আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমাদের দিনগুলি - ৩: নিয়মিতভাবে অনিয়মিত এবং আমাদের অবকাশ যাপন



এইতোকিছুদিন আগেই ছিল আমাদের ১২ তম বিবাহবার্ষিকী। এক যুগ পেরিয়ে গেল দেখতে দেখতে, বিশেষ করে গত পাঁচটি বছর। অরনীর জন্মের পর থেকে জীবনটা খুব দ্রুত চলতে লাগলো। নাকি জীবন স্থবির হয়ে আছে কোনো একটি জায়গায়, কে জানে। বিয়ের পর লাবনী আর আমি প্রথম ক'টি বছরে অনেক বেড়াতাম।

ইস্ট কোস্ট - যেখানে আমরা থাকি - এখানে তো বটেই, ওয়েস্ট কোস্ট, সাউথ, আর মিড-ওয়েস্টের অনেকগুলো অঙ্গরাজ্যে বেড়াতে গিয়েছি, কখনো কারো নিমন্ত্রনে, কখনো আমার কোনো কনফারেন্সে, আর কখনো শুধুই বেড়াতে। লাবনীর খুব ছোট বেলা থেকেই বই পড়ার খুব নেশা ছিল। ভ্রমন কাহিনী তার খুব পছন্দের ছিল বরাবরই। বিয়ের আগে আমাদের প্রায় এক বছর ইমেইল চালাচালি ছিল। ও ঢাকায়, আমি এখানে।

মনে পড়ে, সুনীলের ছবির দেশে কবিতার দেশে নিয়ে অনেকদিন গল্প হত। আমেরিকার নামকরা দ্রষ্টব্য স্থানগুলো সবই তো অনেক দূরে দূরে। তাই সবতো একসাথে দেখে ফেলা সম্ভব না, তাই আস্তে আস্তে শুরু করেছিলাম। বেড়ানো নিয়ে লাবনীর একটা ব্যাপার আমার খুব পছন্দ ছিল। ও শুধু তথাকথিত নামকরা ভ্রমনের স্থানগুলো দেখতে চাইত না, অনেক ছোট ছোট শহর বা ছোট একটা অজানা লেক দেখেও তাকে আমি অনেক খুশি হতে দেখেছি।

একটা লাল ইটের সরু গলি, পুরানো আধা ভাঙ্গা ভবন, কিংবা ম্যানহাটনের ব্যস্ত রাস্তা - সবকিছুতেই একটা ভালো লাগা, মুগ্ধতার ব্যাপার লক্ষ্য করতাম।

যাই হোক, আমাদের জীবনে অরনী আসার পর থেকে স্বাভাবিক ভাবেই বেড়ানোর ব্যাপারটা কমে গেল। তারপরও মাঝে মাঝে বেড়িয়েছি। অরনীর ৫ মাস বয়সেই নিউ ইয়র্ক থেকে ঢাকা, এরপর আবার কক্সবাজার যাওয়া, ২ বছরের মাথায় আবার ঢাকা যাওয়া এগুলো করেছি। ওর বয়স যখন তিন, তখন সাউথের একটা বিখ্যাত অঙ্গরাজ্যে এক সপ্তাহের জন্য গেলাম।

তখন পর্যন্ত অরনীকে নিয়ে প্লেন জার্নির কথা ভাবতে পারতাম। আজকাল সাহস হয় না। তাই গত দু'বছর ধরে আমরা স্বপরিবারে কোনো প্লেন জার্নি করিনি। আর ৩/৪ ঘন্টার ড্রাইভিং রেঞ্জে না থাকলে গাড়ীতে করেও দূরে যাবার কথা ভাবতে পারি না। আর কিছুদিন পর আমাদের বাসায় কিছু অতিথি আসবেন ।

ঢাকা থেকে লাবনীর বড় বোন শাহানা আপা তার পরিবারসহ আসছেন বেড়াতে। আমাদের এখানে কয়েকদিন থেকে উনারা ফ্লোরিডা যাবেন, অরল্যান্ডোতে। ঐখানে একই সাথে বেশ কয়েকটা থিম পার্কে বেড়াতে পারবেন, যেমন ডিজনী ল্যান্ড, ইউনিভার্সাল ষ্টুডিও, সী ওয়ার্ল্ড। এছাড়া কাছাকাছি সমুদ্র সৈকত আছে - আটলান্টিক এক প্রান্তে, গালফ কোস্ট আরেক প্রান্তে। আরো আছে সোয়াম্প (swamp) টুর।

বেড়ানোর জন্য অসম্ভব আকর্ষণীয় একটি অঞ্চল।

তো, শাহানা আপা অনেকবার করে আমাদেরকে বলছেন যেন উনাদের সাথে আমরাও অরল্যান্ডোতে যাই কয়েকদিনের জন্য। আমরা শুরুতেই নাকচ করে দিলাম। বললাম অনেক খরচ, এখন সম্ভব না। আসলে বেড়াতে গেলে খরচ তো হবেই - প্লেন ভাড়া, হোটেল ভাড়া, গাড়ী ভাড়া (আমেরিকার এসব শহরে গাড়ি ছাড়া পাবলিক ট্রান্সপোর্ট দিয়ে চলাচল করা সম্ভব না), পার্কিং ফী, থিম পার্কের টিকেট (একেকটা থিম পার্ক প্রায় ১০০ ডলার করে জন প্রতি), খাওয়া দাওয়া, আর অন্যান্ন আনুষঙ্গিক খরচ।

আমাদের তিনজনের খরচ বাবদ প্রায় ১৫০০ - ২০০০ ডলারের ব্যাপার। আমাদের মূল কারনতো অন্য জায়গায়, কিন্তু এটাই বললাম। কিন্তু উনারা নাছোড় বান্দা। বললেন হোটেল, গাড়ি ভাড়ার দায়িত্ব উনাদের। প্রয়োজন হলে প্লেন ভাড়াও দিবেন।

এখন আমরা বসলাম হিসাব কষতে। ওরনীকে নিয়ে এরকম একটা টুর করা ঠিক হবে, কি হবে না।

অরনীর একজন থেরাপিস্ট একবার আমাদেরকে বলেছিল - "অরনী হচ্ছে এমন একজন মানুষ যে নাকি নিয়মিতভাবে অনিয়মিত"। অটিস্টিক শিশুরা সবাই এরকম নয়, তবে অনেকেই এরকম থাকে। আমাদের জন্য একেকটা দিন একেক ভাবে আসে।

আজ যেটা অরনী খুব স্বাভাবিক ভাবে করলো, খুব মজা পেল, আরেকদিন সেটা নিয়ে হুলুস্থুল কান্ড বেঁধে যাবে। কিছু উদাহরন দেওয়া যাক। আপনারা অনেকেই হয়ত ইন্ফ্লাটেবলে বাউন্স করা দেখেছেন। এটা বাচ্চাদের একটা খুব প্রিয় কর্মকান্ড। এখানে ইন্ডাস্ট্রিয়াল এলাকাগুলোতে বড় জায়গা জুড়ে এধরনের আয়োজন থাকে - ওখানে জন্মদিনের পার্টি হয় বা বাচ্চারা এমনিতেই বাউন্স করতে যায়।

আমরা অরনীকে নিয়ে ৩ বছর বয়স থেকেই অসংখ্যবার গিয়েছি। কোনো কোনো দিন অনেক মজা পেয়েছে, কোনো দিন তেমন না। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে ও এসব জায়গা গেলেই কাঁদতে থাকে। একদিন একটা জন্মদিনের অনুষ্ঠানে গেলাম। অরনী মনে হয় প্রায় ১ ঘন্টা ধরে কাঁদলো।

পার্টির কেক কাটা হয়নি দেখে আমরা অপেখ্যা করছিলাম। ১ ঘন্টা পর নিজে থেকেই ও বাউন্স করতে চাইল। এরপর একবার শুরু করার পর আর বিরতি নেই। একটার পর একটা ইন্ফ্লাটেবলে গেলো আর বাউন্স করলো, স্লাইড করলো, অন্য সব বাচ্চাদের সাথে। আমরাও খুশি।

কয়েকদিন পর অভ্যাসটা ধরে রাখার জন্য আমরা আবারও সেখানে গেলাম। এইবার শুরুতে অনেক খুশী, কিন্তু এরপর যে কি হলো কিছুই বুঝতে পারলাম না। ভয়ে চিতকার করতে লাগলো। লোক জড়ো হলো। আমরা একটু পরেই বাসা ফেরত আসতে বাধ্য হলাম।





এরকম ঘটনা সব সময়ই হয়। কোথাও যেতে চাইলে লাবনী আর আমার বুকের ভিতর একটা চাপা ব্যাথা শুরু হয় - আজ কি হবে, আজ কি হবে - একটা চরম অনিশ্চিয়তা। এভাবে বেড়ানোর তো কোনো মজা নেই, শুধু অরনীর জন্যই যাওয়া। একবার অরনীর স্কুল থেকে ফিল্ড ট্রিপে যাওয়ার কথা বাসে করে। সকালে স্কুলে দিয়ে আসলাম।

বেশ ভালই ছিল। ১ ঘন্টা পর স্কুল থেকে ফোন আসল। অরনী তখনও ভালই আছে, কিন্তু ফিল্ড ট্রিপে যেতে পারেনি। বাসে উঠা মাত্রই নাকি এমন কান্না আর ভয় পেয়ে এমন চিতকার শুরু করলো যে ২/৩ জন টিচার চেষ্টা করেও ওকে শান্ত করতে পারেনি। ওকে মানসিকভাবে যন্ত্রনা না দেওয়ার জন্যই বাস থেকে নামিয়ে আবার ক্লাসরুমে ফেরত পাঠালো।

একই ঘটনা আমাদের সাথেও ঘটেছে অনেকবার। আমাদের এলাকার লাইব্রেরিতে গল্প শোনার আসরে একদিন খুব ভালো, তো পরের দিন কান্না, চিতকার। যখন ছোট ছিল, ভয় পাওয়ার ব্যাপারটা এত প্রকট ছিল না। এখন একবার কিছুতে ভয় পেলে এটার জের বেশ কয়েকদিন থাকে।

তো লাবনী আর আমি একটা লিস্ট বানালাম।

শুরুতেই প্লেন জার্নির ধাক্কা। যদি অরনী প্রচন্ড ভয় পেয়ে চিতকার শুরু করে, প্লেনে উঠতে না চায়, তখন কি করব। আমি কখনো ওকে খুব বেশি জোড় করে কিছু করাতে চাই না। এতে হিতে বিপরীতই হয়। আর জোড় করে, ভয় পাইয়ে আর যাই হোক ভ্যাকেশন হয় না।

আমাদের মনে হচ্ছে আরেকটা বছর যাক। যখন অরনী আমাদের সাথে তার ভয় আর অন্যান্য কষ্টগুলো একটু কথা বলে বা অন্যভাবে বুঝাতে পারবে তখন আমাদের জন্যও তাকে বুঝানো একটু সহজ হবে। দ্বিতীয় চিন্তা হচ্ছে ডিজনীল্যান্ডের ভিড় নিয়ে। আমি ২ বার এই থিম পার্কটাতে গিয়েছি - একবার এক বন্ধুর পরিবারের সঙ্গে, আরেকবার লাবনীর সঙ্গে। একই দৃশ্য।

প্রতিটা রাইডের সামনে বিশাল লম্বা লাইন। কিছু কিছু লাইন এত লম্বা হয় যে ২/৩ ঘন্টা রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। এটা তো অরনীর জন্য অসম্ভব যন্ত্রণা হবে। এরপর আছে হই হট্টগোল। প্রচুর মানুষ গিজগিজ করছে চারদিকে।

গান বাজছে। রাইডে যারা চড়ছে তারা আনন্দে চিত্কার করছে। অরনীর আজকাল কড়া, বিকট শব্দে সমস্যা হয়। যদি কোনো মত ডিজনীল্যান্ডে ঢুকতেও পারি, ১/২ ঘন্টার মধ্যেই বের হয়ে আসতে হতে পারে। এরকম ঘটনা অনেক ঘটেছে যে আমাদের কাছাকাছি ডিজনীল্যান্ডের তুলনায় একেবারেই ছোট থিমপার্কে গিয়ে ৫ মিনিটের মধ্যে বের হয়ে আসতে হয়েছে।

কিছুদিন আগেও ডিজনীল্যান্ডে অটিস্টিক শিশুদের জন্য বিশেষ পাস থাকত যেন ওদেরকে লাইন এ দাঁড়াতে না হয়। এখন ওরা সেটা বন্ধ করে দিয়েছে। এসবের পাশাপাশি অরনীর শারীরিক কিছু সমস্যা তো সব সময়ই থাকে। মাড়ির দাঁত (মোলার) উঠি উঠি করছে, প্রায়ই ব্যথা থাকে। কোস্ট-কাঠিন্যের সমস্যা তো লেগেই আছে।

গত সপ্তাহে যখন ৬ দিন বাথরুম করলো না, ডাক্তার বলল হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে বৃহদান্ত্র ওয়াশ করাতে। যাই হোক, এরকম আরো অনেক কিছু লিস্ট করলাম। এরপর সিধ্যান্ত নিলাম যে এত রিস্ক নিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না। বেড়ানোর জন্য যদি ও traumatize হয় তার চেয়ে খারাপ কিছু তো হতে পারে না। এই বছরটা বাদ দেই।

ইনশাল্লাহ আগামী বছর। তখন হয়ত সামগ্রিক অবস্থাটা আরেকটু ভালো হতে পারে।

আট বছর আগের কথা মনে পড়ছে। আমি লাবনীর হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছি ডিজনীওয়ার্ল্ড ম্যাজিক কিংডমের ফ্যান্টাসিল্যান্ডের একটা জনপ্রিয় রাইডের সামনে - "it's a small world". যারা জানেন না - এটা একটা বোট রাইড। মূলত একেবারে ছোট বাচ্চাদের রাইড।

পানির মধ্য দিয়ে বোটটা চলতে থাকে। একটার পর একটা আইল্যান্ড পার হয়। বিশ্বের সব মহাদেশের বাচ্চাদের পুতুল তাদের বেশভূষা আর সাজসজ্জায় সজ্জিত। আর ব্যাকগ্রাউন্ড এ it's a small world গানটা বাজতে থাকে। অসম্ভব সুন্দর করে সাজানো একটা রাইড, লিখে যেটার অভিজ্ঞতা বর্ণনা সম্ভব নয়।

রাইড শেষ করে বাইরে যখন আমরা হাঁটছি, তখন দুজনেরই একই কথা মনে আসলো। যদি কখনও একটি সন্তানের বাবা মা হতে পারি তবে ওকে নিয়ে এখানে আসব ইনশাল্লাহ। আজ যা দেখে গেলাম, ওকে নিয়ে আবারও দেখব। ওর চোখ দিয়ে দেখব, ওর মন দিয়ে অনুভব করব। সেই আকাঙ্খাটা যে আজও রয়ে গেছে ...


 ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।