বহুল আলোচিত পদ্মা সেতু এলাকায় বৃহৎ শিল্প-কারখানা গড়তে যাচ্ছেন দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ব্যবসায়ীরা। তাদের অনেকেই শিল্পায়নকে পরিকল্পনায় রেখে সেতু প্রকল্প এলাকার কাছাকাছি জমি কিনেছেন। কিছু কিছু এলাকায় ইতোমধ্যে ক্ষুদ্র শিল্প-প্রতিষ্ঠানও গড়ে উঠেছে। ব্যবসায়ীরা বলেছেন, পদ্মা সেতু এবং গ্যাস সংযোগ নিশ্চিত হলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে যুগান্তকারী উন্নয়ন হবে। এই এলাকায় শিল্পায়নের ধুম পড়বে।
বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে গতি আসবে দক্ষিণাঞ্চলে। পদ্মা সেতুর বাস্তবায়ন নিয়ে দীর্ঘদিনের প্রতীক্ষায় রয়েছেন দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ১৯ জেলার কয়েক কোটি মানুষ। সরকারও মনে করছে, পদ্মা সেতু নির্মিত হলে চাঙ্গা হবে দক্ষিণের অর্থনীতি। এ আশা নিয়ে বৃহৎ বৃহৎ শিল্প গড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন এই অঞ্চলের প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী-শিল্পপতি ও পুঁজিপতিরা। ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্পায়ন নিয়ে আগ্রহী পদ্মাপাড়ের ব্যবসায়ীরাও।
ইতোমধ্যে পদ্মা সেতু ঘিরে দক্ষিণ বঙ্গের বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠেছে ক্ষুদ্রশিল্প। সব মিলিয়ে পদ্মা সেতুর সুফল কাজে লাগিয়ে পুরোদমে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু হলে দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির হার ১ দশমিক ২ শতাংশ বাড়তে পারে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য শিল্পায়ন নিয়ে সরকারের পরিকল্পনা সম্পর্কে পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল (লোটাস কামাল) বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সেখানে জমি সস্তা। সস্তা শ্রমে লোকবলেরও অভাব নেই। কিন্তু জ্বালানি সমস্যা রয়েছে।
তবে পদ্মা সেতু নির্মাণ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে জ্বালানি সমস্যাও থাকবে না। জরুরি ভিত্তিতে জ্বালানি সমস্যা সমাধানের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। ফলে সেখানে ইতোমধ্যে যারা শিল্পায়নের প্রস্তুতি নিয়ে কাজ শুরু করেছেন, তারা অধিক লাভবান হবেন। পুরো দেশের উন্নয়নে সরকার সুষম অর্থনৈতিক কাঠামো তৈরি করে এগোচ্ছে বলে জানান তিনি। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) সভাপতি কাজী আকরাম উদ্দিন আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ব্যবসায়ীরা সেখানে শিল্পায়নের জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত।
তারা অনেকে জমি কিনেছেন। এখন শুধু তাদের প্রতীক্ষা কবে পদ্মা সেতুর কাজ শেষ হবে। কারণ, যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো হলে, পণ্য সরবরাহ স্বাভাবিক থাকবে তার নিশ্চয়তা ব্যবসায়ীরা পেলে শিল্পায়নের ধুম পড়বে। ফলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতিও বাড়বে বলে মনে করেন এই ব্যবসায়ী নেতা। সরকার-ব্যবসায়ী ও সংশ্লিষ্টদের মতে, পদ্মা সেতু নির্মিত হলে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে গ্যাসের নিশ্চয়তা থাকতে হবে।
এটা নিশ্চিত হলেই বাড়বে ব্যাপক কর্মসংস্থান। কমবে আয় বৈষম্য। মংলা বন্দরে আসবে গতিশীলতা। কুয়াকাটায় যে বন্দর নির্মিত হচ্ছে, সেটি হবে গতিশীল। বাণিজ্য সম্প্রসারণেও পদ্মা সেতু হবে নতুন মাইলফলক।
গ্রামীণ অর্থনীতির উৎপাদনশীলতা হবে রপ্তানিমুখী। দারিদ্র্য নিরসন এবং আর্থ-সামাজিক উন্নয়নেও ভূমিকা রাখবে এ সেতু। পাশাপাশি পাটশিল্প তার হারানো ঐতিহ্য ফিরে পাবে।
এসব সম্ভাবনা বিবেচনায় নিয়েই আলোচনা-সমালোচনা ও বিতর্কের মুখে পদ্মা সেতু নির্মাণে এগোচ্ছে সরকার। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত চলতি ২০১৩-১৪ অর্থবছরের বাজেটে পদ্মা সেতু প্রসঙ্গে বলেন, সরকারের একটি অন্যতম উন্নয়ন প্রকল্প হলো পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মাণ।
আমরা এই প্রকল্প বাস্তবায়নে অধিকতর বিলম্ব পরিহারের জন্য নিজস্ব অর্থায়নে প্রাথমিক কাজ শুরু করেছি। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ কাজ সরকারের জন্য একমাত্র উপায়। অর্থ মন্ত্রণালয় প্রকাশিত সর্বশেষ অর্থনৈতিক সমীক্ষা-২০১৩-এর তথ্যমতে, বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণে সাফল্যের পর সরকার দেশের সব অঞ্চলের মধ্যে সুষ্ঠু এবং সমন্বিত যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে মাওয়া-জাজিরা পয়েন্টে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্পকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছে। এ প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য ব্যয় হবে ২০ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা। পদ্মা সেতু হলে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বরিশাল, পটুয়াখালী, খুলনা, যশোর, শরীয়তপুর, গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর, মাদারীপুরসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ১৯টি জেলার সঙ্গে রাজধানী ঢাকাসহ উত্তরাঞ্চলের একটি উন্নত যোগাযোগ নেটওয়ার্ক গড়ে উঠবে।
সেতুটির নির্মাণ কাজ শেষ হলে যাতায়াতের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখার পাশাপাশি পদ্মা সেতু উৎপাদন বাড়ানো, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, আয় বৃদ্ধি ও দারিদ্র্য নিরসনসহ জাতীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা রাখবে। এ ছাড়াও পদ্মা সেতু এশিয়ান হাইওয়েতে অবস্থিত হওয়ায় বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ যাতায়াত ব্যবস্থার পাশাপাশি দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে যাতায়াত ব্যবস্থায় যুগান্তকারী পরিবর্তন ও সুযোগ সৃষ্টি হবে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে খুলনা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (কেসিসিআই) সভাপতি কাজী আমিনুল হক বলেন, পদ্মা সেতু হলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের গ্রামীণ অর্থনীতির ভিত্তি যেমন শক্তিশালী হবে, তেমনি জাতীয় অর্থনীতির চাকাও গতিশীল হবে। তিনি বলেন, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জমি ও জনবল সহজলভ্য এবং সস্তা হওয়ায় বিদেশি বিনিয়োগ বেশি আসবে। সিডর ও আইলায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষেরা ঘরে বসেই কর্মসংস্থান করতে পারবেন।
তবে এ জন্য প্রয়োজন গ্যাসের নিশ্চয়তা। কেসিসিআই সভাপতি বলেন, ইতোমধ্যে অনেক ক্ষুদ্রশিল্প গড়ে উঠেছে। বৃহৎ শিল্প গড়ার পরিকল্পনা নিয়ে অনেক শিল্পপতি ও ব্যবসায়ী কাজ করছেন। এ জন্য ঢাকা ও চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় জমি কিনে রেখেছেন বলেও জানান এই ব্যবসায়ী নেতা। বরিশাল চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিসিআই) সভাপতি সাইদুর রহমান রিন্টু বলেন, পদ্মা সেতু ও কুয়াকাটায় তৃতীয় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ কাজ শেষ হলে এ এলাকায় ব্যাপক শিল্পায়ন হবে।
সে শিল্পায়নের অংশ হিসেবে দক্ষিণ বঙ্গের শিল্পপতি-ব্যবসায়ীরা তৈরি পোশাক, আবাসনসহ বিভিন্ন ধরনের শিল্প-কারখানা স্থাপনের উদ্যোগ নিচ্ছেন। এর ফলে এ এলাকার আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন হবে, শ্রমিকরা ঢাকামুখী না হয়ে বরিশালমুখী হবেন। আগামীতে চট্টগ্রামের পর বরিশালই হবে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র। বরিশালের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (ডিসিসিআই) সভাপতি মো. শাহজাহান খান বলেন, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষ প্রতীক্ষার প্রহর গুনছে কবে পদ্মা সেতু হবে। আর পদ্মা সেতুর অগ্রগতি দেখেই এই অঞ্চলের ব্যবসায়ীরা পুরোদমে বিনিয়োগে নামবেন।
তবে সেতু নির্মাণ বিলম্বিত হওয়ায় অনেকে শিল্প-কারখানার জন্য জমি কিনে হতাশায় ভুগছেন। খুলনার বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ইএবি) সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী বলেন, পদ্মা সেতু আর গ্যাস হলে আমরা খুলনায় বসেই মংলা বন্দরের মাধ্যমে পণ্য রপ্তানি করতে পারব। এ দুটোর কারণেই খুলনায় শিল্পায়ন হচ্ছে না। পদ্মা সেতু হলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে তৈরি পোশাক শিল্পসহ বিভিন্ন শিল্প স্থাপন সহজ হবে বলে মনে করেন তিনি।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।