আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমাদের দিনগুলি ২: তিন দলের আত্তীয়-স্বজন

আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে বিরাজ সত্য সুন্দর
তিন দলের আত্তীয়-স্বজন


খুব বেশি করে তুষার পরছে আজ, ভোর থেকেই। এবারের শীতের সিজনটা একটু অন্যরকম যাচ্ছে। অন্য কোনো বছর ডিসেম্বর মাসে এত ঘন ঘন তুষার পরে না। আজ স্নো-ডে। অতিরিক্ত তুষারপাতের জন্য স্কুল, অফিস সব বন্ধ।

তারপরও ঘুম ভেঙ্গে গেল। কফি মেকারটা চালু করে জানালার পাশে এসে দাড়ালাম। ঘাসের উপর ইতিমধ্যেই কয়েক ইঞ্চি পুরু সাদা প্রলেপ পরে গেছে। এধরনের দিনগুলোতে মা'র কথা খুব মনে পরে। আমার মায়ের খুব বিদেশ যাওয়ার শখ ছিল, তুষারপাত দেখার তার খুব ইচ্ছা ছিল, কিন্তু কখনো সুযোগ হয়ে উঠেনি, এমনকি পার্শবর্তী দেশ ভারত বা নেপালও না।

আফসোস হয়, খুব অসময়েই আমার মা'টা এই পৃথিবী ছেড়ে চলে গিয়েছিল। ছোটবেলা থেকেই আমার যখনি অসহায় লাগত কোনো কারনে, মায়ের কথাই সব সময় সবচেয়ে আগে মনে পরত। আজ যদি মা বেঁচে থাকত, তাহলে কি আমাদের এই ভয়াবহ অসহায়ত্বের দিনগুলোতে আমাদের পাশে দাঁড়াত না?

কিছু কিছু পরিবাব্রের কাছ থেকে জেনেছি, ওরা আত্তীয়দের কাছ থেকে একটু সাহস, সহমর্মিতা, আর সহযোগিতা পেয়ে নিজেদেরকে আরো বেশি শক্ত আর তৈরী করতে পেরেছে। আমি ঢাকায় একটা পরিবারকে চিনতাম। দাদা, দাদী তাদের অটিস্টিক নাতিকে নিয়ে কি না করত।

স্কুল আর থেরাপি দিতে নিয়ে যাওয়া ছাড়াও খাওয়ানো, ব্যায়াম করানো, টয়লেট ট্রেনিং - সব কিছুতেই ওরা সময় দিত। কিন্তু এটা একটা উদাহরন মাত্র, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বাবা মাকে একা একাই এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হয়, এটা আগের একটা পোস্টে লিখেছিলাম।

আজকে আমার পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে যা পেয়েছি বা পাচ্ছি সেটা নিয়েই লিখার ইচ্ছা হচ্ছে। হয়ত অনেকের সাথে মিলে যাবে, হয়ত যাবে না। তবে সব তো আর একদিনে হবে না, আস্তে আস্তে সবার কথাই আসবে ভবিষ্যতে - অন্য কোনো সময়।

আজ তিন ধরনের আত্তীয়-পরিজনদের কথা বলব। প্রথম দলে আছে অভিযোগকারীরা। অনেকেই পিতামাতার দুর্বল অভিভাবকত্ব সন্তানের অটিজমের জন্য দায়ী বলে করেন। আমার বাবার কথাই যাক। অরনীর বয়স যখন সাড়ে তিন চলছে, নিয়মিত থেরাপি দেওয়া হচ্ছে, ঢাকা থেকে একদিন ফোন করে বললেন, "মেয়েটার আজকের এই অবস্থার জন্য আমি মনে করি তোমরাই দায়ী।

ওর ঠিক মত যত্ন, দেখা শুনা হয় নাই"।

আমার একটু অবাক লেগেছিল যে এত মাস ধরে এত কিছু বুঝিয়ে বলার পরও বাবা কিভাবে এভাবে বলতে পারলেন। রাগ, অভিমান, আর কষ্টগুলো বুকের মধ্যে চেপে আমার সাধ্যমত আবারও বুঝানোর চেষ্টা করলাম। পাশাপাশি অন্যদেরকেও কথাটা জানালাম, কিন্তু কারো কোনো ধরনের প্রতিক্রিয়া হলো বলে মনে হলো না। বরং মনে হলো অন্যরাও হয়ত এটা বিশ্বাস করে যে অরনীর অটিজমের পেছনে জন্ম-পরবর্তী সময়কার আমাদের দূর্বল অভিভাকত্ব দায়ী।

অথচ এই মানুষগুলোই কিন্তু আমাদেরকে শুরুতে অন্যরকম বলত। যখন অরনীর ডায়াগনসিস হলো, আমাদেরকে সান্তনা দেওয়ার ছলে ওরা বলত, "ও কিছু না, সব ঠিক হয়ে যাবে। ডাক্তাররা কত কথাই না বলে। "

ওদের কথা শুনে যদি চুপচাপ বসে থাকতাম, তাহলে মেয়েটার যতটুকুই বা উন্নতি হচ্ছে, সেটাও হত না। সেটাই বরং হত দূর্বল অভিভাকত্ব।

উন্নত বিশ্বে এই যে এত গবেষনা করেও অটিজমের রহস্যগুলো বের করতে পারছে না, আর ওরা এমনি এমনি জেনে গেল দূর্বল অভিভাকত্বর জন্যই সব হচ্ছে। এদের অভিযোগের তালিকায় আরো কয়েকটা বিষয় থাকত - আরেকটা বাচ্চা না নেওয়া, ঘন ঘন পার্টি দিয়ে ওরনীকে এক মাসের মধ্যে সোশ্যাল বানিয়ে না ফেলা, ইত্যাদি।

দ্বিতীয় দলে আছে "পাশ কাটানো" আর "দায়িত্ব এড়ানো" মানুষ। এদের প্রধান কাজ হলো কান্না কাটি করা। এরা আমাদের সাথে কথা বলতে পারে না, কারণ এদের শুধুই কান্না পায়।

কালে ভদ্রে এরা কিছু বলতে পারে। একজনের উদাহরন দেই। আমার এক ফুফু থাকেন মধ্যপ্রাচ্যে। আমার পুরো পরিবারের মুরুব্বিদের মধ্যে শুধু তাঁর সাথেই একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল আমার সব সময়। আমার এই পূবালী ফুফু খুব আমুদে আর সুখী একজন মানুষ।

আত্তীয়-স্বজনদের জন্য কি না করেন। তাঁর জীবনের বেশির ভাগ সময়ই কেটে গেছে শুধু অন্যদের কথা ভাবতে ভাবতে। তাঁর জীবনের দুঃখ-কষ্টের নমুনাগুলো হচ্ছে এরকম। শাড়ির সাথে ম্যাচিং স্কার্ফ খুঁজে না পাওয়া, মেহমানকে বেশী করে খাওয়াতে না পারা, প্রতিদিন দিনের বেলা ঘুম পাওয়া, ইত্যাদি।

তো, পূবালী ফুফু কয়েকটি কথা প্রায়ই আমাকে আর লাবনীকে বলেন, "আমার অনেক কান্না পায়, তাই ফোন করি না", "তোমরা বেশি বেশি চিন্তা কর", "দোয়া করছি সব ঠিক হয়ে যাবে"।



একই ধরনের কথা এই দলের অন্যরাও বলেছে। একবার একজন বলেছিল, "তোমরা এত ভেব না, আমার এক বন্ধুর মেয়ে তো বোবা, কিন্তু তার কি সুন্দর বিয়ে হয়ে গেল", "মেয়েকে নিয়ে লজ্জা পাওয়ার কিছু নাই - আল্লাহ যেমন দিয়েছে তাই নিয়েই চলতে হবে"।

এদের বোঝানো অসম্ভব যে আমরা মোটেও কিছু "ঠিক হয়ে যাওয়ার" আশায় নেই। আমরা মোটেও লজ্জিত না। আমরা মেয়ে ভবিষ্যতে বিয়ে করবে কি করবে না এসব নিয়ে মোটেও ভাবছি না।

ভাবার জন্য আর করার জন্য আমাদের আরো অনেক কিছু আছে। এরা সবাই শিক্ষিত, কিন্তু অটিজম এর উপর একটা বই না হোক, একটা আর্টিকেলও কেউ পড়ে দেখেনি, একটা ডকুমেন্টারী দেখেনি। এরপরও সবাই যেন সবজান্তা। দোয়া করা আর সব ঠিক হয়ে যাবার মিথ্যা আশ্বাস দেওয়া ছাড়া এদের আর কিছু করার নেই। সমস্যার ভিতর কেউ ঢুকতে চায় না।

কারন এর মধ্যে তো কোনো বিনোদন নেই, মজা নেই। তার চেয়ে "সব ঠিক হয়ে যাবে" বলে যতদিন মূল সমস্যাকে পাশ কাটিয়ে দায়িত্ব এড়ানো যায়, ততই তো ভালো।

তৃতীয় দলটি আরো ভয়ংকর। এরা সরাসরি কথায় বা আকার ইঙ্গিতে ভালো মত বুঝিয়ে দেয় যে আমাদের এই সমস্যাটা নিয়ে ওরা থোরাই কেয়ার করে। সুযোগ পেলে অরনীকে ঘিরে অপমানজনক কথা বলতেও ছাড়ে না।

আর এদের কাছে আমি আর লাবনী হচ্ছি চরম ব্যর্থ মানুষ - looser। মনে পরে যাচ্ছে আমার ছোট ভাই জামীর কথা। জামী, তার স্ত্রী দিয়া, আর মেয়ে যুক্তরাষ্ট্র বেড়াতে আসল গত বছর। এমনিতে দেশ থেকে আমাদের এখানে তেমন কেউ আসে না। ওরা আসার পর আমাদের এটা ভেবে ভালো লাগছিল যে অরনীকে কাছ থেকে দেখলে হয়ত আমাদের সমস্যার গভীরতাটুকু একটু হলেও বুঝতে পারবে।

একটু বাড়াবাড়ি রকমের আশা করে ফেলেছিলাম। অরনীকে একটু বুঝার চেষ্টা করা, ওর সাথে কিছু খেলা, একটু সময় কাটানো, বা অন্তত একটু আদর করা এসবের ধারে কাছেও গেলনা আমার ভাইটি। উল্টো, ওর প্রবাসী বন্ধুদের সামনে মেয়েটিকে অপমান করলো বিভিন্ন ভাবে। অরনী কথা বলে না, ঠিক মত রেসপন্স করে না, অন্য ছোট বাচ্চাদের মত করে মজা দিতে পারে না - এগুলো ওর দোষ।

ওরা আমাদের এখানে থাকলো প্রায় এক মাস।

অরনীর দৈনন্দিন রুটিন, খাওয়া দাওয়ার সীমাবদ্ধতা, বাইরে বেড়ানোর সীমাবদ্ধতা কিছুই মানতে চাইল না। প্রায় সবটুকু সময়ই মন খারাপ করে রাখল এই ভেবে যে ওদের ঠিক মত আদর, যত্ন, খাওয়া, বেড়ানো, কেনা কাটা, এসব কোনটাই হচ্ছে না। যতই আমাদের সমস্যাগুলো বুঝানোর চেষ্টা করলাম, ততই নিজেকে গুটিয়ে রাখল। নিজের ভাইয়ের মেয়েটাকে এত কাছে পেয়েও একটু বোঝার চেষ্টা করলো না। ওদের কাছ থেকে যে ধাক্কাটা খেলাম, এটা জীবনের অন্যতম একটা লেসন হয়ে থাকবে।

সব কথা লিখা যায় না, লিখতে ইচ্ছেও করছে না, অন্তত আজকে।

খুব ছোট বেলা থেকে আমার স্ট্যাম্প সংগ্রহ করার একটা বাতিক ছিল। স্কুলের টিফিনের টাকা, ঈদের সালামি, এসব জমিয়ে শ'য়ে শ'য়ে স্ট্যাম্প কিনতাম। যখন আগ্রহটা কমে এলো, তখন জামীর ওই বয়সটা চলে এলো। সেও শুরু করতে চাইল।

আমার এত বছরের স্ট্যাম্প এলবামটা ওকে উপহার দিলাম। প্রচন্ড খুশি হলো, কিন্তু পরেরদিন পাড়ার একটা ছেলের কাছে চড়া দামে বিক্রি করে দিল। তো এই ঘটনা কেন যেন আমার আজও মনে আছে। অরনীর ডায়াগনসিস হওয়ার পর লাবনী ঢাকা চলে গিয়েছিল মেয়েকে নিয়ে কয়েক মাসের জন্য। একটু ছোট্ট আশা ছিল, হয়ত আপনজনদের দেখে, অনেক মানুষ দেখে, অন্য ছোট ছোট বাচ্চা দেখে অরনীর মধ্যে কোনো পরিবর্তন আসতেও পারে।

অন্য অনেকেই যেটা করেছিল, আমার ভাইটিও তাই করেছিল। ছয় মাসের মধ্যে একটা দিনও অরনীকে একটু সময় দিতে পারেনি, বেড়াতে নিয়ে যেতে পারে নি, নিজের মেয়েটার সাথে খেলার সুযোগ করে দিতে পারেনি। কার কাছে আমি কি আশা করতে গিয়েছিলাম।

***********************

বরফ পরা বন্ধ হয়ে গেছে বেশ কিছুক্ষন হলো। চারদিকে শুধু সাদা আর সাদা।

অরনী আর তার মা লাবনী বাড়ির পেছনে বরফ নিয়ে খেলছে। সাথে আছে অরনীর দুই কাজিন - ইমাম ভাই আর পপি আপা। ওদের কথা না হয় অন্য একদিন হবে। ওরা সবাই মিলে এখন স্নো-ম্যান বানাবে। আমার কফি শেষ।

আমিও কামেরাটা নিয়ে বেরিয়ে পরলাম।

ডিসক্লেইমার: কোনো চরিত্রই কাল্পনিক নয়, তবে কিছু নাম কাল্পনিক।
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।