আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কিশোরগঞ্জের তিন কিশোরের বিমানবন্দর দেখতে আসার এ্যাডভেঞ্চার: এমন একটা ঘটনা আমাদেরও আছে।



আজ অনলাইনে কিশোরগঞ্জের তিন কিশোরের বিমানবন্দর দেখতে আসার এ্যাডভেঞ্চারের খবর পড়ে মনে হলো এমন একটা ঘটনা আমারও আছে।

আমাদের তখন এসএসসি পরিক্ষার প্রায় শেষ। মানে প্রাকটিক্যাল রয়েছে। আমার চাচার বাস ছিল। সেই বাস কুষ্টিয়া-প্রাগপুর চলাচল করতো।

দুপুরে খাওয়া-দাওয়া সেরে আমরা তিন বন্ধু কুষ্টিয়া মজমপুর গেটে আমাদের বাড়ির পাশে জমায়েত হলাম। সেই সময় চাচার বাস আমাদের পাশে দিয়ে যাচ্ছিল। এই বাসে ফ্রি ফ্রি প্রাগপুর যাওয়া যাবে শুনে খোকন বললো চল যাই। জাহিদ আমতা আমতা করলেও কয়েক মিনিটের মধ্যেই রাজি হয়ে গেল। দুপুর তিনটের দিকে রওনা হলাম প্রাগপুরের পথে।

বাসায় কিন্তু কেউ জানে না।

প্রাগপুরে আমার এক দুসম্পর্কের খালা থাকেন। খালু স্থানীয় স্কুল মাষ্টার এবং এলাকার মেম্বর। গেরস্থ। প্রাগপুর যখন পৌছুলাম তখন প্রায় সন্ধ্যে।

খালাতো দেখে খুবই খুশি হলেন। প্রাকটিক্যাল হতে আরো একদিন বাকি থাকায় রাতে খালার বাড়ি থেকে গেলাম। খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে বাড়ির পেছনের খালের পাড়ে দাতছোলার ডাল দিয়ে দাত মাজতে মাজতে উপস্থিত হলাম। বাড়ির পেছনের খালের ওপারেই ভারতের শীকারপুর। মানে বর্ডার।

খালে হাটু পানি। সময়টা শীতকাল। ওইপারে একটা রাস্তা এসে খালেরর পাড়ে শেষ হয়ে গেছে। রাস্তার দুধারে খালের পাড় ধরে চাষের জমি। একজন কৃষক কেবল গরুতে লাঙ্গল জুড়ছে।

আরেকজন তার জামাকাপড় জিনিসপত্র গোজগাজ করছে। আমি বল্লাম চল ওপার থেকে ঘুরে আসি। অমিতাবের দেশ।

খোকন রাজি হলেও জাহিদ রাজি হলো না। আমি আর খোকন খাল পার হয়ে ওই দুইজন কৃষকের কাছে জানতে চেলাম... এই দিকে গেলে কোন সমস্যা আছে? আগেই বলে রাখি, ওই যে রাস্তা... তার বাম পাশে বিএসএফ এর ক্যাম্প।

চকচক করে দেখা যাচ্ছে। আমরা যেহেতু রাস্তার অপরপাশের নিচুতে তাই আমাদেরকে ওরা দেখতে পারছে না। একজন কৃষক আমাদেরকে বললো যাও চলে যাও কোন অসুবিধে নেই।

বিএসএফ এর ক্যাম্পের সামনে একটা বড় শিমুল গাছ আছে। তার নিচে ছোট্ট একটা ঠাকুরঘর।

আমরা সেই শিমুল গাছের শেকড় বরাবর রাস্তায় উঠলাম। মানে, আমরা এখন বিএসএফ ক্যাম্পের গেটের সামনে দাড়ায়ে আছি। একজন গামছা পরা লোক (বিএসএফ) গেটের বাইরের দিকে আসছিলো। আমাদেরকে তেমন একটা খেয়াল করছিল না। খোকন এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো এই রাস্তাটা কোথায় গেছে।

লোকটা ভাঙাভাঙা বাংলায় জানতে চাইল আমরা কোথা থেকে এসেছি। বললাম ওইপার থেকে। লোকটা চোখ বড় বড় করে আমাদের দিকে তাকালো। তারপর আশেপাশে তাকালো। এরপর বললো... ইধার আও।



আমরা তার পিছপিছ বিএসএফ এর ক্যাম্পে ঢুকে গেলাম। সেই লোকটা তাদের ক্যাপ্টেনকে চেচিয়ে বললো... বাংলাদেশ ছে দো আদমি আয়া হ্যা। ক্যাপ্টেন গোছলখানায় ছিলেন। ওখান থেকে চেচিয়ে বললেন... বান্দো সালেকো।

আমাদের দুজনের গুর্দা শুকিয়ে কিসমিস।

আস্তে আস্তে বুঝতে পারছি কি বিপদে পড়েছি। এরমধ্যে একজন বাঙালী বিএসএফ আমাদের কাছে এসে বিষয়কি তা জেনে নিল এবং আমাদেরকে কি কি বিপদ হতে পারে তা জানালো। ক্যাপ্টেন তাড়াতাড়ি গোছল সেরে দুইজন বাংলাদেশিকে দেখতে এসে একটু ভড়কে গেল।

ক্যাপ্টেন আমাদের ইন্টারগেট করলো এবং আমরা বোঝাতে চেষ্টা করলাম যে ভুল করে আমরা এখানে এসেছি। ওই বাঙালী বিএসএফটা বেশ সাহায্য করেছিল।

ততক্ষনে প্রায় ১ ঘন্টা পার হয়ে গেছে। এবার অর্ডার হলো আমাদেরকে সার্চ করার। দেবজানিকে যেভাবে সার্চ করা হয়েছে তেমন করে সার্চ। আমাদেরকে একটা সেডে নেওয়া হলো। সার্চ শেষে আমরা আবার অপিসের সামনে ফিরে এলাম।

এবার কমান্ডর আমাদের সাথে ইয়ার্কি করা শুরু করলো।

আমারা তখন কিভাবে ফিরে যাবো সেই বুদ্ধি আটছি। আমরা শুনেছি একটু পর একটা সাপ্লাইয়ের ট্রাক আসবে। সেই ট্রাক যদি আমাদেরকে দেখে তাহলে আমাদেরকে চালন করা ছাড়া আর কোন উপায় থাকবে না। বিএসএফরা তখন সকালের প্যারেড করার জন্য ভারতীয় পতাকার সামনে জমায়েত হয়েছে।

ক্যাপ্টেন আমাদেরকে বললো.. প্যারেড ক্যারো। আমি বললাম সকাল থেকে কিছু খায়নি। প্যারেড করবো কিভাবে? তক্ষনি অর্ডান হলো রুটি-আলুভাজি-চা। মোটা মোটা দুটি রুটি, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই সাইজের মোটা মোটা করে কাটা আলু ভাজি আর মগের ভেতর কাচা পাতি সহ চা। সময় নিয়ে নিয়ে খেলাম যেন প্যারেড না করতে হয়।



এসবকিছুর মধ্যে আমরা দুজন নিচু স্বরে কথা বলে বুদ্ধি পাকাচ্ছি যে কিভাবে পালিয়ে যাওয়া যায়। খোকন পালাতে নারাজ। যদি গুলি করে...। ঠিক সেই সময় দেখলাম একজন হাফপ্যান্ট ছ্যান্ডো গেঞ্জি পরা বিএসএফ ১০/১৫ জোড়া বুট নিয়ে আমাদের দিকে আসছে। খোকন বললো... এবার আমাদের দিয়ে জুতো পরিস্কার করাবে।

বুটগুলো আমাদের পাশেই ধুপ করে ফেলে দিয়ে ওই বিএসএফটাই সাফ করতে বসলো আর আমাদের সাথে আলাপ শুরু করলো। আমি তাকে আবারো আমাদের এসএসসি পরিক্ষার কথাটা বুঝিয়ে বললাম। সে ক্যাপ্টেনকে বোঝাতে বললো। আর ভয়নেই বলে অভয় দিল।

আমাদেরকে গল্প করতে দেখে ক্যাপ্টেন বললো... ইধার আও, বাগান মে পানি দেও (সরি ফর মাই হিন্দি)।

এবার খোকন কেদেই ফেললো, সব দোষ তোর, তুই না বললে এখানে আসতাম না... এই সব হাংকিশ পাংকিশ।

বাগানে পানি দিতে দিতে আমরা গেটের কাছে চলে আসলাম। দেখলাম কেউ আমাদেরকে খেয়াল করছে না। মনে আছে সেই রাস্তার কথা? যেটা সোজা চলে গেছে খালের কাছে! আমরা এখন সেই রাস্তা থেকে মাত্র কয়েক গজ দুরে। রাস্তার ওপারে নেমে দৌড় দিলে আমাদেরকে ওরা দেখতেই পাবে না।

কিন্তু খোকন রাজি হয় না। ও কিছুতেই দৌড় দেবে না। আমিও ওকে ফেলে দৌড় দিতে পারছি না। বিপদের উপর ডবল বিপদ।

এতক্ষনে সকাল ১০টা বেজে গেছে।

আর ভাল লাগছে না। দুরে খালের ওপারে জাহিদকে দেখার চেষ্টা করলাম। নাহ,, ও নেই। খোকন ভেউ ভেউ করে কাদছে। আমি ওকে বোঝতে চেষ্টা করলাম, জাহিদ আমাদের খবরটা খালুকে দেবে।

খালু নিশ্চই একটা ব্যবস্থা করবেন। তুই কাদিসনে।

ফুলগাছে পানি দেওয়া শেষ। আমরা এবার ক্যাপ্টেনকে পটাবো। কিন্তু ক্যাপ্টেন বিজি।

অপিসের বারান্দায় বসে আছি। আকাশ পাতাল চিন্তা করছি। কাল যদি পরিক্ষা না দিতে পারি তাহলে এই বছর আর এসএসসি পাশ করা হবে না। বাড়িতে জিন্দেগী খাচাছাড়া করে দেবে। কিন্তু মুখে কিছুই বলছি না।

সবসময় মনে হচ্ছে এই বুঝি সাপ্লাইয়ের ট্রাক এসে গেল।

আমরা শিকারপুর বিএসএফ ক্যাম্পে আটক আছি নাকি আমাদের ছেড়ে দেওয়া হবে কিছুই বুঝতে পারছি না। গাছে পানি দেয়ার সময় পালানোর একটা সম্ভবনা ছিল সেটাও ভেস্তে গেছে। চরম অসহায় টাইপের সময় পার হচ্ছে। দুপুর সাড়ে বারোটার দিকে একজন কটমট করে আমাদেরকে গেটের সাথের সেন্ট্রি পোস্টে নিয়ে গিয়ে বসিয়ে রাখতে বললো।

বিএসএফ ক্যাম্পের মুল গেটের সাথে যে ছোট্ট ঘরটা থাকে সেখানে আমাদেরকে রাখা হলো। সেই শিমুল গাছটার সামনে, রাস্তার পাশে আমাদেরকে রেখে ওরা চলে গেল।

ঘরের আশে পাশে কেউ নেই। আমার চোখ আবার চকচক করে উঠলো। এখান থেকে ৩/৪ গজ দুরে রাস্তা,,, তারপর বেশ খানিকটা ফাকা মাঠ... তারপর খাল... খালের ওপারেই বাংলাদেশ।



রাস্তা একেবারে ফাকা। রাস্তার ওপাশের নিচে নেমে গেলে আমাদেরকে আর দেখা যাবে না। কেউ আমাদেরকে চোখে চোখে রাখছে না। এইতো সুযোগ। রক্ত গরম হয়ে যাচ্ছে।

কিন্তু... খোকন যাবে না। ওরা নাকি গুলি করার জন্য আমাদেরকে এখানে রেখে গেছে। আমরা দৌড়াবো আর আমাদেরকে ওরা গুলি করবে। টার্গেট প্রাকটিস।

বসে আছি তো বসে আছি।

অস্থির হয়ে বসে আছি। একজন পাশ দিয়ে যাচ্ছিলো, তার কাছে জানতে চাইলাম আমাদের কি হবে? সে বললো সাপ্লাইয়ের ট্রাক আসছে তাই আমাদের এখানে রাখা হয়েছে যেন ওরা দেখতে না পায়। ট্রাক দেখলেই আমরা যেন লুকিয়ে পড়ি। যাক এটুকু শিওর হলাম যে ওরা আমাদের চালান করবে না। কিন্তু ট্রাক তো আর আসে না।



দুইটার দিকে ওই বাঙালী বিএসএফ টাকে দেখে ডাকলাম। তাকে দিয়ে কমান্ডারকে বলে পাঠালাম যে আমি তার সাথে কথা বলতে চাই। এরপর আমাদেরকে আবার ক্যাম্পের ভেতর নেওয়া হলো। এখন দেখলাম ক্যাপ্টেনের মেজাজ বেশ নরম। আমাকে বললো তোমার যেন কে ওইপারে থাকে।

আমি বললাম খালু। এখন দেখি এই ব্যাটা খালুকে চেনে। মেজাজটা খ্রাপ হয়ে গেল।

ক্যাপ্টেন আমাকে বললো... যাও তোমার খালুকে ডেকে নিয়ে আসো। শর্ত হচ্ছে খোকনকে রেখে যেতে হবে।

খোকন থাকবে না। কোন ভাবেই না। ও বলে তুই থাক আমি যাই। অনেকটা জোর করে ওকে থুয়ে আমি চিলের মতো উড়ে খালার বাড়িতে চলে আসলাম।

খালাতো আমাকে দেখে ভুত দেখলেন।

এইপারে বড় কান্ড হয়ে গেছে। জাহিদ সব ঘটনা খালুকে বলেছে। খালু সেটা বাড়িতে জানিয়েছে। বাড়ি থেকে বড় ভাই ওখানে চলে এসেছে। বিডিআরের সাথে আলাপ শুরু হয়েছে।

আমাদেরকে ছাড়িয়ে আনতে মিটিং এর পরিকল্পনা হচ্ছে। আমি বললাম খালুকে ডেকে আনেন। কেউ যেন না জানে।

১০ মিনিটের মধ্যে খালু চলে এলেন। তাকে নিয়ে হাটতে হাটতে বিষয়টা ব্রিফ করলাম।

খালু শান্ত ভাবে আমার কথা শুনতে শুনতে খাল পার হলেন। ওপারের ক্যাম্পের পাশের রাস্তায় কমান্ডার আর দুজন বিএসএফ এবং খোকন ছিল। খালুর সাথে হাসি হাসি মুখে কমান্ডার কথা বললেন। কমান্ডার আমাদেরকে খুব ভাল ছেলে বলে প্রসংশা করলেন। এবং আগামী হাটবারের দিন এক কৌটা ডানো এবং দুইটা বড় ইলিশমাছ খালুকে দিয়ে যেতে বললেন।

খালু কিছু বলার আগেই আমি রাজি হয়ে গেলাম। তারপর কাউকে কিছু না জানিয়ে চুপি চুপি বাসে করে রাত আটটার দিকে কুষ্টিয়ায় ফেরত আসলাম।

আমার সেই বন্ধু জাহিদ বর্তমানে কুষ্টিয়া শহরে ব্যবসা করে।
আর বন্ধু খোকন সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে।


সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১০ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.