আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমার বৃহস্পতি : এক

আগ্রহ মোর অধীর অতি— কোথা সে রমণী বীর্যবতী । কোষবিমুক্ত কৃপাণলতা — দারুণ সে , সুন্দর সে উদ্যত বজ্রের রুদ্ররসে , নহে সে ভোগীর লোচনলোভা , ক্ষত্রিয়বাহুর ভীষণ শোভা।

হয়তো হাজার কাজের মাঝে, হাজার কথার মাঝে এই ছোট্ট এবং অতি সাধারণ কথাটিই বলা হয়ে ওঠেনা তোমাকে। তুমি হয়তো আশা করে থাক, আমার মুখ থেকে কথাটা শুনবে বলে। আমি ও বলি বলি করে বলে উঠতে পারিনা।

কি করবো বল, ভুলো মন আমার। পুরো রাস্তা মনে করতে করতে বাসায় আসি, এসেই তুমি যখন দরজা খুলে দিবে, সাথে সাথেই কথাটা বলব তোমাকে। কি যে হয় আমার, সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে উঠতে মনে পড়ে, তুমি পেয়াজ আনতে বলেছিলে। আম্মা, বাবা জর্দা আনতে বলেছিল। আপা আবার ফোন করে বলল- দাদা, ১ লিটার আইচক্রিম আনিসতো।

ফালুদা রান্না করলাম। রাতে সবাই মিলে খাব বলে। কিন্তু দেখি ফ্রিজে আইচক্রিম নাই। আনিস কিন্তু, ভুলে যাস না আবার। তোর যা ভুলো মন।

আমি সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠি আর মিলাতে থাকি, কারও কোন খরচ বাকি আছে কিনা। অথচ মনের মানুষের জন্য ছোট্ট একটা কথা খরিদ করতেই যে ভুলে গেছি, সেটাই মনে থাকেনা আমার। প্রুতিদিন যা হয়, আজও তাই হল। দরজা খুলল কাজের মেয়েটা। মনটা হালকা খারাপ হল।

তুমি তো বুঝতেই পেরেছো আমি এসেছি। তাহলে দরজা খুলতে এলে না কেন? তাহলে কি তোমার কথাটা শোনার ইচ্ছে নেই? আমি কত কষ্টে মনে করতে করতে আসলাম, তুমি দরজা খোলার সাথে সাথেই তোমাকে কথাটা বলব, কিন্তু সেই তোমারই দেখা নাই। আমি কি এই মেয়েটাকে এখন কথাটা বলব? মেয়েটার হাতে বাজারের ব্যাগটা ধরিয়ে দিয়ে আমি সোফায় বসে টিভিটা অন করলাম। খুব ইচ্ছে করছে সরাসরি পাকের ঘরে তোমার কাছে চলে যাই। পিছন থেকে তোমাকে জরিয়ে ধরে ফিসফিস করে কথাটা বলি।

কিন্তু আম্মা তোমার সাথে পাক করছে। কিভাবে যাই বল? আমার বুঝি একটুও লজ্জা নাই! এমনিতেই মনটা খারাপ, তার উপর তুমি এসে আমাকে ঝাড়ি লাগালে কেন আমি জুতা পায়ে পাপসের উপর উঠেছি। কেন অফিস থেকে এসে এখনও হাতমুখ ধুইনি। কার মেজাজ ঠিক থাকে তুমিই বল? আমি রেগে সামনের ফ্লাটে আপার কাছে চলে গেলাম। ইচ্ছে হল যাওয়ার সময় কথাটা তোমাকে বলে যাই।

কিন্তু খেয়াল করলাম, তোমার চোখে আমার জন্য সামান্য মায়াও নাই। রেগে অগ্নিশর্মা হয়ে আছো তুমি। কিসের এতো রাগ তোমার আমার উপর হ্যাঁ? আপার ফ্লাটের দরজা নক করে দাড়িয়ে আছি। কেউ খুলছেনা। মেজাজ খিটমিটে হয়ে উঠছে।

আমি মনে মনে বলছি, আজ কোন ভাবেই রাগ করা যাবেনা। ওকে কথাটা বলতেই হবে। যে ভাবেই হোক। দরজা খুললেন দুলাভাই। দরজা খুলেই আমার দিকে তাকিয়ে হাঁসি মুখে বললেন- ভাইরে ভিতরে না আসলেই কি নয়।

তোর আপার মাথা খারাপ হয়ে আছে। আমাকে আইচক্রিম আনতে বলেছিল। ভুলে গেছি। তুই তুকারি শুরু করেছে আমার সাথে। অপমানের চরম পর্যায়।

ছেলে মেয়েরা আমার দিকে তাকিয়ে মিটি মিটি হাসছে। তুই আমার ছোট ভাই, তোর সামনে অপমান করলে গায়ে লাগবে। আমি দুলাভাইকে পাত্তা না দিয়ে ভিতরে গেলাম। যেতে যেতে বললাম- যান, আপনার শাশুড়ি আপনাকে পেঁয়াজি খাওয়ার জন্য ডাকে। দুলাভাই যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেলেন।

ছুটে গেলেন আমাদের ফ্লাটে। আমি আপাকে আইচক্রিম দিতে দিতে একটা ঝাড়ি দিলাম। বললাম- সহজ মানুষকে জ্বালিয়ে কি লাভ? এই নে তোর আইচক্রিম। আপা আইচক্রিম ফ্রিজে ঢুকাতে ঢুকাতে বলল-সহজ সরল না বদের হাড্ডি। আমি আপার পাঁশে গিয়ে দাড়িয়ে কাচুমাচু করে বললাম-আপা, আমি ওকে একটা কথা বলতে চাচ্ছিলাম, কিন্তু সুযোগ পাচ্ছিনা।

একটু ডেকে দিবি? আপা আমার দিকে না তাকিয়ে বলল-কথাটা কি? আমি অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকলাম। তারপর মাথা নিচু করে বললাম- বলা যাবে না। ওকেই বলতে হবে। আপা কোন কথা না বলে কিসের যেন একটা প্যাকেট হাতে নিয়ে আমাদের ফ্লাটের দিকে হেঁটে চলে যেতে থাকল। আমি পিছন থেকে ডাক দিয়ে বললাম- আপা, একটু তাড়াতাড়ি।

প্রায় ত্রিশ মিনিট হয়ে গেলো, আপার ও খোঁজ নাই, ওর ও খোঁজ নাই। আমি কি করবো ভেবে পেলামনা। রাগে আমার গা কিড়মিড় করতে লাগলো। আমি আর দেরি না করে আমাদের ফ্লাটে চলে আসলাম। যেহেতু আমরা আর আপা সামনা সামনি ফ্লাটে থাকি, সেহেতু একবার দুই ফ্লাটের দরজা খোলা হলে, রাতে ঘুমানোর আগ পর্যন্ত আর বন্ধ হয়না।

আমি ফ্লাটে ধুকে দেখি, আব্বা-আম্মা, আপা-দুলাভাই আর ও, বসে সেই হাসা হাঁসি করছে আর পেঁয়াজি খাচ্ছে। আমাকে দেখে আম্মা বললেন- কিরে বাবু, কই গেছিলি? আয় পেঁয়াজি খা। আমি মনে মনে বললাম-এই সুযোগ। তোমার পাঁশে বসে পেঁয়াজি খাবার ফাঁকে তোমার কানে কানে কথাটা বলব। আমি হাঁসি মুখে পেঁয়াজি খাবার জন্যে এগুতেই তুমি বলে উঠলে- আম্মা দেখেন, অফিস থেকে এসে এখনও জুতা খুলে নাই, হাতমুখ ধোয়নাই।

আর আপনি ওকে খাবার জন্যে ডাকতেছেন? এই তুমি এই দিকে আসবা না। যাও আগে ফ্রেশ হও। আমার মনটা এতো খারাপ হল, ইচ্ছে করছে, মুজা গুলো খুলে তোমার নাকে চেপে ধরে থাকি। হুহ!! বাথরুমে অনেকক্ষণ ধরে মুখে পানি দিলাম। ঠাণ্ডা পানির ছটায় গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠেছে।

শেভ করা আছে, তারপরও আবার শেভ করলাম। আফটার শেভ লাগিয়ে খেয়াল করলাম, আয়নায় তোমার একটা টিপ লেগে আছে। আমি নিজের অজান্তেই টিপটাতে হাত বুলালাম। কি যেন একটা অনুভুতি আমার রক্তে খেলা করে গেলো। মনে হল হৃৎপিণ্ড সারা শরীরের সব রক্ত শুষে নিয়েছে।

একটা ভালো লাগা অনুভুতি নিয়ে দরজা খুললাম বের হওয়ার জন্য। দরজা খুলেই দেখি টাওয়াল হাতে তুমি হাসি মুখে দাড়িয়ে আছো। আমার সারা দিনের সব বিষাদ কেটে গেলো একনিমিশেই। আমি টাওয়াল নেয়ার জন্যে হাত বাড়িয়ে তোমাকে কথাটা বলতে গেলাম, আর ওমনি তুমি বলে উঠলে- এটা নিচ্ছ কেন? আমি কি তোমার জন্যে টাওয়াল হাতে দাড়িয়ে আছি? সরো, আমি ঢুকব। মনটা এতো পরিমানে খারাপ হল, কি বলব।

তুমি টাওয়াল হাতে দাড়িয়ে নাই, সে জন্য না। আবার তোমাকে কথাটা বলতে পারলাম না, সেই জন্যে। আমি চলে গেলাম আম্মাদের সাথে পেঁয়াজি খাওয়ার জন্যে। রাত এগারোটা বিশ। খেতে বসেই মনটা ভালো হয়ে গেলো।

আম্মা আমার পছন্দের তরকারি পাক করেছেন। আলু মোটা করে লম্বালম্বি ভাবে কেটে করল্লা ভাঁজি আর মুসুরের পাতলা ডাল। সাথে পোড়া বেগুনের ভর্তা। তোমার আসতেদেরি হচ্ছে দেখে আমি তারাহুড়া করে প্লেটে ভাত নিয়ে খেতে শুরু করলাম। এক লোকমা ভাত মুখে দিয়েছি, তখন আম্মা বলল উঠলেন- বাবু এইটা তোর ধর্মরে? তোর সাথে খাবে বলে বউটা বিকাল থেকে কিছু মুখে দেয়নাই।

আর তুই ওকে ছাড়াই খাওয়া শুরু করলি? আমি যেন আকাশ থেকে পড়লাম। সাথে সাথে কান্না চলে আসলো আমার। আমি কি করবো বুঝে উঠতে পারলাম না। প্লেট ছেড়ে উঠতে যাচ্ছি, এমন সময় দেখি তুমি আসছ। আমি আর উঠতে পারলাম না।

তুমি এসে আমার পাশের চেয়ারে বসে হাঁসি মুখে খাওয়া শুরু করলে। যেন কিছুই হয়নি এমন একটা ভাব। আমি মন খারাপ করে অনেক কষ্টে খাওয়া শেষ করলাম। খাওয়ার সময় বারবার পানি খেলাম, কিন্তু গলার মাঝামাঝি কি যেন একটা লেগে ছিল, সেটা সরাতেই পারলাম না। খাওয়া শেষের দিকে তোমার কানের কাছে মুখ নিয়ে গেলাম, কথাটা বলব বলে।

কিন্তু গলা দিয়ে কোন কথা বের হলই না। আমি কিছু না বলেই হাত ধোয়ার জন্য উঠে গেলাম। খাওয়া শেষে বারান্দায় বসে তুমি আর আমি চা খাচ্ছিলাম। তোমার আমার পছন্দের সেই সাদা মগে করে। বারান্দা অন্ধকার।

রাস্তার ল্যাম্প পোষ্টের হালকা আলো এসে পড়েছে বারান্দাটাতে। মনে হচ্ছে চাঁদের আলো। তুমি কোন কথা বললেনা। আমি শুধু তোমাকে দেখেই গেলাম। কথাটা বলার এখন ই উত্তম সময়।

এই বলব, এই বলব করছি। কিন্তু সেই ক্রিত্তিম চাঁদের আলো তোমার চেহারায় যে মোহের সৃষ্টি করেছে, আমি সেই মোহ থেকে বের হতেই পারলাম না। অপলক দৃষ্টিতে তোমাকে শুধু দেখেই গেলাম, আর দেখেই গেলাম। ঠিক যখন কথাটা বলব বলে চায়ের মগটা হাত থেকে নামিয়ে সোজা হয়ে বসলাম, ঠিক তখনি তুমি হুট করে শোবার ঘরে চলে গেলে। আমি তাকিয়ে তাকিয়ে তোমার যাওয়া দেখলাম।

তুমি যাওয়ার পরও আমি অনেকক্ষণ বারান্দায় বসে থাকলাম। তোমার ঘুমানোর জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। কারন তোমার ভালবাসার যোগ্য আমি নই, তাই তোমার চোখে চোখ রাখার ক্ষমতাও আমার নেই। প্রায় ত্রিশ মিনিট পরে আমি ঘরে গেলাম। বাতি জ্বালালাম আস্তে করে।

মেইন দরজা লাগানো আছে কিনা, তা দেখে আসলাম। ভিটামিন বি-কমপ্লেক্স খেলাম একটা। তারপর একগ্লাস পানি খেয়ে শুয়ে পড়লাম। তুমি তখন বলে উঠলে, এসি টা কমিয়ে দাও। আমি এসি কমালাম।

তারপর হাজার সাহস যুগিয়ে তোমাকে কথাটা বলতে গেলাম। এখন আর বাঁধা দেয়ার কেউ নাই কথাটা বলার মাঝে। তুমি ও না শুনে কথাও যেতে পারবে না। বেস্ত হয়ে পড়তে পারবেনা সংসারের কোন কাজ নিয়ে। ঠিক তখনি মনে হল- সব কথা কি মুখ ফুটে বলার দরকার আছে? থাকুক না কিছু কথা তোলা।

সে কথা মুখে নয়, চোখের ভাষায় না হয় বুঝে নিলে। তোমার পাঁশে শুয়ে, গায়ে একটা হাত তুলে দিয়েই আতকে উঠলাম আমি। একি তুমি কাঁদছ? খেয়াল করলাম তুমি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছ। ইস, যদি আমার না বলতে পারা কথাটা তোমাকে বলতাম, তাহলে তুমি হয়তো কান্না করতে না। বিষাদে ভরে গেলো আমার দেহ, আত্তা, মন।

আমি পাহাড় সমান অপরাধ বোধ নিয়ে চোখ বন্ধ করলাম। আস্তে আস্তে ঘুমের সাগরে তলিয়ে যেতে থাকলাম আমি, আর আনুভব করতে লাগলাম সেই অপার্থিব জগতে তোমার উপস্থিতি। আহারে ভালোবাসা, আহারে প্রেম।


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.