আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নির্বোধ বুড়োভাম

মেয়েদের সঙ্গে ফষ্টিনষ্টি করা যার স্বভাব, সে নিজেই আন্দাজ করতে পারে না, ও কাজে সময় কিভাবে গড়িয়ে যায়। আর কেমন করে সেও বুড়িয়ে যায়। এমন এক সময় আসে যখন মেয়েরা বাবার বয়সী ঠাওরে কিংবা তারও অধম, দাদা বলতেও দ্বিধা করে না। এটা সত্যিই জটিল ব্যাপার। কারণ মাঝ বয়সীদের মাথার ভেতরে লুকিয়ে থাকে আরেকটা মাথা।

বাইরের মাথায় থাকে বলিরেখা, সাদা চুল, ক্ষয়ে যাওয়া দাঁত, দ্যুতিহীন চোখ। আর ভেতরের মাথা থাকে টগবগে, ঘন কালো চুল, মসৃণ ত্বক, উজ্জ্বল চেহারা, চকচকে দাঁত, জ্যোতির্ময় চোখ। এই ভেতরকার মাথাটাই ঘটায় যত বিপত্তি। এটাই মেয়েদের দিকে কামনার দৃষ্টিতে তাকায়। ভাবে, তার এই মাথাটাই মেয়েদের দৃষ্টিগোচর হয়।

আর তারা বুঝি তাকে সে রকম টগবগে যুবকই মনে করে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। আসলে মেয়েরা দেখে তার বাইরের মাথাটাই। আর বলাবলি করে- ওই বুড়োভামটা চায় কি? দেখছে না যে সে আমার দাদার বয়সী হবে? বুড়োর ভীমরতি ধরেছে, ছিঃ।

আমি পেশায় নাপিত।

তিরিশ বছর সেলুনে কাজ করছি। সেলুনটা এ বছর সংস্কার করায় এর আয়তনটা বেড়েছে। নতুন আয়না, বেসিন, চুনকাম করা হয়েছে দেয়ালে। আলমারিতে নতুন রং। মালিক বাড়তি আকর্ষণ হিসেবে হাত-নখের পরিচর্যার জন্য একজন প্রশাধনকারিণী নিয়োগ করলেন।

ওর নাম ইয়োলি। মালিক ছাড়া আমরা আরও তিনজন দোকানটায় থাকি, একজনের নাম আমাতো। পঁচিশ বছরের যুবক। গায়ের রং কালো। স্বভাব রাশভারী।

কর্মে একনিষ্ঠ। এক সময় পুলিশে ছিল। আরেকজনের নাম গুইসেপ। বয়সে আমার চেয়ে পাঁচ বছরের বড়। বেঁটেখাটো, মোটা।

মাথাভরা টাক। এ দুজন ছাড়া আমি তো আছিই। কয়েকজন পুরুষের মাঝখানে একজন মাত্র মহিলা এসে পড়লে সচরাচর যা ঘটে। তিনজন পুরুষের মাঝে ইয়োলি একমাত্র মহিলা হওয়ায় আমাদের কৌতূহলী দৃষ্টি তার দিকে। ইয়োলি সুশ্রী ও আকর্ষণীয়।

আমিও সুঠামদেহী আকর্ষণীয় পুরুষ। মেয়েরা চোখ দুটোর তারিফ করে। আমার হালকা বাদামি মিহি চুলে পুরোদস্তুর ফিটফাট লাগে। সেলুনের বাইরে থাকলেও ইস্ত্রি করা শার্ট, টাই, মোজা, রুমাল সবই ম্যাচ করে পরি। সেলুনে যে ঢিলেঢালা আলখেল্লাটা পরি সেটা এতটাই সাদা যে, লোকজন আমাকে নাপিত না ভেবে সার্জন বলে ধরে নেবে।

এই অনন্য বৈশিষ্ট্য আমার আছে বলেই মেয়েরা আমার প্রতি দুর্বল। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। কোনো মেয়েকে পছন্দ হলে আমি তাকে চোখে চোখে রাখি। তাকে চোখের আড়াল হতে দিই না। তাকে প্রাণভরে প্রশংসা করি।

তাতেই আমার শতভাগ সফলতা। ইয়োলির দিকে গভীর অন্তর্ভেদী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আমি টের পাই- ফলে পাক ধরেছে, এবার হাত বাড়িয়ে টুপ করে তুলে আনতে হবে।

ইয়োলির ব্যাপারে আমার দোকানের সবচেয়ে স্পর্শকাতর ব্যক্তি আমাতো। সে সুদর্শন নয় তবে টগবগে যুবক। গুইসেপকে তো আমি হিসাবেই ধরি না।

বয়সে আমার জ্যেষ্ঠ, কদাকার। সেলুনের এক কোণের নির্ধারিত টেবিলে সারাক্ষণ বসে থাকে ইয়োলি। অবসাদে আচ্ছন্ন। যেন বিষণ্নতা তাকে পেয়ে বসেছে। সেলুনে পত্রিকাপাঠে সে মগ্ন থাকে।

কখনো সে খদ্দেরদের নখে লাগাবার প্রসাধনী নিজের নখে লাগিয়ে অলস সময় পার করে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমি সারাক্ষণ তার ওপর চোখ রাখি। সেলুনে খদ্দের ঢুকলেই আমি অতি যত্নে চেয়ারে তোয়ালে বিছিয়ে দিই। ওই সুযোগেও ইয়োলিকে দেখতে ভুল করি না। যখন কোনো খদ্দেরের সাবান-মাখা চুলে আমি আলতো হাতে ম্যাসাজ করি, কিংবা তার চুল ধুয়ে দেই, তখনো ইয়োলির দিকে আমার দৃষ্টি থাকে।

খদ্দেরের চুলের প্রান্তভাগ ছাঁটার সময় কাঁচির প্রতিটা পোঁচের ফাঁকে ফাঁকে ইয়োলির দিকে তাকাই। আমার চোখ সারাক্ষণ তাকে অনুসরণ করে।

যখন আমার মনে হলো, আমাদের সম্পর্কটা পূর্ণতা পেয়েছে যাকে লোকে বলে 'ফল পেকেছে'- তখন এক শনিবার আমি ইয়োলিকে পরদিন রবিবার বিকালে অস্টিয়াতে সমুদ্র স্নানে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানাই। তক্ষুণি সে রাজি হয়ে যায় বটে, তবে শর্ত জুড়ে দিল এই বলে যে, তার স্নানের পোশাক নিয়ে আমার ঠাট্টা করা চলবে না মোটেই। কারণ এরই মধ্যে সে অনেকটাই মুটিয়ে গেছে।

আর তার একমাত্র স্নানের পোশাকটা তার শরীরে বেশ অাঁটসাঁট হয়। 'আসলে সারাক্ষণ দোকানে ঠায় বসে থেকে থেকে আমার শরীরটা মুটিয়ে গেছে'- এমন অকপট মন্তব্য করার সময় তার বিন্দুমাত্র লাজ-লজ্জার বালাই ছিল না। ছিল না তিলমাত্র কোনো ভান-ভনিতা। আর এ জন্যই আমি ওকে এতটা পছন্দ করি। যা হোক, পরের দিন সান পাওলো স্টেশনে আমাদের দেখা হবে ঠিক হলো।

রওনা হওয়ার আগে গুছিয়ে সাজগোজ করি। যুৎসুই প্রসাধনী মাখি। মসৃণ করে শেভ করি। গালে টেলকম পাউডার মাখি। মাথায় আর রুমালে ফুলের সুগন্ধি নির্যাস ছিটিয়ে দেই।

গায়ে খোলা কলারের শার্টের ওপর হালকা ট্রপিক্যাল কোট। পরনে সাদা প্যান্ট। একেবারে কেতাদুরস্ত।

ইয়োলির প্রখর সময়জ্ঞান। তখন বেলা ঠিক দুটো।

দেখলাম প্রমোদ ভ্রমণকারীদের ভিড় ঠেলে আমার দিকেই এগিয়ে আসছে সে। পরনে ধবধবে সাদা পোশাক। দেখতে খানিকটা বেঁটে খাট্টা-খোট্টা, স্থূল মনে হলেও বেশ যৌবনদীপ্ত ও আকর্ষণীয় লাগছিল তাকে। 'উঃ বাবা! যা ভিড়!' বলেই আমাকে দেখা মাত্রই বলে ওঠে, 'যা অবস্থা, বোধ করি সারা পথ আমাদের দাঁড়িয়েই যেতে হবে!' সঙ্গে সঙ্গে আমার মনে বীরত্বের ভাব জেগে ওঠে। আমি হয়ে উঠি অদম্য সাহসী।

বলি, নিদেনপক্ষে তার জন্য আমি একটা সিট বের করতে পারবই। এ দায়িত্বটা সে যেন আমার ওপর ছেড়ে দেয়। এরই মধ্যে রেলস্টেশনে এসে দাঁড়াই। সঙ্গে সঙ্গে প্লাটফরমজুড়ে শুরু হয় অপেক্ষমাণ যাত্রীদের সন্ত্রস্ত ছোটাছুটি। যেন তাদের একদল অশ্বারোহী সৈন্য তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে।

সবাই জুড়ে দিয়েছে চিৎকার-চেঁচামেচি। একে অন্যকে করছে ডাকাডাকি। চলছে হাঁকাহাঁকি, হৈচৈ। আমিও ঠেলাঠিলি, ধাক্কাবাজি করে এগিয়ে যাই। দরজার একটা ডাণ্ডা ধরে ধাক্কা মেরে ভিড় ঠেলে ট্রেনে প্রায় উঠে গেছি।

ওরে বাপরে! তক্ষুণি একটা কালো চামড়ার যুবক আমাকে এমন জোরে ধাক্কা মারল যে, আমি আর টিকতে পারলাম না। সেই সুযোগে যুবকটা আমার সামনে চলে আসে। আমিও নাছোড় বান্দা। ওল্টো আরও জোরে ধাক্কা মেরে তাকে পেছনে ফেলে তার সামনে এসে দাঁড়াই। সে আমার জামার আস্তিন টেনে ধরে।

আমিও তার পেটে আমার কনুই দিয়ে এমন এক গুঁতো মারলাম, আমাকে ধরে রাখা তার আর সাধ্যে কুলাল না। এভাবে নিজেকে মুক্ত করে দ্রুত ট্রেনের কামরায় ঢুকে পড়ি। কিন্তু ওই ইতর যুবকটার সঙ্গে ধস্তাধস্তিতে আমি অনেকটা সময় নষ্ট করে ফেলেছি। ফলে কামরায় সবগুলো সিটই দখল হয়ে গেছে। ওদিকটায় একটা মাত্র খালি সিট আমার নজরে পড়ে।

কালো যুবকটাও সেদিকে এমনভাবে ছুটে গেল যেন হুমড়ি খেয়ে পড়বে। আমি যখন ওই সিটটা দখল করার জন্য আমার স্নানের পোশাকটা সিটের ওপর ছুড়ে ফেলে দিলাম, প্রায় একই সময়ে ওই যুবকটাও সিটটায় তার দখল প্রতিষ্ঠা করার জন্য তার জ্যাকেটটা সিটটার ওপর ছুড়ে ফেলে। এবার দুজন মুখোমুখি। আমি কড়া ভাষায় দাবি করলাম, 'আমি আগে এসেছি। তাই এই সিট আমার।

'

যুবকটাও চিৎকার করে বলতে থাকে, 'কখখনো না। কে বলেছে তুমি আগে এসেছ? আমি আগে এসেছি। এ সিট আমার'!

আমি বললাম- 'আমি বলছি আমি আগে এসেছি। তাই এ সিট আমার। এই বলে আমি যুবকের জ্যাকেটটা তার মুখের ওপর ছুড়ে ফেলে দেই।

আর সেই মোক্ষম সময়েই ইয়োলি এসে হাজির। কোনো দ্বিধা না করেই ধপ করে সিটটাতে বসে পড়ে। বলে, 'ধন্যবাদ লুগি'। যুবক তো হতভম্ব। ঘটনার আকস্মিকতায় হতবাক।

ভাবে, আর যা-ই হোক, সে তো আর একটা মহিলাকে সিট থেকে উঠিয়ে দিতে পারে না। অগত্যা সে জেকেটটা হাতে তুলে নিয়ে গজ গজ করতে থাকে। বিরক্ত হয়ে চলে যেতে যেতে কর্কশ স্বরে চেঁচিয়ে মন্তব্য করে-'নির্বোধ বুড়োভাম কোত্থাকার'! যুবকের ঝাঁজাল মন্তব্যের রেশটা কাটতে না কাটতেই ট্রেন চলতে শুরু করে। আমি উপরের হাতল ধরে ইয়োলির গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে। কিন্তু আমি এখন চরম হতোদ্যম এক মানুষ।

আমার সব উত্তেজনা, সব উৎসাহ মুহূর্তে যেন উবে গেছে। ইচ্ছে হচ্ছে ট্রেন থেকে নেমে বাড়ি ফিরে যাই। 'নির্বোধ বুড়োভাম'- বলল কী ইতর ছোকড়াটা! আমি ভাবতেই পারিনি ওই পাজিটার শেষ মন্তব্যটা আমাকে এভাবে পেয়ে বসবে। আমার মনে এমন কালবোশেখি ঝড় তুলবে। যুবকের নির্দয় মন্তব্যে আমার মধ্যে দুধরনের অনুভূতি সঞ্চারিত হয়।

'নির্বোধ' শব্দটার মধ্যে অপমানের গন্ধ রয়েছে বটে, তবে তেমন ক্ষতিকর কিছু নেই। আমাকে বিরক্ত-বিব্রত করার জন্যই হয়তো 'নির্বোধ'বলেছে। বলুক গে। কিন্তু সমস্যা হলো 'বুড়োভাম'কে নিয়ে। এই 'বুড়ো' শব্দটা নিশ্চয়ই শুধু আমাকে অপমান করার জন্যই সে উচ্চারণ করেনি।

আলবৎ এর ভিন্ন কোনো কারণ আছে। সে আমাকে 'বুড়ো' বলেছে, কারণ তার কাছে তাই সত্য হিসেবে প্রতিভাত হয়েছে। আমার বয়স পঞ্চাশ না হয়ে যদি ষোল হতো, তা হলে সে নিশ্চয়ই বলত-'নির্বোধ ছোকরা কোথাকার'। আর এটা তো সত্য যে, তার কাছে, দুনিয়ার সবার কাছে, এমনকি ইয়োলির কাছেও আমি একটা বুড়ো মানুষ। যুবকটা আমাকে ভাবল নির্বোধ, আর ইয়োলি আমাকে ঠাওরাল বুদ্ধিমান- এ দুইয়ের মধ্যে বিশেষ কোনো ফারাক দেখি না।

কারণ উভয়ের কাছেই আমি একটা 'বুড়ো'। এভাবে সিটটার দখল নেওয়া হয়তো ইয়োলির জন্য খুব বেশি জরুরি ছিল না। কারণ হয়তো আমার বয়সের প্রতি সম্মান দেখিয়েই ওই যুবকটা শেষতক আমাকে সিটটা ছেড়ে দিত। এর সমর্থন মিলে ইয়োলির বিপরীত দিকের সিটে বসা লোকটির কথায়ও- যিনি আগাগোড়া ব্যাপারটা ভালো করেই লক্ষ্য করে মন্তব্য করলেন- 'কি পাজি ছেলেরে বাবা... ! অন্য কথা না হয় ছেড়েই দিলাম। অন্তত আপনার বয়সটাকে সম্মান দেখিয়েও তো সে আপনাকে সিটটা ছেড়ে দিতে পারত! কি যে দিনকাল পড়েছে বাপু, বুঝি না!

আমার সারা শরীর নিরুত্তাপ।

যেন অবশ হয়ে আসছে। বিভ্রান্ত, হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে থাকি। অস্বস্তিতে হাতটা ঘন ঘন মুখের ওপর রাখি যেন আয়নার অভাবে আঙ্গুলের সাহায্যেই যাচাই করার চেষ্টা করছি আমার প্রকৃত বয়সটা। অবশ্য ইয়োলি নির্বিকার। এদিকে কোনো খেয়াল নেই।

আধাপথ যখন পার হচ্ছি তখন ইয়োলি মুখ খুলল- 'আমি সত্যিই দুঃখিত' আপনাকে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে। ' আমি জবাব না দিয়ে থাকতে পারলাম না। বললাম- 'জানি বয়স হয়েছে। তবে এতটা বুড়ো হইনি যে, এক-আধ ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে পারব না। একথা বলে আমি খানিকটা আশায় ছিলাম, ইয়োলি বলবে- লুগি! কি? বলছেন কি আপনি? আপনি বুড়ো!- হাসালেন।

কিন্তু হায়! নিরস নিষ্প্রাণ এ মহিলা নিশ্চুপ। কিছুই বলল না। মুখে রাটি পর্যন্ত করল না। তখনই আমি আরও নিশ্চিত হলাম- ও, তাহলে আমি সর্বাংশে সত্যি কথাই বলেছি।

আমরা অস্টিয়াতে পৌঁছলাম।

ইয়োলি চেঞ্জ রুমে ঢুকল। কাপড় বদলে স্নানের পোশাক পরে বেরিয়ে এলো। পোশাকটা আঁটসাটো মানে আঁট-সাঁটই। মনে হয় এক্ষুণি ছিঁড়ে যাবে। ফেটে পড়বে।

বিস্ফোরিত হবে শরীরের নানা অঙ্গ। তার গায়ের রং ফর্সা। সুঠাম গড়ন। সতেজ লাবণ্য। ঋজু আকৃতি।

রমণীয় ভঙ্গি। কমনীয় কান্তি। প্রাণবন্ত উদ্দীপ্ত যৌবন। এতটাই আকর্ষণীয় যে, সহজেই যে কারও মনে ইতিবাচক সাড়া জাগাতে সক্ষম। এবার আমার কাপড় বদলানোর পালা।

চেঞ্জ রুমে ঢুকে আমি সর্বপ্রথম যে কাজটা করলাম, তা হলো দেয়ালে ঝুলানো ভাঙা টুকরো আয়নায় নিজের চেহারাটা দেখে নেওয়া। সত্যিই তো তাই! বুড়োই হয়ে গেছি! এ ব্যাপারে কেন যে এতদিন সচেতন ছিলাম না? চোখ দুটো কেমন নিষ্প্রভ, দ্যোতিহীন। কুঞ্চিত রেখার মধ্যে হারিয়ে গেছে সব উজ্জ্বলতা। সাদা সুতার মতো দেখাচ্ছে চুলগুলোকে। গালের চামড়া ঝুলে গেছে।

দাঁতগুলো বিবর্ণ হলদেটে। খোলা গলার শার্টটায় যুবক যুবক ভাব ফুটে উঠলেও সেটাই আমাকে আরও লজ্জায় ফেলে দিল। কারণ এতে গলার পুরোটাই দৃশ্যমান- শ্বাসনালির উপরে কুঁকড়ে যাওয়া চামড়া অনায়াসেই যে কারও চোখে পড়ে। এবার পরনের কাপড় খুলি। স্নানের পোশাক বের করার জন্য উবু হতেই আমার থলথলে পেট উপরের দিকে ফুলে ওঠে।

পরক্ষণেই আবার নিচের দিকে নেমে আসে। বাতাসভর্তি স্ফীত-ফাঁপা থলের মতোই আমার পেটের অবস্থা। 'নির্বোধ বুড়ো' শব্দ দুটো রেগে মেগে নিজেকে শুনিয়ে শুনিয়ে বার বার উচ্চারণ করি। ভাবি, জীবন কি এরকমই বিস্ময়ে ভরা। এই তো মাত্র ঘণ্টাখানেক আগেও আমি ইয়োলির সঙ্গে প্রেমকৌতুক আর রঙ্গরস করার যোগ্য সাহসী যুবক বলেই নিজেকে ভাবতাম।

আর এখন? ওই শব্দগুলোকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। বেশ বুঝতে পারছি- আমি আসলে তার বাবার বয়সী। ছিঃ! যত ভাবছি ততই লজ্জা পাচ্ছি। সেলুনে এভাবে তার দিকে বার বার তাকিয়ে থাকা আর তাকে এভাবে এখানে নিয়ে আসার জন্য আমি সত্যিই লজ্জিত। আমার সম্পর্কে সে কত কি খারাপ কথাই না ভাবছে! ছিঃ ছিঃ সে আমাকে কি চোখে দেখছে? এ ভেবে আমি সত্যিই কোনো কূল-কিনারা পাই না।

অবশ্য খানিক বাদেই জেনেছি, সে আমাকে কি মনে করে। নিরাপত্তা বেষ্টনীর রশি ধরে আমরা সৈকতে দাঁড়িয়ে। ঢেউ আসছে। ঢেউ ভাঙছে। আমাদের ওপর আছড়ে পড়ছে।

কারণ আবহাওয়া খুব খারাপ। তাই সমুদ্র উত্তাল। প্রতিবার ঢেউয়ের ঝাপটায় আমার শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। নিজেকে বলি, 'আমি বুড়ো মানুষ তো, তাই ওরকমটা হচ্ছে।

আর ইয়োলি? ও তো তখন বল্গাহীন হরিণী। উচ্ছল, প্রাণবন্ত ঢেউয়ের চূড়া ভাঙছে হাত ঝাপটে। জলকেলি করছে খুশির জোয়ারে। ঢেউয়ের গর্জন ছাপিয়ে শোনা গেল তার কণ্ঠ। চেঁচিয়ে বলছে- লুগি।

আপনি যে এতটা আমুদে লোক, আমি তা ভাবতেই পারিনি। মাইরি বলছি।

কী করে বুঝলেন? আপনি আমাকে কেমন লোক ভেবেছিলেন?

না, মানে আপনাদের মত বয়স্ক লোকেরা তো খুব একটা সমুদ্রে যেতে চায় না, এই আর কি!... যুবকরাই...।

ঠিক তক্ষুণি চূড়ায় সাদা ফেনা ভরে প্রকাণ্ড গর্জনে আমাদের ওপর আছড়ে পড়ে বিশাল ঢেউ। সে ঢেউয়ের আঘাতে আমি ধপাস করে পড়ে যাই ইয়োলির গায়ের ওপর।

নিজেকে স্থির রাখার জন্য তাকে আমার দু'বাহু দিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরি। তার সুঠাম, যৌবনদীপ্ত, সতেজ তুলতুলে দেহ বল্লরী আবদ্ধ হয় আমার বাহুর বাঁধনে। আমার মুখ তখনো নোনাজলে ভর্তি। চেঁচিয়ে ইয়োলিকে বলি, 'হ্যাঁ, হ্যাঁ। আমি আলবৎ আপনার বাবার বয়সীই হব।

' ঘূর্ণায়মান ফেনার ভেতর থেকে মাথাটা উঁচিয়ে খিল খিল করে হাসতে হাসতে ইয়োলি বলে ওঠে- 'বাবা না, বাবা না; বরং বলুন আমার আংকেল। ' সমুদ্র স্নানের পর্বটা কেমন বিব্রতকর লজ্জাজনক অবস্থায় যে শেষ করলাম, বলার ভাষা নেই। মনে হচ্ছে, আমার মুখের ভেতরে একটা ফাঁদ বসানো আছে- যা নিজে নিজে খুলে আবার বন্ধ হয়ে গেছে। ওটাকে আবার খুলতে গেলে নির্ঘাত শক্ত কোনো একটা দণ্ডের দরকার পড়বে। ইয়োলি আমার সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে।

ভিজে তার থলথলে শরীরে লেপ্টে আছে স্নানের পোশাকটা। সত্যিই এ দৃশ্যটা নেহাতই বিচ্ছিরি, বেঢপ। অমার্জিত, অশোভন। স্নানের সংক্ষিপ্ত পোশাকটা টেনে-টুনে ইয়োলি তার গুরুভার উরু দুটি আর পিনোন্নত বুকটাকে ঢাকার বৃথা চেষ্টা করে পরক্ষণেই সে বিচের বালুতে লুটিয়ে পড়ে। মনের আনন্দে গড়াগড়ি খায়।

তার শরীর এতটাই সুঠাম, দৃঢ় আর মসৃণ যে, বালুর বন্ধনও তাকে বেশিক্ষণ জড়িয়ে ধরে রাখতে পারে না। স্যাঁতসেঁতে বালুর স্তর ঝুর ঝুর করে ঝরে পড়ে কণা কণা। ইয়োলির পাশে আমি বসে পড়ি নির্বাক, চলৎশক্তিহীন। নড়াচড়া বা কথা বলার মতো শক্তিও যেন অবশিষ্ট নেই। ইয়োলিকে গণ্ডারের চেয়ে বেশি অনুভূতিহীন মনে হলেও আমার দুরবস্থাটা অাঁচ করতে পেরে সে আর চুপ থাকতে পারল না।

অধীর হয়ে জানতে চাইল আমার খারাপ লাগছে কিনা!

আমি জবাবে বললাম- 'না, না। আমি আপনার কথাই ভাবছিলাম। দোকানে আমরা যারা কাজ করি, আমাতো, গুইসেপ আর আমি- এ তিনজনের মধ্যে আপনি কাকে সবচে বেশি পছন্দ করেন? প্রশ্ন শুনে ইয়োলি খানিকক্ষণ চুপ করে থাকে। আমার ধারণা, সে আপনার প্রেমে পড়েছে।

তাই নাকি? সত্যি বলছেন? ইয়োলি মুখে এমনটা বললেও তাকে খানিকটা অন্য মনস্ক দেখাল।

মনে হলো সে কোনো ব্যাপারে চিন্তায় পড়েছে। শেষে বলল- লুগি, আমি একটু সমস্যায় পড়েছি। আমার পোশাকটার পিঠের দিকে জোড়াটার নিচে সেলাই খুলে গেছে। ... তোয়ালেটা একটু এনে দেবেন প্লিজ! আমি গিয়ে পোশাকটা বদলে আসি। সত্যি বলতে কি, তার এ ধরনের বিপর্যয়ে আমি আনন্দিতই হয়েছি।

আমি তোয়ালে এনে তার হাতে দিলাম। সে কোমরের চারপাশে ওটাকে জড়িয়ে কাপড় বদলানোর ঘরটার দিকে দৌড়ে গেল। এর আধা ঘণ্টা পর আমরা আবার ট্রেনে চাপি। পুরো কামরা ফাঁকা। আমার শার্টের খোলা কলারটা এঁটে দি।

ভাবি, যে ব্যাপারটা নিয়ে আমি এতটা বিব্রত ছিলাম- সে সবের নিশ্চিত সমাপ্তি ঘটেছে। আসলেই আমি একটা বুড়ো মানুষ। সে দিন থেকেই আমি প্রতিজ্ঞা করলাম, ইয়োলির দিকে তো নয়ই, এমন কি অন্য কোনো মেয়ের দিকেও আমি জীবনে আর চোখ তুলে তাকাব না। পরবর্তীতে আমি আমার প্রতিজ্ঞা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছি। এতে সে খানিকটা অবাকই হয়েছে বলে মনে হলো।

মাঝে মাঝে তার চাহনিতে তিরস্কারের আভাস পেতাম। অবশ্য এসব আমার অমূলক ধারণাও হতে পারে। এরই মধ্যে মাসখানেক কেটে গেছে। তার সঙ্গে আমার বড়জোড় চার পাঁচবার কথা হয়েছে। ওদিকে গুইসেপের সঙ্গে ইতোমধ্যেই তার বেশ সখ্য গড়ে উঠেছে।

অবশ্য বুড়োটা ইয়োলির সঙ্গে বাবার মতোই আচরণ করে।

সেদিন সেলুন বন্ধের সময় অন্য দিনের মতো আমার ঢিলে আলখেল্লাটা খোলার জন্য সেলুনের পেছনের স্টোর রুমে যাচ্ছিলাম। তখন আমাদের দয়াবান মালিক ঘোষণা দিলেন- আজ সন্ধ্যায় যদি খুব ব্যস্ততা না থাকে, তাহলে আমরা সবাই ডিনারে মিলিত হতে পারি। আপনারা সবাই নিমন্ত্রিত। ...ইয়োলি আর গুইসেপের এনগেজমেন্ট হয়েছে।

আমি সেলুনের ভেতরটায় চোখ ফেরাই। ইয়োলি তার নির্ধারিত টেবিলে বসা। মিটিমিটি হাসছে। ওদিকে ক্ষুর পরিষ্কার করতে করতে ছড়িয়ে দিচ্ছে চাপা হাসির ছটা। যাক বাবা।

হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। গুইসেপ আমার চেয়েও বয়স্ক। দেখতেও কুৎসিত। তথাপিও ইয়োলি আমাকে পছন্দ না করে, পছন্দ করে গুইসেপকে। আমি দৌড়ে গিয়ে দুবাহু বাড়িয়ে গুইসেপকে জড়িয়ে ধরি।

উচ্ছ্বাস ভরে বলি- অভিনন্দন, তোমাকে আমার উষ্ণ অভিনন্দন। তারপর আমি আলিঙ্গনে আবদ্ধ করি ইয়োলিকে। দোকানে আমরা যে তিনজন আছি এদের মধ্যে এ ঘটনায় সবচেয়ে যে বেশি খুশি হয়েছে, সে হচ্ছি আমি।

পরদিন রবিবার। বিকালে বেড়াতে বের হই।

টের পেলাম, আমার চোখ আবার মেয়েদের অনুসরণ করতে শুরু করেছে। আগে যেমনটা করতাম ঠিক তেমনি তীক্ষ্নভাবে। প্রত্যেককে আলাদা আলাদাভাবে, এক এক করে। তাদের সামনের দিক, তাদের পেছনে দিক আগের মতো কৌতূহল নিয়েই আবার পূর্ণোদ্যমে দেখতে শুরু করি।

 

 



সোর্স: http://www.bd-pratidin.com/index.php     দেখা হয়েছে ১০ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।