আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সর্বদলীয় সরকারে সাংবিধানিক বিপত্তি

গত ২০ নভেম্বর থেকে সম্পূর্ণ অবৈধ ও অসাংবিধানিকভাবে দেশ শাসন করছে 'সর্বদলীয় সরকার'। সেই দিন নবম সংসদের শেষ অধিবেশনের সমাপনী ভাষণে প্রধানমন্ত্রী সংসদে ঘোষণা দিয়েছেন, রাষ্ট্রপতি তাকে নির্বাচনকালীন সরকার পরিচালনার অনুমতি দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী আরও বলেছেন, রাষ্ট্রপতির পরামর্শেই তিনি ছোট পরিসরের নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করেছেন এবং এ সরকার শুধু রুটিন কাজ করবে। প্রধানমন্ত্রীর এ ঘোষণায় আমরা স্পষ্টভাবে জানলাম, দেশে একটি নির্বাচনকালীন সরকার গঠিত হয়েছে, যা পরবর্তী নির্বাচনের মধ্যবর্তী সময়ের জন্য গঠিত একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এ সরকারের প্রধান কাজ হবে দৈনন্দিন রুটিন কাজ করা।

কিন্তু আমাদের সংবিধান মোতাবেক এ সরকার গঠন এবং এরূপ সরকার চালানোর অনুমতি প্রদানের বিষয়টি অবশ্যই সাংবিধানিক প্রক্রিয়ায় সম্পন্ন করতে হবে। এরূপ সরকার গঠনের আগে প্রধানমন্ত্রীসহ পুরো সরকারের অবশ্যই পদত্যাগ করতে হবে। পূর্ববর্তী প্রধানমন্ত্রীকে কাজ চালিয়ে যাওয়ার অনুমতির গেজেট নোটিফিকেশনও লাগবে। কিন্তু রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীকে কখন, কীভাবে, কোন প্রক্রিয়ায় এরকম অনুমতি দিলেন কিংবা পূর্ববর্তী সরকারইবা কখন পদত্যাগ করল তা আমরা কেউ অদ্যাবধি জানতেই পারলাম না।

রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীকে সরকার পরিচালনার অনুমতিদানের বিধানটি আমাদের সংবিধানের ৫৭(৩) এবং ৫৮(৪) অনুচ্ছেদে বলা আছে।

কিন্তু এই অনুচ্ছেদে এটাকে প্রযোজ্য করতে হলে আবশ্যকীয় শর্ত 'প্রধানমন্ত্রীর পদ শূন্য হইবে' অবস্থার প্রেক্ষিত অবশ্যই সৃষ্টি হতে হবে। কেননা প্রধানমন্ত্রীর পদ শূন্য হওয়া ব্যতীত এই বিধানের সুবিধা নেওয়া যাবে না। অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রীর উত্তরাধিকারী কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত তিনি কাজ চালিয়ে যেতে পারবেন বলে যে সুবিধা দেওয়া আছে তা পেতে হলে তার আগে তাকে পদত্যাগ করতে হবে। কিন্তু আমরা প্রধানমন্ত্রীর কোনো পদত্যাগপত্র বা তার পুরো সরকারের বহাল না থাকার কোনো অফিসিয়াল কাগজপত্র অদ্যাবধি চোখে দেখিনি।

তা ছাড়া রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে প্রধানমন্ত্রীর সরকার পরিচালনার অনুমতিটি সংবিধানের ৫৫(৫) অনুচ্ছেদ মতে অবশ্যই 'সত্যায়িত বা প্রমাণীকৃত' হতে হবে।

এ অনুমতিপত্র অবশ্যই এই অনুচ্ছেদে বর্ণিত বিধি দ্বারা নির্ধারিত হতে হবে। কারণ এ ধরনের কোনো অন্তর্বর্তী বা নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের অনুমতির বিষয়টি শুধু ব্যক্তিগত যোগাযোগের নিছক কোনো বিষয় নয়। এটা সাংবিধানিক সরকার গঠনের আইনি বাধ্যবাধক বিধান বটে। সে কারণেই রাষ্ট্রপতির নামে যে কোনো আদেশকে অবশ্যই সংবিধানের ৫৫(৫) অনুচ্ছেদ মতে 'সত্যায়িত বা প্রমাণীকৃত' হতে হবে বলে সংবিধানে বাধ্যবাধকতা প্রদান করা হয়েছে। ২০ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী সংসদে বলেন, রাষ্ট্রপতি তাকে নির্বাচনকালীন সরকার পরিচালনার অনুমতি দিয়েছেন।

কিন্তু প্রধানমন্ত্রী তার দুই দিন আগে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে বঙ্গভবনে সাক্ষাৎ করেন। তাহলে ধরে নেওয়া যায়, দুই দিন আগেই বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি তাকে নির্বাচনকালীন সরকার পরিচালনার অনুমতি দিয়েছেন। প্রশ্ন ওঠে, নতুন সরকার গঠনের এত বড় সাংবিধানিক ঘটনাটি সেদিন সরকারের তরফ থেকে কিংবা বঙ্গভবন থেকে জানানো হলো না কেন? এ সাক্ষাতের ঠিক পরদিন বিকালে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে বঙ্গভবনে সাক্ষাৎ করে নির্বাচন কমিশনের পুরো টিম। সেদিনও নির্বাচন কমিশনের মতো একমাত্র নির্বাচনী সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানকে এ কথাটি জানানো হলো না কেন? আরও আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, তার ঘণ্টা দুয়েক পর বিরোধীদলীয় নেতাসহ পুরো ১৮ দলের শীর্ষ নেতারা নির্বাচনী সরকারেরই এজেন্ডা নিয়ে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে বঙ্গভবনে সাক্ষাৎ করে সরকারের কাছে লিখিত দাবিনামা পেঁৗছানোর অনুরোধ করেন। অথচ মহামান্য রাষ্ট্রপতি তখনো জানেন না, তিনি নিজেই একদিন আগে প্রধানমন্ত্রীকে নির্বাচনকালীন সরকার পরিচালনার অনুমতি দিয়ে রেখেছেন!

আশ্চর্য বটে! বিগত কয়েক দিনে রাষ্ট্রপতির কার্যালয় থেকে একাধিক প্রেস রিলিজ ও বক্তব্য দেওয়া হয়েছে।

কিন্তু কোথাও নির্বাচনকালীন সরকার পরিচালনার অনুমতি প্রদানের কোনো প্রেস ব্রিফিং বা প্রেস রিলিজ বা কোনো গেজেট নোটিফিকেশন বা কোনো প্রজ্ঞাপন আজ অবধি আমরা দেখতে পেলাম না। এমনকি পূর্ববর্তী প্রধানমন্ত্রী ও তার মন্ত্রিসভার কোনো পদত্যাগপত্র বা তাদের সংবিধান মোতাবেক স্বীয় পদে বহাল না থাকার কোনো প্রমাণপত্রও আমরা পেলাম না। নির্বাচনকালীন সরকার পরিচালনার অনুমতি প্রাপ্তির ক্ষেত্রটি যেমন অদৃশ্য, তেমনি সংশ্লিষ্টদের স্বপদে বহাল না থাকার প্রমাণপত্রও অদৃশ্যই রয়ে গেল।

বিরুদ্ধ মতবাদীরা হয়তো এটা বলতে পারেন, সংবিধান মতে রাষ্ট্রপতি তার সব কাজ প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে যেহেতু করেন তাই এক্ষেত্রে এরূপ অনুমতি প্রদানের বিষয়টিকে চ্যালেঞ্জ করা যাবে না। এর উত্তরটি আগেই বলে দেওয়ার জন্য আমি এ প্রশ্নটি উত্থাপন করলাম।

উত্তরটি হলো, আমাদের সংবিধানের ৪৮(৩) অনুচ্ছেদ মতে কেবল প্রধানমন্ত্রী ও বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্র ব্যতীত রাষ্ট্রপতি তার সব কাজ প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে করবেন। অর্থাৎ অন্তর্বর্তী বা নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী নিয়োগের বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ নিয়ে করার বিধান নেই।

'সর্বদলীয় সরকারের' ২৮ জন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর নিয়োগের বিষয়টি নিয়েও বড় ধরনের সাংবিধানিক সমস্যা রয়েছে। কেননা বিশ্বের কোনো সংসদীয় গণতন্ত্রের দেশেই 'সর্বদলীয়' বা 'বহুদলীয়' সরকার গঠনের কোনো নজির নেই। আমাদের সংবিধানে 'নির্বাচনী' সরকারের যে ধারণা বিদ্যমান আছে তাতে প্রধানমন্ত্রীর অধীনে স্বরাষ্ট্র, আইন, বিচার, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় অর্থাৎ সর্বশক্তিতে বলীয়ান একজনের হাতে নিরপেক্ষ কোনো নির্বাচন অনুষ্ঠান করা নির্বাচন কমিশনের অস্তিত্বকে সরাসরি চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দেবে।

তা ছাড়া প্রধানমন্ত্রীর কাছে পদত্যাগপত্র দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সাংবিধানিকভাবে ১১ নভেম্বর থেকে মন্ত্রীদের সবার অর্থাৎ পুরো ক্যাবিনেটের পদ শূন্য হয়ে গেছে। তাই সংবিধান অনুযায়ী পদত্যাগ করার পর পদত্যাগী কোনো মন্ত্রীর মন্ত্রিত্ব পেতে হলে তাকে আবার সংবিধানের ১৪৮ অনুচ্ছেদের আওতায় নতুন করে শপথ নিতে হবে ও শপথে স্বাক্ষর দিতে হবে। তাই পদত্যাগী মন্ত্রীদের নতুন করে শপথ না পড়িয়ে পুরনো ২০ জন পদত্যাগী সাবেক মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর নিয়োগের বিষয়টি সম্পূর্ণ অসাংবিধানিক ও অবৈধ।

সর্বদলীয় সরকারের ১০ জনের উপদেষ্টামণ্ডলী যেন 'বারো হাত কাঁকুড়ের তের হাত বিচি'! কেননা ২৮ জন মন্ত্রিসভায় ১০ জন অনির্বাচিত উপদেষ্টা সংবিধান মতে এমনিতেই অবৈধ। তার ওপর সংবিধানের ৫৬(৪) অনুচ্ছেদের বিধান মতে, সংসদ সদস্য নহেন এমন কেউ নির্বাচনকালীন সরকারের সময়ে কোনোক্রমেই সরকার পরিচালনায় থাকতে পারবেন না বলে পরিষ্কার বলা আছে।

নির্বাচনকালীন সরকারে যদি অবৈধভাবে ১০ জন অনির্বাচিত উপদেষ্টা রাখা যায় তাহলে ১০ জন অনির্বাচিত উপদেষ্টা দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করতে অসুবিধাটা কোথায়? উপদেষ্টা বা টেকনোক্র্যাট মন্ত্রীদের কোনো অস্তিত্বকে আমাদের সংবিধান সরাসরি নাকচ করলেও 'সর্বদলীয়' সরকারে এদের এহেন উপস্থিতি আমাদের পবিত্র সংবিধানের শ্রেষ্ঠত্বকেই সরাসরি অনুপস্থিত করে দিয়েছে। আসলে শুধু তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিপরীতে একটি নির্বাচনকালীন জোড়াতালির সরকারকে দাঁড় করানোর অপচেষ্টা করতে গিয়েই সরকার এ তালগোল পাকিয়ে ফেলেছে। সরকারের সব কিছুতেই যেন ফাঁকিঝুঁকি আর রাখঢাক ভাব। সাংবিধানিক বিষয়ে সরকার কখনোই সদাচরণ করতে পারেনি। তার বিপরীতে ক্রমাগত সরকার একের পর এক প্রকাশ্যভাবে সংবিধানকে লংঘন করেই চলেছে।

রাষ্ট্রের প্রতিটি প্রতিষ্ঠান এবং গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় ব্যক্তিবর্গ সরকারের নিজের অধীন এবং দলীয় আজ্ঞাবহ থাকার পরও সরকার কেন সংবিধান নিয়ে এ লুকোচুরি খেলা খেলছে? প্রধানমন্ত্রীকে নির্বাচনকালীন সরকার পরিচালনার অনুমতি প্রদানের বিষয়টি আইনি প্রক্রিয়ায় জারি করতে সরকারের বাধা ছিল কোথায়? যখন যার যা মনে আসে, আর যা মুখে বলে বসে, সেটাই কেন সংবিধানের বিধান হবে? আমাদের স্বীকার করতেই হবে, নির্বাচনকালীন সরকার পরিচালনার অনুমতি প্রাপ্তির বিষয়টি সাংঘাতিক ধরনের সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার বিষয়। আর এর ব্যত্যয়ও সাংঘাতিক ভয়াবহ। তাই 'সর্বদলীয়' সরকার শুধু 'সর্বদোষীয়' নয় বরং এটা সরাসরি অবৈধ এবং অসাংবিধানিক সরকার।

লেখক : আইনজ্ঞ ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ

e-mail: malik.law.associates@hotmail.com

 

 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.