আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

রসিক সুজন হুমায়ূন

ব্যক্তি হুমায়ূনও রঙ্গরস প্রিয় রসিক মানুষ। এ বিশেষ গুণটির উৎস খুঁজতে হলে অবশ্যই তার পিতার দিকে চোখ ফেরাতে হবে। শহীদ ফয়জুর রহমান আহমেদকে বলা হয় খেয়ালি মানুষ। একই সঙ্গে তিনি ছিলেন খুবই সুরসিক। হুমায়ূনের স্মৃতিচারণমূলক লেখাতেই তার নজির আছে।

পিতার এ গুণটি তার সন্তানদের সবার ওপর কমবেশি বর্তেছে। হুমায়ূন গল্প-উপন্যাস, নাটক-সিনেমায় তা মূর্ত করে রেখেছেন। আমরা যারা তার সানি্নধ্যে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছি, উপভোগ করেছি মন ভরে। ব্যক্তিজীবনে হুমায়ূন প্রকৃত অর্থেই ছিলেন অনন্য রসিক-সুজন।

হুমায়ূন দলবল নিয়ে চলতে এবং অবসর সময়ে বন্ধুবান্ধব নিয়ে আসর জমাতে ভালোবাসতেন।

এসব আসর প্রাণবন্ত করে তুলতেন রঙ্গ-রসিকতায়। গুরু-গম্ভীর বিষয় অধ্যয়নের পাশাপাশি হালকা হাসির গল্প বা চুটকি জাতীয় বই পড়তেও তার আলস্য ছিল না। বন্ধুমহলে নিজের তৈরি চুটকির সঙ্গে অধিত গল্পও পরিবেশন করতেন। তবে তার সবই নিজের মনের রসে জড়িয়ে নিয়ে নিজের মতো করেই পরিবেশন করতেন। কখনো বাইরের মনে হতো না।

টক-ঝাল-মিষ্টি এ তিন রস মিশিয়েই তো তৈরি হয় রসিকতা। এই মিশ্রণে মাত্রায় তারতম্য অনেক সময় অন্যের জন্য বিব্রতকর হয়ে ওঠে। আড্ডায় রসিকতা সৃষ্টির ক্ষেত্রে অনেক সময় কোনো একজন বা একাধিক জনকে উপলক্ষ করে নেওয়া হয়। নিতে হয়। হুমায়ূনও তা করতেন।

আমাকেই যে রেহাই দিতেন, তাও না। ডাকতেন তো নানাজি, তাই আমাকে লক্ষ্য করে নেওয়ার সুবিধাও তার ছিল। মাঝে-মধ্যে বিব্রত হলেও ব্যাপারটা উপভোগ করতাম।

বিদেশি গল্পকে কেমনভাবে কাজে খাটিয়ে নিতেন তার একটা নমুনা দিই। এক সময় ছবি আঁকার প্রতি ঝোঁক ছিল।

খেয়াল চাপলে অনেকের পার্শ্ব প্রতিকৃতি দ্রুত আঁচড়ে এঁকে নিতে চেষ্টা করতাম। আদলটা অন্তত অনেক সময়ই এসে যেত। বইমেলায় সব্যসাচী স্টলে আড্ডা দিচ্ছিলাম। এক সময় সস্ত্রীক রফিক আজাদ হাজির হলেন। আমার ঝোঁক চাপল তার ছবি আঁকি।

কাগজ-কলম সঙ্গেই ছিল। আমি আঁকতে উদ্যত হলাম।

হুমায়ূন হাতের ইশারায় আমাকে থামিয়ে দিয়ে রফিক আজাদকে লক্ষ্য করে বলে উঠলেন, 'কবি, নানাজি আপনার ছবি আঁকতে যাচ্ছেন। আপনার জেনে রাখা দরকার, উনি মন্দ আঁকেন না। তবে যাদের ছবি উনি আঁকেন তারা কিছু দিনের মধ্যেই মারা যান।

'

কবি দম্পতি সবে বসতে যাচ্ছিলেন। হুমায়ূনের কথা শেষ হতেই কবির স্ত্রী স্বামীর হাত আঁকড়ে ধরে দ্রুত ওখান থেকে প্রস্থান করলেন। অন্যরা হাসিতে ফেটে পড়লেন। আমি বিব্রত।

এখন হয়েছে কী, একটা বিদেশি ভৌতিক গল্প পড়েছিলাম- একজন চিত্রকর যাদের ছবি আঁকেন তারা অচিরেই মারা যায়।

কিংবা চিত্রকর তাদেরই ছবি আঁকেন যাদের মৃত্যু আসন্ন। চমৎকার গল্প। গল্পটা হয়তো হুমায়ূনের পড়া ছিল। রস সৃষ্টির উপলক্ষে ভৌতিক গল্পকে হাসির উপাদান করে নিলেন। এ অস্ত্র আমার ওপর অনেকবারই প্রয়োগ করেছেন।

রবীন্দ্রনাথেই সম্ভবত একটা সরস মন্তব্য দেখেছিলাম, বটগাছই হচ্ছে সবচেয়ে বড় রসিক, কেননা বট ইট-পাথর থেকেও রস সংগ্রহ করতে পারে। রসিক হুমায়ূন তেমনি ভৌমিক গল্প দিয়ে হাসির গল্প তৈরি করে নিতে পারতেন। যৌনতাকে বলা হয় আদি রস। আদি রস বাদ দিয়ে বন্ধু-মজলিস জমে না। হুমায়ূনও আড্ডা বুঝে এ রসের আমদানি ঘটাতে ছিলেন পারঙ্গম।

লেখালেখিতে সুকৌশলে তা এড়িয়ে যেতেন। জানতেন, কোন লেখা কার হাতে পড়ে তার তো স্থিরতা নেই। তবে এসব রসিকতা ছড়াতেন মূলত তার ভাষায় 'ওল্ড ফুলস ক্লাব'-এর বৈঠকে। এ ক্ষেত্রে হুমায়ূন কতটা খুঁতখুঁতে ছিলেন, তার একটা নজির দিই। ব্রিটেনের এককালীন প্রধানমন্ত্রী ডিজরেলি যখন প্রথম সাংসদ হলেন তখনো বক্তৃতাবাজিতে তেমন পরামঙ্গম ছিলেন না।

পার্লামেন্টে প্রথম ভাষণ দিতে উঠে 'আই কনসিভ... আই কনসিভ... আই কনসিভ' বলতে বলতে থেমে গেলেন। কনসিভ শব্দটির তো অন্য অর্থও আছে। একজন মহিলা সদস্য সে সুযোগে ছিলেন। ত্বরিত বলে উঠলেন 'মি. ডিজরেলি তিনবার কনসিভ করেও কিছু উৎপাদন করতে পারলেন না। আমি একবার কনসিভ করলেই অন্তত একটা সন্তান জন্ম দিতাম।

'

খাদ্যরসিক হিসেবেও হুমায়ূনের নাম বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে। খাওয়া আর খাওয়ানো দুটোতেই ছিলেন সমান উৎসাহী। রঙ্গ-রসিকতায়ও খাওয়া-খাদ্যের ব্যবহার বাদ দেননি। অনেকে লক্ষ্য করে থাকবেন প্রথম দিককার কিছু কিছু লেখায় বেশ গম্ভীর চালেই লিখে দিয়েছেন বিয়ের ভোজের আসরে টেবিলের কোন দিকটায় কয়টা আসন ছেড়ে বসলে খাবার ভালো পাওয়া যাবে কিংবা দিয়ে গেছেন কিছু উদ্ভট রন্ধন-প্রণালি। হুমায়ূন কাজটা করতেন রসিকতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে।

আর অনুরক্ত পাঠকদের অনেকে তা অনুসরণ করতে গিয়ে নাজেহাল হতেন। হুমায়ূন তাই এ অভ্যাস ত্যাগ করেন। তবে খাওয়া-খাদ্য নিয়ে রসিকতায় ক্ষান্ত দেননি।

বন্ধু আসাদুজ্জামান নূর দেশ টিভি চালু করলেন। ঠিক করলেন পহেলা বৈশাখে শাওনের একটি একক গানের অনুষ্ঠান প্রচার করবেন।

অনুষ্ঠানটি ধারণ করা হবে নুহাশ পল্লীতে। হুমায়ূন অনুষ্ঠানের দুই দিন আগেই ওখানে যাওয়ার ডাক দিলেন। ওই দিন আমার পক্ষে যাওয়া সম্ভব ছিল না। জানালাম পরদিন সকালেই আসছি। নির্ধারিত সকালেও যাওয়া হয়নি।

গেলাম সন্ধ্যায়। রাতে খাওয়ার বেলা দেখলাম ঢালাও আয়োজন। সেই সঙ্গে আছে দুপুরের বাসি পোলাও। হুমায়ূন উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন- ওহ বাসি পোলাও! এর সঙ্গে রসুন-মরিচের ভর্তা হলে যা জমে। দীর্ঘ ব্যাখ্যা জুড়লেন- 'গ্রামের গরিবরা এক সময় মাছটাছ জোটাতে পারত না।

মরিচ আর রসুন একসঙ্গে পিষে ভর্তা বানিয়ে তাই দিয়ে ভাত খেত। এ বস্তুটি আমার খুবই প্রিয়। বিশেষ করে বাসি পোলাওয়ের সঙ্গে আর জুড়ি নাই। ইত্যাদি। '

নন্দিত কথাকার এমনভাবে কথার জাল ছড়ালেন যে, আমি তাতে আটকা পড়লাম।

নুহাশ পল্লীতে মাছ-গোশত যতই থাক নানা পদের ভর্তা থাকা ছিল বাধ্যতামূলক। আমি বাসি পোলাও আর মরিচ ভর্তা টেনে নিলাম। ফলাফল অবর্ণনীয়। পরবর্তী দিনটা উপোষ দিয়ে সন্ধ্যায় বাসায় ফিরতে পেরে ভাগ্য মেনেছিলাম। একের কৌতুক অন্যের জন্য প্রাণন্তকর হয়ে উঠতে পারে এ কেবল ঈশপের গল্পেরই নয়, জীবন সত্যও বটে!।

কৌতুক রসে মেতে উঠলে হুমায়ূন এ সীমা কখনো-সখনো ছাড়িয়ে যেতেন।

একবার একদল বন্ধু নিয়ে গেছেন সেন্টমার্টিন। রাতের বেলাভূমিতে আসর যখন জমে উঠেছে লক্ষ্য করলেন বন্ধুদের একজন নেই। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, তিনি সমুদ্রবিলাসে ফিরে ঘুমিয়ে গেছেন। পরিবেশের প্রভাবে হুমায়ূন তখন লাগাম ছাড়া।

সঙ্গীদের অপর একজনকে নির্দেশ দিলেন, 'নিজাম্বু'তে ঘুমন্ত বন্ধুকে নাইয়ে দিতে। হুমায়ূনের নির্দেশ বলে কথা। সঙ্গে সঙ্গেই তা পালিত হয়ে তুলকালাম বাধিয়ে তুলল। আমি সফরসঙ্গী ছিলাম না। ফিরে আসার পর এক সন্ধ্যায় হুমায়ূনের বাসায় গিয়ে দেখি বন্ধুদের অনেকেই হাজির।

হুমায়ূন বললেন, মজা আছে। যাবেন না। মজাটা কী একটু পরে হুমায়ূনই ব্যাখ্যা করলেন। বললেন, সেন্টমার্টিনে হানিফ-খ্যাত অভিনেতা মোজাম্মেল হোসেনকে পুরস্কৃত করবেন বলে কথা দিয়েছিলেন। এবার সে পুরস্কারই দেওয়া হবে।

বের করলেন একটা ক্রেস্ট। ওতে মোজাম্মেল সাহেবের নামের সঙ্গে 'মোতন-শ্রেষ্ঠ' বা ওই জাতীয় একটি বিশেষণ যুক্ত হয়েছে।

মোজাম্মেল তখন ওর এমনই অনুরক্ত যে, হুমায়ূনের একটা লেখায় দেখেছি বলছেন, আমি যদি জাহান্নামে রওনা দিই একজন অন্তত নির্দ্বিধায় আমার সঙ্গী হবেন। আর তিনি হচ্ছেন মোজাম্মেল হোসেন। এরপর অবশ্য বলার অপেক্ষা রাখে না, ক্রেস্টটি তিনি হাসিমুখে শ্রদ্ধার ভাব দেখিয়েই গ্রহণ করেছিলেন! এসব কড়া পাকের রসিকতা অবশ্যি ছিল বিরল ঘটনা।

তার রস-রসিকতায় ঋদ্ধ মননের প্রভাবই ছিল বড়। তাবত সৃষ্টিকর্মে যার পরিচয় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে!

 

 

সোর্স: http://www.bd-pratidin.com/

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।