আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পনেরো জন সম্পাদকের রহস্যময় বিবৃতি

আমাদের বাল্যকালে কলকাতা থেকে আসা শ্রী স্বপন কুমার রচিত মিনি গোয়েন্দা উপন্যাসগুলো আমাদের প্রজন্মের কাছে বেশ জনপ্রিয় ছিল; যেমনটা আজকের প্রজন্মের কাছে জনপ্রিয় হুমায়ূন আহমেদ বা জাফর ইকবালের রচনা। শ্রী স্বপন কুমার তাঁর গোয়েন্দা উপন্যাসে দু’টি কালজয়ী গোয়েন্দা চরিত্র সৃষ্টি করেছিলেন, দীপক চ্যাটার্জি আর তার সহকারী রতন লাল। দু’জনকেই শার্লক হোলমস হতেও বড়মাপের রহস্যভেদী মনে হতো আমার কাছে। দুনিয়ার এমন কোন খুনখারাবি বা রহস্য ছিল না যার সমাধান এই দু’জনে মিলে বের করতে পারতেন না। আট আনা দামের ষাট থেকে সত্তর পৃষ্ঠার এই চটি মিনি উপন্যাস বা বড় গল্প প্রতিসপ্তাহে একটা করে বের হতো।

স্কুলের টিফিনের পয়সা জমিয়ে ওই বই কিনে ঘণ্টাখানেকের মধ্যে তা পড়ে শেষ করে ফেলতে পারতাম। তবে এই মিনি উপন্যাসের শুরুতে যে রহস্য বা অপরাধটার বর্ণনা থাকত তার সমাধানটা কি হতে পারে তার একটা আগাম ধারণা পেতে ব্যর্থ চেষ্টা করতাম। ঠিক এমন একটি পরিস্থিতিতে ফেলেছে সম্প্রতি দৈনিক আমার দেশের সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের মুক্তি দাবি আর দিগন্ত ও ইসলামিক টিভি বন্ধ করে দেয়ার প্রতিবাদ জানিয়ে দেয়া পনেরো জন সম্পাদকের একটি জোরালো বিবৃতি। তাঁদের এই বিবৃতির সমালোচনা করে ইতোমধ্যে বিশিষ্ট সাংবাদিক কলাম লেখক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, মুহম্মদ শফিকুর রহমান, ড. মুনতাসীর মামুন, শাহরিয়ার কবির, রাহাত খান, মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল বিভিন্ন গণমাধ্যমে (বিশেষ করে দৈনিক জনকণ্ঠে) লিখেছেন। বুলবুল বাংলা নিউজ ২৪ ডটকমে এবং আমি নিজে বিডিনিউজ২৪ ডটকমে লিখেছি।

দৈনিক সমকালের সম্পাদক যিনি পনেরো জনের একজন, শ্রদ্ধাভাজন গোলাম সারওয়ার তিনি আবার তাঁর পত্রিকায় এই প্রসঙ্গে কিছুটা কৈফিয়তমূলক একটি মন্তব্য প্রতিবেদনও লিখেছেন। একদল সম্পাদকের একটি বিবৃতি নিয়ে এই ধরনের তুলকালাম কা- অনেকটা নজিরবিহীন। ওই পনেরো জন সম্পাদকের দুই একজনের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় আছে, তাঁদের অনেকেই নিজস্ব পেশায় বেশ সুনামের সঙ্গে পেশাদার সম্পাদক হিসেবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেছেন। যদিও তাঁদের কয়েকজন আছেন ইতোমধ্যে সাংবাদিকতার নামে অসত্য-বানোয়াট সংবাদ পরিবেশনের আশ্রয় নিয়েছেন। এমন গর্হিত কাজকে তাঁরা বাক্স্বাধীনতা বলে চালিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেন।

এই পনেরো জনে অন্তত একজন আছেন যিনি আওয়ামী লীগ যেন আর কোনদিন ক্ষমতায় ফিরতে না পারে তার জন্য তাঁর সঞ্চালিত মধ্যরাতের টকশোতে নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন; কারও কারও মতে তিনি এই কাজে এখন ওভারটাইম খাটছেন। যেহেতু বিষয়টা নিয়ে ইতোমধ্যে অনেক লেখালেখি হয়ে গেছে নতুন করে আর কোন কিছু লেখার প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু প্রয়োজন দেখা দিল যখন দেখি এখনও বিভিন্নজন সুযোগ পেলেই এই বিষয়ে টিভির টকশোতে কথা বলছেন এবং এই বিষয়ে উল্লেখিত মন্তব্য প্রতিবেদনগুলোতে নানা ধরনের মন্তব্য আসা অব্যাহত রয়েছে। এটি একটি ভাল লক্ষণ। কারণ তা প্রমাণ করে পাঠক বিষয়টিকে বেশ গুরুত্ব দিয়েছেন।

আমার লেখায় দুই-একজন পাঠকের মন্তব্যের জবাব দেয়ার প্রয়োজন মনে করছি। একজন মন্তব্য করেছেন, বাংলাদেশে যদি হিযবুত তাহরীরকে একটি সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে নিষিদ্ধ করা হয় তাহলে ছাত্রলীগকে নয় কেন? তিনি যথারীতি বিশ্বজিতের ঘটনা উল্লেখ করতে ভুললেন না। তাঁর উদ্দেশে বলি, হিযবুত তাহরীর বা ছাত্রশিবির একটি আদর্শ প্রতিষ্ঠা করতে সন্ত্রাস সৃষ্টি করে ঠিক যেমনটি করত হিটলারের জামানায় নাৎসি পার্টির এসএস বা গেস্টাপো, অথবা ইতালির মুসোলিনির ব্ল্যাক শার্ট। সত্তর ও আশির দশকে ভারতে আনন্দমার্গীরাও একই কাজ করত। এখন মাওবাদীরা করে।

ছাত্রলীগ কোন আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য বর্তমানে সন্ত্রাস করে না। এই সংগঠনটি গড়ে উঠেছিল একটি আদর্শ ছাত্র সংগঠন হিসেবে, যার জন্ম বঙ্গবন্ধুর হাত ধরে। অযোগ্য নেতৃত্বের হাতে পড়ে এটিতে এখন কিছু দুর্বৃত্ত ঢুকে পড়েছে, যার ফলে এরা নানা কারণে সন্ত্রাস করে। এখানে কোন আদর্শের বালাই নেই। স্রেফ সন্ত্রাস সৃষ্টির জন্য যুক্তরাষ্ট্রে গড়ে উঠেছিল অত্যন্ত শক্তিশালী মাফিয়া চক্র অথবা ইতালিতে কসা নস্ত্রা, যারা পরবর্তীকালে কানাডায় শাখা বিস্তার করেছিল।

যুক্তরাষ্ট্রের কেকেকে একটি আদর্শনির্ভর সন্ত্রাসী সংগঠন, যেটির আদর্শই হচ্ছে বর্ণবাদ। তারা মাথায় সাদা কাপড়ের হুড বা গলা পর্যন্ত টুপি পরে কালোদের বাড়ি পোড়াতে যায় অথবা নিজেদের সভা-সমাবেশ করে। সংগঠনটিকে যুক্তরাষ্ট্রে নিষিদ্ধ না করলেও ওই ধরনের পোশাক পরে তারা এখন আর তাদের কাজকর্ম পরিচালনা করতে পারে না। এক পাঠক আমাকে এই তথ্যটি মনে করিয়ে দিয়েছেন। তাকে ধন্যবাদ।

ছাত্রলীগ বা ছাত্রদল কোন আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য সন্ত্রাস করে না। তারা সন্ত্রাস করে স্রেফ নিজেদের স্বার্থে। এরই মধ্যে সন্ত্রাস সৃষ্টির জন্য ছাত্রলীগের কিছু কর্মী নিজ দল হতে বহিষ্কৃত হয়েছেন অথবা তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে। এটি একটি ভাল লক্ষণ। উল্লেখিত বিদেশের সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো হয় নিষিদ্ধ অথবা প্রকাশ্যে তারা তাদের কাজকর্ম পরিচালনা করতে পারে না।

সে সব দেশে কোন সম্পাদক এদের বাক্স্বাধীনতা রুদ্ধ হয়েছে বলে বিবৃতি দেন না; যেমনটি বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ঘটেছে। প্রশ্ন উঠতে পারে সম্পাদকরা বিবৃতি দিয়ে কি কোন কবিরা গুনাহ করেছেন যে, তাদের বিরুদ্ধে এমন প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে হবে ? সেটির উত্তর না সূচক হতো যদি সেই বিবৃতিতে শুধু দৈনিক ইনকিলাব, নয়াদিগন্ত অথবা মানবজমিনের সম্পাদক স্বাক্ষর করতেন। গোল বেঁধেছে বাকিদের নিয়ে। কারণ তাদের অনেকের সম্পর্কে পাঠক সমাজে একটা শ্রদ্ধাবোধ আছে। যেমন আমি অবাক হয়েছি অন্তত দু’জনের স্বাক্ষর দেখে।

প্রথম জন আমার বন্ধু সহপাঠি মাহফুজ আনাম আর দ্বিতীয় জন বাংলাদেশের সিনিয়র পেশাদার সাংবাদিকদের অন্যতম দৈনিক সমকালের শ্রদ্ধাভাজন গোলাম সারওয়ার। তিনি একজন আপাদমস্তক পেশাদার সাংবাদিক। তিনি যে পত্রিকায় সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন সেই পত্রিকা সফল হয়েছে। সব সময় তাঁর সম্পাদিত পত্রিকাগুলোকে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রকাশের বাহন হিসেবে সচেতন পাঠক মহল বিবেচনা করেছেন। আমার সঙ্গে অনেকেই দ্বিমত পোষণ করতে পারেন কিন্তু মাহফুজ আনাম সম্পাদিত ডেইলি স্টারকেও একটি বস্তুনিষ্ঠ পত্রিকা মনে করি; যদিও এক- এগারোর সময় তাঁর ভূমিকা নিয়ে এখনও অনেক প্রশ্ন অমীমাংসিত রয়ে গেছে।

অন্য আর দু’চারটি পত্রিকার মতো বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে তাদের কোন গোপন এজেন্ডা আছে কি-না আমার পক্ষে তা জানা সম্ভব নয়। গোলাম সারওয়ার বা মাহফুজ আনাম বা তাঁদের মতো আরও কিছু সম্পাদকের উল্লেখিত বিবৃতিতে স্বাক্ষর দেখে স্বাভাবিক কারণেই পাঠক খুবই হতাশ এবং ক্ষুব্ধ হয়েছে। বুঝতে হবে, এই সম্পাদকদের ওপর পত্রিকার সাধারণ পাঠক অনেক আস্থা রাখেন এবং তাঁদের শ্রদ্ধা করেন। আস্থা বা শ্রদ্ধার ব্যক্তিটি যদি আস্থা ভঙ্গ করেন তাহলে তাঁদের গুণগ্রাহীরা আহত হবেন এবং তার বহির্প্রকাশ ঘটতে বাধ্য। এবার আসি কিঞ্চিত দৈনিক আমার দেশ, তার স্বনামখ্যাত ‘সম্পাদক’ মাহমুদুর রহমান আর দু’টি বন্ধ হয়ে যাওয়া টিভি চ্যানেল প্রসঙ্গে।

পাঠকদের একটু পেছনে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চাই। এক-এগারো পরবর্তী দৈনিক জনকণ্ঠ অফিস হতে তার সম্পাদক, মুদ্রাকর ও প্রকাশক মোহাম্মদ আতিকউল্লাহ খান মাসুদকে রাত আনুমানিক নয়টার দিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। গ্রেফতার করার অজুহাত ছিল সম্ভবত সেনানিবাসে তাঁর বাড়ির সীমানা নিয়ে কোন একটা বিরোধ। টিভির স্ক্রলে সংবাদটি দেখার সঙ্গে সঙ্গে আমি তখন জনকণ্ঠে কর্মরত সাংবাদিক অনুজপ্রতিম আলী হাবিবকে ফোন করি। আলী হাবিব অনেকটা বাকরুদ্ধ কণ্ঠে জানায়Ñ তাদের সম্পাদককে এইমাত্র গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে এবং এই ঘটনায় তারা শুধু হতভম্বই নয়, ক্রুদ্ধও।

কিছু পরে শুরু হয় একটি টিভি চ্যানেলের টকশো। সঞ্চালক পনেরো জন সম্পাদকের একজন। শুরুতে আলোচক (নামটি এই মুহূর্তে মনে করতে পারছি না বলে দুঃখিত) বিষয়টির অবতারণা করলে সঞ্চালক তাঁকে থামিয়ে দিয়ে বলেনÑউনাকে অন্য কারণে গ্রেফতার করা হয়েছেÑ সম্পাদক হিসেবে নয় আর উনি তো সঠিক অর্থে সম্পাদকও নন। ওই বিষয়ে আলোচনার ওখানেই সমাপ্তি। মাহমুদুর রহমান ‘সম্পাদক’।

তিনি প্রায় প্রতিদিন নিজ পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় স্বনামে মন্তব্য প্রতিবেদন ছাপেন যার অধিকাংশই উস্কানিমূলক, অতিরঞ্জিত এবং অসত্য ও অর্ধসত্যের ওপর ভিত্তি করে রচিত। তিনি সরাসরি মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। সম্পূর্ণ বেআইনীভাবে ট্রাইব্যুনালের একজন বিচারকের স্কাইপের মাধ্যমে ব্যক্তিগত কথোপকথন রেকর্ড করে এবং তা প্রকাশ করে শুধু দেশীয় আইনেই নয় আন্তর্জাতিক আইনেও একটি অমার্জনীয় অপরাধ করেছেন। শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের সংগঠক ও ব্লগারদের তিনি নাস্তিক আর মুরতাদ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এর ফলে ব্লগার রাজীবকে হত্যা করা হয়েছে।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির আদেশ হলে তিনি চাঁদে সাঈদীকে আবিষ্কার করেছেন; যার ফলে বগুড়ায় ব্যাপক দাঙ্গা-হাঙ্গামা হয়েছে, সংখ্যালঘুরা আক্রান্ত হয়েছেন এবং অনেক প্রাণহানি হয়েছে। পবিত্র কাবা শরিফের গিলাফ পরিবর্তনের একটি ছবিকে ছাপিয়ে বলেছেন সাইদীর ফাঁসির রায়ে ক্ষুব্ধ হয়ে কাবা শরিফের ইমামদের প্রতিবাদ সমাবেশ। দৈনিক সংগ্রামের অনলাইন সংষ্করণে একই ছবি প্রচারিত হয়, কিন্তু কয়েক ঘণ্টা পর তারা তা প্রত্যাহার করে নেয়। কিন্তু দৈনিক আমার দেশ আর মাহমুদুর রহমান তাঁদের এই সব অপকর্ম পরিচালনায় অবিচল থাকেন। তখন কিন্তু এই পনেরো জন সম্পাদকের কেউই দু’লাইনের বিবৃতি দিয়ে বলেননি যে, এটি অপসাংবাদিকতা এবং দেশ ও জাতির স্বার্থে তা বন্ধ করা উচিত এবং এই সব কর্মকা- নিন্দনীয়।

যেদিন হেফাজত বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার প্রাণকেন্দ্রে তাদের দিনভর তান্ডব চালাচ্ছিল সেদিন সরাসরি দিগন্ত আর ইসলামী টিভিসহ কয়েকটি টিভি চ্যানেল মতিঝিলের শাপলা চত্বরের হেফাজতি বয়ান সম্প্রচার করছিল। সাধারণত ইসলামী টিভি ওয়াজ-নসিহত নিয়ে ব্যস্ত থাকে; এই ধরনের অনুষ্ঠানে তাদের তেমন একটা আগ্রহ দেখা যায় না। এই দু’টি চ্যানেল শুধু মঞ্চের বক্তৃতা প্রচার করছিল না, তারা অংশগ্রহণকারী দর্শক-শ্রোতাদের বক্তব্যও সরাসরি প্রকাশ করছিল। যেমন একজন গায়ে কাফনের কাপড় পরিহিত উন্মাদপ্রায় (হেফাজতিরা বলবেন আল্লাহর প্রেমে দেওয়ানা ) দর্শকের সামনে মাইক ধরে তাকে প্রশ্ন করা হলোÑআপনি কেন এসেছেন এখানে ? উত্তর ‘বিদেশ থেকে এসেছি, শহীদ হতে। ’ ‘উনি বিদেশ হতে শহীদ হতে এসেছেন।

’ এ সময় কিছু হেফাজতি একটি মৃতদেহ কাঁধে মঞ্চের সামনে প্রবেশ করলেন। দিগন্ত টিভি: ‘এইমাত্র একজন শহীদের মৃতদেহ এখানে আনা হয়েছে, আরও আসছে। ’ ইসলামী টিভিও ঠিক একই কায়দায় তাদের অনুষ্ঠান প্রচার করছিল। এই সব শুনে মনে হবে, দেশে বুঝি একটা ধর্মযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে এবং তা সরাসরি টিভিতে প্রচার করা হচ্ছে। অন্য টিভি চ্যানেলগুলো কিন্তু এমনটা করেনি।

প্রিন্ট আর ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার মধ্যে পার্থক্য হচ্ছেÑ প্রিন্ট মিডিয়ার সুবিধা সব মানুষ পায় না, দেশের সকল অঞ্চলে সময়মতো পত্রিকা পৌঁছায় না। আর সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে একজন ব্যক্তির যদি অক্ষরজ্ঞান না থাকে তা হলে তার পক্ষে কোন পত্রিকা পড়া সম্ভব নয়। এর বিপরীতে ইলেক্ট্রনিক মাধ্যমটি বর্তমানে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌঁছে গেছে। যাঁরা বর্তমান সরকারকে কোন কিছুর জন্যই কৃতিত্ব দিতে কুণ্ঠিত তাঁরা অন্তত এই ব্যাপারে একমত হবেন যে, এই সরকারের আমলে অন্তত কমপক্ষে ডজনখানেক নতুন প্রাইভেট টিভি চ্যানেলের অনুমতি দেয়া হয়েছে এবং প্রায় সব টিভি চ্যানেলের অনুষ্ঠানই দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষ দেখতে এবং শুনতে পারে, তার জন্য তার অক্ষরজ্ঞানের কোন প্রয়োজন নেই। এটাও ঠিক, বর্তমান সরকারের আমলে যে সকল টিভি চ্যানেলের অনুমতি দেয়া হয়েছে তার একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক চ্যানেল বিএনপি-জামায়াত ঘরানার ব্যবসায়ীদের হাতে চলে গেছে।

এর ফলাফল আগামী সংসদ নির্বাচনের সময় পাওয়া যাবে বলে মনে করি। মে মাসের ৫-৬ তারিখ রাতে হেফাজত মতিঝিল দখল করল। এর একদিন আগে ৪ তারিখ বিএনপি প্রধান বেগম জিয়া সরকারকে ৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দিয়ে বললেনÑএর মধ্যে যদি সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার মেনে না নেয় তা হলে তাদের পদত্যাগে বাধ্য করা হবে। অবাক করার বিষয় হচ্ছে, বিএনপির একজন বড় মাপের নেতা গত বুধবার ‘সময়’ টিভির সম্পাদকীয় অনুষ্ঠানে নির্দ্বিধায় বললেন: বেগম জিয়া আল্টিমেটাম দিয়েছেন সংলাপের জন্য, তত্ত্বাবধায়ক সরকার মেনে নেয়ার জন্য নয়। সমস্যা হচ্ছে রাজনৈতিক নেতারা দেশের আমজনতাকে নিরেট মূর্খ ভাবেন এবং মনে করেন তাঁরাই একমাত্র সবজান্তা; অন্যরা নিম্নশ্রেণীর উজবুক।

এই মুহূর্তে বলতে দ্বিধা নেই, বেগম জিয়ার ৪৮ ঘণ্টার হুমকি হতে শুরু করে ৬ তারিখ রাতের প্রথম প্রহরে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ‘অপারেশন শাপলা’ পর্যন্ত পর্বটা বর্তমান সরকারের জন্য একটি অত্যন্ত সঙ্কটকালীন ও নাজুক সময় ছিল। এই সঙ্কট সৃষ্টির পেছনে বিরোধী দল, বিশেষ করে জামায়াত-বিএনপি অপশক্তি তো কাজ করেছেই; আরও কাজ করেছে দেশের কিছু গণমাধ্যম, একশ্রেণীর বুদ্ধিজীবী আর সরকারের ভেতরে থাকা কিছু অপরিণামদর্শী ব্যক্তি। তবে ন্যূনতম রক্তপাত ও শক্তি প্রয়োগ করে অনেকটা যথাযথ রণকৌশল প্রয়োগ করে সরকার যে এই যাত্রায় দেশটাকে কিছু অর্বাচীনের হাত থেকে রক্ষা করতে পেরেছে তার জন্য তাদের ধন্যবাদ জানাতে হয়। অবশ্য বিরোধী দল সেই রাতে একটি গণহত্যা হয়েছে বলে চিৎকার করছে। এরই মধ্যে হেফাজত ‘কেন এই গণহত্যা‘ শীর্ষক এক সচিত্র পোস্টার দিয়ে দেশের বিভিন্ন শহর ছেয়ে ফেলেছে।

কিন্তু এখন পর্যন্ত বলতে পারেনি তাদের কোন্ কোন্ নেতাকর্মী নিহত হয়েছেন। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না, এই সব কুবুদ্ধি যত না হেফাজতের তার চেয়ে বেশি জামায়াত-বিএনপির এবং বর্তমান মন্ত্রণাদাতা স্বঘোষিত নাস্তিক এবং ‘এবাদত’ নামার রচয়িতা ফরহাদ মজহার। অনেক বিএনপি নেতার কাছে জানতে চেয়েছি, হঠাৎ করে ফরহাদ মজহার কেন বিএনপি নেত্রী বেগম জিয়ার কাছে এত সমাদৃত। তাঁরা এর কোন সদুত্তর দিতে পারেননি। তবে একজন ব্যারিস্টার নেতা ঠাট্টা করে বলেছেনÑকে জানে হয়ত শেখ হাসিনাই বিএনপির রাজনীতিকে বরবাদ করার জন্য ফরহাদকে বিএনপিতে ঢুকিয়েছেন।

অনেকের পছন্দ হবে না, তারপরও বলতে হয়Ñদৈনিক আমার দেশ এবং ওই দু’টি চ্যানেলের বিরুদ্ধে সরকারের অনেক আগেই ব্যবস্থা নেয়া উচিত ছিল। তা যদি হতো তা হলে দেশের অনেক জানমাল রক্ষা পেত। স্বাধীন গণমাধ্যম গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ বলে স্বীকৃত। স্বাধীন গণমাধ্যমের অর্থ দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টি করার স্বাধীনতা নয়। যখন এই তিনটি গণমাধ্যম এতসব উস্কানিমূলক কর্মকা- করছিল তখন এই পনেরো জন সম্পাদকের কেউই তার বিরুদ্ধে একটা কথাও বলেনি।

কিছুটা ব্যতিক্রম ডেইলি স্টার। কেউ কেউ বলার চেষ্টা করেছিলেন, তাদের আগে সতর্ক করা উচিত ছিল। কিন্ত তারা যখন পত্রিকা প্রকাশ অথবা টিভি চ্যানেল চালু করার লাইসেন্স নিয়েছেন তখন তারা কিছু নিয়মনীতি মেনে চলবেন বলে অঙ্গীকার করেছেন। সেই আইন তারা পদে পদে ভঙ্গ করেছেন এবং এর ফলে দেশের নিরাপত্তা ও মানুষের জানমাল হুমকির সম্মুখীন হয়েছে। কোন সরকারই এই পরিস্থিতি মেনে নিতে পারে না।

ইংল্যান্ডের বহুল প্রচারিত ১৬৫ বছরের পুরনো ‘নিউজ অব দি ওয়ার্ল্ড’ পত্রিকা রাজনীতিবিদদের টেলিফোন হ্যাকিংয়ের অভিযোগে বন্ধ হয়ে গেছে। সেখানে কোন সম্পাদক তাঁদের পক্ষে বিবৃতি দেননি। পনেরো জন সম্পাদকের বিবৃতি নিয়ে এতদিন চলমান আলোচনা-সমালোচনার একটাই কারণ: এদের অনেকের ওপরই দেশের সাধারণ মানুষের আস্থা আছে। কারও কারও কোন গোপন এজেন্ডা থাকতে পারে; তবে তা সাধারণ মানুষ তেমন একটা জানতে পারে না এবং তার সত্যতা নিয়েও প্রশ্ন থাকতে পারে। লেখার শুরুটা করেছিলাম আমার শ্রী স্বপন কুমারের মিনি গোয়েন্দা কাহিনীর রহস্য ভেদের ব্যর্থতা দিয়ে।

সে বাল্যকালে যেমন শুরুতে তার কাহিনীর রহস্য ভেদ করতে পারিনি, ঠিক এখনও কেন পনেরো জন নানা মতের সম্পাদক একটি বিতর্কিত বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেছেন তার রহস্যও আমার কাছে পরিষ্কার নয়, যদিও এ ব্যাপারে বাজারে অনেক কথা চালু আছে। তার কোন্টা বিশ্বাসযোগ্য আর কোন্টা নয়, তাও আমার কাছে পরিষ্কার নয়। সে কারণে এ ব্যাপারে মন্তব্য করা হতে বিরত রইলাম। আবদুল মান্নান লেখক : শিক্ষাবিদ ও বিশ্লেষক। মে ৩১, ২০১৩ ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।