বা সচল যানবাহন দেখছি না। তার মানে পৃথিবী সত্যিই ঘুমিয়ে গেছে, আমরাই কেবল যাত্রী! রাস্তার দু'পাশের সব খাবারশালা পানশালা বন্ধ। কোথাও কেউ নেই।
দীর্ঘ যাত্রা শেষে গাড়ি যখন হোটেলে পৌঁছলো তখন আমাদের ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা।

কোনোমতে দু'টো খেয়ে ঘুমাতে পারলেই বাঁচি। কিন্তু হোটেলটা দেখেই মনটা ভরে গেলো। কী সুন্দর! আমরা উঠেছিলাম নাগরকোটের হোটেল প্যারাডাইস ইন এ। এতোই ক্ষুধার্ত ছিলাম যে রুমে ঢুকে ফ্রেস হয়ে খাবো সেই ধৈর্য্য নেই। গাড়ি থেকে নেমে সোজা খাবার টেবিলে বসে গেলাম।

এলো গরম ডাল মুরগী ভাত আর হাতে বানানো রুটি। আহ্, যেন অমৃত। আক্ষরিক অর্থেই খাবারটা খুব স্বাদের ছিলো। খেয়ে দেয়ে সবাই যার যার রুমের দিকে এগুলো, আমি আর তানিম ভাই দাঁড়ালাম। এরকম পাহাড়ি দেশে এসে একটা রাত বিনা জলপানে কেটে তো যেতে পারে না তাই না? কিছুমিছু একটা ব্যবস্থা করে রুমে ফিরলাম।


হোটেলটা আসলেই সুন্দর। মূল ক্যাম্পাসে রেস্টুরেন্ট আর অফিস। তিনপাশে পাহাড়ের গায়ে গায়ে তিনটি হোটেল ভবন। আর তেমন বেশি গেস্ট নেই। যারাও আছে তারা ততক্ষণে ঘুমিয়ে গেছে।

নির্জনতাটা দারুণ উপভোগ্য ছিলো। তারপর জলীয় আড্ডা। তারপর ঘুম। তখনো জানতাম না বিশ্রী একটি দিনের পরে ভোরটা এতো অসম্ভব সুন্দর হতে পারে। নতুন ভোরের গল্প হবে পরের পর্বে।


সোর্স: http://www.sachalayatan.com/     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।