আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

উত্তেজনা

লিখতে ভাল লাগে, লিখে আনন্দ পাই, তাই লিখি। নতুন কিছু তৈরির আনন্দ পাই। কল্পনার আনন্দ। উত্তেজনা মোহাম্মদ ইসহাক খান তার পকেটে দামী মোবাইল ফোন ছিল। ঘরে হাই কনফিগারেশন কম্পিউটার ছিল, ইন্টারনেটের কানেকশন ছিল।

প্লাজমা টিভি ছিল। তার বয়সী বন্ধুরা আর বান্ধবীরা ছিল, তাদের সস্তা অর্থহীন রসিকতা ছিল। অকারণেই রসিকতার, হাসি না পেলেও হাসার উপলক্ষ ছিল। ধূমপানের সরঞ্জাম, পানীয়ের বোতল ছিল। বিছানার পাশে কাত করে রাখা গিটার ছিল।

মানিব্যাগে হাতখরচের টাকা ছিল। কিন্তু যে বস্তুটি মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে, যেটা না থাকলে মানুষ মরে যায়, সেটি ছিল না। উত্তেজনা। রোজকারের নিয়ম মেনে চলা, একগাদা কানুন আর একঘেয়ে জীবনযাত্রা তাকে ভীষণ অবসাদগ্রস্ত করে ফেলেছিল। মনে হচ্ছিল, তার জীবন আর একটা তেলাপোকার জীবনের সাথে কোন পার্থক্য নেই।

খাও, ঘুমোও, কাজ কর। আর কিছু না, কিচ্ছু না। তাই সে ভেবেছিলো, একটু "জেগে ওঠা" দরকার। যা ইচ্ছে তাই করা যায় না, সব কিছু ভুলে? প্রথা আর নিয়মকে কাঁচকলা দেখিয়ে? তবে তাই হোক। ভাবা মাত্রই তার ভেতরে আশ্চর্য এক শক্তি এসে ভর করলো।

সে রাতে ঘুমুতে যাবার সময় ভারী এক আনন্দ বোধ হতে লাগলো তার। মনে হল, রাত ফুরুলে তার জন্য অনেক অনেক আনন্দ অপেক্ষা করছে। অন্য রাতগুলোর মতো বিরক্তিকর নির্ঘুম অবস্থা নিয়ে তাকে ছটফট করতে হল না, বরং মনে হল, রাত বড় দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। *** বহুতল বাড়িটির নিচ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন ভদ্রলোক। সকালের রোদে তাঁর দশাসই টাকমাথা চকচক করছিলো, ঠিক যেন একটা আয়না।

সহসা মাথার ওপর "থ্যাপ" জাতীয় একটা আওয়াজ করে কিছু একটা এসে পড়লো, তিনি তরল পদার্থের অস্তিত্ব অনুভব করলেন। নিশ্চয়ই কাক সম্প্রদায়ের বহুল প্রচলিত কর্মটি, এই ভেবে মাথায় হাত বুলিয়ে ওপরে তাকালেন তিনি, কিন্তু কোন কৃষ্ণকায় পক্ষী দেখতে পেলেন না, দেখতে পেলেন কমবয়সী এক ছেলের মুখ। তাঁকে ওপর দিকে তাকাতে দেখেই এতখানি জিভ বের করে ভেংচি কাটল সে, তারপরই ছাদ থেকে হাপিশ হয়ে গেল। তবে জিনিসটা কী? ভদ্রলোকের হাতে লেগে আছে চটচটে একটা জিনিস, দেখেই ঘেন্নায় মুখ বিকৃত করলেন তিনি। শয়তানের বাড়া, হতচ্ছাড়া ছোকরা তাঁর মাথায় থুথু ফেলেছে! আর কেউ দেখে ফেলেছে কীনা এই ভেবে চারিদিকে তাকালেন তিনি, এবং হাত-মাথা ধুয়ে ফেলার জায়গা খুঁজতে লাগলেন।

জগতসংসারে একমাত্র কাক ছাড়া এমন নিখুঁত নিশানা আর কারো দেখেছেন কীনা তিনি মনে করতে পারলেন না, ছোকরা ঠিক তাঁর আয়নাসদৃশ টাকের মধ্যিখানে ফেলেছে! *** ভ্যানগাড়িটা বোঝাই ডিম। এত এত ডিম। দোকানে দোকানে পৌঁছে দেয়া হবে, শহরতলীর খামার থেকে মাত্রই শহরে ঢুকেছে গাড়িটা। গাড়ির চালকের আসনে যে বসে আছে, সে শিস বাজাচ্ছে, ফুরফুরে মেজাজে আছে। হঠাৎ আশপাশ থেকে সবাই হই হই করে উঠলো।

কী হল? কী হল? পেছনে তাকাতেই চক্ষুস্থির হয়ে গেল তার। প্রায় শ'খানেক ডিম পড়ে আছে রাস্তায়, হলুদ কুসুম আর ভাঙা খোসায় মাখামাখি হয়ে গেছে। সামলে নিয়ে ভ্যান থামাল লোকটা, নেমে এসে মাথা চুলকোতে লাগলো। একটা দ্রুতগামী মোটরসাইকেল এসে পিচ্ছিল জায়গাটায় আছাড় খেয়ে পড়লো, চালক চিৎপটাং। বাধা দেয়ার সুযোগই পেলো না কেউ।

ডিমগুলো যে ভেঙেছে, সে একটু দূরেই দাঁড়িয়ে আছে, অনেক বড় কিছু একটা করে ফেলেছে এমন একটা অনুভূতি হচ্ছে তার। কিছুক্ষণ পরেই শান্তিতে ঘুমিয়ে থাকা শহরবাসীর এক অংশের ঘুম ভেঙে গেল, নিরালা দুপুরবেলায়। তাদের জানালার কাঁচ ভেঙে কেউ একজন চুরমার করে দিয়েছে। কে, কে? রব উঠলো এলাকায়। কিন্তু যে ভেঙেছে সে কি আর আছে? কখন পিঠটান দিয়েছে।

*** যখন বিকেল হয়ে আসছিল, তখন রেডিও আর টিভিতে সতর্কবার্তা ছড়িয়ে পড়লো, এক ভয়াবহ উন্মাদ অমুক এলাকার রাজপথে উল্টোদিকে তীব্রবেগে মোটরবাইক চালিয়ে যাচ্ছে, সবাই সাবধান! হ্যাঁ, ছেলেটাকে সবাই দেখতে পাচ্ছে। ঐ তো, মাথায় হেলমেট নেই, ঠিক যেন হাওয়ায় ভেসে ভেসে যাচ্ছে ছেলেটা, সিনেমার পশ্চাদ্ধাবন দৃশ্যের মতোই আর সবার উল্টোদিকে, অত্যন্ত বিপজ্জনক গতিতে, সবার পাশ কাটিয়ে বাতাসে সাঁই সাঁই আওয়াজ তুলে। তার ঝাঁকড়া চুল বাতাসে উড়ছে। কেউ যেন তাকে থামাতে পারবে না। আটপৌরে, সবসময় ঝামেলা এড়িয়ে চলা, প্রতিটি ট্রাফিক সিগন্যাল আর ছোটবড় আইন মেনে চলা পাকাচুলো ভদ্রলোক গাড়ির চালকেরা ওকে দেখে ভয়ে কিংবা সম্ভ্রমেই রাস্তা ছেড়ে দিতে লাগলো।

রাস্তার মুখে এসে সে দেখল, পথ আটকে যমদূতের মতো দাঁড়িয়ে আছে পুলিশের গাড়ি। তীক্ষ্ণ সাইরেনের আওয়াজ কানে তালা লাগিয়ে দিচ্ছে, রাস্তার পুরোটাই আটকানো, ওকে ধরার জন্য সতর্ক অবস্থান নিয়ে আছে তারা। বুকের ভেতর উত্তেজনায় রক্ত চলকে উঠলো ছেলেটির, আচমকা ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে গেল সে, তারপরই একশো আশি ডিগ্রি কোণে বাইক ঘুরিয়ে, একরাশ ধুলো উড়িয়ে সবাইকে ময়লা করে দিয়ে সে চলে গেল যেদিক থেকে এসেছিল সেদিক থেকেই। পুলিশ অফিসার আদেশ দিলেন, ওকে ধাওয়া করার। নেহায়েত ছেলেমানুষ একটা, যাবে আর কত দূর? সত্যিই, এটা মগের মুল্লুক নয়।

বড় বড় খুনি আর দুষ্কৃতকারীরা ধরা পড়ে যায় চোখের পলকে, আর সে তো আনাড়ি এক কমবয়সী ছেলে। কাজেই সন্ধ্যে নামার পরপরই তাকে দেখা গেল একদল পুলিশের হাতে বন্দী, হাতে হাতকড়া, পিছমোড়া করে রাখা। সারাদিন, আজ সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সে নানাবিধ কুকর্ম করে বেরিয়েছে। দেশে সকল অপরাধেরই শাস্তি আছে, খসখসে কাগজে একেবারে দাঁড়িকমাসহ নিখুঁতভাবে লিপিবদ্ধ। কাজেই ওর শাস্তি হবে।

থুথু ফেলা (!?), জানমালের ক্ষতিসাধন, বিপজ্জনকভাবে ড্রাইভ করা ইত্যাদি কারণে হয়তো তার জরিমানা হবে, ক্ষতিপূরণ দেয়া লাগবে, কিংবা দিনকয়েক আটকা থাকতে হবে। সবই হবে, নিয়মকানুন মেনে। সবাই আনুষ্ঠানিকতা নিয়ে ব্যস্ত, ছেলেটির দিকে কেউ তাকায় নি। যদি তাকাত, তাহলে দেখতে পেত, তার মুখে আকর্ণবিস্তৃত হাসি। না হয় সে সারাদিনে সব আজেবাজে কাজ করে বেড়িয়েছে, তবুও আজ প্রথম সে উত্তেজনা কাকে বলে টের পেয়েছে।

তার মোটেই দুঃখ কিংবা আফসোস হচ্ছে না, বরং মনে হচ্ছে, এটাকেই বাঁচা বলে। একদিনের জন্য হলেও যা ইচ্ছে তাই সে করতে পেরেছে। নাহ, ইটকাঠের এই শহরেও চাইলে বাঁচা যায়, উত্তেজনা খুঁজে নেয়া যায়। তার সারা গায়ে ঘাম, ধুলোবালি। কিন্তু শরীরে যে অবসাদ ভর করেছে, তা বড় আরামদায়ক, তৃপ্তিকর।

ছেলেটির নিজেকে খুব হালকা মনে হয়, পাখির পালকের মতো, যেন বাতাসে উড়ে যাবে। খুশিতে হেসে ওঠে সে, ঘর কাঁপিয়ে, একা একাই। থানার অনেক লোক, সবাই ওর দিকে তাকায়। সবার চোখে অবাক দৃষ্টি। হয়তো ভাবছে, নিশ্চয়ই ছেলেটির মাথায় ছিট আছে।

(২ মে, ২০১৩) ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।